এজেন্ডা ২০৩০ ও নারী অধিকার অর্জনঃ নারীবাদী পর্যালোচনা
সাইদা আখতার || Monday 29 August 2016 ||জাতিসংঘ প্রণীত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য বা Sustainable Development (SDG) একটি বৈশ্বিক কর্মসূচী। একে বাদ দিয়ে এখন উন্নয়ন পরিকল্পনা করার সুযোগ কম। ২০৩০ সাল পর্যন্ত সার্বিক উন্নয়নের চিন্তা করতে হবে এই এসডিজি ঘিরেই। সহস্রব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য (MDG) পথ ধরে এসডিজি আসে। এসডিজি লক্ষ্য মাত্রা অর্জন করতে হলে সরকার এবং বেসরকারী প্রতিষ্ঠান একত্রে কাজের পরিকল্পনা করতে হবে। এসডিজির একটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে শুধু নিজের দেশের উন্নয়ন করলে হবে না, এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের আয় বৈষম্যের যে পার্থক্য রয়েছে সেটাও কমিয়ে আনতে হবে। মানব পাচার রোধ ও নারী শিশুর প্রতি নির্যাতন রোধ, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত করা, পাচার বা চুরি হওয়া সম্পদ উদ্ধার এবং দূনীতি কমানোর লক্ষ্য অবশ্যই অর্জন করতে হবে আর বাঞ্চনীয় হচ্ছে ১৬টি। এর মধ্যে স্বাস্থ্য, পরিবেশ, অংশীদার মূলক, ন্যায়বিচার ও মর্যাদা পূর্ণ জীবন- এ ছয়টি হচ্ছে মূল এর বাইরে লক্ষ্য আছে ১৭ টি। এসডিজিতে ন্যায় বিচারকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। এখানে মনে করা হচ্ছে ন্যায় বিচার ও মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে।
২০৩০ সালের মধ্যে অর্থাৎ আজ থেকে আগামী ১৫ বছরের মধ্যে এসডিজি লক্ষ্য মাত্রা অর্জন করতে হলে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় উন্নয়ন নীতিতে সরকার, বেসরকারী প্রতিষ্ঠান এবং সামাজিক আন্দোলনে সাথে সম্পৃক্তদের একত্রে কাজ করতে হবে, প্রতিটি কাজের জবাবদিহিতার এবং বাস্তবায়নের জায়গা সুনিদিষ্ট এবং স্বচ্ছ থাকবে। এ এজেন্ডায় বা ফ্রেমওয়ার্ক যদি নারীবাদী এবং নারী অধিকার কর্মী সংগঠন এবং নেটওয়ার্ক কাজ করতে হয় তাহলে আমাদের দেখতে হবে টেকসই উন্নয়নে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য যে কাঠামো নির্ধারিত আছে তার মধ্যে নারীর অধিকার অর্জনের বিষয়ে প্রাধান্য কি দেয়া আছে? সমস্যা চিহ্নিত করে বিচার বিশ্লেষনের মাধ্যমে কৌশলী পদক্ষেপ নির্ধারন করা দরকার। আমাদের এখনো পুরুষতান্ত্রিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর নতুন উপায় খুঁজে কাজ করতে হয়, শুধু তাই নয় তুণমূল পর্যায় থেকে কেন্দ্রী পর্যায় পর্যন্ত নারী অধিকার আমাদের কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থাকলে তা খুজে দেখে ভেতরে ও বাইরের কৌশল কাজে লাগাতে হবে। কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এর উপর এখন ভাবতে হবে।
১. আগামী ১৫ বছর বা তার পরবতীতে বিশ্বের মধ্যে বর্তমান এবং এখনো আমাদের সামনে আসছে না তার রূপ কি হতে পারে ?
২. টেকসই উন্নয়নে বাস্তবায়নের পিছনে কারা আছে আর কোন বিষয়ের উপর গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে?
৩. কোন বিষয়গুলোকে প্রাধান্য পেয়ে কাজ হচ্ছে?
৪. সব ধরণের এবং সব বয়সী নারীর অধিকার ও মর্যাদা পূর্ণ আদায়ে কি ধরণের বাঁধা ও সমস্যা আসতে পারে?
৫. কিভাবে এবং কি কৌশল Intersectionality, নারীবাদী কাঠামো ব্যবহার করে অগ্রসর হওয়া যাবে?
