বীজ ব্যাংক ও নয়াকৃষি বীজ সম্পদ কেন্দ্র: আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা
নয়াকৃষি আন্দোলন || Thursday 24 May 2018 ||নয়াকৃষি বীজ সম্পদ কেন্দ্রের বৈশিষ্ট্য
নয়াকৃষি আন্দোলনের কৃষকদের বীজ সম্পদ কেন্দ্র আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কৃষকের উদ্যোগে দেশীয় বীজ রক্ষার আন্দোলনের মধ্যে একটি পরিচিত নাম। আন্তর্জাতিক ভাবে জাতীয় জীন ব্যংকের (National Gene Bank) পাশাপাশি এই ধরনের উদ্যোগকে সাধারণত বলা হয় 'সামাজিক বীজ ব্যাংক' (Community Seed Bank)। তবে বীজ ব্যাংকের মতো নয়াকৃষি আন্দোলনে বীজ কেন্দ্রিক কাজ কেবল বীজ সংরক্ষণ এবং বীজের আদান প্রদানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং রাসায়নিক সার ও বিষ ব্যবহার এবং মাটির তলার পানির অপচয় বন্ধ করে সামগ্রিক ভাবে প্রাণ বৈচিত্রভিত্তিক কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তুলবার গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক, সাংগঠনিক এবং সামাজিক চর্চা। যার আশু লক্ষ্য হচ্ছে একর প্রতি প্রকৃতি থেকে প্রাপ্তি বৃদ্ধি এবং কৃষকসহ গ্রামীন সমাজের সামগ্রিক উন্নয়ন। দূরবর্তী লক্ষ্য হচ্ছে জীবাশ্ম ভিত্তিক শিল্পসভ্যতা এবং পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের বিপরীতে প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশের স্বাভাবিক বিকাশ নিশ্চিত করে নতুন ধরণের সমাজ তৈরির শর্ত গড়ে তোলা। এ কারণে নয়াকৃষির বীজ সংরক্ষণের কাজ নয়াকৃষি আন্দোলনের অন্তর্গত অভিজ্ঞ কৃষকদের নিয়ে গঠিত 'বীজ সংঘ'-এর কর্ম তৎপরতার ক্ষেত্র এবং বীজ রাখার কেন্দ্রটি 'সামাজিক বীজ সম্পদ কেন্দ্র' (Community Seed Wealth Center) নামে আন্তর্জাতিক ভাবে পরিচিত। নয়াকৃষির বীজ সম্পদ কেন্দ্র বিশ্বের অন্যান্য দেশের স্থানীয় বীজ ব্যাংক (Community Seed Bank) বা স্থানীয় বা লোকায়ত উদ্যোগে বীজ রক্ষার কার্যক্রম প্রসঙ্গে সাধারনত আলোচিত হয়; দেখুন, (Ronnie Vernooy, Pitambar Shrestha, Bhuwon Sthapit 2015)।
দক্ষিণ এশিয়ায় কৃষকের একটি বীজঘর। বীজের গুরুত্বের কারণে সব সময় দেখা যায় কৃষক তার বীজঘরটিকে যত্ন করে সাজিয়ে রাখে, কারন এর ওপর শুধু কৃষকের নিজের নয়, পুরা কৃষিব্যবস্থার ভবিষ্যৎ নির্ভর করে।
নয়াকৃষি বীজ সম্পদ কেন্দ্র নয়াকৃষি আন্দোলনের সাথে সরাসরি যুক্ত। নয়াকৃষি আন্দোলনের মধ্য থেকে স্থানীয় বীজ সম্পর্কে অভিজ্ঞ কৃষকদের নিয়ে 'নয়াকৃষি বীজ সংঘ' (Nayakrishi Seed Network) গঠিত ও পরিচালিত হয়। নয়াকৃষি বীজ সম্পদ কেন্দ্র বীজ সংঘের অধীনে পরিচালিত বীজ ব্যবস্থা। নয়াকৃষি বীজ সম্পদ কেন্দ্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে 'জীন ব্যাংক'-এর মতো এটি কৃষক সমাজ বা নিত্যদিনের কৃষিকাজ থেকে বিচ্ছিন্ন বীজ সংরক্ষণ বা বীজ গবেষণা নয়। যে গবেষণা অধিকাংশ সময় কৃষকের স্বার্থে না হয়ে সমাজের এলিট শ্রেণি বা কোম্পানির স্বার্থে পরিচালিত হয়। বীজ সম্পদ কেন্দ্র বরং কৃষক পরিবারের নিত্যদিনের কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত একটি কাজের ক্ষেত্র যাকে কৃষি ব্যবস্থার পরিচালনা কেন্দ্র বলা যেতে পারে। কৃষকের আশু প্রয়োজন এবং পাশাপাশি কৃষি ও কৃষকের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার কথা সুস্পষ্ট ভাবে মাথায় রেখেই বীজ সম্পদ কেন্দ্র পরিচালনা করা হয়। নিত্যদিনের কৃষি চর্চার মধ্য থেকে গড়ে ওঠা অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের পর্যালোচনা করা এবং জ্ঞান ধরে রাখার জন্য অভিজ্ঞতার সারার্থ তৈরি বীজ সম্পদ কেন্দ্রের কাজ। সে কারণে নথি রাখা, প্রতিবেদন তৈরি এবং প্রতিটি নতুন অভিজ্ঞতার সারসংকলন করা বীজ সম্পদ কেন্দ্রের নিত্য দিনের কাজ। কৃষি জ্ঞান ধরে রাখা, চর্চা করা এবং ভুলত্রুটির মধ্য দিয়ে প্রাণ, প্রকৃতি, পরিবেশ ও খাদ্য ব্যবস্থা সম্বন্ধে সামাজিক জ্ঞান বিকশিত করা কৃষকের সামাজিক স্মৃতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী জড়িত। এই স্মৃতি রক্ষা মৌখিক সংস্কৃতির পরিমণ্ডল (oral culture) হিশাবে পরিচিত কিন্তু এই মৌখিক, অর্থাৎ ছাপার অক্ষর কেন্দ্রিক সংস্কৃতির বাইরে লোকায়তিক জ্ঞান চর্চার পরিমণ্ডলের সঙ্গে সাক্ষর সংস্কৃতির (literate culture) সংযোগ রক্ষার