'তামাকজাত পণ্যের উৎপাদন ও চাষ নিয়ন্ত্রণে নীতিমালা জরুরী' শীর্ষক মতবিনিময় সভা


গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ‘ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫, (২০১৩ সালের সংশোধনী) প্রণীত হয়েছে। এই আইনের ধারা ১২-তে বলা আছে “তামাক ও তামাক জাতীয় ফসল উৎপাদন ও ব্যবহার নিরুৎসাহিতকরণ। তামাক জাতীয় ফসল উৎপাদন ও চাষ নিরুৎসাহিত করিবার লক্ষ্যে সরকার প্রয়োজনীয় নীতিমালা গ্রহণ করিতে পারিবে।” তাবিনাজের পক্ষ থেকে তামাক জাতীয় ফসল উৎপাদন ও চাষ নিরুৎসাহিত করিবার লক্ষ্যে কিছু সুপারিশ নীতিনির্ধারণী মহলে তুলে ধরে তামাক বিরোধী নারী জোট (তাবিনাজ) এর আয়োজনে ১১মে,২০১৫ তারিখ সোমবার কেআইবি কমপ্লেক্স, কৃষি খামার সড়কে সকাল ১০টা থেকে ‘তামাকজাত পণ্যের উৎপাদন ও চাষ নিয়ন্ত্রণে নীতিমালা জরুরী’ শীর্ষক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়।

‘তামাকজাত পণ্যের উৎপাদন ও চাষ নিয়ন্ত্রণে নীতিমালা জরুরী’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন মোঃ মকবুল হোসেন, সংসদ সদস্য, সভাপতি, কৃষি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি; বিশেষ অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন রোকসানা কাদের, অতিরিক্ত সচিব (জ ও বি), স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়; সভাপতিত্ব করেন কৃষি বিজ্ঞানী ড. এম এ সোবহান।

মতবিনমিয় সভা সঞ্চালনায় করেন সীমা দাস সীমু, পরিচালক, উবিনীগ; স্বাগত বক্তব্য রাখেন সাইদা আখতার, সমন্বক,তাবিনাজ ও নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা; মূল উপস্থাপনা করেন রফিকুর হক টিটো, উবিনীগের তামাক চাষ সংক্রান্ত গবেষণার সিনিয়র গবেষক।

আলোচক হিসাবে ছিলেন কৃষিবিদ মো: মোসলেহ উদ্দিন ফারুক, অতিরিক্ত পরিচালক (তামাক), কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি; এড.সৈয়দ মাহবুবুল আলম তাহিন, টেকনিক্যাল কনসালটেন্ট, দি ইউনিয়ন; মোঃ শরিফুল আলম, কনসালটেন্ট, ক্যাম্পেন ফর টোবাকো ফ্রি কিডস্ (সিটিএফকে); এড. উম্মে কুলসুম স্মৃতি, সংসদ সদস্য, মহিলা আসন-৪; নাসরনি জাহান, উপ-পরিচালক, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর।

দি ইউনিয়নের টেকনিক্যাল কনসালটেন্ট এড.সৈয়দ মাহবুবুল আলম তাহিন বলেন, ১৯৬৪ সালে রংপুরে তামাক চাষ শুরু হয়। তামাক চাষে কৃষকরা যদি লাভবান হয় তাহলে রংপুরের তামাক চাষীরা ধনী হয়নি কেন? বাংলাদেশের একটা বড় অংশ পাহাড়ী এলাকা পার্বত্য চট্টগ্রাম, সেখানের লোকেরা ধনী হয়নি কেন? সেখানে উৎপাদনের অনেক সম্ভাবনা আছে। শুধু কৃষি মন্ত্রনালয় নয়, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে হওয়া উচিত। এটা শুধু কৃষি বিষয়ক না হয়ে সকলের বিষয় হওয়া উচিত।

ক্যাম্পেন ফর টোবাকো ফ্রি কিডস্রে কনসালটেন্ট মোঃ শরিফুল আলম বলেন, তামাকজাত দ্রব্য কোন খাদ্য নয়। তামাক থেকে যে আয় হয় হিসাব করলে খরচটাই বেশি। ঘুরিয়ে কথা না বলে সরাসরি বলতে চাই তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা প্রয়োজন। তামাক যদি খাদ্য নিরাপত্তার হুমকী হয় তাহলে কেন তামাক চাষ করবো? কৃষকদের অন্যান্য চাষে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। খাদ্য নীতিতে খাদ্য নিরাপত্তাই মুখ্য, তাহলে কেন বিপরীত ধর্মী কাজ করা। শুধু কৃষি মন্ত্রণালয়ের নয় সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণের কাজ করতে হবে। কৃষক পরিবার যেন কোম্পানীর ধোকায় না পড়ে। 

