তামাক চাষ পরিবেশের বোঝা


তামাক একটি দূর্বল গুল্ম। তামাক চাষে প্রচুর পরিমাণ বালাইনাশক, রাসায়নিক সার, জল সেচ ও পরিচর্যার প্রয়োজন। তামাক চাষে কৃষক যেমন শারীরিক ক্ষতির শিকার হন তেমনই সার্বিক পরিবেশ ও দূষিত হয়। তাইতো বিশ্বের ধনী দেশের মানুষরা তামাক সেবনের সাময়িক মজা উপভোগ করেন। কিন্তু তামাক চাষের মারাত্মক বোঝা চাপিয়ে দিয়েছেন উন্নয়নশীল ও গরিব দেশের মানুষ ও পরিবেশের উপর। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে দিনে দিনে উন্নত দেশে তামাকের চাষ কমছে আর উন্নয়নশীল ও গরীব দেশে তামাকের আবাদ বাড়ছে। আরো লক্ষণীয় যে খাদ্য ঘাটতির দেশে তামাকের উৎপাদন বাড়ছে। কিন্তু তামাক কোন খাদ্য নয়। ভাবতে কষ্ট হয় এসব উন্নয়নশীল ও গরীব দেশের কৃষি উৎপাদন পরিকল্পনা করা করেন ? কার জন্য করেন? তামাক চাষ এক দিকে মাটির উর্বরতা হ্রাস করে অন্য দিকে তামাক পাতা শুকাতে বন জঙ্গল উজাড় করে নির্বিচারে গাছ পালা কেটে তামাক পাতা শুকাতে জ্বালানির যোগান দেয়া হয়।

তামাক চাষের ফলে ভূগর্ভস্ত পানি সম্পদ দূষিত হয়। খাল ও নদীর তলা ভরাট হয়। প্রাণ সম্পদ বিলুপ্ত হয়। মাটির উর্বরতা হানী হয়। প্রতিষ্ঠিত আবাসভূমি ক্ষতি গ্রস্ত হয়। পরিবেশের এ ক্ষতির ফলে মানুষের জীবন জীবিকা ও স্বাস্থ্যের উপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করে। তামাক চাষে প্রচুর পরিমাণ রাসায়নিক সার ও বালাই নাশক প্রয়োজন হয়। তামাক গাছ অন্যান্য ফসলের তুলনায় অধিক পরিমাণ নাইট্রোজেন, পটাশিয়াম, ফসফরাস এবং অন্যান্য উপাদান শোষন করে। ফলে মাটিকে অতি দ্রত পুষ্ঠিহীন করে। চাষের অযোগ্য হয়। 

ব্রিটিশ আমলেই এদেশে তামাকের প্রচলন হয়। হুক্কার তামাক, সাদা পাতা, বিড়ি, সিগারেট, জর্দা, গুল, নস্যি, চুরুট ইত্যাদির ব্যবহার চলে আসছে। বিচ্ছিন্ন ভাবে বিভিন্ন জাতের তামাকের চাষ চলে আসছে। তবে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে বৃহত্তর রংপুর জেলায় ব্যাপক তামাক চাষ শুরু হয়। ব্রিটিশ আমেরিফ্যান টোবাকো কম্পানি চুক্তি বদ্ধ চাষীর মাধ্যমে তামাক চাষ সম্প্রসারন করে। যেহেতু তামাকে মাটি দ্রুত অনুর্বর হয় তাই কোম্পানি নতুন জায়গায় চাষ সম্প্রসারণ করে। রংপুরের পরে কুষ্টিয়া অঞ্চলে তামাক চাষ সাম্প্রসারণ করে। এর পরে পার্বত্য চট্টগ্রামে সম্প্রসারণ হয়। এখন তামাক চাষ আরো ব্যাপক এলাকা যেমন মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল, ঝিনাইদহ, গাইবান্ধা, ফরিদপুর, নাটোর, নড়াইল, যশোর ইত্যাদি এলাকায় সম্প্রসারিত হচ্ছে।

তামাক চাষে মাটির ক্ষতিঃ

তামাক চাষে মাটির উর্বরতা নষ্ঠ হয়। মাটি শক্ত হয়ে যায়। ভূমি ক্ষয় বৃদ্ধি পায়। প্রাণবৈচিত্র্য বিলুপ্ত হয়। জীবন জীবিকা ও আয়ের উৎস সংকীর্ণ হয়।

