ধোঁয়াবিহীন তামাক দ্রব্যে কর বৃদ্ধি


ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্য কি?

ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্য তামাক পাতা থেকে তৈরি না পুড়িয়ে যে তামাকজাত দ্রব্য সরাসরি সেবন করা হয়, সেটা মুখে রেখে দিয়ে, চিবিয়ে বা নাক দিয়ে গন্ধ শুঁকে হতে পারে, তাই ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্য ইংরেজীতে (Smoke-less Tobacco (SLT) নামে পরিচিত হয়ে উঠেছে। এতে কোন ধোঁয়া বের হয় না। বেশীর ভাগ সেবনকারী মুখে চিবিয়ে খান, কিংবা পিকের সাথে রস খেয়ে ফেলে দেন। যে কোন তামাকদ্রব্যের মতোই ধোঁয়াবিহীন তামাকে নিকোটিন (Nicotine) আছে এবং তা মুখের ভেতরের আস্তরণ দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে।

নীতি নির্ধারণী পর্যায় ধোঁয়াবিহীন তামাক দ্রব্যে কর বৃদ্ধির চিন্তা ভাবনা কম:

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী তামাক দব্যের উপর কর আরোপোর কারনে দাম বৃদ্ধির ফলে কার্যকর ভাবে তরুন বয়সী এবং তরুন ও গরিবদের মধ্যে সবচেয়ে উপযুক্ত পদ্ধতির ফলে ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহার ও উল্লেখযোগ্য ভাবে কমবে বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু এখনো পর্যন্ত সিগারেট ও বিড়িতে কর আরোপের যে উদ্যোগ নেয়া হয় সে তুলনায় ধোঁয়াবিহীন তামাক সম্পর্কে নীতি নির্ধরণী পর্যায় কম গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশে ধোঁয়াবিহীন তামাক এর ব্যবহারের ব্যপকতা:

  • বাংলাদেশের ৪৩% অর্থাৎ ৪ কোটি ৬০ লক্ষ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক সেবন করে ।
  • ধূমপানের (২৩% অর্থাৎ ২ কোটি ১৯ লক্ষ) তুলনায় ধোঁয়াবিহীন তামাক সেবনের হার (২৭% অর্থাৎ ২ কোটি ৫৯ লক্ষ) বেশী।
  • ২৬.৪% পুরুষ (১ কোটি ২৫ লক্ষ জন) ও ২৮% মহিলা (১ কোটি ৩৪ লক্ষ জন) ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহার করে।

ধোঁয়াবিহীন তামাক সেবনে স্বাস্থ্য ক্ষতি:

  • ধোঁয়াযুক্ত ও ধোঁয়াবিহীন সকল ধরনের তামাক ব্যবহার স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
  • ধোঁয়াবিহীন তামাক এর কারণে মুখের ক্যান্সার, কন্ঠনালীর ক্যান্সার, মুখের ও দাঁতের ক্যান্সার, মারীর ক্ষত, উচ্চরক্তচাপ, ও খাদ্য নালীর ক্যান্সারসহ নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্য ক্ষতি বিশেষ করে কম ওজনের শিশু জন্ম হওয়া এবং মৃত শিশু জন্ম দানের কারণ হিসেবে প্ওায়া যায়।

ধোঁয়াবিহীন তামাক সব চেয়ে সস্তা:

দেশে গুল, জর্দা, সাদাপাতা ইত্যাদি জাতীয় ধোঁয়াবিহীন তামাক পণ্যের দাম অত্যন্ত সস্তা। বাজারে প্রতি কৌটা গুল মাত্র ৫ টাকা পাওয়া যায়। সর্বনি¤œ জর্দার মূল্য-১০ (৮ গ্রাম) টাকা, সর্বোচ্চ মূল্য-১৫৫ (১৩৫ গ্রাম) টাকা বাজারে বিক্রি হয়।

ধোঁয়াবিহীন তামাকের রকমারী ব্যান্ড ও বাজার:

  • ২৯২ টি জর্দার ও ২৬ টি গুলের ব্যান্ড বাজারে পাওয়া যায় ।
  • ১৪৬ টি জর্দা ও গুল কারখানা (৩৮ জেলার তথ্য অনুযায়ই)। এর মধ্যে ১৩২ টি জর্দা কারখানা ও ২৩টি গুল কারখানা।
  • ক্ষুত্র শিল্প আকারে জর্দা, গুল তৈরী হয়।

ধোঁয়াবিহীন তামাকের রকমারী সাইজের কৌটা কর আরোপের কার্যকারীতায় বড় প্রতিবন্ধকতা:

  • জর্দা, গুল প্রধানত টিন,প্লাষ্টিক কৌটা, পলিথিনের পেকেটে বিক্রি হয়।
  • তাবিনাজের অনুসন্ধানে ২৭ ধরনের কৌটার সাইজ পাওয়া গেছে।
  • সবচেয়ে অধিক ব্যবহারিত কৌটায় ১৬ গ্রাম ওজনে জর্দা ১৮ টাকা দামে বিক্রি হয়।
  • সবচেয়ে কম ওজনের জর্দা ৮ গ্রাম ১০ টাকা মূল্যে বিক্রি হয়।
  • সব্বর্চ ওজনে কৌটার জর্দা ১৩৫ গ্রাম ১৫৫ টাকায় বিক্রি হয়।

সাদাপাতা (আলাপাতা) অবাধে খোলা বিক্রি হয়:

