বীজ, নয়াকৃষি ও নবপ্রাণ
নয়াকৃষি আন্দোলন || Tuesday 20 March 2018 ||প্রতি বছর ফাল্গুনি পূর্ণিমায় ফকির লালন শাহ প্রবর্তিত 'সাধুসঙ্গ'কেন্দ্র করে যে উৎসব সাঁইজীর সময় থেকে ছেঁউড়িয়ায় চলে আসছে এবার তার তারিখ পড়েছিল ১৭, ১৮ ও ১৯ ফাল্গুন ১৪২৪। অর্থাৎ ঈসায়ী ১ থেকে ৩ মার্চ ২০১৮। প্রতিবছরের মতো এবারও ছেঁউড়িয়ায় উৎসব ও মেলা উপলক্ষ্যে নবপ্রাণ আখড়াবাড়ীতে নয়াকৃষির কৃষকরা তাদের বীজ প্রদর্শন করেন ও বীজ নিয়ে আলোচনা করেন। এবার তাদের বীজ প্রদর্শন ও আলোচনার মুখ্য বিষয় ছিল বীজ সাজানো এবং শ্রেণিকরণ।
একই তারিখ ও তিথি ধরে হিন্দু সম্প্রদায় শ্রীকৃষ্ণের দোল যাত্রা উপলক্ষ্যে দোল উৎসব পালন করেন, তাই এই উৎসবকে গৌরপূর্ণিমায় সাধুসঙ্গ বা গৌর উৎসব না বলে সাধারণত ‘দোল উৎসব’ বলা হয়। গৌরাঙ্গের জন্মের সঙ্গে নদিয়ার ভাবের সম্পর্ক অস্পষ্ট থাকার কারণে 'দোল উৎসব'কথাটাই প্রচারিত হয়ে রয়েছে। অন্যদিকে ফাল্গুনি পূর্ণিমা তিথি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদেরও যেমন তেমনি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বিদেরও খুবই গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় দিন। কিন্তু নদিয়ার ফকিরী ভাবচর্চা কোন বিশেষ সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসবের সঙ্গে যুক্ত নয়। ছেঁউড়িয়ার উৎসব তাই গৌরপূর্ণিমা উদযাপন, গৌরের আবির্ভাবের ঐতিহাসিক ও ভাবগত মর্মার্থ উপলব্ধির উদযাপন। এই সময় তিন দিন ধরে মেলা চলে, সারা দেশ থেকে এমন কি বিদেশ থেকেও লালন ভক্তরা এসে জড়ো হন সাঁইজীর ধামে।
বাংলার ভাবচর্চায় 'বীজ'
নবপ্রাণ আখড়াবাড়ীতে প্রতি বছর এই উৎসবের সময় তিনদিন লালনের কোন একটি গানের ভাব চিহ্নিত করে গানের আয়োজন থাকে আর থাকে নয়াকৃষি আন্দোলনের কৃষকদের বীজ মেলা; সেই সঙ্গে থাকে কৃষকদের সভা, কর্মশালা, আনুষ্ঠানিক কিম্বা অনানুষ্ঠানিক আলোচনা। নদিয়ার ভাবচর্চার সঙ্গে প্রাণ ও প্রকৃতি রক্ষার সংগ্রাম ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। প্রাণ নিছকই বস্তুগত, কিম্বা জৈবিক সত্তা নয়। জীবিত মানুষকে ডাক্তার কেটে কেটে টুকরা করলেও প্রাণ ঠিক কোথায়, কোন 'কুঠুরি'তে তার বাস সেই বসত খুঁজে পাওয়া যায় না, বা ধরা যায় না। প্রাণ অধরা। অথচ নানান রূপ নিয়ে একটা প্রক্রিয়া ও চক্রের মধ্য দিয়ে প্রাণ পরিবাহিত হয়ে চলেছে। যাকে আমরা নিষ্প্রাণ জড় প্রকৃতি গণ্য করি সেই জড়ও বহু পথ ভ্রমণ করে প্রাণে মূর্ত হয়; জীব হয়, বীজ হয়, মানুষ হয় ইত্যাদি। ছেঁউড়িয়ার এই অতি পরিচিত ভাবটি মনে রাখলে আমরা বুঝব বীজ প্রকৃতিরই একটি মূহূর্ত যেখানে জড় ও জীবের যেমন মিলন ঘটেছে, অন্যদিকে পুরা প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া জীবন্ত মূহূর্ত হিশাবে প্রাণ বা বীজ হয়ে হাজির রয়েছে। বীজের এই ভাবগত দিকটি নদিয়ায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এই ভাবের অনুষঙ্গে নয়াকৃষিতে বীজ কৃষকের কাছে কৃষি উৎপাদনের 'ইনপুট' নয়, বরং একটি বিশাল ব্রহ্মাণ্ডব্যাপী প্রক্রিয়ার মূহূর্ত। মূহূর্ত কেন? কারণ বীজ প্রাণের সাময়িক বা বিশেষ রূপ মাত্র। এই বীজ বা গোটাটি যখন মাটিতে রোপন করা হবে তখন গ্রহ-নক্ষত্র সূর্যালোক জোগাবে শক্তি, মাটি, বায়ু ও পানি জোগাবে পুষ্টি -- অর্থাৎ জৈব-অজৈব যা কিছু প্রাণের জাগরণের জন্য দরকার বীজ তার সব কিছুরই জোগান পাবে। এই যে সামগ্রিক ভাবে বোঝানোর জন্য আমরা 'সব কিছু' কথাটি ব্যবহার করলাম সেটা বোঝাবার জন্য আরেকটি শব্দের সঙ্গেও আমরা পরিচিত। সেটা হচ্ছে 'ব্রহ্মাণ্ড'। সামগ্রিকতাকে এক সঙ্গে বোঝাতে ব্রহ্মাণ্ড কথাটাও আমরা ব্যবহার করতে পারি। অন্য দিকে প্রক্রিয়ার দিকটি বোঝাতে আমরা সাধারণত বলি, 'প্রকৃতি'।
