ফকির লালন শাহ-এর গৌর পূর্ণিমার অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণঃ নবপ্রাণ আখড়াবাড়ি

“এমন বয়সে নিমাই ঘর ছেড়ে ফকিরী নিলে ধন্য মায়ের নিমাই ছেলে, ধন্য মায়ের নিমাই ছেলে” - ফকির লালন শাহ এবার ১৪২৩ বাংলা সালে গৌর পূর্ণিমা ২৭ ফাল্গুন (১১ মার্চ ২০১৭)। শ্রী গৌরাঙ্গ এই ফাল্গুনি পূর্ণিমাতেই নদিয়ায় নিজের আবির্ভাব ঘটান; অবতরণ করেন। জননী শচিদেবী সন্তানের নাম রেখেছিলেন ‘নিমাই’, তাঁর রূপের জন্য পাড়ার লোক নাম দিয়েছিল ‘গোরা’ (গৌরাঙ্গ), গুরু নাম দিয়েছিলেন কৃষ্ণচৈতন্য, সেখান থেকে চৈতন্য। তিনি নদিয়ার প্রথম ‘ফকির’। জ্বি, ‘ফকির। নদিয়ার সাধকদের কাছে তিনি ‘ফকির’ বলেই প্রসিদ্ধ। গৌর পূর্ণিমা নদিয়াবাসীদের জন্য জয়ধ্বণির দিন; ধন্যরে নদিয়াবাসী হেরিল গৌরাঙ্গ শশী যে বলে জীব সেই সন্যাসী লালন কয় সে প’ল ফেরে।। ধন্য নদিয়াবাসী, যারা গোরাচাঁদের আবির্ভাব দেখেছে। আর যে নিমাই অল্প বয়সে ফকিরি নিল তাকে যারা কেবল ‘জীব’ মাত্র জ্ঞান করে, লালন বলছেন তারা বিভ্রান্ত, তাদের এখনও জ্ঞানচক্ষু খোলে নি। নদের নিমাইয়ের আবির্ভাব মুহূর্তের হিসাব ধরে ছেঁউড়িয়ায় ফকির লালন সাঁই প্রবর্তিত ‘সাধুসঙ্গ’ ও বসন্তোৎসব হবে ২৭ থেকে ২৯ ফাল্গুন, ১৪২৩ (১১ – ১৩ মার্চ, ২০১৭)। এটাই অনেকের কাছে ‘দোল’ বা দোল উৎসব’ নামে পরিচিত। কিন্তু গৌর পূর্ণিমার তাৎপর্য ভুলে গেলে এই উৎসবের কিছুই আর অবশিষ্ট থাকে না। এ সময় কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় প্রতিবছর লাখ লাখ লালন অনুসারী, ভক্ত, অনুরাগী ও পরমার্থিক প্রেমের কাঙ্গাল নানান মনের আশেকান ছেঁউড়িয়ায় সাঁইজীর ধামে আসেন। প্রতি বছরের মতো এবারও আপনি এবং আপনার বন্ধু-বান্ধব নবপ্রাণ আখড়াবাড়িতে আন্তরিক ভাবে আমন্ত্রিত।
নবপ্রাণ আন্দোলন গৌরপূর্ণিমার দিন থেকে শুরু করে আখড়াবাড়িতে (সাঁইজীর ধামের উল্টোদিকে) তিন দিন একনাগাড়ে সাধুসঙ্গে একাত্ম হয়ে গৌরপূর্ণিমা ও বসন্তোৎসব পালন করে। এই তিনদিন নদিয়ার ভাব নিয়ে আনুষ্ঠানিক, অনানুষ্ঠানিক কিম্বা নানান ছোট ছোট দলে বাংলার ভাবান্দোলন নিয়ে নানান আলোচনা চলে। আনুষ্ঠানিক অনুষ্ঠানের মধ্যে ভোরে গোষ্ঠ গান থেকে শুরু করে সকাল, দুপুর ও সন্ধ্যায় লালনের গান পরিবেশন করা হয়। শুধু গান নয়, ফাঁকে গানের বাণীর ব্যাখ্যা এবং নদিয়ার ভাবের তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা হয়। আগত ভক্ত-শ্রোতাদের জন্য এই আলোচনা পরম আগ্রহের ও আনন্দের।
যারা নবপ্রাণ আখড়াবাড়িতে আতিথেয়তা নিয়ে থাকেন, তাদের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। ভক্ত ও অনুরাগীদের পদধূলি নিয়েই আখড়াবাড়ি নিজের রূপ নিয়ে দাঁড়ায়। নবপ্রাণ আখড়াবাড়ি একান্তই লালন সাঁইজীর ভক্ত ও অনুরাগীদের জায়গা। সারা বছরই। সারা বছর নদিয়ার ভাব প্রচার ও চর্চাই আমাদের কাজ। সারাবছরই এখানে ভক্ত ও অনুরাগীরা আসেন, আমরা তাঁদের যথাসাধ্য সেবা করার সুযোগ পেয়ে নিজেদের ধন্য মনে করি।
