বাংলাদেশে তামাকচাষের আগ্রাসী সম্প্রসারণ ঝুঁকি ও করণীয় সম্পর্কে নীতি সংলাপ


তামাকচাষের ভয়াবহতা ও ক্ষয়-ক্ষতি নীতিনির্ধারণী মহলসহ সংশ্লিষ্ট সবার মাঝে তুলে ধরে এ বিষয়ক করণীয় স্থির করার লক্ষ্যে ২৩ ডিসেম্বর মঙ্গলবার, সকাল ১০:০০টায় সিরডাপ অডিটরিয়ামে ‘বাংলাদেশে তামাকচাষের আগ্রাসী সম্প্রসারণ: ঝুঁকি ও করণীয়’ শীর্ষক একটি নীতি সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। এই সংলাপটি আয়োজন করেন ‘তামাক বিরোধী নারী জোট(তাবিনাজ)’ ‘প্রয়োজনের জন্য জ্ঞান(প্রজ্ঞা)’র যৌথ উদ্যোগে ‘তামাক বিরোধী সাংবাদিক জোট- আত্মা’। নীতি সংলাপে প্রধান অতিথি ছিলেন সাবের হোসেন চৌধুরী এমপি, বিশেষ অতিথি ছিলেন এডভোকেট ফজিলাতুন্নেছা বাপ্পী এমপি, আবুল কালাম মোঃ আহসানুল হক এমপি, নবী নেওয়াজ এমপি পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য।

মূল উপস্থাপনা ‘বাংলাদেশে তামাকচাষের আগ্রাসী সম্প্রসারণ: ঝুঁকি ও করণীয়’ সম্পর্কে করেন তাইফুর রহমান, সিটিএফকের বাংলাদেশ প্রতিনিধি; বিশেষজ্ঞ আলোচক ছিলেন ড: এম. আসাদুজ্জামান, প্রফেসরিয়াল ফেলো, বিআইডিএস। সংলাপ সংক্ষেপকরণ ও সমাপ্তি করেন দৈনিক সকালের খবর পত্রিকা সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন।


Tabinaj Meeting 14


তামাকচাষ নিরুৎসাহিতকরণে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ না থাকায় বিগত কয়েক দশকে অরক্ষিত কৃষকদের ব্যবহার করে তামাক কোম্পানিগুলো আগ্রাসীভাবে তামাকচাষ বাড়িয়ে চলেছে। অথচ আন্তর্জাতিক চুক্তি ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) সাক্ষরকারী (২০০৩ সালে) দেশ হিসেবে বাংলাদেশ তামাক নিয়ন্ত্রণ (তামাকের চাহিদা হ্রাস ও যোগান নিয়ন্ত্রণ) বিষয়ক পদক্ষেপ গ্রহণে অঙ্গীকারাবদ্ধ। বিশেষত তামাকের যোগান নিয়ন্ত্রণে এফসিটিসি’র আর্টিকেল ১৭ ও ১৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রসমূহ তামাকের বিকল্প ফসল চাষে কৃষকদেরকে সহায়তা প্রদান ও তামাকচাষের ক্ষয়ক্ষতি থেকে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য রক্ষার্থে উদ্যোগ গ্রহণ করতে বাধ্য।

সরকার যদিও ইতোমধ্যে তামাক নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে একটি আইন প্রণয়ন করেছে, কিন্তু তা সার্বিক তামাক নিয়ন্ত্রণের জন্য যথেষ্ট কার্যকরী নয়। আইনটি মূলত তামাকের চাহিদা হ্রাসমূলক কিছু পদক্ষেপ মাত্র, তামাকের যোগান নিয়ন্ত্রণে বাস্তবায়নযোগ্য কোন বিধান নেই এতে। উল্লেখ্য, আইনটিতে তামাক জাতীয় ফসল উৎপাদন ও চাষ নিরুৎসাহিতকরণে সরকার প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রণয়ন করতে পারবে মর্মে একটি ধারা সংযুক্ত করা হলেও এখন পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। এই সুযোগে দেশব্যাপী আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে বিষাক্ত এই ফসলের আবাদ।


