সংরক্ষিত আসনে বিশেষ সুবিধা কার?
ফরিদা আখতার || Tuesday 30 October 2012 ||জাতীয় সংসদে সাধারণ আসন সংখ্যা ৩০০ আর নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন ৫০টি, অর্থাৎ মোট ৩৫০ টি আসন রয়েছে।কিন্তু সামনে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে এতো বিতর্কের মধ্যে যে বিষয়টি পরিস্কারভাবে কোন আলোচনায় আসছে না, সেটা হচ্ছে নির্বাচন আসলে কত আসনে হচ্ছে? জানি, অনেকে বলবেন, এখানে বলাবলির কি আছে, ৩০০ আসনে নির্বাচন হয়ে নির্বাচিত সদস্যরাই নারীদের মনোনয়ন (তাঁদের ভাষায় নির্বাচিত করে) দেবেন!সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচনের জন্য নারী আন্দোলনের দীর্ঘ দিনের দাবী উপেক্ষিত হচ্ছে ক্রমাগতভাবে।
হ্যাঁ, দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এটাই নিয়ম সাংবিধানিকভাবে। ১৯৭১ সালে নয়মাসের মুক্তিযুদ্ধের পর একটি স্বাধীন দেশ হিশাবে আমরা যে সংবিধান পেলাম তার ‘পঞ্চম ভাগ’ আইনসভার ধারা ৬৫(১) এবং ৬৫(২) -এ সাধারণ আসনের কথা বলা হয়েছে। মুশকিল বেঁধেছে ৬৫(৩) ধারা নিয়ে, যেখানে বলা আছে,
৬৫। (৩) এই সংবিধানের প্রবর্তন হইতে দশ বছর কাল অতিবাহিত হইবার অব্যবহিত পরবর্তীকালে সংসদ ভাঙ্গিয়া না যাওয়া পর্যন্ত ১৫টি আসন কেবল মহিলাদের জন্যে সংরক্ষিত থাকিবে এবং তাঁহারা আইনানুযায়ী পুর্বোক্ত সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত হইবেন। তবে শর্ত থাকে যে,এই দফার কোন কিছুই এই অনুচ্ছেদের (২) দফার অধীন কোন আসনে কোন মহিলার নির্বাচন নিবৃত্ত করিবে না। অর্থাৎ মহিলারা অবশ্যই সাধারণ আসনে নির্বাচন করতে পারবেন।সাধারণ আসন নারী-পুরুষ সবার জন্য, আর সংরক্ষিত আসন শুধুই নারীদের জন্য।
বর্তমান সংসদ তার একটি ভাল উদাহরণ যেখানে সাধারণ আসনেও নারী আছেন, আর সংরক্ষিত আসনে তো বটেই। এখন মোট ৩০০ আসনের মধ্যে ১৯ জন নারী পুরুষ প্রার্থীদের সাথে প্রতিদ্বন্দিতা করেই নির্বাচন করে এসেছেন, যা মোট আসনের মাত্র ৬%।এক্ষেত্রে পৃথিবীর অনেক দেশ থেকে আমরা পিছিয়ে আছি।আর ৫০টি সংরক্ষিত আসন ধরে ৩৫০টি আসনের মধ্যে নারীদের মোট সংখ্যা হয় ৬৯ জন, যা মোট আসনের ১৯% । যে কয়জন সাধারণ আসনে জয়ী হয়েছেন তাঁদের মধ্যে মন্ত্রিত্ব পেয়েছেন ৪ জন।কাজেই ইমেজের দিক থেকে দেখতে গেলে নারীদের জন্যে এই আসন দেশের জন্যে ভাল।কিন্তু আসল চিত্র কি তাই?