ক্ষেত্রে নয়াকৃষি বীজ সম্পদ কেন্দ্র অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সম্প্রতিকালে ইলেক্ট্রনিক ও ডিজিটাল মাধ্যমের উন্নতির ফলে বিভিন্ন মাধ্যমে কৃষকের ইন্দ্রিয়পরায়ন জীবন্ত পরিমণ্ডলের অভিজ্ঞতা ধরে রাখা জ্ঞানচর্চার নতুন ক্ষেত্র উদ্ভাবন কৃষিজ্ঞান বিকাশের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বীজ সম্পদ কেন্দ্র তাই যেমন নথিভূক্তি, প্রতিবেদন তৈরি, গবেষণা পত্র রচনার প্রতি মনোযোগী থাকে একই সঙ্গে অডিও রেকর্ড, ফটোগ্রাফি, ভিডিও ইত্যাদিতেও সমান আগ্রহী। সামগ্রিক ভাবে বীজ সম্পদ কেন্দ্র নয়াকৃষি আন্দোলনের সাংগঠনিক কাঠামো ও দৈনন্দিন তৎপরতার প্রধান অংশ বলা যায়।
কৃষক নারী ও বীজ সম্পদ কেন্দ্র
কৃষক, বিশেষ করে কৃষক পরিবারের নারী, তাঁর নিজের ঘরে সব সময় বীজ রক্ষা, পুনরুৎপাদন ও বীছনের কাজ করেন; কৃষক পরিবারের মেয়েরাই প্রধানত কৃষকের বীজ ব্যবস্থা হাজার বছর ধরে টিকিয়ে রেখেছেন; আর কৃষকের বীজ ব্যবস্থাই হোল কৃষির প্রাণ, কৃষি ব্যবস্থার ভিত্তি। এই দিক থেকে কৃষক পরিবার প্রাণ ব্যবস্থাপনার অত্যন্ত কেন্দ্রীয় একটি ক্ষেত্র। কৃষক বীজ শুধু ঘরেই রাখেন তা নয়, যেসব বীজ জীবন্ত মাঠে রাখতে হয় তার ব্যবস্থাপনাও কৃষক পরিবারই সম্পাদন করে। বীজ রক্ষা ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কৃষক নারীর ভূমিকা এখন কম বেশী স্বীকৃত। নয়াকৃষি আন্দোলনের সাংগঠনিক কাঠামোতে কৃষক পরিবারের গুরুত্ব অতএব অপরিসীম। স্বভাবিক কারনেই নয়াকৃষি আন্দোলনের নারীরাই প্রধান ভূমিকা পালন করেন।
নয়াকৃষির বীজ সুরক্ষা আন্দোলনের অগ্রভাগে স্বাভাবিক কারণে নারীরাই নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন। বীজ রক্ষার ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকা এখন কমবেশী আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত। নয়াকৃষি আন্দোলনের কৃষক নারীর একে আরও বৃহত্তর পরিসরে প্রাণ, প্রকৃতি ও প্রাণের বৈচিত্র্য সুরক্ষার আন্দোলনে পরিণত করেছেন। বাংলাদেশের নারী কৃষকদের অবদান এই ক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। নারীর ক্ষমতায়নের প্রশ্ন এর ফলে সুনির্দিষ্ট ভাবে প্রাণ ও প্রকৃতির সুরক্ষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নারীর সংগ্রামকে আরও তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলেছে।
কৃষকের বীজ ব্যবস্থা বা প্রাণসম্পদ ব্যবস্থাপনা
কৃষকের বীজ ব্যবস্থা ও প্রাণসম্পদ ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব ও তাৎপর্য নিয়ে তর্ক বেশি দিনের নয়, অতি সম্পতি কালের। আড়ালে পড়ে থাকা এই কৃষকের জ্ঞান চর্চাকে সামনে নিয়ে এসে ফসলের বীজ এক জায়গায় সংরক্ষণ করা, বিভিন্ন জাত ও প্রজাতির ভালমন্দ বিচার করা, পরিবেশ ও প্রকৃতির উপযুক্ত বীজ নির্বাচন করা, পরস্পরের মধ্যে বীজ, তথ্য, জ্ঞান আদান প্রদান এবং জ্ঞানচর্চার কাজকে আরও প্রণালীবদ্ধভাবে করবার তাগিদ থেকেই স্থানীয় বীজ ব্যাংক আন্দোলন সম্প্রতিকালে পৃথিবীর নানান দেশে গড়ে উঠেছে। বিশ্বে কমিউনিটি সীড ব্যাংক বর্তমানে দেশীয় বীজ সংরক্ষণ এবং প্রসারের একটি কার্যকর এবং নির্ভরযোগ্য কৌশল হিশাবে স্বীকৃত হচ্ছে। নয়াকৃষি আন্দোলন লোকায়ত জ্ঞানচর্চার এই ধারাকেই সাংগঠনিক ও বিধিবদ্ধ ভাবে সম্পন্ন করবার জন্য বীজ সংঘ ও বীজ সম্পদ কেন্দ্র গড়ে তুলেছে। যা এখন সারা বিশ্বে পরিচিত।
কমিউনিটি সীড ব্যাংক কখন কিভাবে শুরু হয়েছে তা নির্দিষ্টভাবে জানা না গেলেও কমবেশি বলা যায় গত শতাব্দির ৮০’র দশকের শেষের দিকে বীজ ব্যাংকের কার্যক্রম আরম্ভ হয়েছে। এর সাথে ১৯৯২ সালে অনুষ্ঠিত ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিওতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব পরিবেশ সম্মেলন সরাসরি সম্পর্ক আছে। সেই কনভেনশানে 'প্রাণ বৈচিত্র্য চুক্তি' (Convention on Biological Diversity) স্বাক্ষরিত হয়। বাংলাদেশে সেই একই সময়ে নয়াকৃষি আন্দোলন শুরু হয়। তার মাত্র চার বছর আগে ১৯৮৮ সালে দেশব্যাপী ভয়াবহ বন্যার কারণে টাঙ্গাইলের কৃষকদের অনুরোধে উবিনীগ (উন্নয়ন বিকল্পের নীতি নির্ধারণী গবেষণা) কৃষি নিয়ে কাজ করতে শুরু করে এবং দ্রুত এবং অনিবার্য ভাবেই আধুনিক কৃষির নানা পরিবেশগত সমস্যা কৃষকদের নিয়ে মোকাবিলা করতে বাধ্য হয়। রাসায়নিক