ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্য জর্দা ও গুল উৎপাদন


একটি অনুসন্ধান
বাংলাদেশ দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ১১টি দেশের অন্যতম যেখানে পৃথিবীর ৯০% ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্য সেবনকারী লোক বাস করেন। এত উচ্চ সংখ্যক সেবনকারী এবং মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকির প্রেক্ষিতে ১৫ বছর বয়সের উর্ধ্বে জনগণের মধ্যে ৩০% ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারের হার ৩০% কমানোর লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়েছে। সংখ্যাগত ভাবে ১১ দেশে প্রায় ২৫০ মিলিয়ন পূর্ণ বয়স্ক মানুষ ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্য সেবন করেন। এ সব দেশের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ, ভুটান, ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কোরিয়া, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালদ্বীপ, মায়ানমার, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড এবং তিমুর লেসটে। (primenews.com.bd September 11, 2013)

তামাক বিরোধী নারী জোট পরিচালিত এ অনুসন্ধানমূলক গবেষণা বিশেষ ভাবে লক্ষণীয় এ জন্য যে নারীরাই ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্যের প্রধান ব্যবহারকারী। নারীগ্রন্থ প্রবর্তনার নেতৃত্বে ২২টি তাবিনাজ সদস্য সংগঠন ৭টি বিভাগের ৩৮টি জেলায় সরাসরি এ গবেষণার সাথে যুক্ত ছিলেন। প্রধান দুইটি ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্য যেমন জর্দা ও গুলের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। নীতিগত বিষয় ও গণসচেতনতা সৃষ্টির জন্য তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে নিবেদিত একটি কার্যকর গবেষণা হিসাবে এ কাজটি পরিচালিত হয়। বাস্তবপক্ষে ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্য সম্পর্কে তেমন কোন তথ্য পাওয়া যায় না। এ গবেষণা প্রধানতঃ আর্থিক ও শ্রমিক নিয়োগ সম্পর্কিত বিষয়ের মধ্যেই সীমিত রয়েছে। সেবনকারীদের বিষয় সীমিত সংখ্যক পরিবারে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। সে যাই হোক এ ধরণের গবেষণা এদেশে এ বিষয় প্রথম উদ্যোগ।

১. ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্য সেবনকারী

বৈশ্যিক তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের ক্ষেত্রে ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্য একটি উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় বিশ্বব্যাপী ২৫টিরও অধিক ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার হয়। যার মধ্যে রয়েছে ব্যবসায়িক ভিত্তিক উৎপাদিত এবং স্থানীয় বা পারিবারিকভাবে উৎপাদিত পণ্য, যা অনুনাসিক বা মুখে সেবন করা হয়। কিছু কিছু পণ্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ রাসায়নিক দ্রব্য যা অন্য উদ্ভিদজাত দ্রব্য মিশ্রন করা হয় যা ব্যবহারকারীর জন্য বাড়তি ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে (Tobacco ATLAS)। কোন কোন দেশে যেমন ফিনল্যান্ড ও মিসরে পুরুষরা মহিলাদের চেয়ে অধিকহারে ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্য সেবন করেন। কারণ ধারণা করা হয় এটা পুরুষালি বিষয়। পক্ষান্তরে অন্য দেশ, যেমন দক্ষিণ আফ্রিকা, থাইল্যান্ড এবং বাংলাদেশে মহিলারা পুরুষদের চেয়ে অধিকহারে ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্য সেবন করেন (Tobacco ATLAS)।

এক কোটি ৩০ লক্ষের অধিক মহিলারা বাংলাদেশে ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্য সেবন করেন যা অনেক রোগের কারণ বিশেষ করে মুখের ক্যান্সার। এ সংখ্যা ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্য সেবনকারী পুরুষদের চেয়ে বেশী। বাংলাদেশে ৭০০,০০০-৭৫০,০০০ মহিলা ধূমপান করেন (দি ডেইলী সান, ১ জানুয়ারী, ২০১১)। বাংলাদেশ, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা এবং থাইল্যান্ড পরিচালিত সমীক্ষায় দেখা গেছে যে কম শিক্ষিত এবং অশিক্ষিত গরীব জনগোষ্টির মধ্যে ধোঁয়াযুক্ত ও ধোঁয়াবিহীন তামাক সেবনের প্রবণতা বেশী (primenews.com.bd September 2013)।

অদ্যাবধি সাধারণভাবে ধোঁয়াযুক্ত এবং ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্যের বিরুদ্ধে উদ্বেগ ও প্রচারাভিজান চলছে। আইটিসি এর ২০১০ সালের প্রতিবেদনে দেখা যায় তামাক জাত দ্রব্যের ব্যবহার লক্ষ্যণীয় ভাবে গত পাঁচ বছরের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশে ৪১.১ মিলিয়ন মানুষ তামাক সেবন করেন। বাংলাদেশে প্রাপ্ত বয়স্ক জনসংখ্যার ৪৩.৩% তামাক সেবন করেন (Fact sheet Bangladesh 2009, Global Adult Tobacco Survey)। প্রাপ্ত তথ্যের লিঙ্গ বিভাজনে দেখা যায় যে ৪৪.৭% পুরুষ এবং ১.৫% মহিলা ধোঁয়াযুক্ত তামাক সেবন করেন, অন্য দিকে ২৫.৯% মিলিয়ন প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে ২৭.২% ধোঁয়াবিহীন তামাক সেবন করেন। এদের মধ্যে পুরুষের (২৬.৪%) চেয়ে মহিলাদের সংখ্যা (২৭.৯%) বেশী। ধোঁয়াবিহীন তামাক সেবনকরীদের মধ্যে গ্রামের মহিলাদের সংখ্যা (২৯%) বেশী অর্থাৎ ১৪ মিলিয়ন।

২. ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্য

সাধারণ মানুষ বিভিন্ন ধোঁয়াযুক্ত এবং ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্যের সাথে পরিচিত। ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্য সেবনের বিভিন্ন পদ্ধতি আছে যেমন, চিবিয়ে খাওয়া, গন্ধ নেয়া, দাঁতের ফাঁকে, মাড়ির ফাঁকে এবং চামড়ার সাথে লাগিয়ে রাখা। হাজার হাজার বছর থেকে দক্ষিণ আমেরিকা ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার চলে আসছে (Tobacco Fact sheet) সময়ের সাথে সাথে বিশ্বব্যাপী এ সব দ্রব্যের ব্যবহার বেড়েছে। এ সব দ্রব্য না পুড়িয়ে মুখে অথবা নাকে ব্যবহার করা হয়। মুখে সেবনীয় ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্য মুখের মধ্যে দাঁত ও মাড়ির ফাঁকে ব্যবহার করা হয়। গুড়া পাউডার তামাক নাকে শুঁকে গন্ধ নেয়া হয়।

৩. ধোঁয়াবিহীন তামাকের ধরণ এবং সেবন পদ্ধতি

অনেক প্রকার ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্য রয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ সব দ্রব্য ব্যবহার হয় (Tobacco Fact sheet)। এ প্রতিবেদনে বাংলাদেশে যে সব দ্রব্য ব্যবহার হয় সে সব দ্রব্যের উদাহরণ নিম্নে -

১. গুল

ব্র্যান্ড নাম: নাই, বাংলাদেশে ব্র্যান্ড নাম আছে।
সাধারণ নাম: গাদাখু, বাংলাদেশে বলে গুল। ব্যবহারের ভৌগলিক এলাকা: মধ্য এবং পূর্ব ভারত, বাংলাদেশ।
পণ্যের উপাদান: তামাকের গুড়া, ঝোলাগুড় এবং অন্যান্য উপাদান।
কিভাবে ব্যবহার হয়: প্রায়শ দাঁত মাজনের জন্য ব্যবহার করা হয়।
কারা ব্যবহার করেন: প্রধানতঃ মহিলারা ব্যবহার করেন। তবে পুরুষেরাও ব্যবহার করেন।
প্রক্রিয়াজাতকরণ/তৈরীকরণ: ব্যবসায়িক ভিত্তিতে উৎপাদিত হয়। ১৯৮৬ সাল থেকে টুথপেষ্টের টিউবের মত টিউবে প্যাকেট করে বাজারজাত করা হচ্ছে।