কৃষকের কাছে এই শব্দগুলো বিমূর্ত কোন শব্দ বা ধারণা নয়। পরাবিদ্যাও নয়। এর মধ্যে কোন গুহ্যবিদ্যা নাই। যাকে আমরা ব্রহ্মাণ্ড কিম্বা প্রকৃতি বলে জানি কৃষক তাকে তার দৈনন্দিন কৃষিচর্চার মধ্য দিয়ে উপলব্ধি করে, বোঝে ও কাজে খাটায়। প্রাণের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বীজ হয়ে ওঠে ফসল, গাছপালা কিম্ব মহীরুহ। সেটা তখন আর বীজমাত্র নয়, ফসল কিম্বা প্রাণেরই আরেক রূপ, আরেকটি মূহূর্ত। এই কারণেই বীজ পুরা প্রক্রিয়ার একটি মুহূর্ত কেবল, একটি বিশেষ রূপ; তেমনি ফসল বা গাছ আরেকটি মুহূর্ত। প্রাণ নানান রূপের মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করে চলেছে।
এতো ব্যাখ্যা দিয়ে বোঝাবার কারণ হচ্ছে 'প্রাণ' কোন সুনির্দিষ্ট বিষয়, জিনিস, বস্তু বা সত্তা নয়। বরং একটি সচল ও জীবন্ত প্রক্রিয়া। একই প্রাণ চক্রাকারে নিজেকে নিজে জন্ম দিচ্ছে নিজেরই বীজ নিজেরই গাছে আবার ফলাচ্ছে, ইত্যাদি।
বীজের অর্থ তাহলে কৃষকের কাছে অনেক গভীর অর্থ জ্ঞাপক । যে কারনে নয়াকৃষি ও নবপ্রাণের দিক থেকে বীজ সংরক্ষণ, সুরক্ষা ও পুনরুৎপাদন খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বীজ প্রাণের ব্রহ্মাণ্ডব্যাপী ভ্রমণ বা চক্রাকার প্রক্রিয়াকে ধারণ করে। বীজেই ব্রহ্মাণ্ড। এই ভাব ধরে রাখবার জন্যই নয়াকৃষির একটি গুরুত্বপূর্ণ শ্লোক হচ্ছে:
এক বীজে কোটি বীজ এক বীজে বিশ্ব
বীজ হাতছাড়া হলে হয়ে যাবে নিঃস্ব
অতএব এটা বোঝা কঠিন নয় যে বীজ রক্ষা, সংগ্রহ ও পুনরুৎপাদন নয়াকৃষি ও নবপ্রাণের গুরুত্বপূর্ণ কাজের অন্তর্গত। নয়াকৃষির প্রতিটি কেন্দ্রে, যাকে 'বিদ্যাঘর' বলা হয়, একটি বীজ সম্পদ কেন্দ্র আছে। নবপ্রাণ আখড়াবাড়ীর বীজ সম্পদ কেন্দ্রের গুরুত্ব হচ্ছে এখানে সারা বছর ধরে বিভিন্ন জাতের বীজ মানুষ দেখতে পারে এবং দেখতে আসে। তাছাড়া বছরে অন্তত দুইবার কৃষকদের বীজ প্রদর্শনীর মাধ্যমে বিভিন্ন বীজ ও ফসল সম্পর্কে মেলায় বা উৎসবে আসা মানুষ কৃষকদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে পারে।
নয়াকৃষির বীজ প্রদর্শন: এবারের বিশেষ বৈশিষ্ট্য
কৃষকরা নিজের হাতে বীজ রাখে। এর অর্থ বীজ কৃষকের বীজঘরে (ex situ) অথবা মাঠে (in situ) থাকে। কৃষকের বীজ ব্যবস্থাকে বাণিজ্যিক বীজ ব্যবস্থার আগ্রাসন থেকে রক্ষা করবার জন্য নয়াকৃষির বীজ সংক্রান্ত কাজের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে বীজ সংঘ। কৃষকের বীজ ব্যবস্থাই বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থার ভিত্তি। কিন্তু বীজের বাণিজ্যকরণ এবং বীজের ওপর কেঋষকের অধিকার হরণ করবার জন্য ঐতিহ্য ও বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির ওপর ব্যক্তিগত মালিকান ব্যবস্থা দেশের ভেতরে এবং আন্তর্জাতিক আইনে প্রচলন করা হয়েছে। এই আগ্রাসন, অর্থাৎ কৃষকের বীজ সম্পদ হরণ করবার আইনী পদ্ধতি আসলে বীজ ডাকাতিরই ধারাবাহিকতা। ঔপ্নিবেশিক আমলে এই দেশ থেকে গাছপালা বীজ ইত্যাদি ঔপনিবেশিক শক্তি চুরি ও ডাকাতি করে নিয়ে গিয়েছে। সেই বীজ থেকে নতুন জাত উদ্ভাবন করে তারা আবার যেই দেশ থেকে চুরি করেছে তাদের কাছেই বিক্রি করছে। নতুন বীজ উদ্ভাবনের নামে রাসায়নিক কীটনাশক কোম্পানির তৈরী হাইব্রীড ও জিএমও বীজ কৃষকের ওপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। ফলে আমাদের নিজস্ব যে সব বীজ কৃষকের সংগ্রহে ছিল এবং তারা চাষ করতেন তা আর চাষ করা হচ্ছে না। এসব বীজ ধীরে ধীরে ‘হারিয়ে’ যাচ্ছে। বীজ হারিয়ে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে কৃষকের মাঠে সেই বীজ বা ফসলের আর চাষ না হওয়া, কৃষকের ঘরে বীজ সংগ্রহে না থাকা এমন কি এই বীজের নাম মনে না থাকা। এতে বীজ কেন্দ্র করে কৃষকের যে বিস্তারিত জ্ঞান গড়ে উঠেছিল তা দ্রুত ক্ষয় পায় এবং বীজ কেন্দ্রিক জ্ঞান চর্চাও হ্রাস পায়। এর ভয়ংকর পরিণতি হচ্ছ বীজের ওপর কৃষক তার নিয়ন্ত্রণ হারায় এবং তা চলে যায় অল্প কয়েকটি বৃহৎ বহুজাতিক কোম্পানি কিম্বা দেশীয় কোম্পানির হাতে।