তামাক পাতা প্রক্রিয়াজাত করে সাদা পাতা তৈরী করে বাজারে বিক্রয় করা হয়। এ পাতা কোন কারখানায় উৎপাদিত হয় না। বাজারে কালো ও সাদা রং এর ২ রকম সাদা পাতা বিক্রি হয়। ১টি সাদা পাতার মূল্য ৫ টাকা। এ পর্যন্ত সাদা পাতা বিক্রয়ের উপর কোন কর আরোপ হয়নি। এর ব্যবহার গরিবদের মধ্যে বেশী হ্ওয়ায় কর আরোপের মাধ্যমে দাম বৃদ্ধি করে ব্যবহার কমানো অত্যন্ত জরুরী।

ক্ষুদ্র শিল্প আকারে কারখানা পর্যায়ে জর্দা এবং গুল তৈরী হয়। অধিকাংশ সময় এইসব পণ্য ঘরোয়া পরিবেশে ছোট পরিসরে উৎপাদন করা হয়। কোন প্রকার সাইন বোর্ড ছাড়া, ছোট বাড়ি বা বাড়ির ভিতরে ১টি রুম নিয়ে অথবা নিজের বাড়িতে এ সকল পণ্য তৈরী করছে। বিশেষ কায়দায় সাদাপাতা ভিজিয়ে প্রক্রিয়াজাত করে পানের সাথে খাওয়ার জন্য বাজারে পাওয়া যায়। এইসব কারখানার কাজ করতে শ্রমিকদের খুব বেশি দক্ষতার প্রয়োজন হয় না। জর্দা এবং গুল কারখানা খুব দ্রুত স্থান পরিবর্তন করে। প্রচুর অনিয়ম রয়েছে এসব কারখানার উৎপাদন স্থানে। জর্দা, গুল ভ্যাট ও করের আওতাধীন পণ্য। ইঝঞও পণ্য তালিকা থেকে বর্তমানে বাদ দেয়া হলেও এর সংযুক্তির দাবী আসছে)

সবচেয়ে কম রাজস্ব আসে ধোঁয়াবিহীন তামাক থেকে:

২০১৪-১৫ অর্থবছরে ধোঁয়াবিহীন তামাক পণ্য থেকে রাজস্ব আদায় হয়েছে মাত্র ১৪.৩৬ কোটি টাকা যা তামাকখাত থেকে অর্জিত মোট রাজস্বের ১ শতাংশেরও কম। তামাক উৎপাদনে অগ্রসর ভৌগলিক অঞ্চলসমূহ পর্যবেক্ষণ করে এটা নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, জর্দা এবং গুলের প্যাকেটে রাজস্ব আদায় নির্ধারণী কোন চিহ্নই নেই যা রাজস্ব ফাঁকির প্রত্যক্ষ প্রমাণ। এছাড়াও, জর্দা ও গুলের প্যাকেটের ধরণ ও মাপের ভিন্নতা কর ফাঁকির পথ সুগম করে।

অর্থবছর ২০১৪-২০১৭ বাজেটে জর্দা ও গুলের কর আরোপ:

ধোঁয়াবিহীন জাত দ্রব্য জর্দা সম্পূরক কর (%) গুল সম্পূরক কর (%)
অর্থ বছর ২০১৪-১৫ ৬০% ৬০%
অর্থ বছর ২০১৫-১৬ ৬০% ৬০%
অর্থ বছর ২০১৬-১৭ ১০০% ১০০%

যদিও ২০১৬-১৭ সালে বাজেটে জর্দা ও গুলের শতভাগ কর বৃদ্দি করা হয়েছে। কিন্তু দাম অত্যন্ত কম হওয়ায় কর আরোপের কারণে দামের পার্থক্য উল্লেখযোগ্য পরিমানে হয়নি।

২০১৭-১৮ বাজেটে ধোঁয়াবিহীন তামাকের কর আরোপের সুনির্দিষ্ট সুপারিশ

১. গুল-জর্দার ক্ষেত্রে এক্স-ফ্যাক্টরি প্রথা প্রভৃতি বাতিল করে প্যাকেট/কৌটা ওজন ও সাইজ অনুযাযী কার্যকরভাবে নির্দিষ্ট পরিমাণ স্পেসিফিক এক্সাইজ ট্যাক্স নির্ধারণ করা।

২. সর্বনিম্ন ২০ গ্রাম জর্দার পেকেট নির্ধারন করে ১৬ টাকা স্পেসিফিকএকস্টাইজ ট্যাক্স আরোপ করে খুচরা বিক্রি মূল্য কম পক্ষে ৩২ টাকা করার প্রস্তাব করা হচ্ছে

৩. মোড়কে বা কৌটায় বিড়ি-সিগারেটের ন্যায় রাজস্ব আদায় নির্ধারণী স্ট্যাম্প বা ব্যান্ডরোল প্রথা চালু করা।

৪. তামাকের ওপর আরোপিত স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ ১ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি করে ২ শতাংশে উন্নীত করা।

তথ্যসূত্র:

  • ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্য জর্দা ও গুল উৎপাদন একটি অনুসন্ধান
  • ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্য: জর্দা সাদাপাতা, গুল খেতে আনন্দ কিন্তু ক্ষতির শেষ নেই
  • Taxing Tobacco in Bangladesh: Budget 2017-18 proposed by: The Campain For Tobacco-Free Kids


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।