নবপ্রাণ আখড়াবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা ফকির লবান শাহ। এই সেই স্থান যেখানে ফকির লালন শাহ কালিগঙ্গার ঘাটে এসে বসন্ত রোগে মুমূর্ষু ভিড়েছিলেন মতিজান ও মলম শাহের শুশ্রূষায় আবার বেঁচে ওঠেন। এ ছাড়াও ফকির লবান শাহের সুখ্যাতি একারণে যে তিনি একই সঙ্গে বাংলার সাধনার ধারার সঙ্গে প্রাণ ও প্রকৃতির সুরক্ষার সম্বন্ধ অবিচ্ছেদ্য গণ্য করেছেন। এই সম্বন্ধজ্ঞান থেকে নয়াকৃষি আন্দোলনের উদ্ভব ও চর্চা, যা এখন দেশে বিদেশে পরিচিত। তিনি সাধুসঙ্গের সেবা বিধান পালন করার মধ্য দিয়ে ভাণ্ডের সঙ্গে ব্রহ্মাণ্ডের সম্বন্ধ বিচারের গুরুত্ব নতুন করে প্রতিষ্ঠা করেছেন; দেহাত্মবাদ যে নিছকই ‘গুহ্য’ কায়কারবার না, বরং খাদ্য গ্রহণের মধ্য দিয়ে অসীম ব্রহ্মাণ্ডের দেহের সঙ্গে মানুষের ক্ষুদ্র শরীরের অবিচ্ছিন্ন সম্বন্ধের উপলব্ধি চর্চা, এটা ফকির লবান শাহ নদিয়ায় যতো স্পষ্ট ভাবে তাঁর শিষ্য পরিকরদের বুঝিয়েছেন তার তুলনা মেলা ভার। তিনি বৃহৎ বঙ্গের ঐক্য সাধনার অংশ হিসাবে ‘সেবাবাদী’ না হবার তাৎপর্য ব্যাখ্যা ও নিজে সেবাবাদী না হবার জন্য প্রাণিজ আমিষ এবং পেঁয়াজ ও রসুন গ্রহণ ত্যাগ করেছিলেন। যদিও লালনপন্থায় সেবায় মাছ গ্রহণ সিদ্ধ। ‘দেহ’ সম্বন্ধে প্রচলিত প্রাচীন তান্ত্রিক ব্যাখ্যা শ্রীচৈতন্যের সময় থেকেই কিভাবে ভিন্ন হতে শুরু করেছে সেই দিকটাও বারবার তাঁর শিষ্যদের কাছে তুলে ধরেছেন। সর্বোপরী বস্তুনেশা পরিহার করে ভাবের নেশায় তরুনদের উৎসাহিত করা এবং একালে নদিয়ার সাধনার বৈশ্বিক তাৎপর্য বিভিন্ন ভাবে তুলে ধরেছেন। নবপ্রাণ আখড়াবাড়ি তারই দীক্ষা ও শিক্ষা প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য হাজার প্রতিকুলতা মোকাবিলা করে শুধুই নদিয়ার ভাব প্রচারের কাজে নিযুক্ত। গৌরপূর্ণিমা উপলক্ষ্যে সাধুসঙ্গ ও বসন্তোৎসবে নবপ্রাণ আখড়াবাড়ি দর্শন এ কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।এখানে নদিয়ার সাধুগুরুদের সঙ্গে কথা বলার যে সুযোগ আছে তা তরুণ প্রজন্মের জন্যে এক দুর্লভ পাওয়া।
আমাদের মিনতি
নবপ্রাণ আখড়াবাড়ি এবারও বাইরে থেকে আসা অতিথিদের স্বাগত জানাচ্ছে। তবে কিছু বিষয় সকলের নজরে রাখার জন্য কয়েকটি নিবেদন সকলের কাছে সবিনয়ে পেশ করছি।
আখড়াবাড়ি আঁচলাভিক্ষা ছাড়া চলতে পারে না। এ যাবত সারা বছর যারা এর ব্যয় নির্বাহ করেন এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানের খরচ জুগিয়ে চলেছেন আমরা তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ। তবে দিনে দিনে এর ব্যয়ও বিপুল ভাবে বেড়েছে। সেই দিকে আমরা সুধিজনের নজর আকাঙ্ক্ষা করি। আশা করি আখড়াবাড়ির আয়োজনে আপনারা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে অংশগ্রহণ করবেন।