সার, কীটনাশক এবং মাটির তলা থেকে পানি তোলার ফলে আর্সেনিক বিপর্যয় সহ আরও নানান ভয়াবহ কুফল তখন সহজেই দৃষ্টিগোচর হয় এবং কৃষকরা সমবেত ভাবে তা মোকাবিলার পরিকল্পনা গ্রহন করে। সেই সঙ্গে আধুনিক বীজের প্রবর্তনের কারণে স্থানীয় জাতের বীজের হারিয়ে যাওয়ার বিষয়টি কৃষকরা প্রবল ভাবে তুলে ধরেন। সে কারণে নয়াকৃষি আন্দোলন শুধু রাসায়নিক সার-বিষ বন্ধ করার চাষ পদ্ধতি নয় বরং প্রাণবৈচিত্র্য নির্ভর কৃষি হিসেবে গড়ে ওঠে; এই আন্দোলনে বীজ কেন্দ্রিক কৃষি ব্যবস্থাপনা, অর্থাৎ প্রাণের ব্যবস্থাপনা কৃষি চর্চার প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে। শুরুতে শুধু রাসায়নিক সার ও কীটনাশক বন্ধের দিকে জোর দিলেও দ্রুত পরিস্কার হয়ে ওঠে যে আসলে বীজ ঠিক না থাকলে এবং বীজের ওপর কৃষকের নিয়ন্ত্রণ না থাকলে প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা যেমন সম্ভব নয়, তেমনি প্রকৃতি ও পরিবেশ অনুযায়ী কৃষি পরিকল্পনা গ্রহণ করে একর প্রতি কৃষি উৎপাদন বাড়ানো যায়। নারী কৃষকরাই প্রধানতঃ এই বিষয়টি তুলে ধরেন। বিশ্ব পরিবেশ সম্মেলনেও এই বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে এবং Convention on Biological Diversity (CBD) গৃহিত হতে পেরেছে। উল্লেখ্য বিশ্ব পরিবেশ সম্মলনে উন্নয়ন বিকল্পের নীতি নির্ধারণী গবেষণা (উবিনীগ) সক্রিয় ভাবে অংশ গ্রহণ করেছিল। এর পর থেকে বাংলাদেশে নয়াকৃষি আন্দোলন বা প্রাণবৈচিত্র্য নির্ভর কৃষিকাজ ব্যাপকভাবে টাঙ্গাইলসহ অন্যান্য জেলায় শুরু হয়। এরই অংশ হিসেবে বীজ ও প্রাণবৈচিত্র্যকেন্দ্রিক কৃষি ব্যবস্থাপনা গুরুত্বপুর্ণ হয়ে ওঠে। নয়াকৃষি আন্দোলনের কাজের নির্ধারক সাংগঠনিক ভিত্তি হিশাবে নয়াকৃষি বীজ সংঘ (Nayakrishi Seed Network) গড়ে ওঠে এবং বীজের কাজ ব্যাপকতা লাভ করে।
নেপালের একটি 'কমিউনিটি বীজ ব্যাংক'। মাটির তৈরী এই ধরনের বীজ ব্যাংকই নেপালে বিশেষ ভাবে দেখা যায়। বীজ ব্যাংককে হতে হয় কৃষকের সামর্থ এবং আর্থিক আয়ত্বের মধ্যে। লক্ষ্যণীয় যে ওপরে টিন ছাড়া বাকি সবই স্থানীয় উপাদান দিয়ে তৈরি।
ধরে নেয়া যায় বিভিন্ন দেশে কৃষকের ফসলের বীজ রক্ষার কাজ সুনির্দিষ্ট সাংগঠনিক রূপ নিয়ে শুরু হয়েছে মাত্র ৩০ বছর আগে থেকে। এর একটি বড় কারণ বাণিজ্যিক কৃষির তোড়ে কৃষকের ঘরে স্থানীয় বীজ হারিয়ে যাবার বিপদ এই সময় তীব্র হয়ে ওঠে এবং ধরিত্রী সম্মেলনে প্রাণ বৈচিত্র্য ধ্বংসের বিপদ আন্তর্জাতিক ভাবে সামনে চলে আসে। পাশাপাশি দেখা যায় বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির নামে কৃষকের জ্ঞান ও আবিষ্কার আত্মস্থ করবার জন্য বহুজাতিক কোম্পানিগুলিও তৎপর হয়ে উঠেছে। তারা দাবি করতে থাকে কৃষকের হাজার বছরের আবিষ্কারের কোন বুদ্ধিবৃত্তিক মূল্য বা মালিকানা নাই, এটা সাধারণের সম্পত্তি (common heritage); যে কেউই চাইলে সেই বীজ চুরি করে নিয়ে গিয়ে সেখান থেকে নতুন জাত বানিয়ে কোম্পানির বীজ হিসাবে উচ্চ মূল্যে বিক্রি করতে পারে। ঔপনিবেশিক আমল থেকে প্রাণ বৈচিত্রে সমৃদ্ধ দেশগুলো থেকে বীজ ও প্রাণ সম্পদ পাচার হয়েছে, বিশ্বব্যাপী পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে 'বীজ' হয়ে উঠেছে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর নতুন জাত বানাবার কাঁচামাল। তারা তা যথেচ্ছা চুরি বা ডাকাতি করতে শুরু করে। বাংলাদেশের মতো দেশগুলো তাদের মূল্যবান বীজ ও প্রাণসম্পদ হারাতে থাকে।
এর আগে শত শত বছর ধরে কৃষক তার নিজের সংগ্রহেই বীজ রেখেছেন। বীজ সংরক্ষণের উদ্যোগ কৃষক সমাজ নিজেরাই গ্রহণ করেছেন; প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কোন কারণে বিশেষ ফসলের বীজ হারিয়ে যাওয়া, কিংবা মান সম্মত বীজের অভাব মোকাবিলার জন্য স্বাভাবিক কারনেই কৃষকদের সেটা করতে হয়েছে। কিন্তু বীজ রক্ষার প্রণোদনা বিশেষ ভাবে কৃষকের মধ্যে জারি থেকেছে নতুন জাত 'নির্বাচন' ও কৃষিকে আরও সমৃদ্ধ করবার তাগিদ থেকে। ভুলে যাওয়া উচিত নয় প্রতিটি কৃষক পরিবারই মূলত একেকটি কৃষি গবেষণা কেন্দ্র। নিত্য দিনের অভিজ্ঞতা থেকে কৃষক নিত্য নতুন আবিষ্কার করতে সক্ষম। আধুনিক কৃষি কৃষকের এই স্বাভাবিক ও সহজাত ক্ষমতাকে অস্বীকার করে এবং আমলে নেয় না। ফলে মাঠে প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্ট জাত