ধোঁয়াবিহীন তামাক দ্রব্যের নিয়ন্ত্রণের কৌশল পত্রঃ প্রেক্ষাপট


১। বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে তামাক দ্রব্যের ব্যবহার উদ্বেগজনক হারে বেশি। প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের মধ্যে ৪৩% ধোঁয়াযুক্ত ও বিভিন্ন ধরনের ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্য (জর্দা, সাদাপাতা, গুল)ব্যবহার করেন। গ্যাটস ২০০৭ সালের জরিপ অনুযায়ি মোট ৪ কোটি ১৩ লক্ষ তামাক সেবনকারীর মধ্যে ২ কোটি ১৯ লক্ষ (২৩%) ধূমপানের মাধ্যমে এবং ২ কোটি ৫৯ লক্ষ (২৭.২% ) ধোঁয়াবিহীন তামাক দ্রব্য সেবন করেন। অর্থাৎ ধোঁয়াযুক্ত তামাক দ্রব্যের চেয়ে সেবনের দিক থেকে ধোঁয়াবিহীন তামাক দ্রব্যের হার বেশি। নারীদের মধ্যে ধুমপান কম হলেও ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহার নারীদের মধ্যে পুরুষের তুলনায় বেশি; নারী ২৮%, পুরুষ ২৬%। তবে পুরুষদের অনেকের মধ্যে ধূমপান এবং জর্দা-গুল সেবন একই সাথে চলে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে “ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫, (২০১৩ সালে সংশোধনী)কার্যকর ভাবে বাস্তবায়ন করতে হলে ধোঁয়াবিহীন তামাক দ্রব্য উৎপাদন, বিক্রি ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত জরুরী।

২। ২০৪০ সাল নাগাদ ‘তামাকমুক্ত বাংলাদেশ’ গড়ার মাননীয় প্রধান মন্ত্রীর ঘোষণা বাস্তবায়ন করতে হলে একটি শক্তিশালী ধোঁয়াবিহীন তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা ও কৌশল প্রণয়ন করা প্রয়োজন।

৩। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ১১ টি দেশে ২৫ কোটি প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ (যা বিশ্বের সকল ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারকারির ৯০%) রয়েছে। ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারের এই উচ্চ হার এবং স্বাস্থ্য ক্ষতির কথা বিবেচনায় রেখে ২০১৩ সালে এই অঞ্চলের জন্যে ৩০% কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করা হয়েছে।

৪। ২০১৪ সালে মস্কোতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি)ষষ্ট Convention of the Parties (COP6) ধোঁয়াবিহীন তামাকের ব্যবহার প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত আলোচনা হয়। ধোঁয়াবিহীন তামাক দ্রব্যের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের জন্যে বিভিন্ন দেশে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে তবে এখনো তা সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণি, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন পর্যন্ত সীমিত রয়েছে। ভারতে ২০১১ সালে নিরাপদ খাদ্য আইন ব্যবহার করে গুটকা এবং পান মাসালা (তামাকসহ) নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে ধোঁয়াবিহীন তামাক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত কৌশল পত্র পুরো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জন্যে একটি দিক নির্দেশনামূলক কাজ হবে। ভারতেও ধোঁয়াবিহীন তামাক দ্রব্য নিয়ে গবেষনা কাজ জোরালো ভাবে এগিয়ে নিচ্ছে।

৫। ধোঁয়াবিহীন তামাক নিয়ন্ত্রণ ধূমপান নিয়ন্ত্রণের চেয়ে তুলনামূলকভাবে কঠিন, কারণ ধূমপানের ব্যাপারে সামাজিক বাধা আছে, কিন্তু পানের সাথে জর্দা খাওয়া সামাজিক ভাবে খারাপ চোখে দেখা হয় না। অর্থাৎ সামাজিক ভাবে এই পণ্যের গ্রহনযোগ্যতা রয়েছে। পরিবারের বড় ছোট একসাথে বসে পানের সাথে সুপারি,জর্দা,সাদাপাতাও সেবন করে। দাওয়াত অথবা যেকোন উৎসবে বিশেষ করে বিয়ের অনুষ্ঠানে পান সুপারি জর্দার বিশেষ আয়োজন থাকে। ভোক্তা পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণ শুধু আইন দিয়ে সম্ভব নয়। এর জন্যে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টির প্রয়োজন।