অনেকে এই তিনদিন ছেঁউড়িয়ার দর্শনার্থী হিসাবে আসেন। তাঁরা স্বাগতম। যারা আখড়াবাড়িতে ওঠেন তাঁদের প্রতি মিনতি হচ্ছে আপনার সাধ্যমতো আমাদের সহায়তা করুন। যারা আখড়াবাড়িতে থাকবেন তাঁরা দয়া করে আমাদের আগে জানালে আমাদের সুবিধা হয়। আখড়াবাড়ির আয়োজনে অংশগ্রহণের জন্য তারা দিনপ্রতি কমপক্ষে ৫০০ টাকা স্বেছায় দান করবেন, এটাই আমাদের ন্যূনতম প্রত্যাশা। যাদের সাধ্য আছে তাঁরা সাধ্যমত নিশ্চয়ই আরও সহায়তা করবেন। আখড়াবাড়ি এই সময় ভক্তদের জন্য উন্মুক্ত। আপনার সহয়ায়তার অর্থ হচ্ছে দীনহীন ভক্তের জন্য আমরা আমাদের সেবা আরও সম্প্রসারিত করতে পারি।
যারা এবার ছেঁউড়িয়া যেতে চান তাঁরা নবপ্রাণ আখড়াবাড়ির প্রতিনিধি আব্দুল জব্বারের সাথে আগে যোগাযোগ করে আসবার চেষ্টা করবেন। এতে ব্যবস্থা ও আয়োজনের সুবিধা হয়।
আব্দুল জব্বারঃ ফোন ৮৮-০১৭১১৯৮৭৫৭১। ই-মেইলঃ আপনি ফেইসবুকে এখানে আমাদের ইনবক্সেও জানাতে পারেন।
আখড়াবাড়ির পরিবেশ রক্ষায় আমাদের সহায়তা করুন
আখড়াবাড়ী কোন ‘হোটেল’ নয়, কিম্বা কোন বাণিজ্যিক ভাবে পরিচালিত আবাসিক জায়গা নয়। এখানে মাটিতে বিছানা পেতে দেওয়ার অধিক সুবিধা আমরা দিতে পারি না। সম্ভব হলে বিছানা পাতার চাদর ও কম্বলও সঙ্গে রাখার অনুরোধ জানাই। এই সময় অনেকে একসঙ্গে পরস্পরের সঙ্গে কথাবার্তা বলাকেই গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। আসলে সাধুসঙ্গের এটাই প্রধান উদ্দেশ্য।
এখানে সেবার কিছু নিয়ম পালন করা হয়
১। আখড়াবাড়িতে কখনই মাংস বা ডিম পরিবেশন হয় না। কার্তিকে ও গৌরপূর্ণিমায় অনুষ্ঠান চলাকালীন দিনগুলোতে, কিম্বা ফকির লবান শাহের খিলকাধারী কোন সাধক কোন দিন আতিথেয়তা ও আসন গ্রহণ করলে কোন মাছও রান্না হয় না। রান্নায় কোন পেঁয়াজ বা রসুনও ব্যবহার করা হয় না। অনুষ্ঠানের সময় শুধু সব্জি-ডাল-ভাত কিম্বা খিচুড়ি তিন বেলা পরিবেশন করা হয়। সেবা পরিবেশনের সময় সবাই একত্রে সেবা নেবেন এটাই কাম্য। এটাই সাধুসঙ্গের আদর্শ। বিচ্ছিন্ন বা আলাদাভাবে কাউকে সেবা দিতে গেলে ব্যবস্থাপনা এলোমেলো হবার আশংকা তৈরি হয়।
২। আখড়াবাড়ীতে প্রতিদিন সকালে গোষ্ঠ গান গাওয়া ও অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক। যারা আখড়াবাড়িতে থাকবেন তারা ভোর বেলা সুর্য উদয়ের মুহূর্তে গোষ্ঠ গানে অংশ নেবেন এটা আমরা প্রত্যাশা করি। একই সাথে সন্ধ্যায় সুর্য ডোবার পর দৈন্য গানের আসর বসে। এই আসরে বসে গান শোনা এবং নিজে গান জানলে আপনি গাইবেন, এটাই নিয়ম। এখানে শিল্পী হবার কোন দরকার নাই। দৈন্যগানে অংশগ্রহণও সকল দর্শনার্থী অতিথিদের জন্য জরুরী।
৩। রাতে আখড়াবাড়ির বাইরে ঘুরতে গেলে দয়া করে রাত ১২টার অধিক সময় বাইরে থাকবেন না। আখড়াবাড়ীর গেট ১২ টার সময় তালা দেয়া হয়।
৪। মনে রাখবেন, আখড়াবাড়ি সম্পূর্ণ ধূমপানসহ জর্দা, সাদাপাতা মুক্ত।