জামদানি ও জিওগ্রাফিকাল ইন্ডিকেশান
প্রবর্তনা || Friday 21 October 2016 ||ভূগোল, পরিবেশ, ইতিহাস, হাতের কাজ বা কারুশিল্পের ঐতিহ্য – ‘জামদানি’ নামটির মধ্যে এ সবেরই বুনুনি নিহিত রয়েছে। জামদানি নামের সঙ্গে ‘ঢাকা’ নামটিও জড়িত। সম্ভবত আদিতে এর নামও ছিল শুধু ‘ঢাকাই’, মুঘল আমলে ইরান থেকে আসা বিভিন্ন পাত্রে ফুলকারি নকশা আঁকা পাত্র আমদানি হয়ে এল। ফারসি ভাষায় ‘জাম’ মানে ফুল আর ‘দানি’ মানে পাত্র। পাত্রে আঁকা ফুলের নকশা তাঁতে তুললেন তাঁতীরা। তাঁতে ফুলকারি নকশা তোলার ঐতিহ্য চালু হওয়ার ফলে ‘ঢাকাই’ কাপড় একসময় ‘জামদানি’ নাম পরিগ্রহণ করল।
মনে রাখতে হবে ‘জামদানি’ নকশার নাম, কাপড় বোনার পদ্ধতি ঢাকাইয়া বা ‘ঢাকাই’। এখন জামদানি মানে তাঁতে ঢাকাই পদ্ধতিতে কাপড়ে ফুলের নকশা করা। বলা বাহুল্য নকশা এখন আর শুধু ফুলের না, নানান রকম হয়। তাঁতশিল্পিরাও শিল্পী, তাঁদের সৃষ্টিশীল প্রতিভার অন্ত নাই। বাংলাদেশে তাঁতও নানান রকম। তাঁতে বোনার পদ্ধতিও বিভিন্ন ও বিচিত্র। বিভিন্ন এলাকার তাঁতের ঐতিহ্যও আলাদা। একরকম নয়। টাঙ্গাইল এলাকার তাঁতীরা জামদানির নকশা অনুকরণ করে যে কাপড় বোনে তাকে অনেক সময় টাঙ্গাইল জামদানি বলা হয়, কিন্তু টাঙ্গাইল তার নিজের একটা চরিত্র অর্জন করে নিয়েছে। এখন তা ‘টাঙ্গাইল বুটি’ নামে খ্যাত। জামদানির মতো টাঙ্গাইল বুটি শাড়ীরও বিশেষ আভিজাত্য আছে।
তাই জামদানি মানেই ‘ঢাকাই জামদানি’। ঢাকার বাইরে অন্য কেউ কাপড় বোনার কারিগরি চুরি করে নিয়ে গিয়ে নিজের দেশে কাপড় বোনার ধরণ নকল করতেই পারে, কিন্তু তাকে ‘জামদানি’ বলা ভুল। কারণ জামদানির নিজের দেশ ও ইতিহাস আছে। তার ‘জায়গা’ আছে। সেই জায়গা চিহ্নিত করবার জন্য বর্তমান বিশ্ববাণিজ্যের যুগে দাবি প্রবল উঠেছে। কারন এই চিহ্নিত করনের সঙ্গে একটি দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থ জড়িত। আপনি পাশের দেশ হতে পারেন, জামদানি আপনার দেশের জিনিস না। কিন্তু আপনি আপনার দেশ থেকে জামদানি ধরনের কাপড় বুনে আন্তর্জাতিক বাজারে দাবি করতে পারেন না যে এটাই ‘জামদানি’। ভারত যেমন ‘উপাধ্যায়’ বিশেষণ জুড়ে ‘উপাধ্যায় জামদানি’ নাম দিয়ে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছে। অন্য কেউ এভাবে জিওগ্রাফিকাল ইন্ডিকেটরের দাবি করলে জামদানির আন্তর্জাতিক বাজার থেকে ঢাকার সোনারগাঁও এলাকার তাঁতীদের বঞ্চিত করা হয়। জামদানির উৎপত্তি যাদের হাতে তাদের বঞ্চিত করা অন্যায়। বাংলাদেশের জন্য সেটা ভাল কোন খবর নয়। এতে জামদানির আন্তর্জাতিক বাজার হারাবার বিপদ আছে।
তাহলে জায়গা শনাক্ত করা, আন্তর্জাতিক ভাবে তা জানিয়ে দেওয়া এবং তার স্বীকৃতি আদায় করা অর্থনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। নিজের দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করবার জন্যই বাংলাদেশের উচিত ছিল বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় পণ্য উৎপাদনের জায়গা নির্দেশনার বিধান গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া। সেটা গুরুতর বিষয় হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই যেসব পণ্যের উৎপত্তি বাংলাদেশে এবং একমাত্র বাংলাদেশেই যাদের চরিত্রগুণ বজায় রেখে