শুরুতেই বলে রাখি জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন নিয়ে কথা বলার অর্থ এই নয় যে যারা সেখানে যাবেন, আমরা ধরে নিচ্ছি যে তাঁরা জনগণের পক্ষে এবং বিশেষ করে নারীদের জন্যে নিজেদের উৎসর্গ করে দেবেন।এটা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে রাজনৈতিক দল এবং তাঁদের আদর্শের ওপর।নির্বাচন এবং গণতন্ত্র যে এক কথা নয় সে ভ্রম আমাদের নিষ্ঠুরভাবে ভেঙ্গে গেছে।নারী হিসেবে বুঝেছি আরও কঠিনভাবে। আমরা প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলীয় প্রধান পেয়েছি নারী; স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র, কৃষি, শ্রম - অর্থাৎ বেশ গুরুত্বপুর্ণ এবং দায়িত্বশীল স্থানেই নারীদের পেয়েছি। কিন্তু হায়! সমাজটাই যেখানে পুরুষতান্ত্রিক, এরা সেই কাঠামোতে গিয়ে নারীদের স্বার্থ বলি দিয়ে দিলেন। কাজেই কোন আশা নিয়ে নয়, জাতীয় সংসদের এই আসন গুলোর একটা মীমাংসা হওয়া দরকার,সে কারণেই প্রসঙ্গের অবতারনা করছি।আমাদের সাফ কথা হচ্ছে যদি জনগণ তাঁদের নির্বাচিত না করতে পারে তাহলে বোনাস এবং বিশেষ সুবিধার আসনের দরকার কী?
একটু পেছেনের দিকে যাওয়া যাক। স্বাধীন দেশে শুরু হোল নারীদের প্রতি ‘বিশেষ দৃষ্টিতে’ জাতীয় সংসদে অংশগ্রহণের ব্যাপারটি। নিয়ত ভাল ছিল কিন্তু ফলাফল দাঁড়িয়েছে ভিন্ন। রাজনৈতিক দলের নারী কর্মীদের নিজেদের মতো করে নির্বাচনী এলাকায় কাজ না করে বসে থাকলেই হবে। দল সংখ্যাগরিষ্টতা পেলে তাদের ভাগে আসন জুটে যেতে পারে, সেই আশায় (গোঁফ তো নাই)মাথার চুলে তেল দিতে থাকবে। আজকাল নারী আসনের জন্যে প্রার্থী সংখ্যা বাড়ছে,তাই বাড়ছে প্রতিযোগিতা। কিন্তু যেহেতু ভোটার এর সাথে সম্পৃক্ত নয়, তাই তদবির ও তোয়াজ করে নেতাদের কাছে যোগ্যতা প্রমাণ করতে হচ্ছে।এটা কি অপমানজনক নয়?
জাতীয় সংসদে সদস্য সংখ্যা প্রথম ১০ বছরের জন্য ৩০০ আসনের সাথে নিবার্চিত সংসদ সদস্যদ্বারা নির্বাচিত হয়েছেন ১৫ জন নারী।মোট সদস্য সংখ্যা হোল ৩১৫।সে সময় সাধারণ আসনে কোন মহিলা ছিলেন না, তাই মনে করা যেতে পারে এই ১৫টি আসন সংরক্ষিত না থাকলে মহিলাদের জাতীয় সংসদে অংশগ্রহণ শুরুই করা যেতো না।এটা ছিল বিশেষ মেয়াদের জন্য ‘বিশেষ সুবিধা’। ধারণা করা হয়েছিল যে ১০ বছর অর্থাৎ সংসদের দুটি মেয়াদ পূর্ণ হবার পর মহিলাদের এই ধরণের বিশেষ সুবিধা আর না দিলেও চলবে। এরপর তাঁরা সাধারণ আসনের নির্বাচনের মাধ্যমে আসতে পারবেন।সেটা অবশ্যই পারতেন যদি বিশেষ সুবিধাটা সরাসরি নির্বাচনের আওতায় আনা হোত। কিন্তু সেটা করা হয় নি, পরিণতি হয়েছে এই যে, নারীদের শক্তিশালী রাজনৈতিক নেতৃত্বে আনার চেষ্টা করা হয় নি, দু’একজন আসতে পারলেও বেশীর ভাগ থেকে গেছেন দয়া বা করুণার ওপর।শিশু যতদিন হাটতে শেখে নি তত দিন কোলে নিতে হয়,বয়স বাড়ছে কিন্তু কোল থেকে না নামালে হাটবে কীভাবে?
