যৌতুক ও বাল্যবিয়েঃ গ্রামের মেয়েদের অভিজ্ঞতা
নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা || Wednesday 01 November 2017 ||“আমি একটু পড়াশোনা বেশি করলে অন্যের সামনে গেলে বলতে পারি আমি এসএস সি কিংবা ‘ইন্টার’ পর্যন্ত পড়েছি। আমার যদি বিয়ে নাও হয় তাহলেও আমি লেখাপড়ার জোরে সমাজে দাঁড়াতে পারি। কিন্তু মেয়েদের পক্ষে এইটুকুন লেখাপড়া করাও হয়ে ওঠে না। অনেকের অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দেয় বাবা মায়েরা। কারণ তারা নিরাপদ হতে চায়। মেয়ের কোন ক্ষতি হবে এই আশংকায় মা-বাবা তাকে বিয়ে দিয়ে দেয়। এতে মা-বাবা নিরাপদ হয়, কিন্তু মেয়ে শেষ হয়ে যায়”।
যৌতুক ও বাল্যবিয়ে নিয়ে টাঙ্গাইলের লাউহাটি ইউনিয়নের ১০ জন নারীর সাথে কথা হচ্ছিল। তারাই বলছিলেন পড়ালেখা শেখার আগ্রহের কথা। যে ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছে সেও নিজেকে শিক্ষিত মনে করে, কিন্তু আরও পড়ার সুযোগ পায়নি বলে মনে কষ্ট পায়। আর যে মোটেও পড়তে পারেনি, তাদের মনের দুঃখ অনেক বেশি। তারা মনে করে পড়াশোনা করেই তাদের জীবনে পরিবর্তন আনতে পারে।
‘বিয়ে’কে কেন্দ্র করেই সমস্যাগুলো হচ্ছে। সঠিক বয়স বলতে তারাও বোঝে এমন বয়স যখন একটি মেয়ে স্বামী সংসার বুঝবে, তার নিজের শরীর সম্পর্কে ধারণা থাকবে, কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া বা দেয়ার ব্যাপারে তারা আত্মবিশ্বাসী হতে পারে। আইনে এই বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে ১৮ বছর। কিন্তু ১৮ বছরের নীচে অনেক মেয়ের বিয়ে হচ্ছে এবং সে বিয়েগুলো কাজীর খাতায় ১৮ বছর বলেই রেজিস্ট্রি করা হচ্ছে। এই সব কথা বলতে গিয়ে নানা জটিল দিক উঠে আসে। যেমন যৌতুক দেয়া ও নেয়া ভাল নয়, বে-আইনী, এমন কি ‘হারাম’ বলেও অভিহিত করেন তাঁরা। হারাম কথা তো আইনে নাই, তাহলে এই কথা কোথা থেকে আসলো? একজন বললেন, মাদ্রাসায় পড়েছিলাম, সেখানে শুনেছি। বোঝা গেল যৌতুক যে খারাপ সেটা সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই শেখানো হচ্ছে। তবুও যৌতুক ঠিকই দেয়া-নেয়া হচ্ছে। না দিতে পারলে বিয়ের কিছুদিন পর জামাই এসে মেয়ে ‘ফেরত’ দিয়ে পরিবারকে বলছে, ‘তোমাদের মেয়ে লয়ে খাবো না’ অর্থাৎ তোমাদের মেয়ে নিয়ে আমি আর ঘর করবো না। একবার যৌতুক দিলে লোভ হয়ে যায়। তারা বারে বারে চায়, না দিতে পারলে মেয়ের ওপর অত্যাচার হয়।
মেয়ে ফেরত দেয়া মা-বাবার জন্যে খুবই অপমানজনক, এটা তারা কিছুতেই সহ্য করতে পারেন না। তাই মেয়ের বিয়ে এমন বয়সে এবং এমন পরিবারে দিলে ভাল, সেখানে দরকার হয় কিছু যৌতুক দিয়ে হলেও যেন মেয়ে ফিরে না আসে। এভাবে করতে গিয়ে মেয়ের পড়াশোনার ওপর প্রভাব পড়ে। বাবার বাড়ীতে মেয়ের পড়াশোনা ততটুকুই হতে পারে যতদিন একটা মন মতো পাত্র পাওয়া না যায়। যত পাত্র পেতে দেরি হয় মেয়ের পড়াশোনা এগিয়ে যায় বটে কিন্তু সমস্যা হয়ে যায় অন্যদিকে। মেয়ের ক্রমে এসএস সি, এইচএসসি ও করা হয়ে যায়, কিন্তু পাত্র জোটে না। এক পর্যায়ে শিক্ষিত মেয়েকে স্বল্প শিক্ষিত পাত্রের হাতে তুলে দিতে হয়, কারণ সেটা মাগনা বিয়ে অর্থাৎ যৌতুক-বিহীন বিয়ে। মেয়ে বেশি শিক্ষিত বলে ছেলের পরিবার যৌতুক দাবি করে নি। মা-বাবা খুব খুশি না হলেও বিয়ে দিয়ে দেয়, কিন্তু মেয়েটি চেয়েছিল হয়তো তার স্বামী শিক্ষিত কেউ হবে। আলোচনার এক পর্যায়ে একজন আক্ষেপ করে বলেন, শুধু কম শিক্ষিত নয়, একেবারে লেখাপড়া জানেনা এমন ছেলের সাথেও বিয়ে দিয়ে দেয়। পাশের জন বলে ওঠে তাইতো এখন বিবাহ বিচ্ছেদও বেড়ে যাচ্ছে। এই সংসার টিকছে না।