তামাক উৎপাদন প্রক্রিয়ায় মারাত্মক রাসায়নিক পদার্থ যেমন এমোনিয়া, নিকোটিন এবং নিকোটিন উপজাত, হাইড্রো ক্লোরিক এসিড ও টলুয়েন উৎপাদিত হয়।

বন ধবংসঃ

বিশ্বের উল্লেখ যোগ্য তামাক উৎপাদন কারী দেশ যেমন উরুগুয়ে, মালাউই, জর্দান, পাকিস্তান, সিরিয়া, চীন, জিম্বাগুয়ে, দক্ষিণ কোরিয়া, আর্জেনটিনা, তিউনিশিয়া, এবং বুরুন্ডির মত বাংলাদেশে ও তামাক চাষের ফলে বনাঞ্চল ধবংশ করা হচ্ছে। একদিকে যেমন বৃক্ষ নিধন করে জমিতে চাষ করা হচ্ছে অন্য দিকে তামাক পাতা প্রক্রিয়াজাত করার জন্য নির্বিচারে বনজ, ফলদ, ওষুধিসহ সব রকম গাছ কেটে চুল্লিতে ব্যবহার করা হচ্ছে।

বালাইনাশক ব্যবহারঃ

তামাক বেগুন, টমেটো ও মরিচ একই সোলানেসি পরিবারের উদ্ভিদ। এ সব ফসল বাংলাদেশে ব্যাপক ভাবে আবাদ হয়। ফলে প্রায় একই প্রকারের রোগ বালাই দারা আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে উল্লেখ যোগা হচ্ছে এনন্থ্রাকনোচ, ব্যাকটেরিয়াল লিফ স্পট, ব্যাকটেরিয়াল সফট স্পট,ডাম্বিং অব, গ্রে মোল্ড, ফাইটপথোরা, পাউডারি মিলডিউ, টবাকো মোজাইক ডাইরাস, টোবাকো ইচ ভাইরাস, জাবপোকা, সাদা মাছি, থ্রিপস, লাল মাকড়, রুট নট নিমাটোড, সাদা মাকড, ইত্যাদি।

এ সব রোগ বালাই দমনে ব্যাপক হারে বলাই নাশক ব্যবহার করতে হয়। উল্লেখ যোগ্য বালাই নাশকের মধ্যে রয়েছে বেভিসটিন, রিডোমিল, শুমিথিয়ন, থাইওভিট, ফুরাডান, রিপকর্ড, ইত্যাদি।

স্বাস্থ্য ঝুঁকিঃ

রোগ বালাই নিয়ন্ত্রণের জন্য বালাই নাশক ছিটানোর সময় কৃষক ও শ্রমিকরা মারাত্মক স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির মধ্যে পড়েন। তাছাড়া তামাক ক্ষেতে কর্মরত শ্রমিকরা ভিজা তামাক পাতা নিয়ে কাজ করার সময় গ্রিণ টোবাকো সিকনেস রোগে আক্রান্ত হন। ফলে তারা মাথা ধরা, বমি, মাথা ঘোরা, ডাইরিয়া, অনিয়ান্ত্রিত রক্তচাপ, হৃদ রোগ সহ নানা রকম জটিল রোগে আক্রান্ত হন।

তামাক উৎপাদন ও জলবায়ু পরিবর্তনঃ

তামাক চাষ প্রতিটি ধাপে যেমন উৎপাদন থেকে তন্দুরে প্রক্রিয়াজাত করা পর্যন্ত সকল ক্রিয়া কর্মে জলবায়ু পরিবর্তন প্রভাবিত করছে। কার্বন ডাইঅক্সইড, মিথেইন, নাইট্রাস অক্সাইড, ইত্যাদি উৎপাদিত হচ্ছে যা পরিবেশ ভারাক্রান্ত করছে।

জেনেটিকালি মডিফাইড তামাক পাতাঃ

তামাকে নিকোটিনের পরিনাম নিয়ে বিপরিতধর্মী জেনেটেক মডিফিকেশনের উদ্যোগ চলছে। একদল চাচ্ছে তামাকে নিকোটিনের পরিমাণ বাড়িয়ে তামাক নেশা আরো জোড়দার করতে। অপর দিকে আর একদল জেনেটিক মডিফিকেশনের মাধ্যমে নিকোটিনের পরিমাণ কমিয়ে ক্যান্সার প্রবনতা কমাতে চান।

উপসংহারঃ

তামাক উৎপাদন বাংলাদেশ পরিবেশের উপর মারাত্মক হুমকি। পরিবেশের বোঝা কমাতে তামাক চাষের পরিবর্তে অন্য ফসলের আবাদ উৎসাহিত করা প্রয়োজন।


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।