৬। ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারের আর্থ-সামাজিক দিক রয়েছে। জর্দা ও গুল ব্যবহার শহরের তুলনায় গ্রামে বেশি, এবং গরীব ও শ্রমজীবি মানুষের মধ্যে দেখা যায়। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত নারী পুরুষদের মধ্যে ব্যবহার করতে কম দেখা যায়। বর্তমানে দাঁতের, মুখের সৌন্দর্যের দিক লক্ষ্য রেখে এর ব্যবহার শহরের মধ্যে কম দেখা যায়। কিন্তু আদালত চত্তর, বাস স্ট্যান্ড, হাট বাজার, রাস্তার পাশে, লঞ্চ ঘাট সব জায়গায় আবার জর্দা,গুল,পান,বিড়ি,সিগারেট এর দোকান জমজমাট। গরিব মানুষ সময় মতো খাবার খাওয়া সম্ভব হয় না বলে ক্ষুধা চেপে রাখার জন্য পান জর্দা খেয়ে থাকে। ক্ষুধা নিবারণের একটি উপায় হিসাবেও পান দিয়ে জর্দা খাওয়া হয়

৭। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য থেকে জানা যায় যে মুখের ক্যান্সারের প্রধান কারণ ধোঁয়াবিহীন তামাক। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় এ রোগের প্রাদূর্ভাব সব চেয়ে বেশী। আন্তর্জাতিক ক্যান্সার গবেষণার মতে মুখের ক্যান্সারে অর্ধেকই তামাক সেবনের সাথে যুক্ত। গরীবরাই মুখের ক্যান্সারে বেশী আক্রান্ত হয়। ধোঁয়াবিহীন তামাক হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। এশিয়া মহাদেশে পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে যে ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্য সেবনকারী মহিলারা পুরুষদের চেয়ে বেশী মৃত্যু ঝুঁকিতে থাকেন। মৃত শিশু জন্মের সাথে গর্ভকালীন অবস্থায় মায়ের ধোঁয়াবিহীন তামাক সেবনের সম্পর্ক রয়েছে এবং কম ওজনের বাচ্চা প্রসবের আশংকা থাকে।ধোঁয়াবিহীন তামাক সেবনের সাথে যুক্ত আন্যান্য রোগের মধ্য রয়েছে দাঁতের ক্যান্সার,মাড়ির ক্ষত,উচ্চ রক্তচাপ,ওরাল সাবকিউটিনাস ফাইব্রোসিস মুখ এবং খাদ্যনালির ক্যান্সার। বাংলাদেশে এই নিয়ে বিস্তারিত গবেষণার প্রয়োজন।এ বিষয়ে চিকিৎসকরা সচেতন হলেও ব্যবহারকারিরা মোটেও সচেতন নন। কাজেই অ-সংক্রামক রোগ প্রতিরোধের কৌশল হিশাবেও ধোঁয়াবিহীন তামাক দ্রব্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন রয়েছে। জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি (২০১১) বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে প্রাধা্ন্য দেয়া হয়েছে। এছাড়া সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় অসংক্রামক রোগ ও তামাক নিয়ন্ত্রনের বিষয়কে সম্পৃক্ত করা হয়েছে।

৮। ধূমপানের আশক্তি থেকে বের হয়ে আসার কৌশল হিশেবে কেউ কেউ ধোঁয়াবিহিন তামাকের ব্যবহার করেন, যা একটি ভুল পদ্ধ্বতি হিশাবে অন্যান্য দেশে চিহ্নিত হয়েছে। বাংলাদেশে তামাক নিয়ন্ত্রণের সার্বিক কৌশলের মধ্যে এই বিষয়টি লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন কারণ ধূমপান নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে ধোঁয়াবিহিন তামাকের ব্যবহার বেড়ে যেতে পারে, ফলে তামাক ব্যবহারের হার কমবে না। অন্যদিকে ধোঁয়াবিহীন তামাক এর আসক্তি থেকে বের হয়ে আসার কোন কার্যক্রম নাই।

৯। “ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫, (২০১৩ সালে সংশোধনী)এর সকল ধারা ধোঁয়াবিহিন তামাক নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রযোজ্য নয়। ফলে ধোঁয়াবিহীন তামাক নিয়ন্ত্রণ করতে হলে আলাদা কৌশল পত্র এবং এই আইনের পরবর্তী সংশোধনীতে সে ধারা গুলো সংযোজন ও সংশোধন প্রয়োজন।

১০। নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে ধোঁয়াবিহীন তামাক দ্রব্যের ক্ষতিকর দিক গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয় না বলে করারোপের ক্ষেত্রে এবং অন্যান্য নীতির ক্ষেত্রে তা উপেক্ষতি হয়। তামাক নিয়ন্ত্রণে জেলা ও উপজেলা টাস্কফোর্স কমিটির নিয়মিত সভায় তামাক নিয়ন্ত্রণের এজেন্ডা ধোঁয়াবিহীন তামাকের বিষয় অনুপস্থিত থেকে যায়। যার কারণে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নে ধোঁয়াবিহীন তামাক অনুপস্থিত।

১১। জর্দা, গুল ও সাদাপাতা উৎপাদনের ওপর নিয়ন্ত্রণের কোন ব্যবস্থা না থাকায় যেখানে-সেখানে,এমনকি বাড়িঘরে্র ভেতরে উৎপাদন করা হয়। ফলে শ্রমিকের স্বাস্থ্য হানী ঘটে, কর ফাঁকি দেয়া হয়। এবং উৎপাদনের প্রক্রিয়ার কারণেও উৎপাদিত পণ্য ক্ষতিকর হতে পারে।