এখন ২০১২ সাল, চলছে নবম জাতীয় সংসদ।দুঃখ এবং লজ্জার সাথে বলতে হচ্ছে সংরক্ষিত আসন বিলুপ্ত করা হয় নি,বরং বেড়েছে। আগে ৩০০ জন মিলে ১৫ জনকে মনোনীত করতেন, এখন করতে হয় ৫০ জনকে। এর মধ্যে সরাসরি নির্বাচনের দাবীর পর একটু গণতান্ত্রিক হয়েছে এইভাবে যে আগে শুধু একচেটিয়া সংখ্যাগরিষ্ট দল করতো, এখন আনুপাতিক হারে বিরোধী দলও মনোনীত করতে পারে। তাই নবম জাতীয় সংসদের শুরুতে ৪৫টি আসনের মধ্যে বিরোধী দল ৫টি আসন লাভ করেছে।কিন্তু মাঝখানে এসে যখন সরকারী দল আরও ৫টি আসন বাড়ালো তখন তার ভাগ আর কেউ পেলো না।এটা যেন সরকারী দলের এখতিয়ার। অর্থাৎ নারীদের জন্যে বিশেষ সুবিধা বলা হলেও দলের জন্যেই বোনাস বা দলের বিশেষ সুবিধা ছাড়া আর কিছুই নয়।দলের অনেক নারী কর্মী নেতৃত্বের পর্যায়ে এসেও কোন স্বীকৃতি পান না। স্বীকৃতি মানে একটি আসন দিয়ে দাও। মন্দ কী?
এ কথা বলতেই হবে যে সংরক্ষিত আসন সংখ্যা বৃদ্ধি করে সংসদে নেতৃত্বদানকারী বা সংখ্যাগরিষ্ট দলের বেশ লাভ হয়।এই নারী সদস্যরা নিষ্ঠার সাথে সংসদের অধিবেশনগুলোতে আসেন, সাধারণ আসনের সদস্যদের ‘অন্য’ কাজ বেশী। সংসদ নেত্রী উপস্থিত থাকলে সাধারণ আসনের সদস্যদের উপস্থিতির সংখ্যা বাড়ে, নইলে বিরোধী দলের মতোই তাঁরাও ‘নিয়মিত বর্জন’ করে চলেন।টেলিভিশনে সংসদ চেনেল থাকায় এই বিষয়টি আমরা দেখতে পারি।সংসদে নারীরা না থাকলে মাননীয় স্পীকারকে শূন্য আসন সম্বোধন করেই কথা বলতে হোত।নারী সদস্যদের ক্ষমতা বা সুযোগ নেই তেমন কিছু করার, কিন্তু তাঁরা প্রশ্ন করছেন,নির্দিষ্ট নির্বাচনী এলাকা না থাকলেও যার যার জেলার উন্নয়নের কথা বলছেন। নেতা নেত্রীর গুনগান করছেন।জাতীয় সংসদ সদস্য হিশেবে সমাজে সমাদৃত হচ্ছেন, বিশেষ বা প্রধান অতিথি হয়ে অনুষ্ঠান করছেন।আমি যতোবার নিজে সংরক্ষিত আসনের সদস্যদের সভায় গেছি, আমি তাঁদের আন্তরিকতা দেখেছি, দেশের জন্যে কাজ করার মানসিকতাও দেখেছি। কিন্তু একই সাথে দেখেছি কোন প্রতিশ্রুতি দিতে না পারার অসহায়ত্ব।
আমি জানি না,হয়তোবা তাঁরা এ কথা স্বীকার নাও করতে পারেন, কিন্তু ‘ক্ষমতাহীন’ বা দ্বিতীয় শ্রেণীর সংসদ সদস্য হয়ে তাঁরা গণতন্ত্রের স্বাদ কতটুকু ভোগ করতে পারছেন, এই কথা তাঁদের বলার সময় হয়েছে। তাঁরা সংসদ সদস্য,অথচ নীতি নির্ধারণীতে তাঁদের কথা কতটুকু শোনা হয় বা গুরুত্ব দেয়া হয়? সাধারণ আসনের সদস্য যারা বহু টাকা খরচ করে এবং ভোটারের বাড়ী বাড়ী গিয়ে ভোট চেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন তাঁদের কাছে এই সংসদ সদস্যদের গুরুত্ব নেই। তাঁরা তো ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি নন। তাদের মনোনয়ন দিয়েছেন দলের নির্বাচিত নেতারা।তাহলে কাদের কাছে দায়বদ্ধ তাঁরা? জনগণ তো নয়ই এমন কি নারীদের প্রতিনিধিত্বও তাঁরা করছেন না।এটা তো তাঁদেরই ব্যক্তিগতভাবে ‘বিশেষ সুবিধা’ পাওয়া। জনপ্রতিনিধি হবার সুযোগ তো বন্ধ করে রাখা হয়েছে সংবিধানেই।এভাবেই কি চলবে এবারের নির্বাচনেও?