নির্বাচন'-এর জায়গায় প্রতিস্থাপিত হতে শুরু করে বিজ্ঞানিদের ল্যাবরটরিতে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে তৈরি তথাকথিত 'উফশি' জাতের বীজ। কৃষকের জাত 'নির্বাচন'কে হঠিয়ে দিয়ে বিজ্ঞানিদের নতুন জাত 'ব্রিডিং' বা প্রজনন কৃষি গবেষণায় মুখ্য হয়ে ওঠে। কৃষকের লোকায়ত জ্ঞান চর্চা ও আবিষ্কারের ধারায় মারাত্মক বিচ্ছেদ ঘটে। আধুনিক বিজ্ঞান চর্চার পদ্ধতি, রূপ ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো এমন ভাবে গড়ে ওঠে যেখানে সামাজিক জ্ঞানচর্চায় কৃষকের অংশগ্রহণ অসম্ভব হয়ে ওঠে তো বটেই একই সঙ্গে তা হয়ে ওঠে কৃষি ও কৃষক থেকে বিচ্ছিন্ন ব্যাক্তি, প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়িক কোম্পানির ক্ষমতা চর্চার ধরণ। জ্ঞানের বিচারের ক্ষেত্রেও খণ্ডিত মানদণ্ড ব্যবহার শুরু হয়। প্রাতিষ্ঠানিক বৈজ্ঞানিক চর্চাকে বলা হয় প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানচর্চা (Formal Knowledge System); কৃষকের জ্ঞান পর্যবসিত করা হয় অপ্রাতিষ্ঠানিক লোকায়ত জ্ঞান (Informal Knowledge System কিম্বা Local Knowledge, Indigenous Knowledge ইত্যাদি) হিশাবে। কৃষকের জ্ঞানকে হীন বা অবমূল্যায়ন করা শুরু হয়। ধরিত্রী সম্মেলনে পরিবেশবাদী ও কৃষক আন্দোলনের ফলে প্রাণবৈচিত্র সংরক্ষণে লৌকিক বা স্থানীয় জনগণের জ্ঞানের গুরুত্ব স্বীকার করা হলেও জ্ঞানের বিভাজন অক্ষুণ্ণ রেখেই সেটা করা হয়েছে; যেমন 'প্রাণ বৈচিত্র্য চুক্তি'র ৮ অনুচ্ছেদ। আধুনিক কৃষি প্রাণবৈচিত্রের যে ধ্বংস সাধন করেছে তার পরিপ্রেক্ষিতেই এই অনুচ্ছেদটি অনিবার্য ভাবেই গৃহীত হয়েছে।
ভারতের একটি বীজ ব্যাংকের অভ্যন্তরের ছবি। দক্ষিণ এশিয়ায় বীজ রাখার পাত্র হিশাবে মাটির হাঁড়ি সাধারণত ব্যবহার করা হয়।
যদিও আন্তর্জাতিক লড়াইয়ের ক্ষেত্রে লোকায়ত জ্ঞানের এই স্বীকৃতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ অর্জন ও তাৎপর্যপূর্ণ কিন্তু নয়াকৃষি আন্দোলন, বলাবাহুল্য, বৈজ্ঞানিক বিচারে এই ধরণের বিভাজনের ঘোর বিরোধী। যে কোন জ্ঞানচর্চায় প্রাকরণিক বা পদ্ধতিগত দিক যেমন থাকে, তেমনি থাকে প্রাকরণিক শৃংখলার বাইরে কল্পনা, অন্তর্দৃষ্টি, ভাব, আকস্মিকতা, এমনকি স্রেফ দৈবক্রমে আবিষ্কারের ঘটনা। বিজ্ঞানচর্চার ইতিহাস নিয়ে যারা কাজ করেছেন তাদের গবেষণাতেই দেখা যায় প্রাতিষ্ঠিনিক/লোকায়তিক, কিম্বা প্রাকরণিক/ দৈব ইত্যাকার বিভাজনের কোন বাস্তব বা ঐতিহাসিক ভিত্তি নাই ( (Kuhn 1970)। পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের যুগে প্রাতিষ্ঠানিক বিজ্ঞান মূলত এখন বহুজাতিক কোম্পানির স্বার্থ রক্ষায় পর্যবসিত হয়েছে। নয়াকৃষি আন্দোলন কৃষকের জ্ঞানচর্চাকে স্রেফ লোকায়ত জ্ঞান হিশাবে 'রোমান্টিক' ভাবনায় রঞ্জিত করতে একদমই আগ্রহী নয়, বরং একে সত্যিকারের জ্ঞানচর্চা হিশাবে বিকশিত করতে আগ্রহী, ঠিক তেমনি আধুনিক বিজ্ঞানের বিমূর্ত বিরোধিতাতেও নয়াকৃষি আন্দোলন সায় দেয় না। বিজ্ঞানের সুনির্দিষ্ট সামাজিক, রাজনৈতিক বা ক্ষমতাকেন্দ্রিক চরিত্র রয়েছে। সেই চরিত্রের পর্যালোচনা দরকার এবং বিজ্ঞানের নামে ক্ষমতার যে চর্চা সুনির্দিষ্ট ভাবে কৃষি ব্যবস্থার ভিত্তি হিশাবে গড়ে ওঠা কৃষকের বীজ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে এবং প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশ বিধ্বংসী, নয়াকৃষি তার বিরুদ্ধে নিরাপোষ লড়াই করে।
বীজ ব্যাংক, বীজ সম্পদ কেন্দ্র
আধুনিক কৃষির ফলে পরিবেশ ও প্রকৃতির ক্ষতি ও বীজ হারিয়ে যাওয়া মোকাবিলা করতে গিয়ে সাংগঠনিক পর্যায়ে বীজ রক্ষার কাজ কৃষকদের লড়াইয়ের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে নানা ধরণের বীজ, বিশেষ করে পরিবেশ ও প্রকৃতির ভিন্নতা ও বৈচিত্র অনুযায়ী বিভিন্ন এলাকা বা অঞ্চলের বীজ সংরক্ষণ করা, ঘরে ও মাঠে কৃষকের বীজ রাখার কাজ শক্তিশালি করা এবং স্থানীয় জাতের বীজ ব্যবস্থা উন্নত করা। এই উদ্যোগগুলো বিভিন্ন নামে পরিচিত হয়, যেমন কমিউনিটি জিন ব্যাংক, সীড সেভার্স গ্রুপ, সীড লাইব্রেরী, কমিউনিটি সীড ব্যাংক এবং বাংলাদেশে কমুউনিটি সীড ওয়েলথ সেন্টার বা নয়াকৃষি বীজ সম্পদ কেন্দ্র। উদ্যোক্তারা মূল ফসলের (major crops) বীজ ছাড়াও বিশেষ ভাবে অবহেলিত জাত ও প্রজাতি এবং কম ব্যবহৃত