তামাক সেবন টেকসই উন্নয়নের অন্তরায়


তামাক সেবনে স্বাস্থ্য ক্ষতি ও নানা সামাজিক ক্ষতি নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বেড়েছে। সারা পৃথিবীতে প্রায় ১০০ কোটি মানুষ, যার অধিকাংশই পুরুষ এবং পরিবারের প্রধান তামাক সেবন করছেন; তাদের মধ্যে বেশিরভাগই রয়েছেন বাংলাদেশসহ স্বল্প আয়ের দেশে। এখানে মানুষের আয়ও কম, আবার তারা সিগারেট, বিড়ি, জর্দা, গুল ইত্যাদি তামাকদ্রব্যের জন্য খরচ করছেন নিয়মিতভাবে। বাংলাদেশে এই পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহভাবে বিরাজ করছে। গ্লোবাল এডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে-গ্যাটস (Global Adult Tobacco Survey-GATS) ২০০৯ অনুসারে, বাংলাদেশে ৪৩ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক সেবন করেন। দেশে বর্তমানে তামাক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৪ কোটি ১৩ লাখ, যার মধ্যে ২৩ শতাংশ (২ কোটি ১৯ লাখ) ধূমপানের মাধ্যমে তামাক ব্যবহার করেন এবং ২৭.২ শতাংশ (২ কোটি ৫৯ লাখ) ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহার করেন। সম্প্রতি বায়োমেডিক সেন্টার (BMC) থেকে প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, স্বল্প আয়ের দেশের ৬০ বছর কম বয়সের ধূমপায়ী পরিবারপ্রধানরা শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয় খরচ কম করছেন। এই গবেষণাটি করা হয়েছে World Health Survey 2002- 2004-এর ওপর ভিত্তি করে, যেখানে ৫৩ হাজার ৬২৫ জন পুরুষ (৬০ বছরের নিচে বয়স) তামাক সেবনকারীর তথ্য নেয়া হয়েছে। বায়োমেডিক সেন্টার (BMC) ২০১৫ সালের অক্টোবর মাসে গবেষণার ফল প্রকাশ করে। এর মধ্যে দুইটি তথ্য খুব গুরুত্বপূর্ণ, যেমন তামাক সেবনকারী পারিবারিক খরচের মধ্যে শিক্ষায় ৮ শতাংশ এবং স্বাস্থ্যসেবায় ৫.৫ শতাংশ কম ব্যয় করে।

৪০টি স্বল্প আয়ের দেশের তথ্য নিয়ে গবেষণা করা হয়েছে, বাংলাদেশ তার মধ্যে একটি। আন্তর্জাতিকভাবে প্রমাণিত তথ্য হচ্ছে, তামাক সেবনকারীদের ৫০ শতাংশ সরাসরি তামাকের কারণে মৃত্যুবরণ করেন। তামাকের কারণে অসংক্রামক রোগের যাকে ইংরেজিতে Non-Communicable Disease (NCD) বলা হয়, তার পরিমাণও বেড়েছে। তামাক নিয়ন্ত্রণের জন্য এখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনেক উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে, বিশেষ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে ২০০৩ সালে গৃহীত Framework Convention on Tobacco Control (FCTC) গৃহীত হয় এবং বাংলাদেশ সরকার এতে স্বাক্ষর করে। এর আলোকে ২০০৫ সালে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করে। পরে ২০১৩ সালে সংশোধিত তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন পাস এবং ২০১৫ সালে এ সংক্রান্ত বিধিমালা কার্যকর করা হয়। কাজেই বাংলাদেশে সরকারি এবং বেসরকারিভাবে তামাক নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ এখন অনেক সক্রিয়। সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং কয়েকটি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এ বিষয়ে আন্তরিক। এরই মধ্যে তামাক সেবন বা চাহিদা এবং উৎপাদন বা জোগান, উভয় দিক নিয়ন্ত্রণের জন্য নীতি করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। যেমন- জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতি এবং তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ নীতি এখন খসড়া পর্যায়ে আছে এবং আলোচনা চলছে। এই দিক থেকে আশা করা যায়, অন্তত জনগণের মধ্যে সচেতনতা আসবে এবং সরকারের দিক থেকে নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ নেয়া হবে। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে, তামাক সেবনের ব্যাপারটি সামাজিক এবং পারিবারিক পর্যায়ে এর প্রভাব দেখা যায়। কাজেই কাজ করতে হবে অনেক গভীরে।