৬. অন্যান্য সামাজিক আন্দোলনের সাথে নারী অধিকার ও মর্যাদা জড়িত তা কি কৌশলে সামনে তুলে আনা যাবে?
এই ধরনের কিছু প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করার জন্য নারীবাদী, নারী অধিকার আদায়ের জন্য কাজ করছে এমন কর্মী, গবেষক, বিভিন্ন সংগঠনের কর্মী, নেটওয়ার্ক সংগঠন এবং সামাজিক আন্দোলনের সাথে জড়িতদের একত্রে করে ৩ দিনের একটি সভার আয়োজন করা হয় Post 2015 Women's Coalition. আয়োজনে সহযোগীতা করেন ARROW and feminist collaborators from Asia and the Pacific, The Asia Pacific Women’s Alliance on Peace and Security (APWAPS), Coordination of Action Research on AIDS and Mobility (CARAM Asia), CREA, and Youth LEAD
এজেন্ডা ২০৩০ বাস্তবায়নের সব আলোচনার বিয়য়গুলোতে নারী অধিকার অর্জনের আলোচনা সব ক্ষেত্রে আনতে হবে এবং তা গঠনমূলক এবং জবাবদিহিতা মূলক হতে হবে। তবে এটা সত্যি যে নারীদের বিষয়, এখন অনেক গুরুত্ব সহকারে প্রাধান্য পাচ্ছে এবং নারীর অংশ গ্রহনের বা প্রতিনিধিত্ব অগ্রাধিকার পাচ্ছে। নারীর অংশগ্রহণ ও প্রতিনিধিত্ব বাড়লেও পুরুষতান্ত্রিকতার প্রভাব সমাজে এখন বিরাজ করছে, এটা অস্বিকার করা যাবে না। এ আলোচনা করে আলোচকরা বলেন বর্তমানে যে প্রতিনিধিত্ব হচ্ছে তা যথেষ্ঠ নয়। প্রতিনিধিত্ব বাড়াতে হলে সব শ্রেনী, পেশা, জাতি বর্নের মধ্যে প্রতিনিধিত্ব বাড়ানো দরকার। উদাহরণ হিসাবে মধ্যবিৃত্তের নারী আন্দোলন এবং একটি নিম্ন বর্ণের নারীর আন্দোলনের বিষয় এক হবে না। বৈষম্যর প্রতিটি পৃথক পৃথক ধারণা সমাজে বিরাজ করছে, সেই জায়গা আন্দোলনের বিষয়ের নানান দিক থাকতে পারে। পৃথক পৃথক বিষয় নিয়ে কাজ করতে পারে। এখানে Intersectionality বিষয় এর চিন্তার গুরুত্ব টানতে হবে। নারীবাদী চিন্তাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে খেয়াল করা জরুরী যে শ্রেনী, জাতি, লিঙ্গ বা মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় নারীরা প্রতিনিধিত্ব করার সমান সুযোগ পাচ্ছে কি না।
তিনটি বিশেষ ধারনার উপর মূলত তিন দিনের আলোচনা স্থায়ী ছিল নারীবাদ, নারী আন্দোলন এবং জেন্ডার। মাইগ্রেশান, দন্ড, জলবায়ু পরিবর্তন এবং ধর্ম নিয়ে রাজনীতির প্রভাবকে বিশ্বায়নের প্রভাব বলে মনে করা হলেও এ প্রভাবের কারণ কোন অবস্থায় আলাদা বা নিদিষ্ট করা যাবে না। টেকসই উন্নয়ন এজেন্ডা নিয়ে কাজ করতে গেলে দেখতে হবে কে এবং কি বিষয়ে কোন লক্ষমাত্রা অর্জনের জন্য কাজ হচ্ছে। এখানে Intersectional feminist framework কাজ করছে কিনা দেখতে হবে। একটা প্রশ্নের উত্তর এসে যায় যে ICPD Program of Action এবং বেইজিং এজেন্ডা বাদ দিয়ে এসডিজি এজেন্ডা বাস্তবায়ন সম্ভব না। ICPD Action Program ও বেইজিং এজেন্ডাকে রেখে বাস্তবায়ন অব্যহত রাখা দরকার। এজেন্ডা ২০৩০ তে অনেক অপুরণীয় বিষয় আলোচনায় আসে যেমন কেউ যদি অপরাধি হিসাবে চিহ্নিত হয় এখানে ন্যায় বিচার পাওয়ার সুযোগ নেই সেখানে কিভাবে নিশ্চিত হবে যে সে এসডিজি তে রয়েছে।