বীজ হারিয়ে যাচ্ছে এই কথা যেমন সত্য তেমনি এটাও সত্য দেশে হাজার হাজার কৃষক ফসলের বৈচিত্র্যময় বীজ চাষ করছেন, নিজ হাতে সংগ্রহ করছেন এবং তারা বীজ সম্পর্কে জ্ঞান চর্চা করেন। নয়াকৃষি আন্দোলনের কাজের নির্ধারক ক্ষেত্রও তাই বীজ। নবপ্রাণ আখড়াবাড়িতে ছেঁউড়িয়ায় লালন সাঁইজীর গৌর পূর্ণিমা উৎসবে কৃষকরা বীজের গুরুত্ব বোঝাবার জন্য বীজ মেলা করে থাকেন।
এবার এই নয়াকৃষির বীজ মেলায় সাথে করে বীজ নিয়ে এসেছেন টাঙ্গাইল, নাটোর এবং কুষ্টিয়ার ২০ – ২৫ জন কৃষক। তাদের নিয়ে আসা বীজ তাঁরা সাজিয়েছেন সুন্দর করে। এবং তাঁরা বীজ ও তাঁদের সাজানোর পদ্ধতি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন। বীজের মধ্যে ছিল ধান, মসলা, ডাল, তেল, শাক, সবজি, ফুল ও ফলের বীজ।
এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বীজ নিয়ে যাওয়া সহজ নয়, কৃষকরা তাই বেশী বীজ সঙ্গে করে আনতে পারেন নি। তবুও এই মেলায় তিন এলাকার কৃষকদের আনা বীজের সংখ্যা ছিল ধান ১৪৯, সব্জি ২৯, মসলা ১৭, ফল ১১, ওষুধি ৩৩ জাতের। কিন্তু তারপরও তাঁরা বীজ সাজানো ও কৃষকের শ্রেণিকরণের পদ্ধতির মধ্য দিয়ে কৃষকের জ্ঞান চর্চার ভৈশিষ্ট্য ও শক্তি দর্শনার্থীদের আকর্ষণিয় ভাব বোঝাতে পেরেছেন। বীজ মেলায় অল্প কিছু পরিমান বীজ আনা হলেও তার মধ্যে বৈচিত্র্য ছিল বিস্ময়কর।
কৃষকরা নিজ হাতে নিজ এলাকার বীজ গুলো সাজিয়ে রাখেন। ধানের বীজ বলে সাধারণ নামে কোন ধান নেই। ধানের বীজ মানে বিশেষ বিশেষ ধানের ধানের বীজ এবং তাদের সেই বীজের ব্যবহার, চাষ পদ্ধতি, মৌসুম, স্বাদ, গন্ধ ইত্যাদি গুণাগুণের আলোকে ঐতিহ্যগত ভাবে চিহ্নিত করা বীজের বা জাতের নাম। বীজের নাম কৃষকের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কৃষকের কাছে নির্দিষ্ট কারণে নির্দিষ্ট ধান থাকে। ধান মানেই শুধু ভাত খাওয়া নয়, ধান থেকে মুড়ি, খৈ, চিড়া, পিঠা-পায়েশ, পোলাও, খিচুড়ী অনেক কিছু তৈরি হয়। বীজের ব্যবাহারিক ও চাষ পদ্ধতি অনুযায়ী বীজের নামকরণ করা ঐতিহ্য একই সঙ্গে বিভিন্ন জাত ও প্রাজাতি রক্ষা এবং কৃষকের জ্ঞান চর্চার গুরুত্বপূর্ণ উপায়। টাঙ্গাইল, নাটোর এবং কুষ্টিয়ার কৃষকদের আনা অল্প পরিমানের বীজের মধ্যে দিয়েও বীজের নামকর ও শ্রেণিকরণ কেন বীজের সুরক্ষার জন্য জরুরী সেটাই দর্শনার্থীদের এবারের বীজ মেলায় কৃষকরা বুঝিয়েছেন। এই দিক থেকে এবার নবপ্রাণ আখড়াবাড়ী্তে নয়াকৃষির বীজ মেলা বীজ মেলা অনন্য।
নয়াকৃষি আন্দোলনের সাথে যুক্ত এই কৃষকদের মাধ্যমে নয়া কৃষি বীজ সম্পদ কেন্দ্রে গত আমন মৌসুমে টাঙ্গাইলের কৃষকরা ১৭৪১ জাতের ধান পুণ উৎপাদন করেছেন, পাবনা ও নাটোরে ৪৩৫ জাত এবং কুষ্টিয়াতে ৩৭৫ জাতের ধান সংগ্রহে আছে। সবজি বীজ টাঙ্গাইলে ২৪০ প্রজাতি, ঈশ্বরদীতে ১২৫ প্রজাতি,কুষ্টিয়াতে ২৬০ প্রজাতি। এতো বীজ এখানে আনা যায় নি, তবে প্রত্যেক ধরণের বীজের কিছু নমুনা আনা হয়েছে।
বীজ সাজানো বা শ্রেণিকরণ পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য
১. মৌসুম ও পরিবেশ
সারা বছরে তিনটি মৌসুমে – আউশ, আমন ও বোরো ধান চাষ করা হয়। অনেকেই এই মৌসুমের নামকে ধানের নাম মনে করেন যেমন আউশ ধান, আমন ধান বা বোরো ধান। এই নিয়ে মেলাতেও দর্শনার্থীদের অনেক ভুল ভাঙ্গানো হয়। প্রতিটি মৌসুমে শত শত জাতের ধান আছে এবং এলাকাভেদে তার চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য ভিন্ন। এমনকি অধিকাংশ ক্ষেত্রে চাষ পদ্ধতিও ভিন্ন। যারা মেলা দেখতে এসেছিলেন তাদের পধিকাংশই অতি সাধারণ অথচ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জেনে অবাক হয়েছেন ধা চাষের মৌসুমের সঙ্গে বীজের নামের কোন সম্পর্ক নাই। আউশ ধান, আমন ধান বা বোরো ধান কোন জাতের নাম নয়। ধান চাষের তিনটা মৌসুমের নাম, অর্থাৎ কখন এবং কিভাবে একটি জাত লাগাতে হবে তার নির্দেশ।
মৌসুমের মধ্যেও আবহাওয়ার তারতম্য অনুযায়ি খরা, বন্যা, কম বা বেশি পানিতে টিকে থাকা ইত্যাদী ধানের বৈচিত্র্য আছে। কৃষক এইসব ধান নিজ সংগ্রহে রাখেন এবং অবস্থা অনুযায়ি তা ব্যবহার করেন ।
২. পরিবেশ অনুযায়ী জাতের শ্রেণিকরণ