যৌতুকবিহীন বা মাগনা বিয়ে দিতে গিয়ে মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে যা বোঝা গেল তা হচ্ছে মেয়ের শিক্ষা একটা বিয়ের অপেক্ষার সময় পার করতে গিয়ে বাড়ছে, কিন্তু সে যতো শিক্ষিত হচ্ছে ততই তার ‘উপযুক্ত’ পাত্র পাওয়ার সম্ভাবনা কমছে এবং শেষ পর্যন্ত তাকে ‘অসম সম্পর্কে’র বিয়ে মেনে নিতে হচ্ছে। মেয়েরা লেখাপড়ায় এগিয়ে যাচ্ছে, একইভাবে গ্রামে ছেলেদের পড়াশোনা এগুচ্ছে না। তারা বিপথে যাচ্ছে, মাস্তানী বা নেশা করে সময় কাটাচ্ছে। কেউ কেউ বিদেশ পাড়ি দিচ্ছে তেমন লেখা পড়া শেষ না করেই। এক সময় এসে গ্রামের কোন মেয়েকে বিয়ে করে আবার চলে যাচ্ছে দুই তিন বছরের জন্য। মোবাইলে নতুন স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক খুব আগায় না। একজন বলে উঠলেন আমাদের মাঝেই আজ এমন একজন আছেন যে এখন বিবাহ বিচ্ছেদের অপেক্ষায় আছে। মেয়ে এইচএস সি পাশ, স্বামী তেমন লেখা পড়া করেনি। বিয়ের দুই সপ্তাহ পর বিদেশ চলে যায়। দুই বছর পর ফিরে এসে এই স্ত্রীকে নিতে রাজী নয়। মেয়েটি বেশ আত্মপ্রত্যয়ী। সে বলে ওঠে আমি পড়া লেখা চালিয়ে যেতে চেয়েছিলাম, বাবা শোনেন নাই।
এই সব জটিলতার মুখোমুখি মা-বাবা হতে চান না বলেই কি বাল্য বিয়ে হয়? বাল্যবিয়ে হচ্ছে কাঁচা বয়সে ঘুন ধরার মতো। কিছু বোঝার আগেই মেয়েটি একটি বড় দায়িত্বে পড়ে যায়। স্বামী, শ্বশুর-শ্বাশুরি, সংসার, সন্তান সবকিছু মিলে মেয়েটির বয়স কোন সময় বেড়ে যায় তা সে নিজেও টের পায় না। সন্তান জন্ম দিয়ে মা হয়েও তার মধ্যে সন্তানের প্রতি মায়া হবার মতো বোধ তৈরি হয় না, বা সে বুঝতে পারে না। একজনের মন্তব্য ‘সন্তানের প্রতি তখন বিরক্ত লাগে’। তের-চৌদ্দ বছরে বিয়ে হতে না হতেই যদি পনের-ষোল বছরে তার সন্তান হয় তাহলে মায়া হবেই বা কোথা থেকে? সে তো নিজেই একটি শিশু। তার ভাই-বোনেরাও এখনো খেলছে। সে খেলার মতো করে সন্তানকে আদর করতে পারে কিন্তু মায়ের মতো সকল কষ্ট মেনে নেয়ার ধৈর্য তার থাকে না।
স্বাস্থ্য ক্ষতি তো আছেই, যদিও সব ক্ষতি বোঝা বা সে সম্পর্কে কোন ব্যবস্থা নেয়ার পরিস্থিতি তাদের নেই। আমাদের দেশের স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে কোন বিশেষ ব্যাবস্থাও আজ পর্যন্ত গড়ে ওঠে নি।
মেয়েগুলো স্কুল বা কলেজের ক্লাশ রুম ছেড়ে শ্বশুর বাড়ী যাচ্ছে, শেষ হয়ে যাচ্ছে তাদের জীবনের একটি অধ্যায়। তাদের মধ্যে দুএকজন সংগ্রাম করে টিকে গেলেও অধিকাংশই যৌতুক বা বাল্য বিয়ের ক্ষতিকর প্রভাবে জীবনে নির্যাতিত নারীর তালিকায় ভিড় করছে। এদের রক্ষা করা এক্ষুণি দরকার। তাই এই আলচনায় যারা অংশ নিয়েছে তারাই দায়িত্ব নিলেন তাদের আশে পাশের মেয়েদের রক্ষা করবেন।
[গ্রামে যেসব মেয়েরা বিভিন্ন কাজে যুক্ত রয়েছেন, তাঁদের নিজেদের নেতৃত্বসুলভ গুণ বিকাশের জন্য নিজেদের নাম দিয়েছেন ‘কলমি নারী’। নামটি কলমি শাকেরই রূপ কল্পনায় নেয়া। কলমি শাক লতায় লতায় তার শাখা বিস্তার করে, অন্যদিকে একই কাণ্ডে যুক্ত থাকে। মেয়েদের সংগঠনের চরিত্র কলমি লতার মতো হওয়া দরকার, যাতে তারা একই নীতিতে শক্ত ভাবে দাঁড়াতে পারে। সব শাখার শক্তি এক নয়, কিন্তু সকলে একই কাণ্ডে যুক্ত থাকার মধ্য দিয়েই টিকে থাকে। নয়াকৃষির রিদয়পুর বিদ্যাঘরে ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭ তারিখে কলমি নারীদের সভার আলোচনা থেকে এই লেখাটি তৈরি করা হয়েছে।]