বিশেষ সুবিধার অসুবিধা হোল যে একবার শুরু করলে বন্ধ করা যায় না। কারণ এর সাথে গোষ্টি-স্বার্থ যুক্ত হয়ে যায়। তাই যে উদ্দেশ্যে প্রথম আসন সংরক্ষণ করা হয়েছিল পরবর্তিতে তা আর সেভাবে থাকে নি। যাদের জন্যে করা তাদের মধ্যে ভাব এই যে এই পদ্ধ্বতিতে সহজভাবে পাওয়ার বিষয় হয়ে গেছে।অন্যদিকে বড় রাজনৈতিক দলগুলো ধরেই নেয় যে ৩০০ আসনে যে কোন একটি দলের সংখ্যাগরিষ্টতা থাকবে এবং তারাই এই বোনাসের ভাগ পাবে। ১৯৯১ সাল থেকে বিএনপি-আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে পালা করে, এবং এই আসন নিয়ে তাদের মতো করে সংবিধান পরিবর্তন করেছে, কিন্তু সরাসরি নির্বাচন নিয়ে নারী আন্দোলনের দাবীর প্রতি সম্পূর্ণ অবহেলা করেছেন। এমন কি নির্বাচনী ইশতিহারে প্রতিশ্রুতি দিয়ে রক্ষা করে নি।সংরক্ষিত আসনে তিনটি দিক আছে। একঃ আসন সংখ্যা, দুইঃ মেয়াদ এবং তিনঃ নির্বাচন পদ্ধতি। প্রথম দুটি বেড়েছে ১৯৭৮ সাল থেকে সংবিধানের ৬৫(৩) অনুচ্ছেদে প্রথমে আসন সংখ্যা ১৫ থেকে ৩০ এবং মেয়াদ ১০ থেকে ১৫ বছর বাড়ানো হয়।১৯৮৭ সালে প্রথম ১৫ বছরের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে কিন্তু আবারো ১০ বছরের জন্য বাড়ানো হয়। সংবিধান (দশম সংশোধন)-আইন, ১৯৯০ প্রবর্তন কালে আবার ১০ বছর বাড়ানো হয়।
স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় থেকে ঐক্যবদ্ধ নারী সমাজ ১৯৮৭ সালে প্রথম দাবী করেছে, সংরক্ষিত আসন ২টি মেয়াদ আরো রাখা যেতে পারে তবে সরাসরি নির্বাচন দিতে হবে এবং রাজনৈতিক দলগুলো সাধারণ আসনে মনোনয়ন দিতে হলে কমপক্ষে ২০% মনোনয়ন দিতে হবে।সাধারণ আসনে নারীদের নির্বাচনের জন্য মনোনয়ন না দেয়ার কারণ হিশেবে বলে হয় নারীদের নাকি টাকা ও মাস্তান পাওয়ার নেই। কাজেই জিতবে না।রাজনৈতিক দল্গুলো ধরে নেয় যে নারী কর্মীদের জন্যে তো সংরক্ষিত আস্ন রয়েছে। এখন দলের জন্যে কাজ করুক, জিতলে একটি আসন দিয়ে দেয়া যাবে।
নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলাপ করতে চাচ্ছেন। কিন্তু তাঁদের এজেণ্ডা কি? নির্বাচন কমিশন কি ৫০টি সংরক্ষিত আসনের মালিকানা সম্ভাব্য সংখ্যাগরিষ্ট দলের হাতে সঁপে বসে আছেন? এই আসন গুলোর সাথে যদি জনগণের কোন সম্পর্ক না থাকে তাহলে এই আসন রাখার দরকার কি? এই আসনের নির্বাচন সরাসরি হলে শুধু রাজনৈতিক দলের কর্মী নয়, নারী আন্দোলন কর্মীরাও অংশ নিতে পারেন এবং জনগনের ভোট নিয়ে জাতীয় সংসদে আসতে পারেন।
আমরা রাজনৈতিক দলের কাছে আর দাবী করবো না, কারণ তাঁরা বেইমানী করেছে। নির্বাচনের কমিশনের কাছেই আমাদের প্রশ্ন, এবারের নির্বাচন কত আসনের হচ্ছে? বিশেষ সুবিধা কারা এবং কিভাবে পাচ্ছে?