খাদ্য উৎপাদ্ন নিরাপদ করার প্রশ্নে
ফরিদা আখতার || Thursday 08 August 2013 ||এক
জেনেটিকালি মডিফাইড (GM) বীজ বা বিকৃত বীজের প্রতি নীতিনির্ধারকদের পক্ষপাতিত্ব বাংলাদেশের কৃষিব্যবস্থাকে সর্বনাশের দিকে নিয়ে যাবার বিপদ তৈরী হয়েছে। অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের সমাজে এ ব্যাপারে সচেতনতা কম। এটা বিপজ্জনক। বাংলাদেশে জেনেটিকালী মডিফাইড (জিএম) শস্য বা খাদ্য উৎপাদনের গবেষণা দেশে বিদেশে নানা আপত্তি সত্ত্বেও চলছে। মনসান্টো, সিনজেন্টা ও আরও বহুজাতিক কোম্পানি আন্তর্জাতিক ও দ্বিপাক্ষিক সাহায্য সংস্থা, সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং কৃষি বিজ্ঞানী ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রায় এক যুগ ধরে বিকৃত বীজের ওপর গবেষণা করে আসছেন। তাঁরা বলছেন খাদ্য উৎপাদনের জন্য নতুন ‘প্রযুক্তি’ প্রয়োজন। কিন্তু ‘প্রযুক্তি’ বলতে তারা বোঝান বীজের মধ্যে এমন বিকৃতি ঘটানো যাতে তাকে আর বীজ বলা যায় না। কৃষক চাইলে সেই বীজ পুনরুৎপাদন করতে পারবে না। কৃৎকৌশলও কোম্পানির সম্পত্তি হয়ে বাজারে আসবে। কৃষককে তা কিনতে হবে। কোম্পনির এই বিকৃত বিজ্ঞান চর্চার বিপরীতে রয়েছে সত্যিকারের বিজ্ঞান চর্চা, যা কৃষিব্যবস্থার বিকাশের জন্য অত্যাবশ্যক। রাসায়নিক সার, বিষ ও মাটির তলা থেকে পানি তুলে ‘সবুজ বিপ্লব’ নামে এতোদিন বিষাক্ত পদ্ধতি্র যে চাষাবাদ চলছিল তার ভয়াবহ পরিবেশগত বিপর্যয় ও কুফল থেকে বিজ্ঞানীরা বলছেন এই ভাবে পরিবেশ ধ্বংস করে খাদ্য উৎপাদনের চেষ্টা বন্ধ করা দরকার। কৃষকের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক অনেক জটিল এবং নানান সম্ভাবনায় পরিপূর্ণ। তাকে পুরাপুরি কাজে লাগাতে হবে। কাজে লাগাতে হলে এই সম্পর্কের বিজ্ঞানকে আগে আত্মস্থ করতে হবে। যার ভিত্তিতে কৃষিব্যবস্থাকে নতুন করে সাজাতে হবে, যাতে ফসলের উৎপাদন যে শুধু পরিমানগত বাড়বে তা নয়, গুণে ও বৈচিত্রেও বিপুল ভাবে সমৃদ্ধ হবে। বিজ্ঞানিরা এই জটিল সম্পর্ক নিয়ে আরও অধ্য্যয়ন, গবেষণা ও পরীক্ষা নিরীক্ষা করবার বিজ্ঞানের নাম দিয়েছেন ইকোলজি বা প্রাণব্যবস্থার বিজ্ঞান। বিভিন্ন জটিল সম্পর্ক রচনার মধ্য দিয়ে প্রকৃতি তার নিজের মধ্য থেকে প্রাণের যে বিকাশ ঘটায় এবং বিভিন্ন প্রাণ ও অপ্রাণ বস্তুর সমন্বয়ে যে প্রাকৃতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলে তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে ফসলের উৎপাদন বিপুল ভাবে বাড়ানো সম্ভব। সেটা করতে হলে কোম্পানির স্বার্থ প্রণোদিত বিজ্ঞান পরিহার করে আমাদের সত্যিকারের বিজ্ঞানের পথে যেতে হবে। প্রাণের বৈচিত্র ও প্রাণের ব্যবস্থা অক্ষুণ্ণ রেখে চাষাবাদ করতে হবে।
