বেগম রোকেয়া নয়, রোকেয়া খাতুনকে চিনুন
ফরিদা আখতার || Friday 12 August 2016 ||গত শতাব্দি থেকে একটি নাম নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল শিক্ষিত মানুষের কাছে পরিচিত এবং গ্রহণযোগ্য সে নাম হচ্ছে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। তাঁকে সংক্ষেপে বেগম রোকেয়া বলা হয়, যদিও এই বেগম কোথা থেকে এলো তার কোন হদিস পাওয়া যায় না। বেগম তাঁর নামের অংশ নয়। তার আসল নাম রোকেয়া খাতুন। মুসলিম পরিবারের অতি চেনা একটি নাম। জন্ম ১৮৮০ সালে রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ গ্রামে। রোকেয়ার কারণে পায়রাবন্দ গ্রামও সারা বিশ্বে পরিচিত। শহর গ্রাম সব জায়গায় মেয়েদের নাম ‘রোকেয়া’ রাখা হয়। আমার বিশ্বাস রোকেয়ার কাজের কারণেও এই নাম অনেক প্রচার পেয়েছে। তাঁর বাবা জহিরুদ্দিন মুহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের জমিদার ছিলেন, তিনি পুরুষতান্ত্রিক চরিত্রের ব্যতিক্রম ছিলেন না। চারটি বিয়েও করেছিলেন। তাদেরই একজন ছিলেন রোকেয়া খাতুনের মা রাহাতুন্নেসা। রোকেয়ারা দুই বোন এবং তিন ভাই ছিলেন, তার মধ্যে বড় বোন করিমুন্নেসা এবং ভাই ইব্রাহীম সাবের তাঁর জীবনে অনেক গুরুত্বপুর্ণ প্রভাব ফেলেছেন।
রোকেয়া খাতুনের বিয়ে হয় ষোল বছর বয়সে, সে সময়ের জন্যে সে বয়স বেশীই ছিল। তাঁর স্বামী ভাগলপুরের ডেপুটি মেজিস্ট্রেট খান বাহাদুর সাখাওয়াত হোসেন তাঁর চেয়ে বয়সে অনেক বড় ছিলেন (৩৮ বছর), এবং আগে বিবাহিত ছিলেন। সাখাওয়াত হোসেন উচ্চ শিক্ষিত ছিলেন এবং রয়াল এগ্রিকালচারাল সোসাইটি অব ইংল্যান্ডের সদস্য ছিলেন। তিনি কৃষি শিক্ষায় বৃত্তিও পেয়েছিলেন। অসম বয়সের বিয়ে হলেও রোকেয়া খাতুনের জীবনে সাখাওয়াত হোসেনের কারণে বড় ধরণের ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। রোকেয়া খাতুনের এই টুকু পারিবারিক পরিচিতি থেকে এটা স্পষ্ট যে তিনি উচ্চবিত্ত পরিবারে হলেও তাঁকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সাথে মোকাবেলা করতে হয়েছে। তবে তিনি সৌভাগ্যবান যে তাঁর ভাই, বড় বোন ও স্বামী তার জীবনকে বদলে দিতে পেরেছেন।