আবাদি ও অনাবাদি ফসলের ওপর জোর দিয়ে থাকেন। বীজ সম্পদ কেন্দ্র বা বীজ ব্যাংক শুরু করার কারণ সব দেশে এক নয়। তবে নানা কারণের মধ্যে আধুনিক কৃষির আগ্রাসন, খাদ্য উৎপাদনের শিল্পায়নের ব্যাপকতা, বীজ উৎপাদনের ক্ষেত্রে কোম্পানির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ আর প্রাকৃতিক দুর্যোগ একটি বড় ভুমিকা রেখেছে। বাংলাদেশে নয়াকৃষি আন্দোলনের শুরু এবং বীজ সম্পদ কেন্দ্রের প্রয়োজন হয়েছিল ১৯৮৮ সালের বন্যার পর, জিম্বাবওয়েতে ১৯৯২ সালে প্রচণ্ড খরা বীজ ব্যাংক সৃষ্টির কারণ ছিল। অন্যদিকে ভারতে বিভিন্ন এনজিও পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয়ে উদ্বুদ্ধ হয়ে বীজ ব্যাংক স্থাপন করে।
বিভিন্ন স্থানে বীজ সংরক্ষণের এই উদ্যোগের মধ্যে ২২টি দেশে ৩৫টি ব্যক্তি ও সাংগঠনিক পর্যায়ের কাজ বিশ্বে এখন আলোচিত। এই দেশগুলো হচ্ছে ভূটান, বলিভিয়া, ব্রাজিল, কানাডা, চীন, কোস্টারিকা, গুয়েতেমালা, ভারত, মালয়েশিয়া, মালি, মেক্সিকো, নেপাল, নিকারাগুয়া, রুয়ান্ডা, শ্রীলংকা, ত্রিনিদাদ, উগান্ডা, বুরুন্ডি, হন্ডুরাস, স্পেইন, জিম্বাবওয়ে ও দক্ষিণ আফ্রিকা। আঞ্চলিকভাবে দক্ষিণ এশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকা, আফ্রিকা ও কানাডার বেশ কিছু সংগঠন এই কাজে এগিয়ে আছেন।
বীজ সংরক্ষণ এবং পুনরুৎপাদনসহ প্রাণ বৈচিত্র্য রক্ষার কাজে যে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে তাদের অধিকাংশই তাদের বীজগারের নামকরণ করেছেন কমিউনিটি সীড ব্যাংক। এর মাধ্যমে বীজের আদান প্রদান হচ্ছে, ব্যাংকের মতো বীজ জমা দেয়া এবং সেখান থেকে বীজ ধার নিয়ে আবার একটা নির্দিষ্ট হারে ফেরৎ দেওয়া। এর সাথে ব্যাংকের মিল পাওয়া যায়। কিন্তু বাংলাদেশে নামকরণ করা হয়েছে 'নয়াকৃষি বীজ সম্পদ কেন্দ্র', যা মূলত নয়াকৃষি বীজ সঙ্ঘের অধীনস্থ সাংগঠনিক ভাবে কৃষকদের সম্মিলিত উদ্যাগ। এর অধীনে রয়েছে গ্রাম পর্যায়ে 'বীজ আখড়া'। এবং অগ্রসর কৃষকদের বীজঘর। বীজ সম্পদ কেন্দ্রের কাঠামোর মধ্যে কৃষকদের গ্রাম পর্যায়ের বীজ আখড়া অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। 'বীজ সম্পদ কেন্দ্র' প্রাণ ও প্রকৃতি সুরক্ষার খবই গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক হাতিয়ার
বীজ ব্যাংক বা বীজ সম্পদ কেন্দ্রের কাজ
বীজ ব্যাংক বা বীজ সম্পদ কেন্দ্র যাই বলা হোক না কেন এর উদ্দেশ্য প্রধানত:
(ক) বীজ সংরক্ষণ করা
(খ) বীজ সম্পর্কে সচেতনতা ও জ্ঞান বাড়ানো
(গ) বীজের তথ্য নথিভুক্ত করা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির অধিকার (Intellectual Property Rights) থেকে স্থানীয় কৃষককে বঞ্চিত করবার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা
(ঘ) কৃষকের বীজ ও প্রাণ সম্পদ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত জ্ঞান চর্চা প্রণালীবদ্ধ করা
(ঙ) বীজ পুনরুৎপাদন এবং কৃষকের মধ্যে বিনিময়।
এই সব কাজের মধ্যে বীজ সংরক্ষণ সবচেয়ে প্রাথমিক কিন্তু গুরুত্বপুর্ণ কাজ বলে বিবেচনা করা হয়। কোন কোন দেশে, যেমন ভূটান, মালয়েশিয়া, মেক্সিকো ও রুয়ান্ডায় বীজ ব্যাংক শুধু বীজ সংরক্ষণের কাজই করে। এখানে স্থানীয় জাতের বীজ সংরক্ষণ করা হয় এবং হারিয়ে যাওয়া বীজ পুনরুদ্ধ্বার করা হয়। অন্য দেশে বীজ সংরক্ষণের পাশাপাশি কৃষকের মাঝে বীজ দেয়ার ব্যবস্থাও রাখা হয়। কিন্তু বাংলাদেশ, ব্রাজিল এবং স্পেইনের বীজ ব্যাংক ও বীজ সম্পদ কেন্দ্র বীজ সংরক্ষণ এবং কৃষকদের মধ্যে বীজ বিনিময়ের পাশাপাশি বীজের ওপর কৃষকের অধিকার এবং খাদ্য ও বীজের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের সঙ্গে যুক্ত। প্রাণবৈচিত্র্য নির্ভর কৃষি চর্চাকে শক্তিশালী করা এবং প্রকৃতি, পরিবেশ ও প্রাণের ব্যবস্থাপনায় অঙ্গীকারবদ্ধ কৃষকদের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি এই ধরনের বীজ ব্যাংক বা বীজ সম্পদ কেন্দ্রের গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