বিখ্যাত ধরিত্রী সম্মেলনে (Earth Summit 1992) এই চাষাবাদের চর্চাকে বলা হয়েছে ‘টেকসই চাষাবাদ’(Sustainable Agriculture)। বিভিন্ন রাষ্ট্র প্রাণবৈচিত্র রক্ষার জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে যার নাম ‘প্রাণবৈচিত্র চুক্তি’। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তা স্বাক্ষর করে নি। তারা তাদের কোম্পনি – যেমন মনসান্টো, সিনজেন্টার মতো কম্পানির স্বার্থ রক্ষা করে চলেছে। তাদের জিএমও বিভিন্ন দেশে প্রবর্তন করবার জন্য দুর্বল সরকারগুলোর ওপর নানান চাপ তৈরী করে চলেছে। জাতিসংঘের অধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, যেমন খাদ্য ও কৃষি সংস্থা আন্তর্জাতিক বিধিবিধান অনুযায়ী চাষাবাদের ক্ষেত্রে প্রাণব্যবস্থাপনার দৃষ্টিভঙ্গী (Ecosystemic Approach to Agriculture) গ্রহণ করবার যে পরামর্শ ও নির্দেশ দিচ্ছে সেইসব আমাদের মানতে দিচ্ছে না। বাংলাদেশ প্রাণবৈচিত্র চুক্তি (Convention on Biological Diversity) স্বাক্ষর করেছে। অতএব তাকে বহুপাক্ষিক আন্তর্জাতিক বিধিবিধান মানতে হবে। কোম্পানির অধীনস্থতা নয়।
কৃষি ব্যবস্থাকে টেঁকসই করবার এই চেষ্টা নস্যাৎ করতে চায় বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। তাই তারা প্রচার করে বেড়ায় যে বিকৃত বীজ হচ্ছে ‘বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা’। বিজ্ঞানের এই ‘অগ্রযাত্রাকে’ বিরোধিতা করা যাবে না। এগুলো বাজে কোম্পানি প্রপাগাণ্ডা, আসলে বিকৃত বীজ প্রবর্তনটাই বরং পশ্চাতপদতা -- বিজ্ঞানবুদ্ধি বিবর্জিত কোম্পানির ব্যবসায়িক উদ্যোগ। এর সঙ্গে বিজ্ঞানের কোন সম্পর্ক নাই। এই প্রপাগান্ডার পেছনে কোম্পানির বাণিজ্যক স্বার্থ জড়িত। তারাই অর্থের যোগানদার। বিকৃত বীজ প্রবর্তনের কুফল সম্পর্কে পুরাপুরি নিশ্চিত হবার জন্য কোন দীর্ঘ মেয়াদী গবেষণাও আজও হয় নি। আমরা এখানে শুধু স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা করব। বিকৃত বীজে উৎপাদিত খাদ্য ব্যবহারের স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে আলোচনার আগে আধুনিক কৃষি নিয়ে কিছু কথা বলা দরকার।