বিশেষ অতিথি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (জ ও বি) রোকসানা কাদের বলেন, তামাক কোম্পানী অত্যান্ত শক্তিশালী। ২০০৫ সালের তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন হয়ে ২০১৩ সালে পাশ হয়। তামাক কোম্পানীর কারণে প্রায় বাইশ মাস পরে ২০১৫ সালে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের বিধিমালা পাশ হয়। বিধিমালা পশের আগে কোম্পানীগুলো বিভিন্নভাবে মিটিং করেছে ধারাগুলো পরিবর্তনের জন্য। নতুন আইনে পাবলিক প্লেস/পাবলিক ট্রান্সর্পোটে ধূমপান নিষিদ্ধ বলা আছে, তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ, আঠারো বছরের নীচের শিশুদের কাছে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি নিষিদ্ধ, এছাড়াও তামাকজাত দ্রব্যের প্যাকেটে/কৌটায় সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী ছাপা হবে।

তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ নীতিমালার জন্য একটি কমিটি করা হয়েছে। কমিটির আহবায়ক অতিরিক্ত সচিব (জ ও বি), সদস্য কৃষি মন্ত্রণালয়, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ ব্যাংক, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল, উবিনীগ। নীতিমালা আমাদের করতেই হবে। আজকের আলোচনা থেকে যে সুপারিশ আসবে তা বিবেচনায় রাখবো।

মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক নাসরীন জাহান বলেন, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর তাবিনাজের সাথে কাজ করে আসছে উপজেলা/জেলা পযার্য়ের মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তাদের মাধ্যমে। মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের কার্যক্রমে তামাকজাত দ্রব্যকে অন্তর্ভুক্ত করে পরিচালনা করা হচ্ছে। তামাক চাষ একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি সংগঠন মিলে নীতিমালা তৈরীর কাজ করতে হবে। আমাদের সমস্যাকে মুক্ত করা, পরিবেশের ক্ষতি থেকে মুক্ত করা, স্বাস্থ্য ভাল রাখা এবং জনগনকে সুরক্ষার কাজ করতে হবে।

সংসদ সদস্য এড. উম্মে কুলসুম স্মৃতি বলেন, আলোচনা থেকে পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে যে তামাক চাষ নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন। মানুষ বাঁচার জন্য তামাক চাষ নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন। তামাক বেশি ব্যবহার করে দিন মজুর এবং নি¤œ শ্রেণীর পেশার লোক। আমাদের দেশে অশিক্ষিত লোক বেশি তাই এই দেশটাকে বেছে নেয় কোম্পানীরা। প্রান্তিক চাষীদের হাতে কলমে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। খাদ্য উৎপাদন কিভাবে বাড়ানো যায় সরকার সেদিকে খেয়াল রাখবে।

প্রধান অতিথি কৃষি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি সংসদ সদস্য মোঃ মকবুল হোসেন বলেন, আন্দোলন সিগারেটের বিরুদ্ধে নয়, আন্দোলন তামাকের বিরুদ্ধে। তামাক চাষ বন্ধ করতে হবে। এটা স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও মানুষের জন্য ক্ষতিকর। মানুষের মাঝে ঘৃণা জমানোর জন্য তামাক সম্পর্কে বলতে হবে। মানুষ সচেতন হলে পরবর্তী প্রজন্ম সচেতন হবে। আমরা যদি কৃষকদের সচেতন করতে হবে তাহলে তামাক চাষ কমবে। তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা নিয়ে আলোচনা করার জন্য সংসদ অধিবেশন চলাকালীন সময় তাবিনাজকে সময় দেয়া হবে আলোচনার বসার জন্য।

সভাপ্রধান কৃষিবিদ ড. এম এ সোবহান বলেন, আমাদের দেশ খাদ্যের স্বয়ং সম্পূর্ণ তারপরও চাল আমদানী করতে হয়। গোখাদ্য থেকে মানুষের খাদ্যে রুপান্তরিত করেছে চালকে। তামাক স্বাস্থ্য, পরিবেশ, মাটির জন্য ক্ষতিকর। তামাকের সর্বাঙ্গে বিষ সেটা আমরা চাষ করবো কেন। তামাক চাষ ও সেবন বন্ধ করতে হবে। বেগুন, আলু, টমেটো রক্ণষা করতে হলেও তামাক বন্ধ করতে হবে। 

মুক্ত আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন নিরাপদ ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ইবনুল সাইদ রানা, কুড়িগ্রাম জেলার এসোসিয়েশন ফর অল্টারনেটিভ ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক সাইদা ইয়াসমিন, যশোর জেলার জননী মহিলা উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক রেবেকা পারভীন, কুমিল্লা জেলার সৃষ্টি সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক মোঃ সালমা আকতার এবং উবিনীগের গবেষক জাহাঙ্গীর আলম জনি।