উৎপাদন সম্ভব, অন্যত্র অসম্ভব -- তার জন্য উৎপত্তি নির্দেশক অধিকার দাবি করা। উৎপত্তি নির্দেশক অধিকারকেই আন্তর্জাতিক বিধিবিধানে Geographical Indicator বলা হয়। এর কটমটে আক্ষরিক অনুবাদ হচ্ছে ‘ভৌগলিক নির্দেশক’। সোজা কথায় কোথায় কি উৎপন্ন হয় সেই জায়গাগুলো শনাক্ত করা ও নিজ নিজ দাবির পক্ষে সার্টিফিকেট জোগাড় করা। পদ্মার ইলিশ, বাংলাদেশের পদ্মা নদিতেই উৎপন্ন হয়, সিন্ধু বা মেকং নদিতে হয় না। জামদানিও তেমনি বাংলাদেশের ঢাকাতেই তৈরি হয়। তেমনি বিভিন্ন জাতের আম, কালিজিরা, রাঁধুনিপাগল কাটারিভোগের মতো সুগন্ধি চাল ইত্যাদির উৎপত্তিস্থল হিসাবে বাংলাদেশ উৎপত্তি নির্দেশক অধিকার বা জিওগ্রাফিকাল ইন্ডিকেটরের বাণিজ্যিক সুবিধা দাবি করতে পারে। অন্তত জামদানির ক্ষেত্রে একটা সাফল্যের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি বা মেধাস্বত্ব নিয়ে গভীরতর তর্ক থাকলেও, এটা খুশির কথা।
আন্তর্জাতিক পরিভাষায় জিওগ্রাফিকাল ইন্ডিকেটর (জি-আই) কিম্বা উৎপত্তি নির্দেশক জায়গা শনাক্তকরণ ব্যাপারটির ব্যাখ্যা হচ্ছে এরকম:
‘A geographical indication (GI) is a sign used on products that have a specific geographical origin and possess qualities or a reputation that are due to that origin. In order to function as a GI, a sign must identify a product as originating in a given place. In addition, the qualities, characteristics or reputation of the product should be essentially due to the place of origin. Since the qualities depend on the geographical place of production, there is a clear link between the product and its original place of production’.
উৎপত্তি নির্দেশক চিহ্ন হচ্ছে পণ্যকে বিশেষ চিহ্ন দিয়ে চিহ্নিত করে রাখা, যার উৎপত্তির বিশেষ ভৌগলিক পরিবেশ রয়েছে। এর গুণ বা খ্যাতিও সেই বিশেষ জায়গার কারণেই।জি-আই হিসাবে কার্যকর রাখতে হলে পণ্যকে একটি চিহ্ন দিয়ে অবশ্যই চিহ্নিত করতে হবে যাতে পণ্যটির উৎপত্তি যে একটি বিশেষ জায়গায় সেটা বোঝা যায়। তদুপরি পণ্যটির গুণাবলী অথবা খ্যাতি সেই ভোগলিক উৎপত্তিস্থলের কারণে হতে হবে।যেহেতু পণ্যের গুন বিশেষ জায়গায় তার উৎপত্তির সঙ্গে জড়িত, তাহলে পণ্য তার উৎপত্তিস্থলের মধ্যে স্পষ্ট একটা সম্বন্ধ রয়েছে।
কোনো একটি দেশের নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের মাটি, পানি, আবহাওয়া ও সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা এবং সেখানকার জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি যদি কোনো একটি পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে নির্ধারক ভূমিকা পালন করে,তাহলে সেটিকে সেই দেশের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। অর্থাৎ, সেই পণ্য শুধু ওই এলাকায় উৎপন্ন না হলে তাকে তার সেই বিশেষ নামে ডাকা যাবে না। ভৌগলিকতা পণ্যটির পরিচয় বহন করবে। একই সঙ্গে পণ্যটিকে কেন্দ্র করে তার উৎপাদকদের বিশেষ বাণিজ্যক অধিকারো থাকবে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের দিক থেকে এর গুরুত্ব অপরিসীম। কেউ জামদানির কারিগরি চুরি করে নিজের দেশে বানালে সেই পণ্য ‘জামদানি’ নামে বিক্রি করতে পারবে না। বাণিজ্যের দিক থেকে জায়গা বা উৎপত্তিস্থলের স্বীকৃতি এক ধরণে অর্থনৈতিক স্বার্থ সুরক্ষাও বটে। প্রবর্তনা দীর্ঘদিন ধরে অনেকের সঙ্গে এই স্বার্থ অর্জনের জন্য চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে। এই স্বীকৃতি তাই প্রভূত আনন্দের।