চাষ পদ্ধতির দিকে থেকে কৃষকের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে পরিবেশের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ধানের জাত শনাক্ত করা এবং বিভিন্ন জাতের ধানকে সেই বৈশিষ্ট্য অন্যযায়ী শ্রেণিকরণ করা। এই শ্রেণিকরণের ক্ষেত্রে কৃষকরা দুই ধরণের ধান প্রদর্শন করছেন এবং তাদের বোশিষ্ট্য বিস্ত্রিইত ভাবে ব্যাখায় করেছে।
খরা সহিষ্ণু ধান
কুষ্টিয়া: মজিয়া, বিলবাউস, কালামোটা, চানমনি, সখিজান, লালমুগুর,খড়া জামরি।
টাঙ্গাইল: আজল দিঘা,গাছি, তুলিনি, কালা বকরী।
নাটোর: সাদাকাইকা, লালকাইকা, ঝিংগা শাইল, কালা বকরী, খাড়া মাজারী, সাদা ঢেপা।
বন্যা সহনশীল ধান:
কুষ্টিয়া: বক শাইল, পানি শাইল, দুলা মানিক, চেইচা, তলবঙ্গা, সখিজান, গাজনা, কলমিলতা,শালীবোরো, আমনিশাইল,পানি ঝড়া।
নাটোর: আজল দিঘা, ধল দিঘা, কাল পাট, হিদা, পাকড়ী, ভরিলতা, মাধবা, গুটা, কলামুচা।
টাঙ্গাইলঃ হলদি জাবন, সাদামোটা, লালচামাড়া, চিনিকানী, কাজলগরি, হাসায়েন, চামারা, জইল্যা।
৩. ভোক্তা হিশাবে ধানের শ্রেণিকরণ
সব ধানের চালের ব্যবহার একরকম নয়। পায়েশের ধান আর মুড়ির ধান এক নয়। আবার খৈ আর মুড়ির ধানও এক নয়। তাহলে কৃষকের চাহিদা অনুযায়ী ধানের শ্রেণীকরণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞান।
পোলাও-পায়েশের ধান
টাঙ্গাইল: কালজিরা, বেগুন বিচি,
নাটোর: কালজিরা, বেগুন বিচি, জামাইচিটা, সারনি
কুষ্টিয়া: সূর্যমুখী,কালিজিরা, ক্ষিরনলী,বেগুনবীচি।
পিঠার ধান
টাঙ্গাইল: কালোমোটা, সাদা কাজল, চাপা মোটা, টোপা আমন, লালমোচা, কার্তিক শাইল, বোয়ালী বোরো, জিয়াধান, দুধকটকি, তালরোদা।
নাটোর: আজল দিঘা, ধলদিঘা, কালপাট, পাকড়ী, ভরিলতা, মাদভা, কালামুচা, হিদা,ঝিঙগামৈাল,সাদা ঢেপাা লালকাইকা
কুষ্টিয়া: দুধরাজ, কালা বকরী, রোয়াজবা, পিঠাই, লালসোনা, শালুক, লালডেপা।
মুড়ির ধান
টাঙ্গাইল: মুখ কালানি, মালশিরা, বরিশাল, তারাগোনা
নাটোর: শালুক, চেইচা, পাকড়ি কানিমুখি, বড়ন,
কুষ্টিয়া: আগুন শাইল, কার্তিক কাইকা, হরিঙ্গাচামারা, হিজল দিঘা, রাজাশাইল, শালিক শাইল, হিদি, লালঢেপা, লতিরাজ, দাদমনি, নীলরোদা, ঝিংগাশাইল,খড়াজামুড়ি,রেনফুল।
চিড়ার ধান
টাঙ্গাইল: ময়না, চনশনি, জটি বালাম, তুলিনি, খেয়াই, শিলকোমড়, বিন্নাফুল, পানি তঙ্গা,
নাটোর: নাতুয়া, বায়কালি, পাইজাম
কুষ্টিয়া: শীল কমড়, স্বর্ণ, হলুদ জারন, বাঁশীরাজ, কালো বকরী, দিঘা, ঝিংগা শাইল, বরণ, জলামোটা।
খৈয়ের ধান
টাঙ্গাইল: মতিচিকন, লালকাহাস, লতিশাইল।
নাটোর: মাটি চিকন, লালকাহাস, লতিশাইল।
কুষ্টিয়া: লালবিন্নি, বাড়িয়াচিকন, হিজলদিঘা, দুলন, চামাই।
এ ছাড়া কুষ্টিয়ার কৃষকরা বিশেষ প্রয়োজনের ধানের জাত প্রদর্শন করেছেন
ওষুধিগুণ সম্পন্ন ধান
কুষ্টিয়া: আতগেই, লালচিকন,বোরকা,কারতিয়া, রাগমনি, সাটিয়া, বোরচকলম, কালারাই, জলামোটা, ডিঙ্গামতি, রাগমনি, কাইসাবিন্নি, নয়নমনি, যষ্টিমধু, অষ্টমনি, বাইটাসোনা।
গর্ভবতী মায়ের জন্য ধান
কুষ্টিয়া: দুধরাজ, জামরুল, জিয়া এগারো, সোনাই, সোনাইদিঘা, কাইসাফুল, মাটিয়া, শালুক, বারখিলাম, মালশিরা, গাইরাল, লালসরু, ময়নামতি, মাইসাকালি।
সব্জি বীজ
টাঙ্গাইল: সীম বীজ, চালকুমড়া, ডাটা, ঢেঁড়স, ঝিংগা, লাউ, ধুন্দুল, টমেটো, আউশে ডাটা, আমনে ডাটা,
নাটোরঃ: মিষ্টি কুমড়া, লাউ, ডাটা, চালকুমড়া, পালংশাক, সিম, চিচিঙগা, ঝিংগা, বরবটি, বড়সিম
কুষ্টিয়াঃ: তবলা লাউ, লম্বালাউ, বৈরাগী লাউ, মাইটা মিষ্টি কুমড়া, ধামামিষ্টি কুমড়া, লম্বা মিষ্টি কুমড়া, লালশাক, চালকুমড়া, পালংশাক, সিম, ঢেঁড়স, নটে শাক, টমেটো, আউশে ডাটা, আমনে ডাটা, ধুন্দুল, চ্যাপটা সিম, নলডোগা সিম, কার্তিক সিম, ইলসা সিম, আইড়ে সিম, সিরা সিম, সূর্যমুখী সিম।
ডাল বীজ
টাঙ্গাইল: মশুরীকালাই, খেসারী, মটর ডাল, মাসকালাই, কালীকালাই।
নাটোর: মশুরীকালাই, কালীকালাই, মটর ডাল, অরহর, ছোলা, মাসকালাই,খেসারী,
কুষ্টিয়া: মশুরীকালাই, কালীকালাই, মটর ডাল, অরহর, ঠিহরী কালাই, ছোলা, মাসকালাই।
মসলা
