তামাক বিরোধী নারী জোট ও ধোঁয়াবিহীন তামাক দ্রব্যের নিয়ন্ত্রণ


বাংলাদেশে তামাক বা ধূমপান নিয়ন্ত্রণের কার্যক্রম শুরু হয়েছে আশির দশকের শেষের দিকে আমাদের দেশের অত্যন্ত নিষ্ঠাবান কিছু চিকিৎসকের উদ্যোগে। তাঁরা স্বাস্থ্যের ক্ষতির বিষয়টি বিবেচনায় এনে ধূমপানের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। তাই দীর্ঘদিন তামাক নিয়ন্ত্রণ শুধুমাত্র ধূমপান বিরোধি আন্দোলন হিসেবেই সকলেই জেনেছে। এমন কি ২০০৫ সালে “ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫ বিশেষভাবে ধূমপানের নানা দিক নিয়ন্ত্রণের দিক তুলে ধরেছে।

আমরা জানি বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে তামাক দ্রব্যের ব্যবহার উদ্বেগজনক হারে বেশি। সর্বশেষ জাতীয় পর্যায়ের সার্ভেতে গ্যাটস ২০১৭ অনুযায়ি প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের মধ্যে ৩৫.৩% ধোঁয়াযুক্ত ও বিভিন্ন ধরনের ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্য (জর্দা, সাদাপাতা, গুল) ব্যবহার করেন। এই জরিপ অনুযায়ি মোট ৩ কোটি ৭৮ লক্ষ তামাক সেবনকারীর মধ্যে ১ কোটি ৯২ লক্ষ (১৮%) ধূমপানের মাধ্যমে এবং ২ কোটি ২০ লক্ষ (২০.৬% )ধোঁয়াবিহীন তামাক দ্রব্য সেবন করেন। অর্থাৎ ধোঁয়াযুক্ত তামাক দ্রব্যের চেয়ে সেবনের দিক থেকে ধোঁয়াবিহীন তামাক দ্রব্যের হার বেশি। নারীদের মধ্যে ধুমপান কম হলেও ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহার নারীদের মধ্যে পুরুষের তুলনায় বেশি; নারী ২৪.৮%, পুরুষ ১৬.২%। নারীদের মধ্যে মাত্র ০.৮% ধূমপান করেন। বাংলাদেশের মতো দেশে নারীদের মধ্যে ধূমপান বিশেষ করে সিগারেট সেবন সবসময়ই কম ছিল। কিন্তু বিশ্বের অন্যান্য দেশে নারী ধূমপায়ির সংখ্যা মোট ১০০ কোটি ধূমপায়ির ২০%। তামাক কোম্পানি বিষয়টি নজরে এনে বিভিন্ন দেশের নারীদের সিগারেট সেবনে আকৃষ্ট করার বিশেষ উদ্যোগ নেয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সে কারণে ২০১০ সালে নারীদের জন্যে কোম্পানীর বাজারজাতের কৌশলের বিরুদ্ধে সচেতন করার লক্ষ্যে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবসে বিষয়টি সামনে নিয়ে আসে। এই সময় উন্নয়ন বিকল্পের নীতি নির্ধারণী গবেষণা (উবিনীগ) ও নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা যৌথভাবে সারাদেশের নারী প্রধান সংগঠনের প্রধানদের নিয়ে ঢাকায় ৩১শে মে, ২০১০ সালে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় নারীদের ধূমপানের চেয়ে বেশি আলোচনা হয় পরিবার এবং কর্মক্ষেত্রে পুরুষদের ধূমপানের কারনে নারী কিভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তার চেয়েও বেশি প্রশ্ন ওঠে নারীদের তামাক সেবন প্রকৃত পক্ষে ধোঁয়াযুক্ত নয়, ধোঁয়াবিহীন, যা প্রায় প্রতি ঘরে দেখা যায়। পানের সাথে জর্দা খাওয়া সামাজিক ভাবে খারাপ চোখে দেখা হয় না। অর্থাৎ সামাজিক ভাবে এই পণ্যের গ্রহনযোগ্যতা রয়েছে। পরিবারের বড় ছোট একসাথে বসে পানের সাথে সুপারি,জর্দা,সাদাপাতাও সেবন করে। দাওয়াত অথবা যেকোন উৎসবে বিশেষ করে বিয়ের অনুষ্ঠানে পান সুপারি জর্দার বিশেষ আয়োজন। কিন্তু এর অনেক ক্ষতি আছে, যা অনেকেই জানেন না। এ নিয়ে কাজ করার প্রয়োজনীয়তার উপলব্ধ্ব্বি থেকে তামাক বিরোধী নারী জোট (তাবিনাজ) গঠনের প্রস্তাব আসে যা ২০১১ সালের মার্চ মাসে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রাক্কালে ৬ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে।