Tabinaj Meeting 14


কৃষি সস্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী দেশে ২০১৩-১৪ মৌসুমে ১০৮,০০০ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়েছে, ২০১২-১৩ মৌসুমে যা ছিল ৭০,০০০ হেক্টর। অর্থাৎ এক বছরেই তামাক চাষের জমির পরিমাণ বেড়েছে ৩৮,০০০ হেক্টর। সাময়িক মুনাফার প্রলোভনে পড়ে কৃষক ক্রমশ তামাক চাষে আগ্রহী হয়ে উঠায় খাদ্য ও অর্থকরী ফসলের জমি চলে যাচ্ছে তামাকের দখলে। সরকারের দেওয়া কোটি কোটি টাকার ভর্তুকিকৃত সার ও সেচ সুবিধা ব্যবহার করে বছরের পর বছর মুনাফা লুটে নিচ্ছে তামাক কোম্পানিগুলো।

প্রধান অতিথি সাবের হোসেন চৌধুরী এমপি বলেন, গত বছর যে বাজেট অনুমোদন করা হয় সেখানে তামাকের উপর ১% করে কর ধার্য করা হয়। কর ধার্য করার পরে আড়াই শত কোটি টাকা রাজস্ব এসেছে। সেই তহবিলটা ব্যবহারে একটি নীতিমালা তৈরী করতে হবে। তামাক চাষের সম্প্রসারণের ক্ষয়-ক্ষতির সাথে কৃষি মন্ত্রণালয়, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয় জড়িত সেই সাথে তিনি বানিজ্য মন্ত্রণালয়কেও জড়িত করতে বলেন।

বিশেষ অতিথি এডভোকেট ফজিলাতুন্নেছা বাপ্পী এমপি বলেন, তামাক পুজি করে যারা মুনাফা করছে তারা অনেক শক্তিশালী। তামাকের কারণে একটি অসুস্থ প্রজন্ম উপহার দিচ্ছে। শিশুরা পড়ালেখা বন্ধ করে তামাকের বিষাক্ত কাজে জড়িয়ে পড়ছে। বাংলাদেশ খাদ্য ঝুকিতে পড়ে যাচ্ছে এটা আমরা হতে দিতে পারিনা। তামাক চাষের আগ্রাসন যেভাবে সম্প্রসারিত হচ্ছে তার জন্য নীতিমালা অত্যান্ত জরুরী। তামাকের আগ্রাসন রোধে যে যে ধরণের কার্যকর ভুমিকা রাখবে তিনি তার সাথে একাত্মতা এবং আগামী জানুয়ারী মাসে জাতীয় সংসদের সেশন অধিবেশনে তামাক চাষের আগ্রাসন রোধে কন্ঠ তোলার ঘোষণা করেন ।

বিশেষ অতিথি পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য নবী নেওয়াজ এমপি বলেন, তামাক চাষের কারণে তামাক চাষের জমির পরিমান বেড়ে যাচ্ছে। যেখানে খাদ্য শস্য উৎপাদন হবার কথা।তামাক চাষের এলাকায় পরিবেশ, গাছপালা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। সাংবাদিক ভাইয়েরা চাষের ব্যাপারে মিডিয়াতে বেশি করে প্রচার করতে পারেন। জাতীয় সংসদের প্রত্যেকটা (খাদ্য, পরিবেশ, অর্থ, তথ্য) মন্ত্রণালকে টার্গেট করে তামাক চাষের বিরুদ্ধে যা যা পদক্ষেপ আছে তা তুলে ধরবো।

বিশেষ অতিথি আবুল কালাম মোঃ আহসানুল হক এমপি বলেন, রংপুরে তামাকের চাষ কমেগেছে। পার্শ্ববর্তী জেলা লালমনিরহাট, নীলফামারীতে তামাকরে চাষ শুরু হয়েছে। শিল্পের মাধ্যমে আমরা তামাক চাষ থেকে কৃষকদের ফিরিয়ে আনতে পারি। আমি আহবান করবো রংপুরে বিভিন্ন শিল্প কারখানা গড়ে তোলার জন্য। রংপুরে শতরঞ্জী নামে একটি পাড়া আছে আগে সেখারকার কৃষকেরা তামাক চাষ করতো। এখন তারা শতরঞ্জী তৈরী করছে এবং সেটা বিদেশে রপ্তানী হচ্ছে। বদরগঞ্জ, তারাগঞ্জ, কাউনিয়া, গঙ্গাচড়া এলাকাগুলোতে তামাকের চাষ নাই শিল্প কারখানার কারণে। তিনি তামাক চাষ সম্প্রসারণের প্রতিরোধে অংশীদার হবেন।