বাংলা ভাষার জন্যে প্রাণ দেয়া এদেশের মানুষের কাছে অনেক গর্বের ব্যাপার। আমরা বাংলা ভাষার জন্যে লড়াইয়ের ইতিহাস খুঁজতে গেলে বাহান্ন’র ভাষা আন্দোলনের আগে কোন সংগ্রাম ছিল কিনা খুব একটা চিন্তা করি না। কিন্তু কবি সাহিত্যকদের বাইরে যারা বাংলা ভাষাকে ভালবেসে এই ভাষায় সমাজের জন্যে প্রয়োজনীয় লেখা লিখে অবদান রেখেছেন, তাদের মধ্যে রোকেয়া খাতুন এবং তাঁর বড় বোন করিমুন্নেসার নাম উল্লেখযোগ্য। সে সময় উচ্চবিত্ত মুসলিম পরিবারে বাংলার চল ছিল না, আরবী এবং উর্দুতে কথা বলা এবং পড়াশোনা করার নিয়ম ছিল। কিন্তু রোকেয়া এবং করিমুন্নেসা সাধারণ মানুষের ভাষা যেহেতু বাংলা তাই ভাইয়ের কাছে বাংলা ভাষা শেখেন, পাশাপাশি ইংরেজীও শেখেন। মেয়েদের ক্ষেত্রে আরবী পড়ালেই যথেষ্ট মনে করা হোত। দুই বোনের মধ্যে করিমুন্নেসা এই ক্ষেত্রে বেশ দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন বলে তাঁর পড়াও বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। শাস্তি হিসেবে তাকে বলিয়াদিতে মাতামহের বাড়ীতে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল বিয়ের আয়োজন করার জন্যে। করিমুন্নেসার মাত্র ১৪ বছর বয়সে বিয়ে হয়, তিনি মাত্র ৯ বছরের মধ্যেই বিধবা হন। অর্থাৎ ২৩ বছর বয়সেই তিনি বিধবার পোষাক পরেন। অন্যদিকে রোকেয়ার সৌভাগ্য যে তাঁর স্বামী সাখাওয়াত হোসেন তাঁর বাংলা ভাষা শেখা এবং লেখালেখি করার ইচ্ছাকে স্বাগত জানান এবং তাঁকে পুর্ণ সমর্থন দেন। আজ আমরা বাংলায় লেখা রোকেয়া রচনাবলীর যে ভান্ডার পাচ্ছি তা সম্ভব হয়েছে বাংলা ভাষা শেখার জন্যে তাঁর নিজের সচেতন সিদ্ধান্ত এবং সাখাওয়াত হোসেনের সমর্থন।
রোকেয়া চেয়েছেন সাধারণ নারীরা লেখা পড়ার সুযোগ পাক। তিনি কাজের পাশাপাশি অনেক লিখেছেন। রোকেয়ার বাংলায় লেখা গ্রন্থ মতিচুর প্রথম ও দ্বিতীয় খন্ড, পুস্তকাকারে অপ্রকাশিত ১৬টি প্রবন্ধ, উপন্যাস’পদ্মরাগ’, অবরোধবাসিনী, ছোট গল্প ও রস রচনা ছয়টি এবং কয়েক গুচ্ছ কবিতাবলী, ইত্যাদি। ইংরেজীতে দুটি লেখা আছে: Sultana’s Dream ও God Gives, Man Robs । বাংলা একাডেমী প্রকাশিত আবদুল কাদির সম্পাদিত রোকেয়া রচনাবলী ১৯৭৩ সালে প্রথম প্রকাশ পেয়েছিল,এরপর দ্বিতীয় প্রকাশ হয় ১৯৮৪ সালে।
রোকেয়া বিয়ের পর উচ্চবিত্ত পরিবারের রীতি অনুযায়ী স্বামীর নাম ধারণ করেন। তাঁকে এখন সকলেই রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন নামে চেনে। নারীদের নামের শেষের অংশে বাবার বংশের নাম দেয়া হয়নি, তাকে পরে স্বামীর ধারণ করতে হবে বলে। তাই মুসলিম নারীদের নামের শেষে কিছু বিশেষ সাধারণ অংশ থাকে, যেমন বেগম, খানম, খাতুন, নেসা ইত্যাদী যা সহজেই খোয়া যায়। এতে পরিবারের কোন ক্ষতি হয়না। রোকেয়া নিজেও সেই রীতির শিকার হয়েছেন। তাঁকে ‘খাতুন’ অংশটি খোয়াতে হয়েছে এবং রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন নাম ধারণ করতে হয়েছে। দেখা যায় সমাজে তিনি মিসেস আর এস হোসেন হিসেবেও পরিচিত থেকেছেন ।