টাঙ্গাইল: ধনিয়া, মিষ্টি সজ, মেথি, কালোজিরা,
নাটোর: গুয়ামুড়ি , মিষ্টি সজ, মেথি, কালোজিরা, মরিচ, হলুদ।
কুষ্টিয়া: ধনিয়া, মিষ্টি সজ, মেথি, কালোজিরা, জাউন।
নয়াকৃষির কৃষকদের বক্তব্য
নিহার বানু, নয়াকৃষির কৃষক, রাজেন্দ্রপুর, নাটোর,পাবনা
আমি নয়াকৃষির একজন কৃষক। বীজ নিয়ে গবেষণা করি। আদি আবাদের ধান আমরা ধরে রাখছি। আমার বাড়িতে নয়াকৃষি বীজ আখড়া আছে।
আজকে এই মেলায় আমি ৮৫ জাতের ধান, ৫ জাতের ডাল, ৭ জাতের তৈল বীজ, ১৫ জাতের ওষুধি বীজ, ৫ জাতের ফুল বীজ, ১০ জাতের কাঠ, ১৫ টি মসলা জাতীয় বীজের প্রদর্শন করেছি। সবমিলে ২৫০ জাতের বীজ আমার সংগ্রহে আছে।
ধানের মধ্যে বাওলা আউশ, কালামানিক, মরিচ বুটি, নারকেল ঝুপা, ধোলাই বরণ হারিয়ে গেছে।
তৈল জাতীয় একটি ফসল নাম ‘গোজা’ এটা হারিয়ে গেছে। আমরা এটা সংগ্রহ করার চেষ্টা করছি।
নয়াকৃষি পদ্ধতিতে চাষাবাদ করলে সার বিষ লাগেনা। আমরা নিজ হাতে জৈব সার তৈরি করে জমিতে দেই। এই ফসল খুব ভাল হয়। কোন রোগ বালাই লাগে না। শাক সবজি খেতে খুব মজা লাগে। বাজারে নয়াকৃষির ফসলের চাহিদা বেশি। টমেটো,বেগুন,চাল কুমড়া,মিষ্টি কুমড়া চাষ করি।
কুষ্টিয়ার ষ্টলে বিন্নি ধান দেখেছি আমাদের এলাকায় বিন্নি ধান নাই। আমাদের এলাকায় পঙ্খী রাজ ধান নাই। ধানটা দেখতে সোনালী রং দুই পাশে সাদা দেখতে খুব সুন্দর লাগে দুর্যোগের কারণে ধানটি হারায়ে গেছে।
শাইলা ধানের ওপরে একটি গান আছে
আমার বাড়ি যাইও বন্ধু বসতে দিব পিড়া
জলপান করিতে দেব শাইলি ধানের চিড়া
শাইলি ধানের চিড়া দেব বিন্নি ধানের খই।।
ধান নিয়ে আমাদের গান গল্পের অভাব নাই। ধানের নাম খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ধানের নাম ভুলে যাওয়ার অর্থ ধান কৃষকের হাত থেকে হারিয়ে যাওয়া।
আল্লাহ্তালা ১৮ হাজার মাকলুকাত সৃষ্টি করেছেন। একেকটা প্রাণীএকেক উপকারে লাগে জুনি পোকা কলার ভিতর দিয়ে খাওয়ালে রাতকানা রোগ ভাল হয়ে যায়।
রূপসী বেগম, নয়াকৃষির কৃষক, মৌশাকাঁঠালিয়া, দেলদুয়ার, টাংগাইল
আমি নয়াকৃষির একজন কৃষক। তিনটি এলাকা থেকে আমরা বীজ এনেছি। আমরা নারী জাতি হাতে বীজ রাখি। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে কোন ঝগড়া নাই। নারী জাতির হাতে বীজ না রাখলে ঝগড়া হয়। আমরা কৃষকরা বীজ বিনিময় করি। নাটোর থেকে ২ জাতের সিম বীজ এনেছে। কুষ্টিায় ১১ ধরণের সিম বীজ রেখেছে। টাঙ্গাইল ১২ জাতের সিম বীজ এনেছি।
নাটোরে একটি ধানকে কার্তিক শাইল বলে। আমরা টাঙ্গাইলে কার্তিক কাইকা বলি। কুষ্টিয়াতে কুইজ বীজ রেখেছে। আমাদের টাঙ্গাইলেও কুইজ বীজ আছে। টাঙ্গাইলে আগে প্রচুর কুসুম ফুল হতো এটা তৈল জাতীয় ফসল । কুসুম ফুল মিষ্টি আলুর জমির পাশে দিত।এখন কুসুম ফুলের ফলন কমে গেছে। আগের ফসল ভাল ছিল এখন যারা নয়াকৃষি করে না তারা ফসলে হরমোন ব্যবহার করে, যার কারণে মানুষের রোগ বেড়ে গেছে। সবার এলাকা থেকে যে সব বীজ হারিয়ে গেছে প্রত্যেকে বীজ সংগ্রহ করে ধরে রাখার অনুরোধ জানাই। আমাদের বীজ আখড়া আছে। প্রত্যেকে ঘরে ঘরে বীজ রাখি। বীজ আমাদের সম্পদ।
উফশী জাতের বীজ আমরা হাতে রাখতে পারি।২৯ ধান বীজ আমরা হাতে রাখতে পারি। আলোক ধানের বীজ হাতে রাখা যায় না। এই ধানে সার বিষ লাগে।
আব্দুল মজিদ, নয়াকৃষির কৃষক, নন্দলালপুর, কুমারখালী কুষ্টিয়া
আমার বাড়িতে বীজ ঘর আছে। ২০০ জাতের ধান আছে। ১৬ জাতের শাক, সবজি বীজ আছে। মুড়ির ধান, পিঠার ধান,ভাতের ধান আছে। আমার হাতে গুজি এবং যব নাই। বাজারে গেলে নয়াকৃষির ফসল শুনলে মানুষ আগে নিতে চায়। বাজারে আমার আগে কেউ সবজি বিক্রি করতে পারে না।
ওসমান গনি, নয়াকৃষির কৃষক, টাঙ্গাইল
সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ বলে দাবি করা হয়। ভাল খাবার না খাওয়ার কারণে একদিনে মানুষ মরে না। আস্তে আস্তে নানা রোগে ভোগে তার পর মারা যায়। লাল ধানের চাল থেকে মানুষ অনেক পুষ্টি পায়। আগে মেয়েদের নরমালে বাচ্চা হতো। এখন সিজার ছাড়া বাচ্চা হয় না। আমার মনে হয় ভেজাল খাবার খাওয়ার কারণে এমন অবস্থা হচ্ছে। সবাইকে অনুরোধ করছি নিরাপদ ফসল উৎপাদন করার জন্য।