বাংলাদেশের ৪০টি (কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, বগুড়া, পঞ্চগড়, নীলফামারী, ভোলা, সাতক্ষীরা, চুয়াডাঙ্গা, সিলেট, ফেনী, ব্রাক্ষণবাড়িয়া, নোয়াখালী, কুমিল্লা, টাঙ্গাইল, রাজবাড়ি, পিরোজপুর, কুষ্টিয়া, দিনাজপুর, মাদারীপুর, নাটোর, খুলনা, যশোর, বরিশাল, ময়মনসিংহ, জামালপুর, নারায়নগঞ্জ, হবিগঞ্জ, কক্সবাজার, মৌলভীবাজার, ঝিনাইদহ, পটুয়াখালী, গোপালগঞ্জ, রংপুর, বাগেরহাট, চাঁদপুর, রাজবাড়ি,চট্টগ্রাম) জেলার নারী সংগঠনের প্রতিনিধিগণ এবং আরো অংশগ্রহন করেন তামাক নিয়ন্ত্রকারী সংগঠন ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট, নিরাপদ ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন, প্রজ্ঞা, ঢাকা আহসানিয়া মিশন, একশন ইন ডেভেলপমেন্ট, ইনভায়রনমেন্ট কাউন্সিল বাংলাদেশ, মানবিক, ইপসা, উবিনীগ এবং ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনির্ভাসিটির টোবাকো কন্ট্রোল এন্ড রিসার্চ সেল এর প্রতিনিধিগণ।


১১ মে ২০১৫ তাবিনাজ মিটিং


‘তামাকজাত পণ্যের উৎপাদন ও চাষ নিয়ন্ত্রণে নীতিমালা জরুরী’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় তাবিনাজের সুপারিশ:

  • মাঠ পর্যায়ে তামাক চাষের ক্ষেত্রে তামাক কোম্পানি কর্তৃক কোন সুবিধা প্রদানের সুযোগ রাখা যাবে না এবং তামাক চাষের জন্য একবারের বেশি জমি ব্যবহার না করা।
  • তামাক চাষের জন্য কোন তামাক কোম্পানি কৃষককে ঋণ, সার, কীটনাশক বা বীজ সরবরাহ করতে হলে তামাক নিয়ন্ত্রণ টাস্ক ফোর্সের অনুমোদন নিতে হবে।
  • তামাক চাষ বনজসম্পদ ধ্বংস করে তাই পাহাড় ও বন সরকারি বনভূমি/রিজার্ভ বনভূমি এলাকায় তামাক চাষ নিষিদ্ধ মর্মে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় যৌথ উদ্যোগে আইন বা নীতিমালা প্রণয়ন করতে পারে।
  • তামাক চাষের জন্য পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে তার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরকে নীতিমালা গ্রহন করতে হবে।
  • খাদ্য ফসলের জমিতে তামাক চাষ নিষিদ্ব করা এবং তামাক চাষের জন্য কৃষকের জমি লীজ না দেয়া।
  • কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলার মধ্যে প্রবাহিত সাংগু, মাতামুহুরী, বাঁকখালী নদীর তলদেশ পর্যন্ত তামাক চাষে মৎস্য ও জলজ সম্পদ বিপন্ন রোধে মৎস্য ও পানি সম্পদ মন্ত্রনালয় যৌথভাবে আইন তৈরী করতে পারে।
  • উত্তরবঙ্গ, যশোর, কুষ্টিয়াসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য উৎপাদন অঞ্চলসমূহকে ‘খাদ্য উৎপাদন জোন’ ঘোষণা করে ঐসব এলাকায় তামাক চাষ নিষিদ্ধ করা এবং পর্যাক্রমে কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে পারে কৃষি মন্ত্রণালয় ও খাদ্য মন্ত্রণালয়।
  • কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের অর্থকরী ফসলের তালিকা থেকে তামাককে বাদ দেয়া।
  • শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তামাক চাষের জন্য সারের বিপণন নিষিদ্ধ করতে পারে। বিসিআইসি প্রতিটি সারের বস্তায় লিখে দিতে পারে ‘তামাকচাষের জন্য নহে’ ইত্যাদি। কেননা কৃষি মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যে তামাক চাষে ভর্তুকিকৃত সার ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
  • বিদ্যুৎ চালিত সরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন সেচ প্রকল্পের আওতায় তামাক চাষ করা হলে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন / স্থগিত করা যেতে পারে। বিএডিসি পরিচালিত সেচ প্রকল্পের আওতায় তামাক চাষ নিষিদ্ধ করা যেতে পারে। 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।