বীজ সম্পদ কেন্দ্রের কাজ শুধু বীজ রাখা বা বিনিময় নয়, বরং নয়াকৃষি বীজ সংঘকে শক্তিশালী করা এবং বীজে অভিজ্ঞ কৃষকদের সঙ্গে নিয়মিত সভা করা। প্রতিটি বীজ প্রকৃতি ও পরিবেশ ভেদে কৃষকের জন্য নতুন অভিজ্ঞতা বা জ্ঞানের সূচনা ঘটাতে পারে। সেই অভিজ্ঞতা নিয়মিত লিপিবদ্ধ করা এবং বিভিন্ন কৃষকের অভিজ্ঞতা যাচাই, পর্যালোচনা ও আলোচনা করা বীজ সংঘের গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কৃষকের মৌখিক জ্ঞানচর্চাকে কখনই অক্ষর বা লিপিকেন্দ্রিক টেকনলজিতে পর্যবসিত করা যায় না। নয়াকৃষি আন্দোলন মৌখিক জ্ঞানচর্চা (Oral Culture) এবং অক্ষর কেন্দ্রিক জ্ঞানচর্চা (Literate Culture) পার্থক্যকে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিশাবে গণ্য করে। এই পার্থক্য মনে রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রাণ ও প্রকৃতি সংক্রান্ত জ্ঞানের ক্ষয়ের একটি বড় কারন এই পার্থক্য সম্পর্কে অসচেতনতা।
কিছু বীজ ব্যাংকের কাজ হচ্ছে যেসব কৃষক কোন কারণে বীজ হারা হয়েছেন তাদের প্রয়োজনের সময় বীজ দেয়া। এই বীজ দেয়া-নেয়ার জন্যে নিয়ম বেঁধে দেয়া হয়, এবং ঋণ আকারেই বীজ দেয়া হয়। যা আবার ফেরৎ দিতে হয়। ফসল তোলার পর নেয়া বীজের ৫০ – ১০০% বেশি ফেরৎ দিতে হয়। আফ্রিকায় বুরুন্ডিতে বীজ ব্যাংক বীজ সংরক্ষণের পাশাপাশি শস্য গোলার মতো কাজ করে; যেসব কৃষকের বাড়ীতে বীজ রাখার ভাল জায়গা নাই বলে বীজ সংরক্ষণ করতে পারেন না, কিংবা বীজ চুরি হয়ে গেছে, অথবা আর্থিক দুর্দশায় পড়ে বীজ বিক্রি করে ফেলেছেন, এমন কৃষক বীজ ব্যাংক ব্যবহার করতে পারেন।
বাংলাদেশের নয়াকৃষি বীজ সম্পদ কেন্দ্র, স্পেইনের সীড নেটওয়ার্ক, ব্রাজিলের রিজিওনাল সীড হাউজ বীজ সংরক্ষণ এবং গ্রামের কৃষকদের প্রয়োজনে বীজ সরবরাহের পাশাপাশি কৃষি ব্যবস্থা, বীজ সংক্রান্ত বিষয়ে সরকারের নীতি পর্যালোচনা, বীজের ওপর কৃষকের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা ইত্যাদি বিষয়ে কাজ করে। এছাড়া হাইব্রিড ও বিকৃত ফসলের (জি এম ও) মাধ্যমে কৃষকরা কি ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হন সে সব বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির কাজও তারা করে। কৃষির বৈচিত্র্য এবং খাদ্যের বৈচিত্র্য নিশ্চিত করে সার্বিকভাবে খাদ্য সার্বভৌমত্ব অর্জন করা তাদের বিশেষ লক্ষ্য।
বীজ সম্পদ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপনা
কমিউনিটি সীড ব্যাংক বা বীজ সম্পদ কেন্দ্র পরিচালনায় আর্থিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও নৈতিক (moral) দিক রয়েছে। কমিউনিটি সীড ব্যাংক বা বীজ সম্পদ কেন্দ্র শুধুমাত্র কিছু বীজ সংগ্রহশালা নয়, এর সাথে সেই এলাকার, বা গ্রামের কৃষক এবং জনগণেরও একটা সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। বীজ কৃষকদের মাধ্যমেই আসে এবং তাদের সম্পৃক্ততায় বীজ সম্পদ কেন্দ্রের কাজকর্ম নির্ধারণ করা হয়। সেখানে যে ধরণের কৃষিব্যবস্থা রয়েছে, যে প্রাণ বৈচিত্র্য রয়েছে, তার প্রসার ঘটানোতেও বীজ সম্পদ কেন্দ্রের ভুমিকা থাকে।
বীজ সম্পদ কেন্দ্র ব্যবস্থাপনায় দৈনন্দিন কাজের সম্বন্বয়, বীজের দেখভাল করা, মান ঠিক রাখার বিষয়, সাংগঠনিক এবং আর্থিক বিষয়াদি সম্পাদন করতে হয়। বীজ ব্যাংক/ বীজ সম্পদ কেন্দ্র এর কিছু নিয়ম ও নীতিগত সিদ্ধ্বান্ত থাকে, যা মেনে চলেই এই কেন্দ্র পরিচালিত হয়। কৃষকদের সাথে সক্রিয় সম্পর্কের বিষয়েও সিদ্ধান্ত গ্রহণের কাঠামো থাকে। বাংলাদেশে নয়াকৃষি বীজ সম্পদ কেন্দ্র সংগঠন এবং কৃষকদের কমিটির সম্বন্বয়ে বীজ সংঘ গঠিত হয়েছে, যা একটি বীজ অভিজ্ঞ নারী কমিটি এবং নেতৃস্থানীয় কৃষক (পুরুষ-নারী উভয়ে) সম্বন্বয়ে বীজ সম্পদ কেন্দ্র ও বীজ আখড়া পরিচালিত হয়। ব্যাবস্থাপনার নানা ধরণের প্রথা বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ধরণের চর্চা হচ্ছে, তবে কৃষকদের নিয়ে কমিটি গঠন করার চর্চা প্রায় সব দেশেই আছে।
বীজ সম্পদ কেন্দ্র এবং বীজ আখড়া চালাতে কিছু খরচ আছে। বীজ সংরক্ষণের জন্যে পাত্র জোগার করা, পুবরুৎপাদনের জন্যে জমির ব্যবস্থা করা ইত্যাদি খরচের ব্যাপার। বীজ সম্পদ কেন্দ্র রক্ষণাবেক্ষণের খরচও যথেষ্ট লাগে।
বীজ সম্পদ কেন্দ্রের কারিগরি বিষয়
