সোনার হৃৎপিন্ড পান
ড. এম এ সোবহান || Sunday 20 October 2019 ||পান একটি বহুবর্ষজীবি চিরহরিৎ লতা। মানুষের হৃৎপিন্ডের আকৃতির সাথে পানপাতার সাদৃশ্য লক্ষণীয়। কৃষি সভ্যতা বিকাশের বহু আগে থেকে মালয়শিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলংকা, মায়ানমার, ভারত, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম ও লাওসে পান পাতা ব্যবহারের নিদর্শন পাওয়া যায় (খ্রীষ্টপূর্ব ২৬০০-৭০০০)। পানের আদি নিবাস মালয়শিয়া। পরবর্তিতে চীনা ও আরব বনিকরা এশিয়ার বিভিন্ন দেশে পানের আবাদ ও ব্যবহার বিস্তার করেন। পরে মাদাগাস্কারসহ পূর্ব আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে পানের আবাদ ও ব্যবহার সম্প্রসারিত হয়। আরো পরে মধ্য আমেরিকা পর্যন্ত পানের আবাদ সম্প্রসারিত হয়।
দীর্ঘকাল ধরে দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় পান সামাজিক ও আচারগত ব্যবহার হিসাবে চলে আসছে। যেমন জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ, যে কোন চুক্তি সম্পাদন পান খাওয়ার মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয়।
এখনও বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পান ছাড়া কোন সামাজিক অনুষ্ঠান হয় না। কিছুকাল আগেও বাংলাদেশের সাগর তীরবর্তী দক্ষিণ অঞ্চলে বিশেষ করে বরিশাল অঞ্চলে বরযাত্রী বরণ করার সময় পান সাজিয়ে দিয়ে বর পক্ষের দিকে কনে পক্ষ থেকে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়া হতো:
“পান খাও পন্ডিত ভাই কথা কও ঠারে
পান সুপারী জন্ম হইছে কোন অবতারে”।
এ নিয়ে দুপক্ষের মধ্যে কাব্যিক ভাব বিনিময় চলতো বহু সময় ধরে।
তবে দিনে দিনে পানের ব্যবহার কমে আসছে। কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের পরে দক্ষিণ আমেরিকা থেকে তামাক প্রথমে স্পেনীয় এবং পর্তুগীজ নাবিকদের মাধ্যমে, পরে ওলন্দাজ ও ইংরেজদের মাধ্যমে এশিয়া মহাদেশে তামাক প্রবর্তন হয়। আস্তে আস্তে তামাক পানের জায়গা দখল করে নেয়। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে সাদাপাতা, আলাপাতা, তামাকপাতা, জর্দা ইত্যাদি রুপে পানের ভিতরে অনুপ্রবেশ করে। হাজার বছরের সামাজিক রীতি ভুলে এ অঞ্চলের মানুষ তামাকের নেশায় ডুবে যায়।
পান একটি বৈদিক পণ্য। বেদ শাস্ত্রে পানের নাম সপ্তশিরা। পানের সংস্কৃত নাম তাম্বুল। বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় পানের ব্যবহার চলে আসছে। পান কখনও এককভাবে, আবার কখনও অন্য ওষুধের অনুপান হিসাবে ব্যবহার হয়ে আসছে। হৃৎপিন্ডের শক্তি বৃদ্ধি অথবা রক্ত সঞ্চালন নিয়ন্ত্রণের জন্য পান ব্যবহার করা হয়। ইউনানী মতে পান ব্রেইন, হৃৎপিন্ড ও লিভারের টনিক হিসাবে কাজ করে। পিপসা নিবারণ করে, গলা সাফ করে এবং রক্ত পরিস্কার করে। পানের রস হজম শক্তি বাড়ায়। শরীরের ঘা সারায়। পান পাতার রস ফোড়া, কনজাঙ্কটিভাইটিস, কোষ্ঠকাঠিণ্য, মাথাব্যথা, স্তন প্রদাহ, শ্বেত প্রদর, কর্ণগ্রন্থি প্রদাহ, রিউমাটিজম, কফ এবং ব্রনকাইটিস চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়।
