নারীর দৃষ্টিতে কোভিড-১৯
ফরিদা আখতার || Saturday 02 October 2021 ||আমরা একটি দুঃসময় পার করছি। কবে এর থেকে মুক্তি পাবো বা আদৌ মুক্তি পাবো কি না আমরা জানি না। এখনও কোভিড এর চরিত্র বোঝা নিয়েও নানা মত এবং সংশয় আছে। দুই হাজার বিশ সালে কোভিড-১৯ ভাইরাস সম্পর্কে প্রথম যখন সবাই শোনা শুরু করে তখন একে ‘নভেল’ কোরোনা বলা হোত; অন্যান্য ভাইরাসের তুলনায় এটি নতুন। সংক্রমণ চরিত্রে ও উপসর্গেও নতুনত্বের কারণে। একবছরের মধ্যেই এর নানা ধরণের ভ্যারিয়েন্ট বেরুতে শুরু করে, ফলে এর চরিত্র বোঝা আরও কঠিন হয়ে উঠেছে। কয়েকটি করোনা ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন যেমন দক্ষিণ আফ্রিকা ভ্যারিয়েন্ট, ইউকে ভ্যারিয়েন্ট আর সর্বশেষ এবং সম্ভবত সব চেয়ে মারাত্মক ডেলটা ভ্যরিয়েন্ট এখন বাংলাদেশ সহ বিশ্বের অনেক দেশেই আতংকের সৃষ্টি করেছে। এই ভ্যারিয়েন্ট প্রথম ভারতে শনাক্ত হয়েছিল, তাই একে ইন্ডিয়ান ভ্যারিয়েন্টও বলা হয়। এর চরিত্র চেনার আগেই ছিনিয়ে নিচ্ছে শত শত প্রাণ, দ্রুত ফুসফুসে ছড়িয়ে যাওয়ায় হাসপাতালে হাসপাতালে রোগীরা অক্সিজেনের জন্যে কাতর দিন কাটাচ্ছে। এই লেখা যখন লিখছি তখন আমারই চার পাশে আপনজনদের কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিয়ে ভাবতে হচ্ছে, উৎকন্ঠায় দিন কাটছে।
কিন্তু তবুও এই অবস্থায় আমাদের পথ চলা থামবে না। কোভিডের সব চেয়ে মর্মান্তিক দিক হচ্ছে আপনজনদের জন্যে যতোই মায়া থাকুক তার কাছে গিয়ে সেবা করার সুযোগ কম। যাদের বাড়ীতে কোভিড রোগী শনাক্ত হয়, তারা যেমন চান না কেউ আসুক, তেমনি অন্যরাও যেতে পারেন না। করোনা পরীক্ষায় পজিটিভ হলে এবং অক্সিজেনের সেচুরেশান ৯৫ এর উপরে থাকলে ‘হোম আইসোলেশান’ এ ১৪ দিন কাটিয়ে দিলে সুস্থ হয়ে যেতে পারে। একই বাড়িতে যদি কয়েকজনের হয়, তাহলে জনে জনে আইসোলেশনের জন্যে আলাদা রুম দেয়া সম্ভব না হলে সব পজিটিভরা একসাথে থাকতে পারেন আর সংখ্যা লঘু নিগেটিভদের বরং একটু দুরে সরিয়ে রাখা যায়, এমন ব্যবস্থাও করতে হচ্ছে। নভেল করোনার নভেল আয়োজন। শতকরা ৮০ ভাগের হাসপাতালে যাওয়ার প্রয়োজন নেই, (যদি অক্সিজেন সাপোর্ট না দিতে হয়), তারা তো এভাবেই সুস্থ হচ্ছেন।
‘কোভিডের কোন চিকিৎসা নাই’ এটাই এখন পর্যন্ত বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমানিত তথ্য। কিন্তু তা হলেও কোভিড ধরা পড়লেই চিকিৎসকরা এন্টিবায়োটিক, প্যারাসিটামল, কয়েক ধরণের ভিটামিনসহ বিভিন্ন ওষুধ অবস্থা বিশেষে দিচ্ছেন। এর সব গুলোই প্রয়োজন ছিল কিনা তা আলোচনাতেই নেই। ডাক্তার দেখালেই তাকে এই ব্যবস্থাপত্র নিতে হচ্ছে। গত বছর অথবা কোভিডের শুরুতে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধ্বির কথা বলা হয়েছে অনেক বেশি। খাওয়া দাওয়ার মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ালে কোভিড মোকাবেলা সহজ হবে। তার জন্যে প্রোটিন যুক্ত খাদ্যের প্রয়োজন। খাদ্যের মধ্যে প্রোটিন, ভিটামিন সি, লিকুইড খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। পরবর্তীকালে কোভিডের রোগীরা ওষুধ নির্ভর হয়ে গেছে। রোগী করোনা শনাক্ত হওয়ার কিছু দিনের মধ্যে স্বাদ-গন্ধ যখন পায় না, তখন তার খেতে খুব কষ্ট হয়। তার মাথা-ব্যাথা শরীর ব্যাথা, শ্বাস কষ্ট ইত্যাদি কখন মারাত্মক হয়ে উঠবে তা কেউ বলতে পারে না। অক্সিমিটারে সেচুরেশান ৯০ এর নীচে গেলে বিপদ এটুকু মোটামুটি সবাই জানেন, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হয়। কিন্তু এই ফাঁকে খাদ্য যে একটা গুরুত্বপুর্ণ চিকিৎসা তা অনেকেই আর মনে রাখে নি। কোভিডের নতুনত্ব নিয়ে মাথা ঘামাতে গিয়ে সকলেই ওষুধের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। যারা চিকিৎসকের নাগাল পাচ্ছেন না, তারা অন্যদের দেয়া ওষুধের প্রেসক্রিপশান থেকে দেখে ওষুধ কিনে নিচ্ছেন। প্রশ্ন আসতে পারে এটা করা ঠিক কি না, সেই প্রশ্ন করার আগে এটাও প্রশ্ন করতে হবে চিকিৎসকরা কি আসলেই রোগী ভেদে ভিন্ন ভিন্ন প্রেস্ক্রিপশান দিচ্ছেন? উত্তর হচ্ছে, না। চিকিৎসকরাও কোভিড পজিটিভ শুনলেই টেমপ্লেট প্রেস্ক্রিপশান দিচ্ছেন দেখা যায়। কাজেই একই বাড়ির সবাই জনে জনে চিকিৎসকের ফি দিয়ে দেখানোর যদি প্রয়োজন মনে না করেন তাহলে দোষ দেয়া যায় না।
কোভিড কি নারী-পুরুষ বাছবিচার করে?
নারীর দৃষ্টিতে কোভিড-১৯ অতিমারীর পর্যালোচনা করতে গিয়ে এসব সাধারণ কিন্তু দৈনন্দিন বিষয়গুলো শুরুতে টেনে আনলাম। আমরা প্রতিদিন জানতে পারছি গত ২৪ ঘন্টায় কত জন শনাক্ত (পজিটিভ) হয়েছেন, কত জন মারা গেছেন, কত জন সুস্থ (নিগেটিভ) হয়েছেন। কতজনকে পরীক্ষা করা হয়েছে তাও বলা হয়। এবং ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে এ পর্যন্ত মোট কত শনাক্ত হয়েছেন, কত জন মারা গেছেন তা প্রতিদিন জানা যায়। কিন্তু যা জানা যায় না তা হচ্ছে এর মধ্যে নারী-পুরুষের বিভাজনটা কেমন। যদিও শনাক্তের মধ্যে কত জন পুরুষ, কত নারী আছেন, মৃতদের মধ্যে কত জন পুরুষ এবং নারী আছেন জানা যাচ্ছে। কিন্তু যাদের পরীক্ষা করা হয়েছিল তাদের মধ্যে কত জন নারী এবং কতজন পুরুষ ছিলেন তা বলা হয় না। ফলে আমরা জানি না কতজন নারীকে পরীক্ষা করে কত শতাংশ শনাক্ত হয়েছে, এবং কত জন পজিটিভ হওয়ার পর কত নারী মৃত্যু বরণ করেছে। নারীদের বিষয় আলাদা করে দেখতে চাওয়ার কারণ হচ্ছে আমরা দেখেছি অ-সংক্রামক রোগ (NCD) বা হার্টের অসুখ, উচ্চ রক্তচাপ, ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, শ্বাসকষ্টজনিত রোগের ক্ষেত্রেও নারী-পুরুষ ভেদে তথ্য পাওয়াও খুব সহজ হয় না। কিছু গবেষণায় দেখা উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা, ডায়াবেটিসের মতো রোগ নারীদের মধ্যে বেশি পাওয়া গেলেও চিকিৎসা নেয়ার ক্ষেত্রে নারীরা পুরুষের তুলনায় পিছিয়ে আছেন। অনেক ক্ষেত্রে নারী তার রোগ চরম অবস্থায় যাওয়ার আগ পর্যন্ত হয়তো ডাক্তারের কাছেই যান না। পরিবারেও তিনি তাঁর শারিরীক সমস্যার কথা জানাতে পারেন না। ফলে তাদের রোগও শনাক্ত হয় না। পুরুষ পরিবারের প্রধান, তার সুস্থ থাকার সাথে পরিবারের ভরণ পোষণ জড়িত, তাই তার অসুস্থতা দূর করা প্রাধান্য পেলে দোষ দেবার কিছু নেই। পরিবার প্রধান অসুস্থ হলে কিংবা মারা গেলে পরিবারের সদস্যদের, বিশেষ করে স্ত্রীর কান্নার ভাষা হচ্ছে “এখন আমাদের কি হবে? আমরা কিভাবে চলবো?”। ফলে পুরুষকে সুস্থ রাখা, কর্মক্ষম রাখার প্রয়োজনে রোগ শনাক্ত হয়, এবং চিকিৎসা হয়। অথচ পরিবারে নারীর মৃত্যু হলে সেই পরিবারের সব কিছু তছনছ হয়ে যায় সেটা যেন কোণ বিষয় নয়। এই সমাজের নারী-পুরুষের দায়িত্ব যেভাবে নির্ধারণ করে দেয়া আছে, তারই ভিত্তিতে হচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ড্যাশ বোর্ডে দেয়া তথ্য থেকে (৩ আগস্ট, ২০২১) পর্যন্ত বাংলাদেশে মোট সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা হচ্ছে ১২,৯৬,০৯৩, মৃত্যু হয়েছে ২১, ৩৯৭ জন। Worldometer এ নারী-পুরুষ ভাগ দেখানো হয় না। IEDCR এর তথ্য অনুযায়ি শনাক্ত হওয়া রোগীদের ৬৮% পুরুষ, ৩২% নারী, অর্থাৎ নারীর তুলনায় পুরুষের সংখ্যা দ্বিগুন। মৃতদের ৭৩% পুরুষ, ২৭% নারী – নারীর তুলনায় পুরুষের মৃত্যু হার প্রায় ৩ গুন। ভ্যাক্সিনের ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে পুরুষ পেয়েছেন ৬১%, নারী পেয়েছেন ৩৯%।
কোভিড সংক্রমণে নারীর কম হচ্ছে দেখে ভাল লাগছে অবশ্যই, কিন্তু কেন? বিষয়টা কেবল বাংলাদেশে ঘটেছে তা নয়। চীনে Chinese Centre of Disease Control প্রায় ৪০,০০০ মানুষের ওপর ব্যাপক একটি গবেষণা করে দেখেছে করোনা আক্রান্ত পুরুষ রোগীদের ২.৮% মারা গেছেন, অথচ নারী মারা গেছেন ১.৭%। এর একটি ব্যাখ্যা গবেষকরা দিয়েছেন এভাবে যে পুরুষ ও নারীর জীবন যাপনের পদ্ধ্বতির মধ্যে পার্থক্য আছে। একটি বড় পার্থক্য হচ্ছে চীনে ৫২% পুরুষ ধুমপান করেন, নারীদের মধ্যে মাত্র ৩% ধুমপায়ি রয়েছে। ধুমপান ফুসফুসের ক্ষতি করে। করোনা ভাইরাসও ফুসফুসের ক্ষতি করে। বাংলাদেশে পুরুষদের ধুমপান ৩৬.২% আর নারীদের মধ্যে মাত্র ০.৮% পাওয়া যায়। তবে বাংলাদেশে নারীদের ২৪.৮% পানের সাথে জর্দা ও সাদাপাতা খায়, এবং গুল ব্যবহার করে। অর্থাৎ তামাক সেবন নারীও করে। কিন্তু বেশির ভাগ পুরুষ ধুমপান এবং ধোঁয়াবিহীন তামাক দুটোই সেবন করে। ধুমপান সরাসরি ফুসফুসের জন্যে মারাত্মক ক্ষতিকর, তাই পুরুষদের বেশি মৃত্যু কিছুটা ব্যাখ্যা হয়তো এখান থেকে পাওয়া যায়।
