সুবর্ণচরে নারী ধর্ষণে কলংকিত গণতন্ত্র
ফরিদা আখতার || Sunday 20 January 2019 ||ডিসেম্বর ৩০ তারিখ, ২০১৮। এই দিন সারাদেশে একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন হয়েছে। দিনশেষে নির্বাচনের ফলাফল আমরা জেনেছি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছে, আর অন্যান্যরা ধড়াসায়ী হয়েছে। সারাদিন এটাও জেনেছি ভোটাররা ভোট দিতে গিয়েও দিতে পারেন নি, তাদের বলা হয়েছে “আপনার ভোট দেয়া হয়ে গেছে”; কেউ কেউ ভোট কেন্দ্রে গিয়েও ঢুকতে পারেন নি। তবুও নির্বাচন অংশগ্রহণমুলক হয়েছে বলে সবাই স্বস্তিতে ছিলেন। যদিও নির্বাচনের ফলাফল অংশগ্রহণকারি রাজনৈতিক দলগুলো মেনে নেয় নি। এসব ভিন্ন আলোচনা। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে যে বিষয়টি এখনো নির্বাচনের জয়ের কপালে একটা কলংক চিহ্ন হয়ে আছে, তা হচ্ছে নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলায় ভোট প্রয়োগ করতে আসা নারীর ওপর হিংস্র আক্রমন। পালাক্রমে গণধর্ষণ।
পাঠক নির্বাচনের পর থেকেই প্রতিদিন পত্রিকায় বিষয়টি নিয়ে কোন না কোন খবর দেখছেন বা পড়ছেন। বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের সারমর্ম করে ঘটনাটি আবার উল্লেখ করছি। ত্রিশ ডিসেম্বর নির্বাচনের দিন দুপুরের দিকে একজন নারী ভোটার তার স্বামীসহ স্থানীয় ভোটকেন্দ্র চরজুবলীর ১৪নং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভোট দিতে যান। একই এলাকার চরজুবলী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য রুহুল আমিনের লোক নির্বাচনে নৌকার পক্ষে কাজ করেছিলেন। ভোটের দিন তাঁরা সেই নারী (৩২) ভোটারকে তাঁদের পছন্দের প্রতীকে (অর্থাৎ নৌকায়) ভোট দিতে বলেন। তিনি তাতে রাজি না হলে এ নিয়ে তর্কাতর্কির একপর্যায়ে সেই লোকেরা তাঁকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেন। সেই নারী ভোট দিয়ে ফেরার পথে রুহুল আমিন তাকে অনুসরণ করে এবং উত্ত্যক্ত করে। নারী এর প্রতিবাদ জানিয়ে দ্রুত বাড়ি ফিরে আসেন। এরপর রুহুল আমিন ও তার লোকজন নারীর ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং গভীর রাতে রুহুল আমিনের নেতৃত্বে ৮-১০ জনের একদল সন্ত্রাসী দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে স্বামী-সন্তানকে বেঁধে রেখে নারীকে পালাক্রমে ধর্ষণ করে চলে যায়। এতে নারী অচেতন হয়ে পড়েন। সন্ত্রাসীরা চলে যাওয়ার পর পরিবারের অন্য সদস্যদের চিৎকারে আশপাশের লোকজন এসে তাদের উদ্ধার করে। গুরুতর আহত অবস্থায় ওই গৃহবধূকে নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালের গাইনি ওয়ার্ডে পরদিন দুপুরে ভর্তি করা হয়।
সুবর্ণচরের সেই নারীকে ডাক্তারি পরীক্ষার পর গণধর্ষণের আলামত পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক মো. খলিল উল্যাহ। ডাক্তারি পরীক্ষার প্রতিবেদন জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওই নারীর শরীরের বিভিন্ন স্থানে নির্যাতনের চিহ্ন আছে। বিষয়টি এখন প্রমাণের অপেক্ষায় নেই যে ধর্ষণ হয়েছে কিনা, কিন্তু কিছুদিন ব্যয় হয়েছে কে এবং কেন করেছে তা নিয়ে।