রোকেয়াকে কি পরিচয়ে চিনবো? তিনি একাধারে লেখিকা, সমাজ সংস্কারক, আবার নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার কর্মী, চিন্তা চেতনায় পুরুষতন্ত্রের ঘোর বিরোধিতাকারী একজন ফেমিনিস্ট? সাহিত্যিক হিসেবে রোকেয়ার লেখার পর্যালোচনা কিছু পুরুষ সাহিত্যিকরা করেছেন। কাজী আবদুল ওদুদ এক্ষেত্রে খুব বড় মুল্যায়ন করেছেন। তিনি বলছেন, ‘মিসেস আর এস হোসেন আমাদের সমাজে একটি জ্যান্ত মানুষ। ...। জীবিত ও মৃত বুড়োদের মধ্যে সত্যিকার মুসল মান সাহিত্যিক সংখ্যার দিক থেকে অতি অল্প – মীর মোশাররফ হোসেন, পন্ডিত রেয়াজুদ্দিন, কায়কোবাদ, কাজী ইমদাদুল হক ও মিসেস আর এস হোসেন। এঁদের মধ্যে কাল মিসেস আর এস হোসেনকে বোধ হয় সর্ব শ্রেষ্ঠ আসন দেবে ( মাসিক সঞ্চয়, অগ্রহায়ন, ১৩৩৬) । রোকেয়া নারীদের দুর্দাশার কথা লিখে তাদের জাগিয়ে তুলেছেন। এর জন্যে তাঁর পরিচয় নারী মুক্তির দিশারী, ইংরেজীতে ফেমিনিস্ট ও বলা যায়। তবে তার লেখার ধরণের জন্যে পুরুষরা ইতিবাচকভাবেই মূল্যায়ন করেছেন। আবুল হোসেন মতিচুর সম্পর্কে লিখছেন, “লেখিকা বঙ্গীয় মোসলেম নারী সমাজের আদর্শ। তিনি অবরুদ্ধা, অবলা ভগিনীগণের দুরবস্থা দেখিয়া তাহাদিগকে জ্ঞান, শিক্ষা, নীতি, কর্ম ও স্বাধীনতায় প্রবুদ্ধ্ব করিবার জন্যে পুস্তকখানি লিখিয়াছেন। ... পুস্তকে তিনি পুরুষদের বিরুদ্ধ্বে এমন কিছুই বলেন নাই, যাহাতে পুরুষেরা আপত্তি করিতে পারে। আমার মনে হয় পুরুষের অপরাধের তুলনায় তাহাদিগকে আরও অধিক কষাঘাত করা উচিত ছিল। কিন্তু লেখিকার মাহাত্ম্য এই স্থলে প্রকাশ পাইয়াছে বেশি; তিনি ভগিনীগণের ত্রুটিই বেশি করিয়া দেখাইয়াছেন – পুরুষকে কেবল আঙ্গুলি দ্বারা নির্দেশ করিয়া দিয়াছেন মাত্র”। (বঙ্গীয় মুসল মান সাহিত্য পত্রিকা কার্তিক ১৩২৮) । রোকেয়া নারী মুক্তি চেয়েছেন এবং সে লক্ষে সমাজে যে যে কাজ করা দরকার তা করেছেন, কিন্তু কৌশলের দিক মনে রেখেছেন সব সময়। অর্থাৎ তিনি নিজেকে সমাজের বাইরে বা সমাজের উর্ধে স্থাপন করে নি, ফলে নারীবাদী আত্মম্ভরিতার চেয়েও সমাজের সংস্কার কিভাবে করা যায় সেই দিকে নজর রেখেছেন। একালের ফেমিনিস্টরা রোকেয়ার ‘কৌশল’-এর তাৎপর্য বুঝতে পারলে ব্যাক্তি ও সমাজের সম্পর্কের টানাপড়েন মোকাবিলার গুরুত্ব ভাল বুঝতে পারবেন। নারীবাদ আর ব্যাক্তিতান্ত্রিকতায় একাকার হয়ে যাবার বিপদ থেকে কিভাবে রক্ষা পেতে হয় রোকেয়া সেই শিক্ষা আমাদের দিতে পারেন।