দুই
তো ‘জামদানি’ কে স্রেফ কাপড় বা পণ্য ভাবলে ভুল হবে। ‘জামদানি’ হচ্ছে বিশেষ ভূগোল ও পরিবেশে শিল্পকলা চর্চার বিশেষ একটি ধরণ যার মাধ্যম হচ্ছে তাঁত, মাকু, রং এবং সুতা। স্রেফ কাপড় হিসাবে এর ব্যবহার ছিল। এখনও আছে। তবে বাংলাদেশের মেয়েদের অত্যন্ত প্রিয় শাড়ী ঢাকাই জামদানি। শাড়ী হিসাবেই এখন জামদানির গৌরব।
তাঁতে বিশেষ শৈল্পিক কায়দায় ফুলকারী নকশা তোলা নিবিড় মনোযোগ ও নিষ্ঠা দাবি করে। তাঁতশিল্পীর বিশেষ শিল্পকর্ম হিসাবে এর কদর আলাদা।
‘জামদানি’ একই সঙ্গে ব্যবসাও বটে। বিশ্বব্যাপী বাজার সম্প্রসারণ ও ব্যবসার প্রতিযোগিতার মুখে বুদ্ধি ও শিল্পপ্রতিভা থেকে জাত আবিষ্কার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আবিষ্কারের অর্থনৈতিক মূল্য আছে। তাই এর ওপর মালিকানা স্বত্ব দাবির প্রশ্ন উঠেছে। এই মালিকানা বা ব্যাক্তিগত সম্পত্তির বিশেষ ধরণকে বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি (Intellectual Property Rights) বা মেধাস্বত্ব বলা হয়।
‘জামদানি’ কোথাকার, কাদের, তার মালিক কারা ইত্যাদি নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে তর্ক চলছিল অনেক দিন। মনে হচ্ছে সম্প্রতি মেধাস্বত্ব নিয়ে এই কাড়াকাড়ির অবসান ঘটেছে। আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ববিষয়ক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল প্রোপার্টি রাইটস অর্গানাইজেশনের (আইপিও) নিয়ম মেনে জামদানি বাংলাদেশের বলে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির ধাপগুলো শেষ করেছে। জামদানিকে বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিওগ্রাফিক্যাল ইনডিকেশন—জিআই)পণ্য হিসেবে ঘোষণার পর্যায়গুলো সমাপ্ত হয়েছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনকে (বিসিক) এই জিআই স্বত্ব দেওয়া হয়েছে।
জামদানির উৎপত্তি ও বিকাশ বাংলাদেশে, এই দেশই তার আদিভূমি। তারই পাকাপাকি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়া গেল। ভারতের অন্ধ্র প্রদেশ থেকে এর আগে ‘উপাধ্যায় জামদানি’ নামের একটি শাড়ির নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে। ‘জামদানি’ নামযুক্ত করে ভারতের নিবন্ধন বিতর্ক সৃষ্টি করেছিলো। তবে শুধু ‘জামদানি’ নামে নিবন্ধন চেয়ে কেউ দাবি করেনি।
আইপিও (IPO) থেকে বাংলাদেশের জিআই পণ্য নিবন্ধন দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অন্তর্ভুক্ত সংস্থা পেটেন্ট ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তরকে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী কোনো পণ্যের ভৌগোলিক নির্দেশকের (জিআই) জন্য নিবন্ধন নিতে হয়।
‘প্রবর্তনা’ জামদানির স্বীকৃতি আদায়ের এই উদ্যোগের সাথে দীর্ঘদিন সক্রিয়ভাবে নানান দিক থেকে কাজ করেছে, তাই এই স্বীকৃতিকে প্রবর্তনা স্বাগত জানাচ্ছে।