বীজ ব্যাংক এবং বীজ সম্পদ কেন্দ্র ক্রমে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। তবে বীজ সংরক্ষণসহ সংশ্লিষ্ট সকল বিষয়ের সাথে কৃষকের অভিজ্ঞতালব্ধ্ব্ব জ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সম্পর্ক আছে। কাজেই কোন্ বীজ সম্পদ কেন্দ্রে বীজ রাখা হচ্ছে এটা বলাই যথেষ্ট নয়, কারণ এই বীজ কোন শিল্প পণ্য নয় যে শো-কেসে সাজিয়ে রাখা যাবে। বীজ ব্যাংক বা বীজ সম্পদ কেন্দ্র কোন সাধারণ সংরক্ষণশালাও নয় যে ইচ্ছে মতো যতো দিন ইচ্ছা কোন বীজ রেখে দেয়া যাবে বা যখন তখন ইচ্ছে মতো ব্যবহার করা যাবে। দেখা গেছে কারিগরি দিক পরিকল্পনা না করে যেসব বীজ ব্যাংক /বীজ সম্পদ কেন্দ্র কাজ শুরু করেছে তারা বেশি দিন টিকতে পারেনি। যেসব বীজ রাখা হচ্ছে তার বিষয়ে সম্পুর্ণ বৈজ্ঞানিক তথ্য থাকা বীজ ব্যাংক/বীজ সম্পদ কেন্দ্রের অপরিহার্য্য বিষয়।
কয়েকটি কারিগরি দিক বীজ সম্পদ কেন্দ্রে অবশ্যই থাকা চাই।
১. ফসলের জাত ও প্রজাতি বাছাই
বীজ ব্যাংক/বীজ সম্পদ কেন্দ্রের দায়িত্ব প্রাপ্ত কৃষক এবং সংগঠন নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে বীজের জাত ও প্রজাতি রাখার সিদ্ধান্ত নেন। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে তারা স্থানীয় জাতের এবং ঐতিহ্যগত (traditional) বীজ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন (বাংলাদেশ,ভারত ও নেপাল)। অন্যদিকে বিশেষ ফসলের বীজ যেমন ভূট্টা, সীম (গুয়েতেমালা) , সীম ও মরিচ (মেক্সিকো), জোয়ার, মুক্তা বাজরা (জিমবাবওয়ে), আলু (বলিভিয়া) রেখেছেন। স্থানীয় সংস্কৃতি পুণরুজ্জীবিত করার জন্যে ভূটানে বাজরা (buckwheat)বীজ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কারণ বাজরা মূল খাদ্য ছিল কিন্তু ১৯৭০ –এর দশকে সরকার বাজরার পরিবর্তে আলু প্রবর্তন করলে এর চাষ কমে আসে। তাই বীজ ব্যাংকে বাজরা বীজ সংরক্ষণ করা হয়। বাংলাদেশেও বিটি বেগুন (জিএম ফসল) প্রবর্তনের কারণে স্থানীয় জাতের বেগুনের বীজ সংরক্ষণ ও প্রসারের ওপর জোর দেয়া হয়েছে।
২. বীজ সংগ্রহ এবং বপনের উপাদান (Planting material)
কৃষকের মাধ্যমে বীজ সংগ্রহ করার সময় লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে বীজগুলো রোগ-মুক্ত কিনা পরীক্ষা করা। জমিতে ফসল থাকা অবস্থায় সিদ্ধান্ত নেয়া কোথা থেকে সংগ্রহ করা হবে, রাস্তার ধারের জমির বীজ এড়িয়ে যাওয়া ইত্যাদী দেখার বিষয় আছে। বীজ ব্যাংক/বীজ সম্পদ কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কৃষক ও কর্মীদের কারিগরি সক্ষমতা, তাদের কাজের পদ্ধতি ও কৌশল সম্পর্কে জানা খুব গুরুত্বপুর্ণ।
বীজ সংঘের একজন সদস্য বীজ পরীক্ষা করে বিভিন্ন পাত্রে রাখছেন। বীজ ভালমন্দ বাছাই ও যাচাই করা বীজ সম্পদ কেন্দ্রের গুরুত্বপূর্ণ কাজের অন্তর্ভূক্ত।
৩. নথিভূক্ত করা এবং অন্যকে জানানো
বীজ ব্যাংক/বীজ সম্পদ কেন্দ্রে শুধু বীজের জাত সংগৃহিত থাকে না এর সাথে জড়িত তথ্য ও জ্ঞান নথিভুক্ত করা হয়। এর মাধ্যমে অন্যরাও বীজ সম্পর্কে জানতে পারেন। বীজের তথ্য নথিভুক্ত করার নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম আছে যা অনুসরণ করেই তথ্য রাখা হয়। তথ্য নথিভুক্ত করার এই পদ্ধতি পাসপোর্ট ডাটা নামে পরিচিত। কৃষকরা সব সময় নিজেরা এই কাজ করতে পারেন না, তবে কোন না কোন সংগঠনের পক্ষ থেকে এই কাজ করা হয়। এ ছাড়াও স্থানীয় প্রাণবৈচিত্র নথিকরণ (Community Biodiversity Register) একটি উদ্যোগ যা সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন দেশে বীজ বা প্রাণ সম্পদের তালিকা রাখার জন্য ব্যবহার করা হয়।
এছাড়া বীজ ও প্রাণ সম্পদ সংক্রান্ত জ্ঞানের বহুল প্রচারের জন্য বীজ ও প্রাণবৈচিত্র্য মেলা করা এবং কৃষক বিনিময় খুবই কার্যকর পদ্ধতি। ইন্টারনেটের যুগে ওয়েবসাইট ও ইলেকট্রনিক মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহলে তথ্য আদান প্রদান করাও এখন নিয়মিত হয়ে উঠেছে।
প্রতিটি পাত্রে বীজের নাম, জাত, কখন কোথায় কিভাবে সংগ্রহ করা হোল তার তথ্য, বীজ সম্পদ কেন্দ্রে নথিভূক্তির নাম্বার বা শনাক্তিকরণ নাম্বার ইত্যাদি পাত্রের গায়ে লেখা থাকে। এছাড়া প্রতিটি বীজের জাত সংগ্রহের আলাদা আলাদা পাসপোর্ট ডাটা রয়েছে। নয়াকৃষি আন্দোলন এ কাজে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে।
৪. বীজ সংরক্ষণঃ কাঠামো ও পদ্ধ্বতি
বীজ ব্যাংক/বীজ সম্পদ কেন্দ্রে বীজ সংগ্রহ করে তা সুস্থ, পরিস্কার এবং টেকসই ভাবে রাখা হয়। এই জন্য বীজ ঘরের নির্মাণ সামগ্রী কেমন হবে তা সেই স্থানের পরিবেশ, আবহাওয়া ও কৃষকের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে। কোন দেশেই বীজ ব্যাংক/বীজ সম্পদ কেন্দ্রে “আমদানী” করা সামগ্রী দিয়ে তৈরি হয়নি। কারিগরি দিক থেকে এই ধরণের বীজ ঘরে তাপমাত্রা ও আদ্রতা মাপার যন্ত্র থাকা খুব জরুরী। সেটা অনেক কৃষকের কাছেই থাকে না।