বিশ্বের চিত্র দেখা যাক। ২০০৯ সালের হিসাব অনুযায়ী বছরে তামাকের কারণে ৫০ লাখ মানুষের অকাল মৃত্যু ঘটছে। যদি তামাক সেবন নিয়ন্ত্রণ করা না যায় ২০৩০ সালের মধ্যে এই সংখ্যা দাঁড়াবে ৯৭ লাখ বা প্রায় ১ কোটি। দুইগুণ বাড়বে। এর মধ্যে যারা সরাসরি ধূমপান করেন না তারাও রয়েছেন। ধূমপায়ীদের কাছে থাকলেও তার ধোঁয়ার কারণে সৃষ্ট রোগের শিকার হচ্ছেন নারী, শিশু এবং অধূমপায়ী পুরুষরা। তারাও মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পাবেন না। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, তামাক সেবনের কারণে পরিবার, সমাজ ও জনগোষ্ঠী এবং দেশের ওপর নেতিবাচক অর্থনৈতিক চাপ পড়ে। তামাক সেবনের সঙ্গে দারিদ্র্যের সম্পর্কও এখন ক্রমাগতভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। তামাকসৃষ্ট রোগের চিকিৎসার জন্য পরিবারে বাড়তি চিকিৎসা খরচ করতে হয়, আর দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপরও চাপ পড়ে। সে কারণে টেকসই উন্নয়নের বিবৃতিতে বলা হয়েছে যে, তামাক সেবন শুধু একটি স্বাস্থ্য সমস্যা নয়, এটা উন্নয়নের জন্যও অন্তরায়। তামাক টেকসই উন্নয়ন এবং উন্নয়নে সমতার জন্য একটা বিরাট হুমকি; তামাকের কারণে দারিদ্র্য সৃষ্টি এখন আর প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। বর্তমানে টেকসই উন্নয়নের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তার সঙ্গে তামাক নিয়ন্ত্রণ ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত করা হচ্ছে, নইলে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে না।

ব্যক্তিগত পর্যায়ে দেখতে গেলে তামাক সেবনের কারণে পরিবারগুলোতে আয়ের ব্যবহারে একটা বড় ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হয়। সিগারেট-বিড়ি বা জর্দা কেনার জন্য আলাদা কোনো আয় করা হয় না। নির্ধারিত ও সীমিত আয়ের টাকাই ব্যবহার করা হয় এসব পণ্য কেনার জন্য, যা সহজেই সবখানে, পথেঘাটে পাওয়া যাচ্ছে। তাহলে নিশ্চয় এমন কোনো খরচ বাদ পড়ে যায় যা পরিবারের জন্য প্রয়োজনীয়, কিন্তু টাকা না থাকার জন্য ব্যয় করা যাচ্ছে না। বিশেষ করে শিশুর মানবিক উন্নয়নের জন্য দরকার এমন খরচটাই বাদ পড়ে যাচ্ছে। যেমন ভালো খাবার, শিক্ষায় ব্যয় এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষার খরচ করা হচ্ছে না। অথচ এগুলো পরিবারের সুস্থ জীবনের জন্য খুব প্রয়োজন।

স্বল্প আয়ের দেশেই তামাক সেবনকারীর সংখ্যা বেশি এবং এসব দেশে তামাক সেবনকারীদের অধিকাংশই নিম্নআয়ের। কাজেই তাদের কাছে যথেষ্ট বাড়তি অর্থ থাকে না যে, তামাক সেবনের জন্য খরচ করবে এবং একইসঙ্গে পরিবারের অন্য প্রয়োজনীয় খরচও মেটাবে। আয়ের অনুপাতে দেখতে গেলে দেখা যায়, নিম্নআয়ের মানুষের রোজগারের একটা বড় অংশ চলে যায় তামাকের খরচে। ধরা যাক, একজন রিকশাওয়ালার দৈনিক আয় যদি ৫০০ টাকাও হয়, তার আয়ের মধ্যে পান-সিগারেটের জন্য খরচ হচ্ছে কমপক্ষে ৭০ থেকে ৮০ টাকা, কখনও ১০০ টাকা, যা একবেলা খাবারের খরচ হতে পারত কিংবা একটা ভালো খাবার কিংবা পড়াশোনার কাজে লাগত। গবেষণায় তাইওয়ান, চীন ও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি পরিষ্কারভাবে এসেছে যে, তামাকের খরচের কারণে পরিবারের অন্য প্রয়োজনীয় খরচ করা হয় না।

পরিবারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মধ্যে শিশুদের শিক্ষার জন্য খরচ করা একটা অন্যতম প্রধান বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়। দুঃখজনক হচ্ছে যে, তামাক সেবনকারী পরিবারপ্রধান হলে তার চিন্তা অত দীর্ঘ মেয়াদের থাকে না। সে ব্যস্ত থাকে তার দৈনন্দিন চাহিদার তামাক পণ্য ক্রয়ের জন্য। এ কারণে শিশুদের শিক্ষায় খরচ কমে যেতে পারে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গবেষণায় এই ধারণার প্রতিফলন আছে, যার কারণে বলা হয় যে, তামাক সেবন মানবসম্পদ উন্নয়নে বা Human Capital Investment ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াতে পারে। এটা পরিবার থেকে শুরু হয়ে জাতীয় পর্যায়ে দেখা যায়। ধূমপায়ীরা শিক্ষার দীর্ঘমেয়াদি সুফল এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের গুরুত্ব বুঝতে পারেন না, কাজেই শিক্ষায় খরচ কমিয়ে দেয়া তাদের সিদ্ধান্ত হয়ে যায়।

এই গবেষণায় স্বাস্থ্য খাতে খরচের ক্ষেত্রে একটু বিপরীতমুখী তথ্য পাওয়া যায়। একদিকে তামাকের কারণে অসুস্থতা বেড়ে যায় বলে স্বাস্থ্য খাতে খরচ বেড়ে যায়, অন্যদিকে তামাক সেবনের কারণে হাতে যথেষ্ট অর্থ থাকে না, চিকিৎসা করানো সম্ভব হয় না। এই বিপরীতমুখী প্রভাব পরিবারকে এক বিরাট সমস্যায় ফেলে দেয়।

দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে, তামাকের ব্যবহারের সঙ্গে আয়ের সম্পর্ক এমনই যে, আয় কম হলেই তামাকের ব্যবহার কম হচ্ছে না, বরং গরিব বা স্বল্প আয়ের মানুষের মধ্যে তামাক সেবন অনেক বেশি। তার মানে হচ্ছে, তারা যা আয় করছে তার একটি বড় অনুপাতে তামাক পণ্য সেবনে খরচ করছে। অন্যদিকে তাদের পরিবারে খাদ্য, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার খরচ কমিয়ে দিয়ে এই টাকা ব্যবহার করা হচ্ছে। এ বিষয়ে পরিবারের প্রধান হিসেবে তার কোনো দায়দায়িত্ব নেই। তিনি আয় করছেন এবং পরিবারকে ততটুকুই দিচ্ছেন যা তার তামাক পণ্য ক্রয়ের টাকা রেখে দিয়ে বাকি থাকছে। সীমিত আয়ের মধ্যে পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে তার চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে না, আর তামাকসেবীরা একপর্যায়ে নিজে অসুস্থ হলে পুরো পরিবার আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাকে সুস্থ করে তোলার জন্য চিকিৎসা করতে হচ্ছে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে স্বাভাবিক স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য তামাক সেবনকারীরা খরচ না করলেও এক পর্যায়ে ধার করে কিংবা গরু-ছাগল বিক্রি করে হলেও তার চিকিৎসা করতে হয়। চিকিৎসা করতে না পারলে এক সময় মৃত্যু ঘটে।

মোট কথা হচ্ছে, তামাক সেবনের কারণে স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে আর বিতর্ক নেই, এই তামাক সেবনকেই এখন মহামারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু তামাক সেবনের কারণে সৃষ্ট সমস্যা শুধু স্বাস্থ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটা যে একটা টেকসই উন্নয়নের সমস্যা তা ক্রমাগতভাবে পরিষ্কার হয়ে উঠছে। কাজেই তামাক নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ অর্জনও সম্ভব হবে না।

এই বিষয়গুলো নজরে রেখে ২০১৬ সাল থেকে শুরু হওয়া টেকসই উন্নয়ন লক্ষ বা Sustainable Development Goals (SDG) এর দৃষ্টিতে সরকারের পদক্ষেপ নিতে হবে।

বি.দ্র. এই লেখাটিতে Tobacco use and household expenditures on food, education and healthcare in low and middle-income countries : a multilevel analysis by Young Kyung Do1* and Mary Ann Bautista2 BMC Public Health (2015) 15:1098 তথ্য নেয়া হয়েছে।


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।