২. খৈণী

ব্র্যান্ড নাম: রাজা কুবের।
সাধারণ নাম: নাই।
ব্যবহারের ভৌগলিক এলাকা: বিহার (ভারত) পশ্চিম এবং মধ্য ভারত, মহারাষ্ট্র (ভারত)।
বাংলাদেশ পণ্যের উপাদান: তামাক, চুন, সুপারি।
কিভাবে ব্যবহার হয়: মুখে ধারণ করে, ১০-১৫ মিনিট মুখে রাখা হয় এবং মাঝে মাঝে চুষে খাওয়া হয়।
কারা ব্যবহার করেন: সাধারণত পুরুষরা ব্যবহার করেন তবে মহিলারাও ব্যবহার করেন।
প্রক্রিয়াজাতকরণ/তৈরীকরণ: তামাকের গুড়া এবং চুন ব্যবহারকারীর হাতের তালুতে বল তৈরী করে মুখে ব্যবহার করেন। কখনও কখনও সুপারির সাথে মিশিয়ে ব্যবহার করা হয়। সাধারণত ব্যবহার-কারীরা নিজ হাতে এ সব উৎপাদন মিশিয়ে একত্র করে ব্যবহার করেন।

৩. পান মসলা

ব্র্যান্ড নাম: মানিকচান্দা মাহক, পান পরাগ নম্বর ১, ভিমল, সাগর, রাজদরবার, কুবের, ইয়ামু, বাদশা, তুলসি, রাহাট, পান কিং, জুবলি, কাঞ্চন।
সাধারণ নাম: পান মসলা।
ব্যবহারের ভৌগলিক এলাকা: ভারত, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্থান, বাংলাদেশ, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, নিউগিনি, তাইওয়ান, চীন।
পণ্যের উপাদান: তামাক, সুপাড়ি, চুন, পান, সুগন্ধি, মেনথল, কর্পুর, চিনি, গোলাপজল, মৌরি, পুদিনা এবং অন্যান্য মসলা।
কিভাবে ব্যবহার হয়: পান মসলা মুখে নিয়ে আস্তে আস্তে চুষে সেবন করা হয়। পান মসলা রেস্তোরা, বিয়ে বাড়ীতে খাবারের পরে পরিবেশন করা হয়।
কারা ব্যবহার করেন: সাধারণত মহিলারা ব্যবহার করেন। তবে পুরুষরাও ব্যবহার করেন।
প্রক্রিয়াজাতকরণ/তৈরীকরণ: ব্যবসায়িক ভিত্তিতে উৎপাদিত হয়। সুপারি পানিতে ফুটানোর পরে শুকানো হয়, শুকনা তামাক পাতার সাথে মিশিয়ে মিহি করে কাটা হয়। গোলাপজল অথবা অন্য সুগন্ধির সাথে মিশ্রন করে চুন ও খয়েরের সাথে মিশ্রন করে পান পাতার মধ্যে ঢুকিয়ে মুখে দেয়া হয়।

৪. জর্দা

ব্র্যান্ড নাম: বাবা, ভারত, গোপাল।
সাধারণ নাম: নাই।
ব্যবহারের ভৌগলিক এলাকা: ভারত, আরবদেশ, বাংলাদেশ।
পণ্যের উৎপাদন: তামাক, চুন, মসলা, উদ্ভিজ্জ, রং, সুপারি।
কিভাবে ব্যবহার হয়: পানের সাথে সেবন করা হয়।
কারা ব্যবহার করেন: মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত পরিবারের পুরুষ ও মহিলারা সেবন করেন।
প্রক্রিয়াজাতকরণ/তৈরীকরণ: তামাকপাতা গুড়া করে চুন ও মসলার সাথে মিসিয়ে পানিতে ফুটানো হয়। এ মিশ্রানের সাথে উদ্ভিজ্জ রং এবং গুড়া করা সুপারির সাথে মিশ্রন করা হয়। তারপর শুকানো হয়। ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের ফ্যাক্ট শিট তালিকায় বাংলাদেশের নামের উল্লেখ নাই। এ সব দ্রব্য উৎপাদন ও ব্যবহারকারীরদের সর্ম্পকে তথ্য ঘাটতির কারণে এমনটি হতে পারে।

আরো তথ্য জানতে এই লিংকটিতে ক্লিক করুণ: http://ubinig.org/index.php/networkdetails/showAerticle/6/125/bangla


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।