কিন্তু ল্যান্সেটে প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রতিবেদনে (নভেম্বর ৫, ২০২০) দেখা গেছে ভারত, নেপাল, ভিয়েতনাম, স্লোভানিয়াসহ বেশ কিছু দেশে পুরুষের তুলনায় নারীর সংক্রমণের হার বেশি দেখা গেছে। ভারতে case fatality rate পুরুষের ২.৯%, নারীর ৩.৩%। এই ফলাফল দেখে অনেকেই অবাক হয়েছেন কারণ এরই মধ্যে ধারণা জন্মেছিল যে পুরুষের জীবন ধারণের কারণে তারা বেশি ঝুঁকিতে থাকেন আর নারীর শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা (immune responses) অনেক বেশি। এই বিশ্বাস আমাদের গার্মেন্ট শিল্পের মালিকদের মধ্যেও তীব্রভাবে আছে। তারা মনে করেন গার্মেন্ট শ্রমিকদের (যার অধিকাংশই নারী) কোভিড সংক্রমণের হার মাত্র ০.০৩% । কাজেই তাদেরকে একবার বাড়ী যাও, আর একবার চলে আস বললেও কোন ক্ষতি হবে না। ওরা ভাল থাকবে। চল্লিশ লক্ষ শ্রমিকের মধ্যে মাত্র ৫০০০ জনকে পরীক্ষা করা হয়েছে, ২৯৯ জনের পজিটভ এসেছে। কিন্তু নতুন গবেষণা সেই ভুল ভেঙ্গে দিচ্ছে।
বর্তমানে সারা বিশ্বে কোভিডের ডেল্টা ভ্যরিয়েন্ট, যা প্রথমে ভারতে ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে শনাক্ত হয়, বিশ্বে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে, কোভিড শনাক্ত হওয়া রোগীদের ৮০ ভাগ ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হচ্ছে। এই ভ্যরিয়েন্ট প্রথম ভ্যারিয়েন্ট (আলফা), (যা যুক্তরাজ্যে প্রথম শনাক্ত হয়েছে বলে ইউকে ভ্যারিয়েন্ট বলে পরিচিত) এর তুলনায় ৬০% বেশি সংক্রমণ ঘটাতে সক্ষম। ইউকে ভ্যরিয়েন্ট চিনের উহানের ভ্যারিয়েন্টের তুলনায় বেশি সংক্রমন করছিল। উল্লেখ্য, এরই মধ্যে কয়েকটি ভ্যারিয়েন্ট নতুনভাবে শনাক্ত হওয়াতে বিশ্বে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চারটি ভ্যারিয়েন্টকে বিশ্ব স্বাস্থ সংস্থা Variants of Concern (VOCs) বা উদ্বেগজনক ভ্যারিয়েন্ট বলে চিহ্নিত করেছে, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট তার মধ্যে অন্যতম।
সিডিসি এর তথ্য মতে যুক্তরাষ্ট্রে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট পুরুষদের জন্যে বেশি হুমকি সৃষ্টি করেছে কারণ ভ্যাক্সিন দেয়ার ক্ষেত্রে নারীরা এগিয়ে আছেন (৫৩%)। ভ্যাক্সিন দেয়া পুরুষদের (৪৭%) এর মধ্যে শ্বেতাংগ পুরুষের সংখ্যাই বেশি। বাংলাদেশে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট সংক্রমণের হার প্রায় ৭৮%, এবং এই ভ্যারিয়েন্ট নারীদের ছাড়ছে না। এর একটি অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে আগের ভ্যারিয়েন্টের তুলনায় ডেল্টা দ্রুত ছড়ায়, একটি পরিবারে একজনের হলে পরিবারের সকলের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ফলে নারী যদি ঘর থেকে বের নাও হন, তার পরিবারের পুরুষ সদস্যদের মাধ্যমে সংক্রমিত হবার সম্ভাবনা থেকেই যায়।