এখন সুবর্ণচর পত্রিকার শিরোনামের অংশ হয়ে গেছে। প্রতিদিন কিছু না কিছু খবর ছাপা হচ্ছে, তাতে জানা যাচ্ছে অপরাধিরা ধরা পড়ছেন কিনা। তাদের রিমান্ডে নেয়া হচ্ছে, তারা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে নিজেদের সম্পৃক্ততার কথাও বলছেন। যদিও মূল আসামী রুহুল আমিনকে মামলায় আসামী রাখা নিয়ে পুলিশ অনেক গড়িমসি করেছে। সেই নারীর স্বামী বাদী হয়ে মামলা করলেও তিনি জানেন না কেন রুহুল আমিনকে আসামী করা হয় নাই। তাঁর ভাষায়, 'আমি অশিক্ষিত মানুষ; থানায় গিয়ে ঘটনা খুলে বলেছি। পুলিশকে বলেছি সব লিখে নিতে। তারা কেন রুহুল আমিনের নাম লেখে নাই, বলতে পারি না।' অন্যদিকে পুলিশের পক্ষ থেকে তা অস্বীকার করা হচ্ছে। তাঁরা বলছেন, 'বাদী যার যার নাম উল্লেখ করেছে, তাদেরই আসামি করা হয়েছে। এখানে পুলিশের কিছুই করার নেই।' এ ব্যাপারে স্থানীয় পর্যায়ে দলের পক্ষ থেকে আজ পর্যন্ত কোন ব্যাখ্যা আসেনি। প্রভাবশালীদের ক্ষেত্রে এমনটাই ঘটবে, এটাই সবাই জানে।
কাজেই এই গণধর্ষণ অন্যান্য নারী নির্যাতনের ঘটনার মতো বিবেচনা করার বিষয় নয়। এই ঘটনা সরাসরি নির্বাচনে সহিংসতা ও ভোটারের নিরাপত্তার প্রশ্নের সাথে জড়িত। এই ঘটনার সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্ক আছে। এই ঘটনা বুঝিয়ে দিয়েছে নির্বাচনে ভোটারের নিরাপত্তার যে দাবি তোলা হয়েছে তা কত জরুরি ছিল। যদিও কেউ ঘুণাক্ষরে ভাবে নি নির্বাচনে ধর্ষণের বিষয়ে সাবধানতার কথাও বলতে হবে। ব্যবস্থা নিতে হবে তার বিরুদ্ধেও। ধর্ষণ প্রায় ক্ষেত্রেই ক্ষমতার প্রদর্শন হিসেবে করা হয় আমরা জানি। নির্বাচন কমিশন কি বুঝতে পারছেন একটি দলকে নির্বাচনের সময় অতিমাত্রায় ক্ষমতাধর করে ফেলা এবং নির্বাচন কমিশনের দুর্বল উপস্থিতি মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে কত ভয়াবহ হতে পারে? তার প্রমাণ দিয়েছে সুবর্ণচরের এই ধর্ষণের ঘটনা। ভোটের অধিকার প্রয়োগ করতে গিয়ে অন্যের নির্দেশে অন্য প্রতীকে সীল না মারার পরিণাম কী হতে পারে তা একজন নারীকে নির্মম ভাবে বুঝিয়ে দেয়া হোল। এটাই ছিল একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন, যেখানে জয় হয়েছে সেই প্রতীকে্র সীল যে প্রতীকে ভোট দেয়ার জন্যে এই নারীকে বাধ্য করা হচ্ছিল, এবং শেষ পর্যন্ত তাকে ধর্ষিত হতে হয়েছে।
সংবাদ মাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যাপক আলোচনার কারণে সুবর্ণচরের এই ঘটনা আড়াল করা যায় নি ঠিকই কিন্তু লক্ষ্য করছি, ইতিমধ্যে পত্রিকার প্রথম, দিত্বীয় বা পেছনের পাতা থেকে ধীরে ধীরে সরে গিয়ে ১২, ১৩ নম্বর পাতায় গিয়ে ঠেকছে। একসময় পাঠকও ভুলে যাবে। মামলাও খুব এগুবে না। যেমন এগুয় নি অন্যান্য চাঞ্চল্যকর ধর্ষণের ঘটনার ক্ষেত্রে। কিন্তু সারাজীবন ভুলতে পারবেন না সেই নারী এবং তার পরিবার। কলংক চিহ্ন থেকে যাবে নিরংকুশ সংখ্যা গরিষ্টতা পাওয়া জয়ের কপালে।
আমরা এখনো সরকার প্রধানের মুখে, যিনি একজন ক্ষমতাধর নারী, এই ঘটনার নিন্দা জানাতে শুনি নি। নোয়াখালির প্রতিনিধি হিসেবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের মূখে কোন দুঃখ প্রকাশ করতে শুনিনি, শুধু বলেছেন কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। এটা দায়সারা কথা। ব্যাস। তাঁর দায়িত্ব শেষ। একাদশ জাতীয় সংসদে এবার রেকর্ড সংখ্যক নারী “নির্বাচিত’ হয়েছেন। তাঁরা কেউ ছূটে যান নি, সুবর্ণচনের নারীকে দেখতে। নোয়াখালির কাছের নারী সংসদ সদস্য হচ্ছেন ফেনী-১ আসনের শিরীণ আখতার। তিনি এককালে নারী আন্দোলনে বেশ সক্রিয় ছিলেন। আমরা একসাথে মিছিল-মিটিং করেছি। দিনাজপুরের ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যার বিরুদ্ধে সম্মিলিত নারী সমাজে যারা সোচ্চার ছিলেন, তিনি তাদের মধ্যে অন্যতম। কিন্তু তিনি এখন কেন নিশ্চুপ হয়ে আছেন। শিরীণ আখতার ছাড়া নোয়াখালি -৬ এ আছেন আয়শা ফেরদৌস, চাঁদপুর-৩ এ ডাঃ দীপু মনি। তিনি শিক্ষা মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছেন। নাকি তাঁরা নিজেরাও নৌকায় ভোট না দেয়ায় সেই নারীর ওপর বিরক্ত হয়ে আছেন? তাঁরা নিজেরাই কি নৈতিক শক্তি হারিয়েছেন? তাই যদি হয়, আগামি পাঁচ বছরে আরো যেসব ঘটনা ঘটবে, এবং ইতিমধ্যে প্রতিদিন ঘটে চলেছে, তখনও কি তাঁরা চুপ থাকবেন? তাহলে রেকর্ড সংখ্যক নারী জাতীয় সংসদে গেলে সাধারণ নারীদের কি উপকার? তাঁরা নৌকা মার্কায় ভোট পেয়ে জিতে সুবর্ণ চরের নারীর কষ্ট বুঝতে অক্ষম হচ্ছেন। ঘটনার সাথে নৌকা মার্কাও জড়িয়ে গেছে। তাই এই ধর্ষণের ঘটনা আর দশটি গণ ধর্ষণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারছে না। নির্বাচন সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন আছে, ভোটাররা ভোট দিতে না পারলেও ৯৮% ভোট পড়েছে। এইসব অনিয়মের বিরুদ্ধে ট্রাইবুনাল করার ঘোষণা এসেছে ঐক্য ফ্রন্টের পক্ষ থেকে।
কিন্তু নির্বাচনের দিন এবং ভোট কেন্দ্রের ঘটনার জেরে নারী ধর্ষণ হলে তার বিচার কি শুধুই সাধারণভাবে অন্যান্য নারী নির্যাতনের ঘটনার মতো করা হবে? এর দায়দায়িত্ব কি নির্বাচন কমিশন নেবে না? কে জানে দেশের বিভিন্ন স্থানে অনেক নারী ভোটাররা এই ধরণের ভয় পেয়েছেন কিনা, এবং ভোট কেন্দ্রে যাওয়া থেকে বিরত থেকেছেন। কে জানে গণধর্ষণের শিকার না হলেও নারীদের হেনস্থা করা হয়েছে কিনা। এইসব বিষয় তদন্ত হওয়া দরকার। ঐক্যফ্রন্ট, বাম গণতান্ত্রিক জোটসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন যারা নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন তাঁদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই, নারীর প্রতি সহিংসতা নিয়েও তথ্য সংগ্রহ করুন। অবস্থা এমন থাকলে নারী ভোটার, নারী প্রার্থী সব হারিয়ে যাবে। এখন বড় দায়িত্ব নিতে পারেন নৌকা প্রতীকে জয়ী হওয়া নারী সংসদ সদস্যরা। দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্যে আপনাদের ভুমিকা দেখতে চাই। সুবর্ণচরের নারীকে যারা ধর্ষণ করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন। সামনে সংরক্ষিত আসনের মনোনয়ন শুরু হবে। এখানে দৌড়ঝাপ করার আগে প্রমাণ করুন আপনারা একটি দলের নয়, নারীদের প্রতিনিধি হয়ে এই আসনে বসবেন। সুবর্ণচরে গিয়ে সেই নারীর প্রতি সংহতি প্রকাশ করুন। তাহলেই বুঝবো, আপনাদের প্রতিনিধিত্বের প্রতি ভরসা রাখা যায়।
সুবর্ণচরের ঘটনার সর্বশেষ আঘাত এসেছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সাথে ভিকটিমের মারপিট ও ধর্ষণের শিকার হওয়ার কোনো সম্পর্ক খুঁজে পান নি। সারাদেশের মানুষ হতবাক হয়ে গেছে দেশের মানবাধিকার সংস্থার তদন্ত কমিটির এহেন কানা চোখের বিচার দেখে। তাঁরা প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছেন “ভিকটিমের স্বামীর দায়েরকৃত এজাহারের ভাষ্যমতে এটি আসামিদের সাথে ভিকটিমের পরিবারের পূর্বশত্রুতার জের।” আমরা এর তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।