বীজ ঘর কখনো শুধু একটি রুমে করা হয়, কেউ কেউ বীজ ঘরেই মিটিং করার জায়গাও রেখে দিয়েছেন।
বীজ রাখার জন্যে যে পাত্র ব্যাবহার করা হয় তাও স্থানীয় ভাবে সংগ্রহ করা, যেমন মাটির পাত্র, ধাতব, বাঁশ ও খড়ের পাত্র, শুকনো ফল ( যেমন ঝিংগা), কাঁচের বোতল ইত্যাদি ব্যাবহার হতে দেখা গেছে। বাংলাদেশে মাটির পাত্র এবং কাঁচের বোতলে বীজ রাখা হয়েছে। শুকনো ফল এবং আলুর মতো ফসল খোলাভাবেও রাখা আছে। কাঁচের বৈয়াম, সুপারগ্রেইন ব্যাগ ( যাতে গ্যাস এবং আদ্রতা নিয়ন্ত্রিত থাকে) প্লাস্টিক ব্যাগের ব্যবহার পাওয়া গেছে চীন, গুয়েতেমালা, মেক্সিকো এবং নেপালে।
৫. বীজ পুনরুৎপাদনঃ বৃহৎ আকারে উৎপাদন এবং মান বজায় রাখা
সাধারণত বীজ ব্যাংক/বীজ সম্পদ কেন্দ্রে স্থানীয় জাতের বীজ সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ করাই প্রধান কাজ। কিছু বীজ ঘরে বাণিজ্যিকভাবে বেশী পরিমানে বীজ উৎপাদনেরও পরিকল্পনা করা হয়েছে। জিমভাবওয়ে এবং কস্টারিকায় বেশী উৎপাদন করে বিক্রির ব্যবস্থাও করেছে। কিন্তু বীজ ঘরের মাধ্যমে বাণিজ্যিক বীজ উৎপাদন ও বিক্রি স্থানীয় জাতের বীজ সংগ্রহ ও সংরক্ষণের কাজ ব্যাহত করে বলে অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে।
বীজ পুনরুৎপাদন করে জাত রক্ষার কাজ প্রায় সব বীজ ব্যাংক/বীজ সম্পদ কেন্দ্রে করা হয় তবে এর কোন নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। অনেক বীজ ব্যাংকের যথেষ্ট জমি না থাকায় সব বীজ পুনরুৎপাদন করা সম্ভব হয় না। নেপালে ৮০ জাতের ধান ৯ মিটার X ৯ মিটার পরিমান জমিতে চাষ করে প্রতি জাতের ধানের প্রায় ৫ কেজি বীজ সংরক্ষণ করা হয়। বাংলাদেশে নয়াকৃষি বীজ সম্পদ কেন্দ্রে প্রায় ২০০০ জাতের ধান প্রতি বছর নিজেদের জমি এবং লীজ নেয়া জমিতে পুনরুৎপাদন করা হয়।
৬. কৃষকের বীজের বৈশিষ্ট্য লিপিবদ্ধ করা এবং মূল্যায়ন
এখন পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে যেসব বীজ ব্যাংক/বীজ সম্পদ কেন্দ্র আছে তারা বিশ্বের গুরুত্বপুর্ণ বীজের জাত সংরক্ষণ করছে এবং স্থানীয়ভাবে মাটি ও আবহাওয়ার সাথে খাপ খাওয়ানো জাত কৃষকের কাছে জনপ্রিয় করে তুলছে। এর সাথে জড়িত কৃষকের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাও লিপিবদ্ধ করে রাখা হচ্ছে। এর ফলে সুবিধা হয় যে বন্যা, খরা, রোগ-বালাই, বিশেষ গুণাগুন, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিষয় সম্পর্কে জানা যায় এবং সে জাত সংরক্ষণের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়ার ক্ষেত্র তৈরি হয়।
৭. কৃষকের সামর্থ্য বাড়ানো
সার্বিকভাবে বীজ ব্যাংক/বীজ সম্পদ কেন্দ্রগুলো নিজ নিজ এলাকার প্রাণ বৈচিত্র্য রক্ষায় কৃষকের শক্তি ও সামর্থ্য বাড়াতে বিশেষ ভুমিকা রাখে। এখানে স্থানীয় জাতের বীজ সংরক্ষণ সম্পর্কে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া হয়, সভার আয়োজন করে অন্যদের সাথে জ্ঞান বিনিময় হয়, নিজেরা বসে বীজ সম্পর্কে তথ্য আদান প্রদান করেন। মাসিক সভার আয়োজন প্রায় সব ক্ষেত্রে দেখা গেছে। নেপালের বীজ ব্যাংকে স্থানীয় জাতের বীজের চাষ করে নিজেদের অবস্থার উন্নতির জন্যে চিন্তাভাবনা করেন।
বাংলাদেশে নয়াকৃষি বীজ সম্পদ কেন্দ্র নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে প্রচার, সুপারিশ এমনকি বিশেষভাবে ক্যাম্পেইন করে স্থানীয় বীজের গুরুত্ব তুলে ধরেন এবং হাইব্রীড ও জিএমও বীজের ক্ষতির সম্ভাবনা সম্পর্কে অবগত করে। উগান্ডায় উইভিল নামক একটি ছোট গুবরে পোকার জীবনচক্র সম্পর্কে কৃষকদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া হয় যেন তারা তাদের ফসল এই পোকার আক্রমন থেকে রক্ষা করতে পারেন। মালিতে কৃষকের ফিল্ড স্কুলে নিয়মিত বীজ ব্যাংকের সদস্যদের সভা করা হয় যেন তারা তাদের জ্ঞান সমৃদ্ধ্ব করতে পারেন।
তথ্যসূত্র
Kuhn, Thomas S. The Structure of Scientific Revolution. Chicago: University of Chicago Press, 1970.
Ronnie Vernooy, Pitambar Shrestha, Bhuwon Sthapit. Community Seed Banks:` Origins, Evolution & Prospects. New York: Earthscan, 2015.