তাবিনাজ বর্তমানে ৬৪ জেলায় ১০৬টি সংগঠন নিয়ে কাজ করছে। তাবিনাজের সদস্যরা নিজ নিজ জেলায় তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকেন। ধোঁয়াবিহীন তামাক দ্রব্যের ক্ষতিকর দিক নিয়ে তাঁরা বিভিন্ন সভায় আলোচনা করেন এবং যেখানে সম্ভব জর্দা, গুল ফ্যাক্টরী কিংবা দোকানে আইনের লংঘন দেখলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিগোচর করেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য থেকে জানা যায় যে মুখের ক্যান্সারের প্রধান কারণ ধোঁয়াবিহীন তামাক। আন্তর্জাতিক ক্যান্সার গবেষণার মতে মুখের ক্যান্সারে অর্ধেকই তামাক সেবনের সাথে যুক্ত। গরীবরাই মুখের ক্যান্সারে বেশী আক্রান্ত হয়। ধোঁয়াবিহীন তামাক হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। এশিয়া মহাদেশে পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে যে ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্য সেবনকারী মহিলারা পুরুষদের চেয়ে বেশী মৃত্যু ঝুঁকিতে থাকেন। মৃত শিশু জন্মের সাথে গর্ভকালীন অবস্থায় মায়ের ধোঁয়াবিহীন তামাক সেবনের সম্পর্ক রয়েছে এবং কম ওজনের বাচ্চা প্রসবের আশংকা থাকে।ধোঁয়াবিহীন তামাক সেবনের সাথে যুক্ত আন্যান্য রোগের মধ্য রয়েছে দাঁতের ক্যান্সার, মাড়ির ক্ষত, উচ্চ রক্তচাপ, ওরাল সাবকিউটিনাস ফাইব্রোসিস মুখ এবং খাদ্যনালির ক্যান্সার। বাংলাদেশে এই নিয়ে বিস্তারিত গবেষণার প্রয়োজন। এ বিষয়ে চিকিৎসকরা সচেতন হলেও ব্যবহারকারিরা মোটেও সচেতন নন। কাজেই অ-সংক্রামক রোগ প্রতিরোধের কৌশল হিশাবেও ধোঁয়াবিহীন তামাক দ্রব্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন রয়েছে। তাবিনাজের সদস্যরা এই সব তথ্য পর্যালোচনা করে সচেতনতা বাড়াবার কাজ করেন। কোন কোন ক্ষেত্রে তাঁরা জর্দা-গুল সেবনের কারনে মূখের ক্যান্সারে আক্রান্ত গরিব রোগীদের চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগের ব্যবস্থাও করেন। নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্যের সমস্যার ক্ষেত্রে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞদের সাথেও আলোচনা করা হয়।

“ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫”, ধোঁয়াবিহীন তামাক দ্রব্যের নিয়ন্ত্রণে আইন বাস্তবায়নের সমস্যা চিহ্নিত করে তাবিনাজ প্রথম থেকে কাজ করেছে এবং ২০১৩ সালে সংশোধনীতে তামাক দ্রব্যের সংজ্ঞায় জর্দা, গুল ও সাদাপাতা অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষেত্রে ভুমিকা রেখেছে। এখনো দেখা যাচ্ছে সংশোধিত আইনের সকল ধারা ধোঁয়াবিহিন তামাক নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রযোজ্য নয়। ফলে ধোঁয়াবিহীন তামাক নিয়ন্ত্রণ করতে হলে আলাদা কৌশল পত্র এবং এই আইনের পরবর্তী সংশোধনীতে সে ধারা গুলো সংযোজন ও সংশোধন প্রয়োজন। তাই তাবিনাজ নিজস্ব গবেষণা পরিচালনা করে তথ্য সংগ্রহ করে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে বোঝার জন্যে একটি কৌশল পত্র প্রণয়নে সরকারের তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল এর সাথে কাজ করেছে।

নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে ধোঁয়াবিহীন তামাক দ্রব্যের ক্ষতিকর দিক গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয় না বলে করারোপের ক্ষেত্রে এবং অন্যান্য নীতির ক্ষেত্রে তা উপেক্ষিত হয়। তামাক নিয়ন্ত্রণে জেলা ও উপজেলা টাস্কফোর্স কমিটির নিয়মিত সভায় তামাক নিয়ন্ত্রণের এজেন্ডা ধোঁয়াবিহীন তামাকের বিষয় অনুপস্থিত থেকে যায়। যার কারণে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নে ধোঁয়াবিহীন তামাক অনুপস্থিত। তাবিনাজ প্রতি বছর ধোয়াবিহীন তামাক দ্রব্যের ওপর কর বৃদ্ধ্বির জন্যে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করে, এবং সংসদ সদস্যদের কাছ থেকে ডিও লেটার সংগ্রহ করে অন্যান্য তামাক নিয়ন্ত্রণ সংগঠনের সাথে সংসদে পেশ করে। তাবিনাজে একটি অন্যতম অবদান হচ্ছে ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্য বিশেষ করে জর্দা-গুল ও সাদাপাতার দাম যে অত্যন্ত কম তা তুলে ধরা। মাত্র ১ টাকা, দুই টাকার মধ্যে কিনতে পাওয়া যায়, কিংবা খুচরা বিক্রি হয়। তাবিনাজের গবেষণায় দেখা গেছে একজন ব্যবহারকারি গড়ে মাসে শুধু জর্দার জন্যে ২০০ টাকা এবং পানের জন্যে ৬০০ টাকা খরচ করছেন; পান এবং জর্দা মিলে ৮০০ টাকা খরচ হচ্ছে। যা দিয়ে তিনি অন্তত ১০-১২ দিনের চাল কিনতে পারতেন।

তাবিনাজের সদস্যরা বিভিন্ন জেলা থেকে কৌটার সাইজ, ওজন ও নানা রকম আকৃতি কৌটা সংগ্রহ করেছেন। প্রায় ২৭টি নানা সাইজের জর্দার কৌটা, বেশিরভাগ গোলাকৃতির, টিনের, প্লাস্টিক ও পলিথিনের প্যাকেটে ২৪৭ টি ব্রান্ডের জর্দা পাওয়া গেছে। এর মধ্যে কম ওজন ৫ গ্রাম থেকে বেশি ওজনের ১৫০ গ্রাম জর্দার কৌটা বিক্রি হয়। কোন স্টান্ডার্ড নিয়ম মেনে চলা হয়না। তামাক পাতা বিশেষ কায়দায় সাদা পাতা তৈরী করে বাজারে খোলা বিক্রয় করা হয়। এ পাতা কোন কারখানায় উৎপাদিত হয় না।

ধোঁয়াবিহীন তামাক দ্রব্যের ব্যবহার নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যে ক্ষতিকর। কিন্তু এই বিষয়টি নারীর স্বাস্থ্য ও সামাজিক অবস্থানের দিক থেকে বিবেচনার বিশেষ দাবী রাখে। নারী স্বাস্থ্য, বিশেষ করে প্রজনন স্বাস্থ্যের ওপর এর প্রভাব এবং নারীর ওপর অর্থনৈতিক চাপ অনেক বেশি। নারীর শারিরীক অসুস্থার কথা অনেক দেরীতে জানা যায়, ফলে তার সময়মতো চিকিৎসাও সম্ভব হয়না।

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।