আমাদের মনে রাখা দরকার রোকেয়া যে সময় নারী মুক্তির কথা বলছেন সে সময়টা ছিল মুসলমান নারী ও পুরুষ – উভয়েরই পিছিয়ে থাকার সময়। পুরুষরা লেখা পড়া করার জন্যে এক পর্যায়ে এগিয়ে এলেও নারীদের জন্যে বলার কেউ ছিল না, কোন বিদ্যালয়ও পাওয়া যেতো না সাখাওয়াত সাহেব তাঁর সম্পত্তি থেকে কিছু অংশ এই কাজের জন্যে দান না করলে। রোকেয়া মুসলিম নারীদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন, এটাকে শিক্ষার বিষয় হিসেবে দেখলে শুধু হবে না। তিনি আসলে নারীদের জন্যে পথ খুলে দিয়েছিলেন। একই সাথে তিনি নারীদের শিক্ষিত করেই বসে থাকেন নি । তিনি মুসলমান নারীদের সংগঠিত করার জন্যে ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতিন এ ইসলাম’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যেন সেখানে মুসলিম নারীরা ধর্মের গোঁড়ামি ও কোরানে নারীর জন্যে বিধান নিয়ে ইতিবাচক বিতর্ক করতে পারেন। এ কারণে তাঁকে কেউ কেউ প্রথম ‘ইসলামিক ফেমিনিস্ট’ হিসেবেও আখ্যায়িত করে থাকেন, অবশ্য এতে তাঁর গুরুত্বকে মহিমান্বিত নয়, বরং খাটো করা হয়। রোকেয়ার নারীচিন্তা দেশকালপাত্র নির্বিশেষে বানানো বিমূর্ত ‘নারী’ ভাবনা নয়। ঔপনিবেশিক ইংরেজ আমলে মুসলমান নারীর লড়াই, ইসলাম ও মুসলমান সমাজের আভ্যন্তরীন লড়াই-সংগ্রামের বাইরের কিছু নয়।
বঙ্গীয় নারী শিক্ষা সমিতির একটি সভায় তাকে সভানেত্রী করা হয়েছিল। সভানেত্রীর ভাষণে তিনি নারী শিক্ষা নিয়ে বলতে গিয়ে সমাজের যে সমালচনা তুলে ধরেছিলেন তা একদিকে খুব আধুনিক এবং অন্যদিকে অত্যন্ত সাহসী। এখানে তাঁর ভাষণের কিছু অংশ তুলে ধরছি:
‘এখন প্রশ্ন এই যে মুসলমান বালিকাদের সুশিক্ষার উপায় কি? উপায় ত আল্লাহর কৃপায় অনেকই আছে, কিন্তু অভাগিনীগণ তাহার ফলভোগ করিতে পায় কই? আপনারা হয়ত শুনিয়া আশ্চর্য হইবেন যে,আমি আজ ২২ বৎসর হইতে ভারতের সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট জীবের জন্য রোদন করিতেছি। ভারতবর্ষে সর্বাপেক্ষা নিকৃর্ষ্ট জীব কাহারা, জানেন? সে জীব ভারত-নারী! এই জীবগুলির জন্য কখনও কাহারও প্রাণ কাঁদে নাই। মহাত্মা গান্ধী অস্পৃশ্য জাতির দুঃখে বিচলিত হইয়াছেন; স্বয়ং থার্ড ক্লাশ গাড়ীতে ভ্রমণ করিয়া দরিদ্র রেল-পথিকদের কষ্ট হৃদয়ঙ্গম করিয়াছেন। পশুর জন্য চিন্তা করিবারও লোক আছে, তাই যত্রতত্র ‘পশুক্লেশ-নিবারণী সমিতি’ দেখিতে পাই। পথে কুকুরটা মোটর চাপা পড়িলে, তাহার জন্য এংলো-ইন্ডিয়ান পত্রিকাগুলিতে ক্রন্দনের রোল দেখিতে পাই। কিন্তু আমাদের ন্যায় অবরোধ-বন্দিনী নারীজাতির জন্য কাঁদিবার একটি লোকও এ ভূ-ভারতে নাই। ‘