পান পাতার রস পুরুষের প্রজনন দক্ষতা কমিয়ে দেয়। অন্যদিকে পান গাছের শিকড়ের রস মহিলাদের ওরাল কন্ট্রাসেপটিভ হিসাবে কাজ করে।
পান পাতায় আছে ব্যাপক ভিত্তিক ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধী ক্ষমতা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ষ্ট্রেপটোকক্কাস, ষ্টেফাইলোকক্কাস, ই-কলাই, এনটারোকক্কাস ইত্যাদি। এছাড়াও পান পাতায় আছে ছত্রাকজনিত রোগ প্রতিরোধি ক্ষমতা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ত্বক, চুল ও নখের রোগ সৃষ্টিকারী ছত্রাক যেমন- ট্রাইকোফাইটন, মাইক্রসপোরাম এবং ইপিডারমোফাইটন।
পান পাতার রস পাকস্থলির অভ্যন্তরে নানা কারণে সৃষ্ট ঘা সারাতে সহায়তা করে। পান পাতার রস মানবদেহে এন্টিঅক্সিডেন্ট হিসাবে জটিল রোগ যেমন-ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, ক্যান্সার ইত্যাদি প্রতিরোধ করতে সহায়তা করে।
পানের পুষ্টিগুণ:
পান পাতায় আছে পানি (৮৫-৯০%), আমিষ (৩-৩.৫%), শর্করা (০.৫-৬.১%), খনিজ লবণ (২.৩-৩.৩%), চর্বি (০.৪-১.০), আঁশ (২.৩%), অত্যাবশ্যকীয় চর্বি (০.০৮-০.২%) ট্যানিন (০.১-১.৩%)। এছাড়াও আছে ভিটামিন যেমন: ভিটামিন সি (০.০০৫-০.০১%), ভিটামিন এ (১.৯-২.৯ এমজি/১০০ গ্রাম), থায়ামিন (১০-৭০ এমজি/১০০ গ্রাম)। আরো আছে ক্যালসিয়াম (০.২-০.৫%), আয়রন (০.০০৫-০.০০৭%), আয়োডিন (৩.৪ এমজি/১০০ গ্রাম), ফসফরাস (০.০৫-০.০৬%) এবং পটাসিয়াম (১.১-৪.৬%)।
ভেষজ নৈতিকতা:
মানুষের হৃৎপিন্ডের আকৃতি সাদৃশ পান পাতা সেবনে হৃদযন্ত্রের শক্তি বৃদ্ধি পায়, রক্তচাপ স্বাভাবিক হয় এবং হৃদ স্পন্দনের শৃংখলা নিশ্চিত হয়। পান পাতার রস লিভারের দক্ষতা বাড়াতে সহায়তা করে। খাবার গ্রহণের পরে পান সেবনের ফলে দাঁতে রোগ সৃষ্টিকারী অনুজীবের কার্যকলাপ ও বংশবৃদ্ধি প্রতিহত করে দাঁত ও মুখের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করে। তবে পানের সাথে কোনক্রমেই তামাক পাতা ও জর্দা গ্রহণযোগ্য নয়।
উপসংহার:
পানে লিভার সুরক্ষার উপাদান এবং ডায়াবেটিস, সন্ন্যাস ও ক্যান্সার প্রতিরোধী গুনাগুণ রয়েছে। তাছাড়া পান পাতায় ব্যাপক ভিত্তিক রোগজীবানু যেমন ব্যাসিলাস, এনটারোকক্কাস, লিসটেরিয়া, মাইক্রোকক্কাস, ষ্টেফাইলোকক্কাস, ই-কলাই, সিউডোমোনার্স, একটিনোমাইসিটিজ এবং ফিউসোব্যাকটেরিয়াম প্রতিরোধী ক্ষমতা রয়েছে। পান পাতায় আরো আছে বিভিন্ন প্রজাতির ছত্রাক ও প্রোটোজোয়া প্রতিরোধী ক্ষমতা। পান পাতা সেবনে শুধু যে মুখে লালা নিসৃত হয় তাই নয় বরং পাচক রস নিসৃত হয় যা খাদ্য হজমে সহায়তা করে। সেই সাথে এ রস রোগজীবানুও বিনাশ করে। তাইতো যথার্থই বলা যায়- সোনার হৃৎপিন্ড পান।