দুই
আধুনিক কৃষির তথাকথিত বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি পরিবেশ ও মানুষের স্বাস্থ্যের যে ক্ষতি করেছে তা নিয়ে কেউ এখন আর ভিন্নমত পোষণ করেন না। বিজ্ঞানীরাও তা স্বীকার করেন। দাবী করা হয় আধুনিক কৃষি খাদ্যে স্বয়ং-সম্পুর্ণতা এনে দিয়েছে, কারণ ফলন বেড়েছে কয়েকগুন। মালথাসের অংক পালটে দিয়েছে। খাদ্য উৎপাদনও জ্যামিতিক হারে বাড়ছে, অন্যদিকে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করে জন্মহার গাণিতিক হারে বাড়ছে। তাঁরা বেশ কিছুদিন বাহবা নিয়েছেন। যে কোন মূল্যে “খাদ্য নিরাপত্তা” বা Food Security অর্জন করা একটি দেশের সরকারের সাফল্যের বড় মাপকাঠি। বিষ মাখানো খাদ্য নিরাপত্তা এখন সবার নজরে পড়ছে। পেট ভরছে ঠিকই কিন্তু ডাক্তারের কাছেও যেতে হচ্ছে আগের চেয়ে অনেক বেশী। খাদ্যের পাশাপাশি খেতে হচ্ছে ওষুধ। গত কয়েক বছর থেকে বলা হচ্ছে খাদ্য নিরাপত্তা যথেষ্ট হয় না, এর সাথে বলতে হয় নিরাপদ খাদ্য বা Safe food। অর্থাৎ খাদ্য উৎপাদন নিরাপদ কিনা দেখার প্রয়োজন হচ্ছে। খাদ্য যদি বিষাক্ত হয় তাহলে তো আর তাকে ‘খাদ্য’ বলা যায় না। কৃষকের ফসলের মাঠ থেকে শুরু করে শহর-বন্দরের বাজার এবং শেষ পর্যন্ত ভোক্তার পাতে ওঠা পর্যন্ত যতো রকম প্রক্রিয়াজাতকরণের মধ্য দিয়ে যেতে হয় তার মধ্যে অনেক গলদ ঘটতে শুরু করেছে। খাদ্য আর স্বাস্থ্যের জন্য ‘নিরাপদ’ থাকছে না। দেখতে চকচকে, কিন্তু স্বাদ নেই, পুষ্টি নেই, নেই কোন খাদ্য গুন। উপরন্তু তাতে রয়েছে বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার। কৃষি পণ্যের প্রাকৃতিক ধরণ পালটে বাজারের প্রয়োজনে তার চরিত্র নির্ধারণ করা হচ্ছে। যেমন মাছ নদী, পুকুর বা সমুদ্র থেকে তোলার একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর পচে যাবে,কিন্তু তাকে পচা দেখানো যাবে না, তাই ফরমালিন দিতে হবে। পাকা আম বা কলা গাছ থেকে পেড়ে ঢাকা পর্যন্ত আসতে গেলে নরম হয়ে যাবে, তাই কাঁচা পেড়ে নিয়ে তাতে কারবাইডের মতো বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য মিশিয়ে পাকিয়ে ফেলতে হবে। আনারস ছোট দেখতে ভাল লাগে না, হরমোন দিয়ে বড় করতে হবে,পটল,ঢেঁড়শ সবুজ রংয়ে ডুবিয়ে বিক্রি করলে ভাল দাম মেলে। যে সব রাসায়নিক দ্রব্য মেশানো হচ্ছে তা কোনটাই খাদ্য দ্রব্যের জন্যে নয়, এর মধ্যে কোনটা আছে প্লাস্টিক সামগ্রীর রং, কোনটা কাপড়ের রং। তা কি শরীরে সয়?