আমিনুল ইসলাম গায়েন, নয়াকৃষির কৃষক, দৌলতপুর, কুষ্টিয়া
ফকির লালন সাঁইজির চারণভূমি কুষ্টিয়া।
লালন সাঁইজি বলেছেন,
ইন্দ্রিয় দমন আগে কর মন
তানা হলে সাধন হবে না মন
বীজের অর্থ না জেনে ভজলে অনুমানে
জীবনে কখনো পাবে না পাবে না।।
বেতো ধান বন্যা সহনশীল ধান, বন্যা হলেও এই ধান বন্যার সাথে সাথে বেড়ে উঠত। বর্তমানে এই ধান আর নাই। মুড়কি মালা ধান হতো এখন নাই। জবাহুল ধান পেটের পীড়া হলে এই ধানের ভাত খাওয়ানো হতো। এই ধান এখন তেমন নাই। কেউ কেউ ধরে রেখেছে।
আগে মশুর ডাল বোনা হতো তাতে কোন সার বিষ লাগতো না।এখন হাইব্রিড জাতের মশুর ডাল বোনে তাতে সার বিষ লাগে। ইরি ধান লাগালে তাতে সার বিষ দিতে হয়। আমাদের এলাকায় একজন কৃষক বিনা ধান -৭ লাগিয়েছিল। তাতে শীষ এসেছিল কিন্তু ধান হয়নি। প্রথম যখন মানুষ ইরি লাগাতো তখন ৩০/৩২ মান ধান হতো । এখন ফলন কমে গেছে। ৫/১০ বছর পরে আর হবে না তখন কৃষক কোথায় যাবে? যখন তামাক ছিল তখন বিষ ব্যবহার করে ফসলের বীজ হারিয়ে ফেলেছি। এখন দেশীয় বীজ সংগ্রহ করে মানুষ তামাক চাষ বাদি দিয়ে দেশীয় ফসলের চাষের দিকে ঝুকছে।
রোকেয়া বেগম, নয়াকৃষির কৃষক, নন্দলালপুর, কুষ্টিয়া
আমার বাড়িতে বীজ ঘর আছে সেখান থেকে মানুষকে বীজ দেই। দেয়ার সময় বল দেই ফসল হলে আমাকে বীজ ফেরত দেবেন। আমি কষ্ট করে বীজ ধরে রাখছি হারিয়ে গেলে আপনাদের আর দিতে পারবো না।
রীনা আকতার, নয়াকৃষির কৃষক, রাজেন্দ্রপুর, নাটোর
ধান চাষের পর রসুন লাগাই। আমার হাতে ইরি ধান এবং কুশাইর নাই। আমন ধান আছে।
শাকেরা বেগম, নয়াকৃষির কৃষক ও দাই, দাসগ্রাম, কুষ্টিয়া
আমি ১৫বছর ধরে নয়াকৃষির কাজ করি। আমি ওষুধি গাছ নিয়ে কাজ করি। ৯০ টি ওষুধি গাছ আমার হাতে আছে। আমার কাছে লালমুনসা গাছ নাই। অন্য এলাকায় থাকলে আমাকে দেয়ার জন্য অনুরোধ জানাই। এমন কিছু পোকা মাকড় আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন যা মানুষের উপকারে আসে।
মো: নাজিমুদ্দীন, নাউথী, কুষ্টিয়া
আমি আগে তিন জাতের কুশাইল (আখ) লাগাতাম। আখ চাষ করতাম। নতারি জাবা, হইলে জাবা, হাজাবা পিয়ারা। এই আখের গুড় খুব ভাল হয় এবং গন্ধ ভাল হয়।এখন আমার কুশাইড় নাই। মশুরী ডাল বুনি। নাজির শাইল ছিল, চিচড়ি ছিল এখন নাই। দুধরাজ, কাজলা দিঘী, হিজল দিঘী এখনো হাতে রেখেছি। ৫ টি গরু আছে ২ মন দুধ হয়। সব দেশী গরু। ফরিদা আপা একবার বিদেশী মেহমান নিয়ে গিয়েছিল। নাড়া দিয়ে জৈব সার তৈরি করেছি শুনে বলেছে থ্যাংকিউ থ্যাংকিউ। কচুরি পানা দিয়ে সার তৈরি করি। কৃষক জানে কচুরি পানার কি উপকার। আমার ছেলেরা বলে অন্যেরা ধান বুনে তাদের অনেক ধান হয়। আমাদের তো কম ধান হয়। তখন ছেলেদের বলি তাদের যে খরচ হয়েছে হিসাব করে দেখো কার বেশি লাভ হয়েছে। নয়াকৃষি থেকে অনেক কিছু শিখেছি তার জন্য তার জন্য ধন্যবাদ জানাই।
ডলি ভদ্র, সমন্বয়ক, নবপ্রাণ আখড়াবাড়ি, কুষ্টিয়া
নবপ্রাণ আখড়াবাড়ির সমন্বক হিশাবে ডলি ভদ্র কৃষকের বীজ সাজানো ও শ্রেণিকরণের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেন। প্রদর্শনিতে খরা সহনশীল, বন্যা সহনশীল,ধান শ্রেণিকরণের গুরুত্ব হচ্ছে জলবায়ু মোকাবিলার জন্য কৃষকের প্রস্তুতি কিভাবে ধানের জাতকে তার পরিবেশ মোকাবিলার সামর্থ দিয়ে চিহ্নিত করার সঙ্গে যুক্ত। হাজার বছর ধরে কৃষকের এই জ্ঞান গড়ে উঠেছে,যা বইপড়া কৃষি এক্সপার্ট দিয়ে জানান সম্ভব নয়। অথচ এই জ্ঞানের ওপর জল্বায়ুর বিপর্যয়ে কৃষকের বাঁচা মরার সঙ্গে যুক্ত।
ধান যে শুধু ক্ষুধা নিবারণের জন্য চাষ করা হয় তা নয়। ধানের ওষুধিগুণ রয়েছে। এবং ওষুধি গুণ বিবেচনা করেও বীজের শ্রেণিকরণ করা হয়। যেমন, আমরা গুনাগুণ বিবেচনা করে হজমের জন্য যে ধান প্রদর্শন করা হয়েছে সেইগুলি হলো, জৈষ্ঠ মধু, ডিঙ্গামতি এবং রাধা মালি।
