তামাক খাদ্য নয়, অথচ মানুষ খাচ্ছেঃ নিয়ন্ত্রণের আলোকে কিছু প্রশ্ন


সিগারেট, বিড়ি, জর্দা, সাদাপাতা বা গুল তামাকজাত দ্রব্য বলেই স্বীকৃত এবং বাজারে অবাধে বিক্রি হচ্ছে। এর মধ্যে কোনটি ধোঁয়ার মাধ্যমে এবং কোনটি সরাসরি চিবিয়ে খাওয়া হচ্ছে, যাকে আমরা ধোঁয়াবিহীন বলে চিহ্নিত করি। যেটাই হোক না কেন, এই দ্রব্য মুখের মাধ্যমে অন্যান্য খাদ্য দ্রব্যের মতোই খাওয়া হয়। সিগারেট, বিড়ি ইতিমধ্যে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে এবং ক্ষতিকর বলে এর ব্যবহারে আইনী বাধ্যবাধকতা এসেছে।

কিন্তু পানের সাথে জর্দা খাওয়া সামাজিক ভাবে খারাপ চোখে দেখে না। পরিবারের বড় ছোট একসাথে বসে পানের সাথে সুপারি, জর্দা, সাদাপাতাও সেবন করে। দাওয়াত অথবা যে কোন উৎসবে বিশেষ করে বিয়ের অনুষ্ঠানে পান, সুপারি জর্দার বিশেষ আয়োজন থাকে। দরিদ্ররা সময় মতো খাবার খাওয়া সম্ভব হয় না বলে, ক্ষুধা চেপে রাখার জন্য পান, জর্দা খেয়ে থাকে। জর্দা দিয়ে পান খেয়ে নিলে অনেকক্ষণ ভাত না খেয়ে থাকা যায়। অর্থাৎ এর সাথে খাওয়ার সম্পর্ক অনেক বেশি, সরাসরি যুক্ত।

সার্বিকভাবে তামাকদ্রব্য সেবন ক্ষতিকর, এই সত্য প্রমাণে আর তর্ক করতে হয় না। জর্দা, গুল ও সাদাপাতা সরাসরি গ্রহণ করা হয় বলে এর স্বাস্থ্য ক্ষতির প্রভাব অনেক বেশী। কিন্তু এই দ্রব্য সেবনের ক্ষতির দিক চোখে পড়ে না। জর্দা ও গুল ব্যবহার গ্রামের মানুষ এবং গরীব ও শ্রমিকদের মধ্যে বিশেষ করে দেখা যায়। তারা ক্ষুধার মধ্যে যেভাবে খায় তা স্বাস্থ্যের জন্যে মারাত্মক ক্ষতিকর। জর্দা, গুল ও সাদাপাতা গ্রহণ করার কারণে মুখের ক্যান্সার, কন্ঠনালীর ক্যান্সার, মুখের ও দাঁতের ক্যান্সার, মারীর ক্ষত, উচ্চরক্তচাপ ও খাদ্য নালীর ক্যান্সারসহ নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্য ক্ষতি বিশেষ করে কম ওজনের শিশু জন্ম হওয়া এবং মৃত শিশু জন্ম দানের কারণ হিসেবে পাওয়া যায়।

স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে প্রথম চুক্তি Framework Convention on Tobacco Control (FCTC) প্রণীত হয়, এতে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করে ২০০৩ সালে। তার পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৫ সালে ধূমপান ও তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন ২০০৫ প্রণয়ন করা হয়। পরবর্তীতে কিছু সংশোধনী এনে ২০১৩ সালে ধোঁয়াবিহীন তামাক যেমন জর্দা, গুল, সাদাপাতা খৈনী সংঙ্গা অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

তামাক খাদ্য নয়, কিন্তু তামাক ব্যবহারকে আমরা ‘খাওয়া’ বা ‘সেবন’ বলি। ধোঁয়বিহীন তামাক দ্রব্য জর্দা ও সাদাপাতার মুখের মাধ্যমে চিবিয়ে খেলেও এটা জীবনধারণ, পুষ্টি সাধন ও স্বাস্থ্য রক্ষা ব্যবহৃত হচ্ছে না। অথচ মানুষ খাচ্ছে এবং নানা ধরণের স্বাস্থ্য ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে। তামাক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হলে এই ধারণা বদলাতে হবে। তামাক খাদ্য নয়, বরং তামাক বিষের মতোই ক্ষতিকর। মানুষ বিষ খায় আত্মহত্যার জন্যে, আর তামাক আনন্দের জন্যে খায় কিন্তু বিষের মতোই মানুষকে নীরবে এবং ধীরে ধীরে হত্যা করতে থাকে।

বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ নিশ্চিত করা একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা জানি যে খাদ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার জন্য অনেক উদ্যোগ নেয়া রয়েছে।খাদ্য নিরাপত্তাকে বরাবরই প্রধানতম অগ্রাধিকার ভিত্তিতে রেখেছে এবং উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য নানান ধরণের কীটনাশক ও রাসায়নিক সার প্রয়োগ কৃষি কাজে রয়েছে, যদি ৬০ দশকের এ প্রশ্ন আসে নি।