রোকেয়ার লেখা ও কথার শক্তি ছিল তার রস বোধ ও বিষয় সম্পর্কে স্বচ্ছ ও দূরদর্শী চিন্তার মধ্যে। তিনি সভানেত্রীর ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন “ আপনাদের নির্বাচন ঠিক হয় নাই। কারণ আমি আজীবন কঠোর সামাজিক ‘পর্দার’ অত্যাচারে লোহার সিন্দুকে বন্ধ আছি – ভালরূপে সমাজে মিশিতে পারি নাই - এমন কি সভানেত্রীকে হাসিতে হয় না কাঁদিতে হয়, তাহাও আমি জানি না।” তার সমালোচনার মধ্যে যে রসবোধ তা যে বিষয় নিয়ে তিনি বলতে চাচ্ছেন তা বুঝতে সাহায্য করে । একটি উদাহরণ দিচ্ছি। রানী ভিখারিনী প্রবন্ধে তিনি হিন্দু ও মুসলমান নারীর তুলনামুলক অবস্থার আলোচনা করেছেন। কিন্তু এই কথা বলতে গিয়ে তিনি আমেরিকাবাসিনী মিস মেয়োর লেখা ‘ভারত মাতা’ নামক পুস্তকে হিন্দু নারীদের দুঃখ-দৈন্য অবস্থার বর্ণনা দিয়েছেন। মিস মেয়োকে হিন্দুরা অনেক গালাগালি করেছেন। রোকেয়া এই প্রসঙ্গে লিখছেন, ‘কিন্তু এই গালির চোটে কাকের কালো রঙ বকের মতো সাদা মত সাদা হইবে না, পরিত্যক্ত জারজ শিশু পুনর্জীবন লাভ করিবে না, দ্বাদশ বর্ষীয়া প্রসুতিদের বিবিধ রোগ নিরাময় হইবে না; হাসপাতালে রোগিণীদের সংখ্যাও হ্রাস পাইবে না।‘ আশ্চর্য যে এর মধ্যে উল্লেখ করা প্রতিটি বিষয় এই আধুনিক কালে (বর্তমান ২০১৬ সালে) বড় বড় দাতা সংস্থার নারীর ক্ষমতায়নের জন্যে নেয়া প্রকল্পের অংশ। যেমন বাল্য বিবাহ ও অল্প বয়সে মা হওয়া এখন বিশ্বব্যাপী আন্দোলনের অংশ হয়েও আছে। লক্ষ লক্ষ টাকা অনুদান আসছে শুধু এই বিষয়ে সচেতনটা সৃষ্টির জন্যে। অথচ রোকেয়া সে সময় বিষয়টি লক্ষ করেছেন। শুধু তাই নয়, কোন একটি বিষয় নিয়ে বলতে গেলে যেভাবে পরিসংখ্যান তুলে ধরতে হয়, রোকেয়া শত বছরেরও আগে তা করেছেন। তিনি বলেছেন, এখন আমাদের শিক্ষার অবস্থা এই যে আমাদের দেশের গড়পড়তা প্রতি ২০০ বালিকার মধ্যে একজনও অক্ষর চেনে না; প্রকৃত শিক্ষিতা মহিলা প্রতি ১০,০০০ এ একজন পাওয়া যাইবে না। তিন কোটি মুসলমানের মধ্যে বঙ্গের মাত্র একজন মুসলমান মহিলা গ্রাজুয়য়েট পাওয়া গেছে। স্ত্রীলোকেরা ভোটের অধিকার প্রাপ্ত হইয়াছে, কিন্তু ইলেকশানের সময় কলকাতায় মাত্র ৪ জন স্ত্রীলোক ভোট দিয়াছে ”। এভাবে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখালে কে না বুঝবে কি দুর্দাশার মধ্যে আছে নারী জাতি!