গর্ভবতীর পুষ্টির জন্য ব্যবহার করা হয় দুধরাজ, জামরুল, জিয়া এগারো, সোনাই, সোনাইদিঘা, কাইসাফুল, মাটিয়া, শালুক, বারখিলাম, মালশিরা, গাইরাল, লালসরু, ময়নামতি, মাইসাকালি।
পিঠার ধান: জামাই আদুরী, বাদশা ভোগ।
গর্ভবতী মায়েদের পুষ্টির জন্য প্রোটিনে সমৃদ্ধ শিম কতো গুরুত্বপূর্ণ সেটা কৃষকদের পাশাপাশি দাইমায়েরাও বোঝেন। কোষ্ঠকাঠিণ্য হলে দাইমারা যবের ছাতু খাওয়ার পরামর্শ দেন।
বড়লোকরা হরলিকস খায়। রক্তশূন্যতার জন্য ডুমুর, ভাদাল, কলমি শাক, কাটাখুড়ে শাক, যে শাক কেটে পানিতে রাখলে পানির রং কালো হয়। সেই ধরনের ক্যাটাগরি করে সাজানো হয়েছে।
আরিফুজ্জামান, প্রভাক, আলাউদ্দিন ডিগ্রীকলেজ, কুমারখালী, কুষ্টিয়া
আরিফুজ্জামান অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিশাবে হাজির ছিলেন। তিনি বলেন, কৃষকদের কাছ থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বক্তব্য শুনলাম। কৃষকরা বিলুপ্ত বা বিপন্ন জাতের ধান তাদের সংগ্রহে রেখেছেন। সেই জন্য তারা কৃতিত্ব পাওয়ার অধিকারী। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনিস্টিটিউট (বারি) বীজ সংগ্রহ করেন তাদের কাছেও এত ধরণের বীজ সংগ্রহে আছে কিনা আমার সন্দেহ আছে। কৃষক না বুঝে আধুনিক কৃষিতে ঝুকে পড়েছে, অসুবিধা ও পরিণতির কথা চিন্তা না করেই ঝুঁকে পড়েছে। প্রতিটি বীজেরই জন্ম প্রক্রিয়া রয়েছে । এখানে বাধা থাকলে বীজের ক্ষেত্রেও সেই রকম হয়। অধিক মুনাফার জন্য আধুনিক কৃষিতে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করা হয়। বাঙালির যে সংস্কৃতি তারা সেই সংস্কৃতি হারাতে বসেছে। নয়াকৃষি ও বীজ বিস্তার ফাউনডেশান যে কাজটি করছে তারা প্রকৃতগুণ ধরে রাখার কাজ করছে। তাই তাদের ধন্যবাদ জানাই। জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা দেলদুয়ার উপজেলায় তারা নিরাপদখাদ্য নিশ্চিত করতে পেরেছে। বিষাক্ত খাবার খেয়ে শারীরিক, মানষিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছি। এটা একদিনে হয়না ।ধীরে ধীরে শরীর নষ্ট হচ্ছে। শরীরে এন্টিবডি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে মানুষের রোগ বেড়ে যাচ্ছে।
ফরহাদ মজহার, নরাকৃষি আন্দোলন
ফরহাদ মজহার সরাসরি কৃষকদের সঙ্গে কাজ করেন এবং কৃষকরাই কৃষি বিষয়ে তাঁর শিক্ষক।তিনি বলেন বিজ্ঞানের বই আমি পড়ি কিন্তু সেটা কৃষকের অভিজ্ঞতাকে বিজ্ঞানের ভাষায় কিম্বা বিজ্ঞানের ভাষা কৃষকের নিত্যদিনের ভাষায় অনুবাদ করে নেবার জন্য।জ্ঞান চর্চার এটাই আদর্শ পথ।কারন লোকায়ত জ্ঞান আর বৈজ্ঞানিক জ্ঞান নামক আলাদা আলাদা দুইটা বস্তু নাই। কৃষক যেমন বিজ্ঞানী, তেমনি একজন আদর্শ কৃষি বিজ্ঞানীও মূলত কৃষক।ফলে কৃষক নিয়ে রোমান্টিক হবার যেমন কারন নাই, তেমনি বিজ্ঞানীকে বিজ্ঞান নামক ধর্মের ইমাম বানিয়ে তাঁরা যা বলেন তাই নির্বিচারে সত্য গণ্য করবার অন্ধ বিশ্বাস থেকেও আমাদের মুক্ত হতে হবে।
একালে আমামদের সবচেয়ে বড় বিপদ হচ্ছে বিজ্ঞান শিক্ষার সঙ্গে ব্যবহারিক শিক্ষার বিচ্ছেদ ঘটে যাওয়া।সেটা এতো গভীর যে বলে ছেলে মেয়েরা কৃষি সম্পর্কে কিছুই প্রায় জানে না। জানতে পারছে না। ছেলে মেয়েরা যারা গ্রামে থাকে তারাও ধানের নাম জিজ্ঞাসা করলে বলতে পারে না। কারন এই জানাটা যে শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং না জানলে কৃষি জ্ঞানের গোড়ার ভিত্তিটাই ক্ষয়ে যায়, লুপ্ত হয়ে যায় সেই সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানটুকুও জাতি হিশাবে আমরা হারিয়েছি। কৃষকের জ্ঞানও যে জ্ঞান সেটা আমরা স্বীকার করি না। অন্যদিকে বিজ্ঞান মানে সব স্ময় থিক তাতো নয়। কারণ বিজ্ঞানীদের বিশাল একটি অংশ এখন কামলা খাটে বহুজাতিক কোম্পানি যেমন মনসান্টো, সিনজেন্টা এই সবের সঙ্গে। ঐতিহ্যগত বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের ভিত্তি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এই প্রতিকুলতার মধ্যে আমরা নয়াকৃষি নিয়ে কাজ করছি।