আধুনিক কৃষি বা সবুজ বিপ্লবের ভিত্তি হচ্ছে রাসায়নিক সার, কীটনাশক, ভুগর্ভস্ত সেচের পানির ব্যবহার ইত্যাদি। বলা হয়,এই রাসায়নিক সার ও কীটনাশক দিয়ে উৎপাদন বাড়ানো হবে এবং পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবে। গত ৬০ বছরে বিশ্বব্যাপী কীটনাশক ব্যবহারের পরিমাণ এবং ধরণ বেড়েছে ব্যাপক হারে। যেখানেই আধুনিক কৃষির প্রচলন হয়েছে সেখানেই কীটনাশক ব্যবহার বেশী। তারা খুশি যে কীট দমন করে ফসলের উৎপাদন বেড়েছে। কিন্তু ‘কীটনাশক’ শুধুই নাশ করে, কারণ এটা বিষ। ফসলের মধ্য দিয়ে শরীরে যায়, তাৎক্ষনিক কেউ মারা যায় না ঠিক কিন্তু শরীরে বিষের ক্রিয়া চলে। বিষ হিশেবে বোঝার সহজ প্রমাণ হচ্ছে ফসলের জন্যে কেনা তরল বিষ পান করেই গ্রামের কৃষক পরিবারের মেয়েরা আত্মহত্যা করে। এটাই তাদের হাতের কাছে মরে যাওয়ার সহজ পথ। সে একই বিষ কীট মারার জন্যে খাদ্য উৎপাদনে ব্যবহার হয়। আমরা খেয়েই তক্ষুনি মরে যাই না বটে, কিন্তু স্লো-পয়েজনিংয়ের মতো করে নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে মানুষ এখন নানা স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে আছে। ফসল উৎপাদনে কীটনাশক স্প্রে করার দৃশ্য আমরা সব সময় দেখি। এই কীটনাশক বেছে বেছে শুধু ক্ষতিকর কীটকেই মারে না, প্রজাপতি ও অন্যান্য বন্ধু কীটকেও ছাড়ে না। বিষ তো সবার জন্যেই বিষ। মাটি, পানি এবং বাতাসকেও দুষিত করে। অরগানোক্লোরিন ও অরগানোফসফেট ধরণের কীটনাশক মাটি ও পানিতে খুব বেশী পাওয়া যায় এবং এর প্রভাব অনেক দীর্ঘস্থায়ী হয়। ডিডিটি ও পিসিবি জাতীয় কীটনাশক ব্যবহারের কারণে ক্যান্সার, বিশেষ করে স্তন ক্যান্সারের ঘটনা সারা বিশ্বে দেখা যাচ্ছে।
ফসলের মধ্যে ধানের পাশাপাশি হাইব্রিড জাতীয় সব্জির চাষে ব্যাপক হারে কীটনাশক ব্যবহার হয়। আধুনিক কৃষির কারণে শহরের মানুষের ধারণা যে কোন সব্জিতেই কীটনাশক দিতে হয়, কিন্তু আসলে কীটনাশক ব্যবহার হয় হাইব্রিড ও উচ্চ ফলনশীল বীজ ব্যবহার করলে এবং অ-মৌসুমে করলে। স্থানীয় জাতের বীজ, স্থানীয় পরিবেশ ও মৌসুমের ফসলে কৃষক নিজস্ব উপায়ে কীটব্যবস্থাপনা করতে পারেন। সরকারের কৃষি পরিসংখ্যানে খরিফ মৌসুমে ১৯টি সব্জি ও রবি মৌসুমে মাত্র ১২টি সব্জির তালিকা দেয়া হয়েছে যা প্রধানত বাণিজ্যিকভাবে চাষ করে শহরের বাজারে বিক্রি করা হয়।এর মধ্যে লাউ, বেগুন, পটল, ঢেঁড়শ, ঝিংগা,চিচিংগা, করলা, টমেটো, ফুলকপি, বাধাকপি, পেপে, লাল শাক, মুলা, পালং শাক,লাউশাক,ডাটা, সীম, গাজর ইত্যাদী রয়েছে। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হচ্ছে যে দেশের বেশ কয়েকটি এলাকা থেকে বাণিজ্যিক চাষের সব্জি ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যায় যাতে কীটনাশক ব্যবহার হ্য় এবং রাসায়নিক রং ব্যবহার হয়। টমেটো পাকাতে গিয়ে ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহারের তথ্য পত্র-পত্রিকায় এসেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বুরোর তথ্য ১৯৮৪ থেকে ২০১০ পর্যন্ত (২৭ বছরে) কীটনাশক ব্যবহারের পরিমাণ যোগ করে দেখা গেছে ৪,৪৬,২৪৬.৭৮ মেট্রিক টন, গড়ে বছরে ১৬৫২৭.৬৫ মেট্রিক টন মানুষের শরীরে যাচ্ছে।কীটনাশক দ্বারা ক্ষতি নানাভাবে হতে পারে।কীটনাশক স্প্রে করতে গিয়ে কৃষি শ্রমিক সরাসরি সংস্পর্শে আসছেন, পরিবারের সদস্যরা সারাক্ষণ কীটনাশক ব্যবহারে যুক্ত হচ্ছে, (স্প্রে মেশিনটি দামী হওয়ায় ঘরের ভেতরেই রেখে দেয়া হয়),ভোক্তারা কীটনাশকযুক্ত ফসল খেয়ে এর ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। একটি গবেষণায় দেখা গেছে বিশ্বব্যাপী ১৯৯০ সালে কীটনাশক খেয়ে আত্মহত্যা করে ৭,৯৮,০০০ জন মারা গেছে যার মধ্যে ৭৫% হচ্ছে উন্নয়নশীল দেশে। নারীদের মধ্যে এই প্রবনতা অনেক বেশী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণায় দেখা গেছে বিশ্বে প্রতি বছর ৩০ লাখ মানুষ কীটনাশকের বিশাক্ততায় আক্রান্ত হয়, এবং প্রায় ৭ লাখ ৫০ হাজার মানুষ দীর্ঘ মেয়াদী রোগে আক্রান্ত হয় কীটনাশকের কারণে।কিডনী রোগ, লিভারের রোগ, ক্যান্সার, শ্বাসকষ্ট,এখন খুব দেখা যাচ্ছে। নারীদের প্রজনন স্বাস্থের ক্ষেত্রে মরা বাচ্চার জন্ম দেয়া (Still Birth) এবং নবজাতকের মৃত্যু অনেক বেড়ে গেছে, ভারতে প্রায় আগের তুলনায় যথাক্রমে ৩০০ এবং ২০০ গুন বেড়ে গেছে। তাই জাতি সংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ফসল উৎপাদনে কীটনাশক ব্যবহার কমাবার পরামর্শ দিচ্ছে।তেরটি কীটনাশক নিষিদ্ধ্ব ঘোষণা করা হয়েছে যার মধ্যে ডিডিটি অন্যতম (যা আমাদের সুটকীমাছে ব্যবহার হচ্ছে)।
কীটনাশকের ক্ষতি নিয়ে আরও অনেক লেখা যায়, কিন্তু এই তথ্য দিচ্ছি শুধু এই কারণে যে এখন ধারণা দেয়া হচ্ছে কীটনাশক যেহেতু এতো ক্ষতিকর (যা একেবারেই সত্যি কথা) তাই জেনেটিকালী মডিফাইড ফসল করার কোন বিকল্প নাই। এই দাবিও করা হয় যে এই ফসলের উৎপাদনে কীটনাশকের ব্যবহার নাই। ১৯৯৬ সালে সর্ববৃহৎ বায়োটেক কোম্পানি মনসান্টোর সিইও রবার্ট শ্যপিরো দাবী করেন যে মনসান্টো তার প্রযুক্তি দিয়ে দুনিয়ার মানুষের খাদ্যের যোগান দেবে, পরিবেশও রক্ষা করবে। তারা কীটনাশক ব্যবহার করবে না, বীজের বিকৃতি ঘটিয়ে বীজকেই বিষাক্ত করে দেবে। কোন কীটের সাধ্য নাই, এর ভেতরে ঢোকে! কিন্তু এই জিএম প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি খাদ্য কি মানব দেহের জন্য নিরাপদ? এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা স্বাধীনভাবে। অর্থাৎ কোন বায়োটেক কোম্পানির অর্থায়ন ছাড়া গবেষণা করে দেখিয়েছেন সাধারণভাবে জিএম ফসল এবং বিশেষভাবে, বিটি প্রযুক্তি ব্যবহার করে উৎপাদিত ফসল নিরাপদ নয়। বায়োটেক কম্পানির দাবী যে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করলে কীটনাশকের ব্যবহার কমবে তাও একদম সত্যি নয়। প্রাণের বিকৃতি বা বংশগত বৈশিষ্ট্যে অদলবদল ঘটিয়ে নতুন ফসল উৎপাদনের প্রয়োজন কৃষক বা ভোক্তাদের স্বার্থে নয়, কোম্পানি নিজের মুনাফার জন্যেই করছে।
বাংলাদেশে জেনেটিকালী মডিফাইড খাদ্য (GM Food) এবং জেনেটিকালী মডিফাইড ফসল (GM Crop) নিয়ে গবেষণা বলতে গেলে বেশ প্রাথমিক পর্যায়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়োটেক বিজ্ঞান বিভাগ খোলা হয়েছে মাত্র ২০০১ সালে। বহুজাতিক কোম্পানির অর্থায়নে আমাদের দেশের কৃষি বিজ্ঞানীদের দিয়ে গবেষণা করানো হয়েছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান (BRRI), বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান (BARI), কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ আণবিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান (BINA) ইত্যাদীতে। এখানে গবেষণাগুলো বেশিরভাগই বায়োটেক কোম্পানী মনসান্টো, সিনজেন্টা ইত্যাদীর সরাসরি অর্থায়ন ও তদারকিতে হচ্ছে। তাদের এই কাজে সহায়তা করছে মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, যেমন কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়। গবেষণা পর্যায়ে যেসব জিএম ফসল আছে তার মধ্যে রয়েছে ধান, পেপে, আলু, আঁখ ইত্যাদী।
বিদেশে উৎপাদিত জিএম খাদ্য হিশেবে আমাদের দেশে কোন প্রকার নিয়ন্ত্রণ ছাড়া আমদানি করা হচ্ছে, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সয়বিন তেল। যেহেতু কোন বাধা ছাড়াই আসতে পেরেছে তাই এটাকেই উদাহরণ হিশেবে ব্যবহার করে বলা হচ্ছে জিএম খাদ্য খেলে কোন স্বাস্থ্য ঝুঁকি নেই কারণ আমরা তো সয়াবিন দীর্ঘদিন ধরেই খাচ্ছি। এ নিয়ে আজ পর্যন্ত কোন পরীক্ষা নিরিক্ষা না করেই দাবী করা হচ্ছে জিএম খাদ্য খেলে কোন ক্ষতি নাই। এই দাবীর পক্ষে কোন গবেষণা নাই। যদি স্বাস্থ্য ঝুঁকি না থাকতো তাহলে ইওরোপ ও আমেরিকায় ভোক্তাদের মধ্যে জিএম লেবেল লাগাবার দাবী উঠতো না। আর কোম্পানি লেবেল লাগাতে গড়িমসিও করতো না।