কোভিড রোগী সেবা দানে নারীও বৈষম্যের শিকার
হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসকের মধ্যে নারী এবং পুরুষ রয়েছেন এবং বিপুল সংখ্যক নার্স ক্রমবর্ধমান কোভিড রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। কোভিড ডেডিকেটেড সরকারি এবং বেসরকারী হাসপাতালে হাজার হাজার ডাক্তার এবং নার্স নিরলস সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। তাদের অনেকেই কোভিড আক্রান্ত হয়েছেন, মারাও গিয়েছেন কয়েকশত চিকিৎসক এবং নার্স। গত বছর জুন মাসের তথ্য (ইউএনবি) যখন মোট সংক্রমণ ছিল ১ লক্ষ ৮ হাজার ৭৭৫ জন তখন ডাক্তার, নার্স এবং টেকনিশায়ানদের মধ্যে সংক্রমণ ছিল ৩৩০১ জন (১০৪০ জন ডাক্তার, ৯০১ জন নার্স, ১৩৬০ জন টেকনিশিয়ান)। বাংলাদেশে কোভিড সংক্রমিত রোগিদের ১১% ডাক্তার এবং নার্স রয়েছেন। এটা আমরা জানি চিকিৎসকদের বেশির ভাগ পুরুষ হলেও নার্সদের সিংহভাগ হচ্ছেন নারী। তাদেরকেই রোগীর একেবারে কাছে গিয়ে সেবা করতে হয়, ওষুধ খাওয়ানো, অক্সিজেন দেয়া কোনটাই শারীরিক দুরুত্ব বজায় রেখে করা সম্ভব নয়। গত বছর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে দৈনিক যে বুলেটিন প্রকাশ করা হোত তাতে জানা যেত হাসপাতাল গুলোতে PPE, মাস্ক ইত্যাদী কত দেয়া হচ্ছে। কিন্তু পত্রিকার খবরে দেখা যায় ডাক্তাররা PPE পেলেও নার্স দেয়া হচ্ছে সাধারণ স্যুট, আর যারা পরিস্কার করতে আসেন তাদের দেয়া হয় শুধুমাত্র মাস্ক। N95 mask সকল ডাক্তার নার্সরা পান নি। যারা হাসপাতালে আসা রোগিদের সেবা দিয়ে সারিয়ে তুলছেন তাদের নিরাপদ রাখার ক্ষেত্রে যথেষ্ট উদ্যোগ নেই। এবং এখানেও নারী-পুরুষ বৈষম্য দেখা যাচ্ছে।
কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের দ্বারা ঢাকা শহরের দুটি প্রাইভেট হাসপাতালে (২০২০ সালে) পরিচালিত গবেষণায় দেখা যায় নার্সদের প্রতি সপ্তাহে মাত্র দুই সেট পিপিই প্যাক দেয়া হয়, যার মধ্যে একটী গাউন এবং জুতার কভার (Nx1 to Np5)। কোন গ্লাভস, মাস্ক বা ফেস শিল্ড দেয়া হয় নি। নার্সরা নিজেরাই N95 মাস্ক কিনেছেন এবং মেডিকেল ওয়ার্ডে ঢোকার সময় তা ব্যবহার করেন। দশ ঘন্টার শিফটে কাজ করলে ১০ দিনের মাস্ক ৫ দিনে শেষ হয়ে যায়। ডাক্তারদের ক্ষেত্রেও সুরক্ষার যথেষ্ট অভাব রয়েছে।
নার্স এবং ডাক্তারদের যথেষ্ট সুরক্ষা না থাকা বিশ্বের অন্যান্য দেশেও দেখা গেছে। ইতালীতে অনেক ডাক্তার এবং নার্স কোভিড আক্রান্ত হয়েছেন; ফ্রান্সে একজন ডাক্তার কোভিড সংক্রমিত হয়ে আত্মহত্যা করেছেন। আসলে তাদের যথেষ্ট পিপিই না থাকা এবং সুরক্ষার অভাব বোধ ডাক্তার-নার্সদের মানসিক ভাবে দুর্বল করে দেয় এবং ভীতি সৃষ্টি করে। চীন এবং অস্ট্রেলিয়াতেও একই চিত্র দেখা গেছে।
লক ডাউন ও নারী