এসডিজি তে প্রতিবন্ধীদের কোন অধিকারে কথা বলা আছে? The Conversion on the Righs of persons with Disabilities (CRPD) সম্পর্ণ রুপ এসডিজি পাশাপাশি বাস্তবায়ন করা উচিত। SDG একটি দূর্বল অংশ হলো বিদ্যমান জবাবদেহিতার ম্যাকানিজাম, বিদ্যমান ম্যাকানিজাম এর সাথে যুক্ত করতে হবে, CEDAW, The Committee on Economic, Social and Cultural Rights (CESCR) ), The Convention on the Rights of the Child (CRC)
গ্রুপ আলোচনা বিষয়টি তোলা হলে গ্রুপের মধ্যে একমত হয় যে সর্বস্তারে নারীর প্রতিনিধিত্ব কি করে নিশ্চিত করা যায় তা বের করতে হবে। নিরব প্রতিনিধিত্ব কোন অবস্থাতে গ্রহনযোগ্যতা থাকা উচিত হবে না। নারীর মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য নারীকে এমন ভাবে প্রতিনিধিত্ব করতে হবে রাজনীতি, সংস্কৃতি, ধর্ম, গনমাধ্যম এবং পরিবারে একজন গেট কীপার হিসাবে। নিজেদেকে নিয়ন্ত্রন করার জন্য নিজস্ব আইন ও নীতিমালা রয়েছে তা দিয়ে এসডিজি তে Intersectionality হিসাবে কাজ করলে প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে প্রকাশের স্বাধীনতা শক্তিশালী করবে। পরিশেষে আলোচনায় আসে যে এখান থেকে আমাদের চিন্তার জন্য বিষয় নির্ধারন করে আলোচনা চালিয়ে নিতে হবে এবং নজর রাখতে হবে কে এজেন্ডা নির্ধারন করছে, কার জন্য এজেন্ডা নির্ধারন হচ্ছে। সমস্যা সমাধানের হাতিয়ার হিসাবে এসডিজি কে তুলে ধরা হয়, বিশ্ব ব্যাপি। শুধু নারীবাদ কি এ বিষয়ে আলোচনার জন্য একটি সেশন রয়েছে। এখানে আলোচনা হয়েছে নারীবাদ দ্বারা কি বুঝানো হচ্ছে নারীবাদী লেন্স কি? নারীবাদ ও নারী অধিকার অর্জন কি? স্থানীয় ভাবে কাজ নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের জ্ঞান চর্চ্চা ও অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। অংশগ্রহন কারীদের মধ্যে ১টি কার্ডের লিখানো হলো যে কখন থেকে সে উপলব্ধি করলো যে সে নারীবাদ বিষয় চিন্তা করছে। জবাবে কেওই সুস্পষ্ট ধারণা দিতে পারলো না কারণ তারা মনে করেন নারীবাদ উপলদ্ধিটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া প্রতিনিয়ত শিখতে হচ্ছে। নারীদের সংগ্রামের মূল কারণ একই থাকছে। শুধূ সংগ্রামের মানচিত্রের পরিবর্তন হচ্ছে।
প্রথম দিনের আলোচনা থেকে আমার একটা বিশেষ অনুভুতি হয়েছে যে নারী মেয়ে বা বিশেষ করে প্রান্তিক গ্রুপে যে অধিকার রয়েছে তার থেকে আমরা কোন অবস্থা পিছিয়ে নেই, কিন্তু সেটা ধরে রাখার জন্য যে চর্চ্চার প্রয়োজন তাকে শক্তিশালী করতে হবে। বরং যে বিষয়টি একেবারে উপেক্ষিত দিক তা এখন আলোচনায় সমৃদ্ধ হচ্ছে। intersectionalit feminist ফ্রেমওয়ার্ক ব্যবহার করে এসডিজি কে বিশ্লেষন করে আমাদের নারীবাদী চিন্তাকে একটি লেন্স হিসাবে ব্যবহার করা এবং এই লেন্সের ব্যবহারের গুরুত্ব বুঝে বিশ্লেষন করে কাজ করা। পরিশেষে আমি মনে করি কি চিন্তা বা কি কাজ করলে উন্নয়ন এজেন্ডা বাস্তবায়নে ভুমিকা রাখা যাবে। এই চিন্তা বা কাজকে চিন্তার মধ্যে না রেখে বাস্তবায়নে রুপ দেয়াই হবে বাস্তবতা ।