১২। ধোঁয়াবিহীন তামাক দ্রব্য বাজারজাত করণ এবং ছোট ছোট দোকানে বিক্রির ওপর কোন নজরদারি নেই। বিক্রেতারা সিগারেট বিড়ি সম্পর্কে জানলেও জর্দা-গুলের ক্ষতি সম্পর্কে জানেন না। ফলে না জেনেই তারা চায়ের দোকানে, রকমারী পণ্যের দোকানে বিক্রি হচ্ছে। একই এলাকায় অনেক ছোট ছোট বিক্রেতা জর্দা বিক্রি করছেন। ছোট শিশুদের এই কাজে নিয়োগ করা হচ্ছে।

১৩। ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্য বিশেষ করে জর্দা-গুল ও সাদাপাতার দাম অত্যন্ত কম। মাত্র ২ টাকার প্যাকেট,৫ টাকার মধ্যে কিনতে পাওয়া যায়, কিংবা খুচরা বিক্রি হয়। তাবিনাজের গবেষণায় দেখা গেছে একজন ব্যবহারকারি গড়ে মাসে শুধু জর্দার জন্যে ২০০ টাকা এবং পানের জন্যে ৬০০ টাকা খরচ করছেন; পান এবং জর্দা মিলে ৮০০ টাকা খরচ হচ্ছে। যা দিয়ে তিনি অন্তত ১০-১২ দিনের চাল কিনতে পারতেন।

১৪। কৌটার সাইজ, ওজন ও আকৃতি নানা রকম করে ইচ্ছে মতো দাম নেয়া হচ্ছে। প্রায় ২৭টি নানা সাইজের জর্দার কৌটা, বেশিরভাগ গোলাকৃতির, টিনের, প্লাস্টিক ও পলিথিনের প্যাকেটে পাওয়া গেছে। এর মধ্যে কম ওজন ৫ গ্রাম থেকে বেশি ওজনের ১৫০ গ্রাম জর্দার কৌটা বিক্রি হয়। কোন স্টান্ডার্ড নিয়ম মেনে চলা হয়না। তামাক পাতা বিশেষ কায়দায় সাদা পাতা তৈরী করে বাজারে খোলা বিক্রয় করা হয়। এ পাতা কোন কারখানায় উৎপাদিত হয় না।

১৫। “ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫, (২০১৩ সালে সংশোধনী) ৫নং ধারাঃ তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন ও প্রচারণা নিষিদ্ধ এবং পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত বিধান বলা আছে। সিগারেট-বিড়ি অর্থাৎ ধোঁয়াযুক্ত তামাকজাত দ্রব্য যেভাবে বিজ্ঞাপন, প্রচারণা ও পৃষ্ঠপোষকতা দৃশ্যমান হয়, ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্য বিশেষ করে জর্দা-গুল সেভাবে করতে দেখা যায় না বটে, কিন্তু সরবরাহকারী হিশাবে কোম্পানি নিজের পণ্য বিক্রির জন্যে দোকান্দারকে নানা ভাবে প্রভাবিত করে।

১৬। “ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫, (২০১৩ সালে সংশোধনী) তে Metropolitan police Ordinance কথা বলা রয়েছে। আমরা যদি দেখি The Dhaka Metropolitan police Ordnance 1976 (ord. no(111) of 1976), The Chittagong Metropolitan police Ordnance 1978 (ord. no(XLV.111 of 1978) , The Khulna Metropolitan police Ordnance 1985 (ord. no(L11) of 1985), ধুমপান ও থুথু ফেলা বিষয়ে নোটিশ দেওয়া এবং নোটিশ লংঙ্ঘনকারী শাস্তি ও জরিমানার বিধান রয়েছে। আইন দিয়ে ধোঁয়াবিহীন তামাক নিয়ন্ত্রনের ক্ষেত্রে থুথু ফেলা বিষয়ে নোটিশ জর্দা,গুল ব্যবহার কমানো যেতে পারে।

১৭. ধোঁয়াবিহীন তামাক দ্রব্যরে ব্যবহার নারী-পুরুষ উভয়রে জন্যে ক্ষতিকর। কিন্তু এই বিষয়টি নারীর স্বাস্থ্য ও সামাজিক অবস্থানের দিক থেকে বিবেচনার বিষয় দাবী রাখা। নারী স্বাস্থ্য, বিশেষ করে প্রজনন স্বাস্থ্যের ওপর এর প্রভাব এবং নারীর ওপর অর্থনৈতিক চাপ অনেক বেশী। নারীর শারিরীক অসুস্থতার কথা অনেক দেরীতে জানা যায়, ফলে তার সময়মতো চিকিৎসাও সম্ভব হয়না।

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।