মুক্ত আলোচনায় তাবিনাজের আহবায়ক ফরিদা আখতার বলেন, এন্টি টোবাকো মিডিয়া এলায়েন্স (আত্মা) গড়ে ওঠার পরে তামাকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন কার্যক্রমে তামাকের ঝুঁকি তুলে ধরেছে আবার তামাক কোম্পানী গুলিও সাংবাদিকদের নানাভাবে প্ররোচনা করে। তিনি সংসদ সদস্যদের প্রতি আহবান জানান অন্তত দুইবার তামাক এলাকা ভিজিট করতে। এই সময়ে গেলে সবুজের সমারোহ দেখা যাবে আর মার্চ মাসে গেলে তামাকের চুল্লিতে পাতা পোড়ানো দেখা যাবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মোঃ মোসলেহ উদ্দিন ফারুক কে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো এর তালিকা থেকে তামাকের নাম তুলে দিতে অনুরোধ করেন।

উবিনীগের কনসালটেন্ট ড. এম এ সোবহান বলেন, তামাক গাছকে তিনি উদ্ভিদের দৃষ্টিকোণ থেকে চিনেন। তামাক গাছের গোড়ায় একটি উদ্ভিদ জন্মে। কৃষকরা মুলা বলে। ইংরেজী নাম অরবংকর। এটা তামাক গাছের পরগাছা। তামাক গাছের খাদ্য নিয়ে বেড়ে উঠে। জমির র্উবরা শক্তি কমেগেলে তামাক উৎপাদন যেমন ভাল হয় না তেমনি এই মুলার কারণেও তামাক উৎপাদন কমে যায়। তাই নতুন নতুন এলাকায় কোম্পানী তামাক চাষ করতে এগিয়ে যাচ্ছে। তামাক গাছ কাটার পরে সেখানে কোন প্রাণী গরু, ছাগল চড়ে না। এমনই একটা বিষ সেই জমিতে আগাছাও জন্মে না।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মোঃ মোসলেহ উদ্দিন ফারুক বলেন, পর্যায়ক্রমে তামাক চাষ নিরুৎসাহিত করছি । তামাক চাষের জন্য তামাক চাষীদের কোন ভর্তুকী দেয়া হয় না। খাদ্য উৎপাদন বৃদ্দি করার জন্য বিভিন্ন প্রযুক্তি কৃষকদের দেই। উচ্চমূল্যের শস্য করার জন্য কয়েক বছর কৃষকদের মোটিভেট করেছি কিন্তু কৃষকেরা করে না কারণ কৃষক তামাক চাষ করার আগেই তামাকের দাম পেয়ে থাকে। তাই সে খাদ্য শস্য করতে চায় না। খাদ্য শস্যর দাম ন্যায্য পেলে সেই চাষী আর তামাক চাষ করবে না।

মুক্ত আলোচনায় আরো বক্তব্য রাখেন, নজরুল ইসলাম টিটু, একুশে টিভি, বান্দরবান প্রতিনিধি; আজাদ রহমান, প্রথম আলো, ঝিনাইদহ প্রতিনিধি; এস. দীলিপ রায়, ডেইলি স্টার, লালমনিরহাট প্রতিনিধি; জহুরুল হক, এনটিভি; মিজানুর রহমান, দৈনিক যুগান্তর; স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরো প্রতিনিধি; হেলাল আহমেদ, প্রত্যাশা মাদক বিরোধী সংগঠন; জোৎস্না বেগম, ইউপি সদস্য, বান্দরবান; এমদাদুল হক ভুঁইয়া ও আরিফ সিকদার, ইসি বাংলাদেশ এবং জাকির হোসেন, উবিনীগ, কক্সবাজার।


Tabinaj Meeting 14


নীতি সংলাপের সুপারিশ:

. তামাক চাষ বন্ধে পরিবেশ মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, পানি সম্পদ, খাদ্য মন্ত্রণালয়, বন মন্ত্রণালয় উদ্যোগ গ্রহন করা
২. খাস জমিতে তামাক চাষ বন্ধ করা
৩. তামাককে ক্যাশক্রপ তালিকা থেকে তুলে দেয়া
৪. তামাক চাষের ক্ষেত্রে সেচের জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করা
৫. সিএসআর এর নামে তামাক কোম্পানীর কার্যক্রম বন্ধ করা
৬. আর্টিকেল ৫.৩ অনুযায়ী তামাক কোম্পানীর সাথে পার্টনারশীপ করা যাবে না
৭. তামাক কোম্পানীর সাথে করা যে কোন বৈঠক সম্পর্কে জানাতে হবে
৮. তামাক কোম্পানী নামক নেকড়ের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে আমাদের কৃষকদের


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।