তার বিশেষ চিন্তা ছিল মুসলমান সমাজকে নিয়ে। তাদের পশ্চাদপদতা নিয়ে তিনি খুব উদ্বিগ্ন ছিলেন। কিন্তু এটা করতে গিয়ে তিনি রসালো ভাষায় মুসলমান সমাজকে দেখিয়েছেন তাদের অবস্থা কি। বিশেষ করে যাদের অবস্থা একটু ভাল তারা কি ধরণের হীনমন্যতায় ভোগেন। তিনি ‘ধ্বংসের পথে বঙ্গীয় মুসলিম’ শীর্ষক একটি লিখিত বক্তব্যে বলেন, ‘ক্রমে শিক্ষিত বাপ মেয়েকে আর শুধু ‘রাহে-নাজাত’ এবং ‘সোনাভান’ পুঁথি পড়িয়ে ক্ষান্ত থাকতে পারলেন না – তাই তারা মেয়েদের দিলেন Convent এবং হিন্দু স্কুলে পড়তে। Convent –এ পড়তে গিয়ে লায়লার নাম বদলে হল ‘লিলী’ আর জয়নব হল ‘জেনী’। হিন্দু স্কুলে গিয়ে আয়শার নাম হল ‘আশা’, আর কুলসুম হয়ে গেল ‘কুসুম’। ইত্যাদী। এই সমালোচনা অত্যন্ত সাহসী এবং প্রকৃত অবস্থা বোঝার জন্যে খুব সহায়ক। প্রশ্ন হচ্ছে আমরা কি এখনও সে অবস্থানে নেই? হীনমন্যতা কি আমাদের গিয়েছে? যায় নি।
রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনকে আমরা চিনি, বেগম রোকেয়া বলে আমরা তাঁকে এখন সেলিব্রেট করছি। কিন্তু আমি আজ তাঁকে তাঁর আসল পরিচয়ে চিনতে অনুরোধ করবো। তিনি রোকেয়া খাতুন, মনে প্রানে স্বাধীন চিন্তার একজন মানুষ। যিনি দুরদর্শী ,সমাজকে দেখার এবং চেনার মতো চোখ ও মনের মানুষ তিনি। তিনি সমালোচনা করেন কঠোরভাবে জাগিয়ে তোলার জন্যে।
আমরা জেগেছি কতখানি সেটা আমাদের নিজেদেরই মূল্যায়ন করতে হবে। তবে রোকেয়া খাতুনকে আমাদের দেশের ইতিহাসের মধ্য দিয়েই বুঝতে হবে। তখন এই দেশের নারীদের জন্য তিনি কেন অপরিমেয় সম্পদ সেটা আমরা বুঝব। অনেক দেশের নারীবাদী বা ফেমিনিস্টদের চিন্তার চেয়ে তিনি এগিয়ে ছিলেন সন্দেহ নাই, কিন্তু তিনি ভিন দেশের বা ভিন্ন সমাজের নারীদের আদর্শ হিসাবে অনুকরণ করেন নি। রোকেয়া খাতুন রোকেয়া খাতুনই হতে চেয়েছেন। তাঁর সঠিক মূল্যায়ন তখনই হবে যখন মুসলমান সমাজের অংশ হিসাবে নারীর লড়াই-সংগ্রামকে তার সুনির্দিষ্ট বাস্তবতা ও ইতিহাসের মধ্যে আমরা বুঝতে শিখব। নারীদের অবস্থা এখন মোটেও ভাল নয়। যে নারী নিজেকে মুসলমান হিসেবে পরিচয় দিতে চায়, কিম্বা সমাজের মধ্যে থাকে নারীর মুক্তির প্রশ্ন তোলে তাকে তথাকথিত ফেমিনিস্টরা বয়কট করে, আবার অন্যদিকে যারা পুরুষতন্ত্রের সকল রূপের বিরুদ্ধে নারীর সার্বজনীন ধারণার জায়গা থেকে ফেমিনিস্ট হতে চায় তাদের মুসলিম পরিচয়ের নারীরা ‘নাউজুবিল্লাহ’ বলে। এই দুইয়ের সমন্বয় আজও ঘটানো গেল না।
আমরা রোকেয়া খাতুনকে নিয়ে গর্ব করি। হয়ত তিনি যেভাবে সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন, সেটা একালে খুবই শিক্ষণীয় কৌশল হতে পারে।
ধন্যবাদ, রোকেয়া খাতুন। আপনার পথচিহ্ন আমাদের খুবই কাজের হয়েছে।
৬ অগাস্ট ২০১৬