এ পর্যন্ত জিএম ফসলের স্বাস্থ্য ঝুঁকির ওপর যতো গবেষণা হয়েছে তার বেশির ভাগই করেছে কোম্পানি নিজেরাই এবং তাদের ফলাফল হচ্ছে ‘জিএম ফসল নিরাপদ’। কিন্তু বিজ্ঞানীরা যখন স্বাধীনভাবে পরীক্ষা করেছেন তখন তাঁরা প্রাণী গবেষণায় ক্ষতিকর ফলাফল পেয়েছেন। ২০০৩ সালে কোম্পানি নিয়ন্ত্রিত পাঁচটি গবেষণায় “কোন ক্ষতিকর ফলাফল নেই” বলে দেয়া হোল, কিন্তু একই সময়ে তিনটি স্বাধীনভাবে করা গবেষণায় “মাত্র ১৪ দিন পরেই প্রাণী শরীরে ক্ষতিকর প্রভাব দেখা যায়। ” প্রাণী গবেষণার ক্ষেত্রে কোম্পানির গবেষণা পদ্ধতিতেও সমস্যা ধরা পড়েছে। তাঁরা প্রাণী ওপর বৈজ্ঞানিক গবেষণা (Scientific Study) এবং প্রাণী নিয়ে জিএম উৎপাদন পরীক্ষা (animal production exercise) এর মধ্যে কোন পার্থক্য না করেই ফলাফল দিয়ে দেন। বিজ্ঞানীরা এই ধরণের অনেক গবেষণার সারমর্ম (abstract) ২০০৪ সালে তুলনা করে দেখেছেন যে ৬৭% ক্ষেত্রে ফলাফল দেখা গেছে যে জিএম খাদ্য স্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর, অথচ এই গবেষণার ভিত্তিতেই দাবী করা হয়েছে, জিএম নিরাপদ। প্রাণী গবেষণার ক্ষেত্রে কোম্পানি কিছু কৌশল অবলম্বল করে যেন ক্ষতিকর প্রভাব ধরা না পড়ে। যেমন তারা গবেষণার প্রাণী নির্ধারনের সময় বেশী বয়স, জিএম ফসলের পরিমান কম দেয়া, বেশী রান্না করে দেয়াসহ নানাভাবে প্রভাব কমাবার চেষ্টা করে। ২০০৭ সালে মাত্র একটি গবেষণা হয়েছে মানবদেহে, কিন্তু জিএম খাদ্য বাজারজাত করার পর যখন ব্যাপকভাবে ব্যবহার হচ্ছে তখন কোন প্রকার গবেষণা বা তদারকি নাই। যারা খাচ্ছে তাদের কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা, হলে কি ধরণের হচ্ছে তা জানতে কোম্পানি আগ্রহী হয় না। কারণ একবার বাজারজাত হয়ে গেলে তা কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে চলে আসে, তখন অন্য কারো কথায় কান দেবার প্রয়োজন পড়ে না।
জিএম প্রযুক্তির পক্ষের প্রবক্তারা সাধারণত বলে থাকেন যুক্তরাষ্ট্রে জিএম খাদ্য মানুষ গত ১০ বছর ধরে খাচ্ছে, কেউ তো অসুস্থ হয় নি। ঠিক যেমন বাংলাদেশে এখন বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে জিএম সয়াবিন আমদানী করা হচ্ছে এবং তা মানুষ খাচ্ছে। কিন্তু কেউ অসুস্থ হয় নি এমন কথা কি বলা যাবে? যেসব অসুস্থতায় মানুষ বর্তমানে ভুগছেন, তার সাথে জিএম খাদ্যের কোন সম্পর্ক আছে কিনা তা দেখার কোন আগ্রহ কোম্পানির নেই। কোন মনিটরিং নাই, এবং এই ধরণের সম্পর্ক চিহ্নিত করার জন্যে যে সময় দরকার তা করা হচ্ছে না।কীটনাশকের কারণে স্বাস্থ্য ক্ষতি সম্পর্কে জানতেই আমাদের দীর্ঘ ৩০-৪০ বছর লেগে গেছে। গ্রামের কৃষকরা কীটনাশকের ব্যবহারের কারণে রোগে ভুগে মারা গেছেন, কেউ কখনো জানতে পারে নি, তার আসলে ক্যান্সার হয়েছিল কিনা।
[তথ্য সুত্রঃ Poisons in our food: links between pesticides and Diseases by Dr. Vandana shiva, Dr. Mira Shiva and Dr. Vaibhav Singh, 2012 এবং Genetic Roulette: The documented health risks of genetically engineered foods by Jeffrey M. Smith, 2008]