কৃষির কথা বাদ দিন। পারিবারিক ক্ষেত্রে এর ফলে দেখুন। আমাদের খাদ্য ব্যবস্থা বিষময়, বিষ যুক্ত। ফলে আমরা অসুখে কাত্রাচ্ছি। শরীর সুস্থ রাখতে হলে কৃষিকে সুস্থ রাখা দরকার।ভাবুন মায়েরা কতো যত্ন করে কোম্পানি প্রপাগান্ডায় বিশ্বস করে শিশুদের হরলিক্স খাওয়ান। অথচ তার চেয়ে যব বা ছোলার ছাতু, দুধ ও গুড় মেশানো ড্রিংক্স ১০০ গুন বেশি পুষ্টির কাজ করবে। কিন্তু শিক্ষিত শ্রেণি কম্পানির মিথা বিজ্ঞাপনে বিশ্বাস করে। তাদের অনুকরণ করে নিম্ন বর্গের মানুষ, অন্যান্য শ্রেণি।
আমি কৃষকদের কাছ থেকে কৃষি শিখেছি। এবার নবপ্রাণ আখড়াবাড়িতে নয়াকৃষির কৃষকরা খুবই সুন্দর ভাবে কৃষি প্রদর্শনী করেছেন -- বিশেষত বিভিন্ন ধান ,ডাল, তেল, ফুল, ফলের বীজ এটা দেখে আমার নিজেরই চোখ দিয়ে পানি এসেছে। আমরা বাস করছি এক ভয়ংকর কৃষক ও কৃষক স্বার্থ বিরোধী সময়ে । এই অবস্থার মধ্যে এই ধরনের প্রদর্শনী করতে পারা এক অসম্ভব ব্যাপার। কৃষক তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ফসলের পরিকল্পনা করে । পিঠার ধান, খইয়ের ধান, মুড়ির ধান, পায়েশ খাওয়ার ধান -- ধানের শ্রেণিকরনে পেছনে কৃষকের অভিজ্ঞতার সারমর্ম যেভাবে এভাবে এই প্রদর্শনীতে হাজির হয়েছে তা রীতিমতো অভিভূত করবার মতো।
যেখানে আমরা কথা বলছি এই কুষ্টিয়া একসময় বিখ্যাত নবদ্বীপের অন্তর্গত ছিল। এক সময়ের কৃষিতে ফসলে বাড়ন্ত এলাকা। সব চেয়ে ধনী এলাকা। কালিগঙ্গা ও গড়াই নদীর পানি, বান ও পলিমাটি, সূর্যের আলো আর কৃষকের জ্ঞান মিলে এই অঞ্চলে কৃষির যে বিকাশ ঘটেছিল সেটাই ছিল কুষ্টিয়ার অর্থনৈতিক ভিত্তি। এখনঞ্চারদিকে দেখুন কংকালটুকু ধুঁকছে।
বীজ সংরক্ষণ না করার জন্য আজ আমাদের এই দুর্দশা। কৃষকদের যে জ্ঞান আছে অন্য কারো সেই জ্ঞান নাই। কৃষক সারা দিনই গবেষণা করে। কৃষকের চেয়ে বড় বিজ্ঞানী কেউ হতে পারে না। কৃষি কাজ সব চেয়ে কঠিন কাজ। কৃষি জানতে হলে গ্রহ, পানি, নক্ষত্রের যোগ জানতে হবে। এটা বুঝেই জমিতে বীজ বা বীছন দিতে হয়। কীট পতঙ্গ ঠেকাবার প্রথম কাজ হলো দেশী জাতের ফসল চাষ করা এবং মিশ্র ফসল করা।
আমরা লালন ফকিরের গান শুনি।কিন্তু সাধনা কী জিনিস, সেটা ধরতে পারি না।যখন পারিনা তখন গুহ্যবিদ্যার নামে দুনিয়ার যত্তোসব আজেবাজে কেচ্ছাকাহিনী আধুনিক বাবু শ্রেণী গড়ে ওঠার সময় থেকেই ্তারা যেভাবে বলেছে সেই ভাবে আমরা শুনছি। যে বীজ ঘরের নীচে আমরা বসে আছি সেটা ফকির লবান শা নিজ হাতে উদ্বোধন করে গিয়েছিলেন। একটা ছোত বীজ হাতে নিয়ে তিনি বলেছিলেন এই বীজটি কিভাবে ব্রহ্মাণ্ড ভ্রমণ করে এবং তার ভ্রমণের মধ্য দিয়ে এই বীজটির আপন স্বরূপ তার নিজের ব্রহ্মকে ধারণ করে জীবন্ত বীজ হয় এতোটুকু বুঝতে পারলে ফকির লালন শাহের সাধনার সদর দরজা আমরা পেয়ে যাবো।
আজ তাঁকে ভক্তি জানিয়ে শেষ করছি।
... ... ... ... ...
এবার বীজ সম্পদ রক্ষায় নয়াকৃষি কৃষক সভা ও বীজ প্রদর্শনী হয়েছিল ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ তারিখে ছেঁউড়িয়া, কুষ্টিয়ায়,নবপ্রাণ আখড়াবাড়ীতে। তিনটি এলাকার কৃষকদের নিয়ে মতবিনিময় সভা অনুষ্টিত হয়। এলাকাগুলি হচ্ছে টাংগাইল, পাবনা, কুষ্টিয়া। সভা সঞ্চালনা করেন সীমা দাস সীমু,পরিচালক, উবিনীগ। বিশেষ অতিথি ছিলেন,জনাব আরিফুজ্জামান,প্রভাষক, আলাউদ্দিন ডিগ্রী কলেজ, কুমারখালী, কুষ্টিয়া।
লালন সাঁইজির একটি গান দিয়ে সভা উদ্বোধন করা হয়। গানের কথা হচ্ছে: সত্য কাজে কেউ নয় রাজি/সবই দেখি তানা নানা।। বীজ সাজানো ও শ্রেণিকরণ ছাড়াও বীজ মেলা ও মতবিনিময় সভার একটি উদ্দেশ্য ছিল নয়াকৃষি আন্দোলনের বিভিন্ন এলাকায় কৃষকদের হাতে যে সব বীজ আছে এবং কৃষকরা যেসব বীজ চাষ করছে তার মধ্যে কোন বীজ হারিয়ে যাচ্ছে কিনা এবং কৃষক্রা পুরানা কোন বীজ চাষে যুক্ত করতে পেরেছেন কিনা ইত্যাদি। অংশগ্রহনকারী কৃষক ছিলেন ১৭ জন। এর সবাই নয়াকৃষি বীজ সঙ্ঘের অভিজ্ঞ বীজ কমিটির সদস্য। এছাড়াও লালন সাঁইজির গৌর পূর্ণিমা উৎসবে বিভিন্ন জেলা থেকে আগত দর্শনাথীরা এই মতবিনিময় সভায় অংশগ্রহন করেন।