বাংলাদেশে কখনোই সরকার দ্বারা ঘোষিত কোন ‘লক ডাউন’ হয় নি, আমরাই সরকারের দেয়া বিধিনিষেধকে লক ডাউন বলে আখায়িত করেছি। লক ডাউন মানে সব কিছু বন্ধ হয়ে যাওয়া, রাস্তাঘাট ফাঁকা থাকা এমন ছবি ইতালী, লন্ডন, নিউ ইয়র্কের দৃশ্য দেখে মনে হয়েছে, বাংলাদেশের এই বিধিনিষেধেও তাই হতে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষ লক ডাউন ইংরেজী শব্দ হলেও বাংলায় বিধিনিষেধ, সাধারণ ছুটি, কঠোর বিধিনিষেধ ইত্যাদি অনেক নাম করণ করলেও এটাকে লক ডাউনই বুঝেছে। এর অর্থ জনগণের কাছে দাঁড়িয়েছে সরকারের নির্দেশে অফিস, আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, দোকান পাট, গণপরিবহন, হাট বাজার, শিল্প কল কারখানা সব এক সপ্তাহ বা দুই সপ্তাহ বন্ধ রেখে জনসমাগম হতে না দেয়া। করোনা যেহেতু মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় তাই মানুষের সমাগম বন্ধ রাখা খুব জরুরি। করোনা সংক্রমণ বাড়তে না দেয়ার জন্যে এই সরকারি নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, ফলে সঠিক বলেই ধরে নেয়া হয়েছে। দুইহাজার বিশ সাল থেকে কয়েক দফা এভাবে বিধি নিষেধ আরোপ করা হোল, এক সপ্তাহের কথা বলে শুরু করে তা দুই মাসে গিয়ে ঠেকলো। একবার মেয়াদ শেষ হতে না হতেই আরও বাড়াতে গিয়ে মাসের পর মাসও পেরিয়ে গেছে।
মধ্যবিত্ত এবং উচ্চ বিত্ত কর্মজীবিদের জন্যে নির্দেশনা এলো “ওয়ার্ক ফ্রম হোম” বা বাড়ীতে বসে কাজ করার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই প্রস্তাব দিয়েছে; এবং কর্পোরেট অফিস, এনজিও, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এমন নির্দেশনা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেছে। তারা মনে করে করোনা ভাইরাস ঠেকাতে হলে ঘরের বাইরে বের হওয়া ঠিক হবে না। আইসিটি প্রযুক্তির কল্যাণে মধ্য ও উচ্চবিত্তের ঘরে ঘরে ইন্টারনেট সংযোগ থাকায় ওয়ার্ক ফ্রম কার্যকর করা হোল। দেখা গেল এতে একটি কম্পুটার/ বা ল্যাপটপ ঘরে থাকা জরুরি, মোবাইল ফোনটাও এন্ড্রয়েড হতে হবে, নইলে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বেন। অফিসের সাথে যোগাযোগ রাখা সম্ভব হবে না। লক ডাউনের প্রথম অবস্থায় ল্যাপটপ বেচা কেনার খোঁজ নিলে জানা যেত অনেক পরিবারে কাজ রক্ষা করতে গিয়ে ধার করে হলেও ল্যাপটপ কেনা হয়েছে, বাড়ীতে ওয়াই-ফাই সংযোগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু দেখার বিষয় হচ্ছে মধ্যবিত্ত পরিবারের সব নারী কি ওয়ার্ক-ফ্রম-হোম করতে পেরেছেন? তা্রা কাজ রক্ষা করতে পেরেছেন? অনেক নারী নীরবে চাকুরি হারিয়েছেন তার ঘরে বসে কাজ করার সরঞ্জাম না থাকার কারণে। কিন্তু তাই বলে তাদের কাজ কমে যায় নি। কারণ ফ্লাট বাড়ীতে গৃহকর্মীদের ঢুকতে দেয়া হয় নি, তারা করোনা বহন করে আনবে বলে। তাই মধ্যবিত্ত নারীদের ঘরের কাজ করতে হয়েছে আগের চেয়েও বেশি, কারণ এখন স্বামী-সন্তান সবাই ঘরেই আছে।