অন্যদিকে শিল্পজাত, খাদ্যের ব্যবহার ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন কারখানায় খাদ্য তৈরীতে ব্যবহৃত কাঁচামাল ব্যবহার এবং প্যাকেজিং ব্যবস্থায় রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার বেড়েছে। মানুষের খাদ্য ব্যবস্থাপনা এ ধরণের অরাজকতা মানুষকে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার অধিকার লংঘন হচ্ছে।দিনে দিনে স্বাস্থ্য হুমকির সম্মুখিন হচ্ছে। জাতিসংঘ বিশ্বব্যাপী নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার জন্য ইন্টারন্যাশনাল হেলথ রেগুলেশান ২০০৫ আইন পাশ করে। সরকার ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠান নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করনের জন্য আন্দোলন গড়ে তোলে এরপর জাতীয় সংসদে ‘নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩’ পাশ হয়।

নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩ (২০১৩ সনের ৪৩ নং আইন) এর সংজ্ঞা (৩) দেখি সেখানেও ‘খাদ্য’ “অর্থ চর্ব্য, চুষ্য, লেহ্য, পিয়। যেমন খাদ্য শস্য, ডাল, মৎস্য, মাংস, দুগ্ধ, ডিম ভোজ্য তেল, ফলমূল, শাকসবজি ইত্যাদি) বা পেয় যেমন- সাধারণ পানি, বায়ুবায়িত পানি, অঙ্গারিত পানি, এনার্জিড্রিংক, ইত্যাদি)-সহ সকল প্রকার প্রক্রিয়াজাত, আংশিক বা অপ্রক্রিয়াজাত আহার্য উৎপাদন এবং খাদ্য, প্রক্রিয়াকরণ বা প্রস্ততকরণে ব্যবহৃত উপকরণ বা কাঁচামাল ও যাহা মানবদেহের জন্য উপকারী আহার্য হিসাবে জীবন ধারণ, পুষ্টি সাধন ও স্বাস্থ্য-রক্ষা করিতে ব্যবহৃত হইয়া থাকে, উহার আন্তর্ভক্ত হইবে”।

এবার আসি ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯ (২০০৯ সনের ২৬ নং আইন) প্রসঙ্গে। ভেজাল খাবার এর কথা আজকাল আমরা প্রায় শুনে আসছি। অর্থাৎ ভেজাল, নানা ধরণের রাসায়নিক পদার্থ মিশ্রণ খাবারে পাওয়া যাচ্ছে ।২০০৯ সালে বাংলাদেশে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন প্রণয়ন করা হয়। এখানে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ, ভোক্তা অধিকার বিরোধী কার্য প্রতিরোধ এর কথা বলা আছে। আইনের সজ্ঞা ২(৭) ‘খাদ্য পণ্য’ অর্থ মানুষ বা গবাদি পশু- পাখির জীবন ধারণ, পুষ্টি সাধন ও স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য ফল-মূল এবং পাণীয়সহ অন্য যে কোন খাদ্য দ্রব্য।

ধূমপান ও তামাকজাতদ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫ আইনের সংজ্ঞায় ২(গ) ধারায় ”তামাক জাত দ্রব্য” অর্থ তামাক, তামাক পাতা বা উহার নির্যাস হইতে প্রস্তুত যে কোন দ্রব্য, যাহা চোষণ বা চিবানোর মাধ্যমে গ্রহণ করা যায় বা ধূমপানের মাধ্যমে শ্বাসের সহিত টানিয়া লওয়া যায় এবং বিড়ি, সিগারেট, চুরুট, গুল, জর্দা, খৈনী, সাদাপাতা, সিগারেট এবং হুক্কা বা পাইপের ব্যবহার্য মিশ্রণও (mixture) ইহার অন্তর্ভুক্ত হইবে।

বিএসটিআই (বাংলাদেশ ষ্ট্যান্ডার্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন) এর খাদ্য দ্রব্যের তালিকায় তামাকে বাদ দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ খাদ্যের মান সংক্রান্ত যতো আইন আছে তামাক তার তালিকাভুক্ত নয়। খাদ্য নামে আমাদের সামনে যা যা আছে সবগুলো কি জীবন ধারণ, পুষ্টি সাধন ও স্বাস্থ্য-রক্ষা কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে? এর মধ্যে অনেক খাদ্য ক্ষতিকর বলে বিবেচিত। কিন্তু সেগুলো সংজ্ঞায় খাদ্য বলে বিবেচিত। জর্দা, গুল ও সাদাপাতার বেলায় এই বিষয়ের সুরাহা করা প্রয়োজন। তামাক খাদ্য পণ্য হিসাবে বিবেচিত নয় অথচ তামাক পণ্য জর্দা, সাদাপাতা মানুষের মুখ দ্বারা চিবিয়ে খাদ্য নালীর মাধ্যমে পেটে প্রবেশ করছে। যা খাদ্য বলে বিবেচিত নয় তাও মানুষ খাচ্ছে কি ভাবে। এ পণ্য কোন আইনের সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে? এগুলো খাদ্যের আশে পাশেই বা থাকছে কিভাবে?


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।