ওদিকে নিম্ন বিত্ত ও গরিব মানুষের জীবন জীবিকা হুমকির মধ্যে পড়ে গিয়েছে। এখনো লক ডাউন দিলেই সে প্রশ্নই ঘুরে ফিরে উঠছে। দিন আনে দিন খায়, মাস গেলে বেতন না হলে যাদের চলে না, তাদের জন্যে লক ডাউন যে নামেই আসুক না কেন করোনার মতোই ভয়ংকর হয়ে যায়। করোনা দেখা যায় না, কিন্তু জীবিকা হারালে দিন শেষে বা মাস শেষে হাতে টাকা না থাকলে বেশ দেখা যায়। সকলের চোখে মুখে ফুটে ওঠে। বস্তিতে থাকা মানুষদের মধ্যে গৃহকর্মীরা ভালই আয় রোজগার করছিল, তারা দ্রুত কাজ হারালো। মাসের পর মাস কোন বাসাবাড়িতে তাদের বিনা কাজে বেতন দিয়ে রাখবে না। শুরুতে কেউ কেউ বেতন চালিয়ে নিলেও সেটা বেশি দিন করা সম্ভব হয় নি।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার হিসাবে সারা বিশ্বে প্রায় ১৩ কোটি ৬০ লক্ষ শ্রমজীবি স্বাস্থ্য এবং সামাজিক সেক্টরে কাজ করে, এর ৭০% নারী। বিশ্বের ৮০% গৃহ শ্রমিকই নারী। বাংলাদেশে গৃহশ্রমিকের সংখ্যা আইএলও’র হিশাব অনুযায়ি ১ কোটি ৫ লক্ষ (২০১৩ সালের জরিপ), যার ৯০% নারী। অর্থাৎ সংখ্যার দিক থেকে গার্মেন্ট শ্রমিকের চেয়েও গৃহশ্রমিক বেশি। প্রবাসেও বেশির ভাগ নারীদের কাজের সুযোগ দেয়া হয় গৃহশ্রমিক হিসেবে। করোনা এবং লক ডাউনের কারণে এদের সিংহভাগ কাজ হারিয়েছে।
বস্তিতে থাকা নারীদের কাজ কর্ম না থাকায় তারা ঢাকা শহর ছেড়েছে। অনেক গার্মেন্ট কারখানা কর্মী ছাটাই করেছে। প্রায় তিন লাখের ওপর নারী শ্রমিক কাজ হারিয়েছে বলে জানা যায়। স্বামী-স্ত্রী উভয়ে কাজ হারাবার পর যখন তারা গ্রামে ফিরে গেলেন, কিন্তু তাদের বাপের বাড়ী কিংবা শ্বশুর বাড়িতে খুব স্বাগত জানানো হয় নি। এতো দিন তারা প্রতি মাসে বাড়িতে টাকা পাঠাতো, কারণ তাদের ছেলে মেয়েদের দাদা-দাদী বা নানা-নানীর কাছে রেখে গিয়েছিল। কিন্তু এখন তারা ফিরে এসেছে নিঃস্ব হয়ে। বস্তির বাড়ী ভাড়া এবং দোকানের ঋণ শোধ করে হাতে বেশি টাকা নিয়ে আসতে পারে নি।
গ্রামে পুরুষের জন্যে কিছু কাজ পাওয়া গেলেও নারীদের জন্যে কোন কাজ নেই। গ্রামে কাজ ছিল না বলেই তো তারা এতো কষ্ট করে আয় উপার্জনের জন্যে তারা শহরে গিয়েছিল। এই শহর তাদের কাজ ছাড়া আর কিছুই দেয় না। তাই একটু ছুটি হলেই তারা ছুটে আসে গ্রামে। লক ডাউনের কারনে কাজ হারিয়ে যারা গেছে তাদের আবার কোন চাকুরি না হওয়া পর্যন্ত ঢাকা শহরে ফিরতে হবে না। গ্রাম তাদের নিয়ে কি করবে?
তাদের সাথে আরও যোগ হয়েছে প্রবাসী শ্রমিক। তারাও দলে দলে ফিরে আসছে করোনার কারণে কাজ হারিয়ে। পুরুষ প্রবাসী শ্রমিকরা ফিরে আসলেও নারীদের আর্থিক অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হতে হয়েছে। আর যেসব নারী নিজেরাই প্রবাসে কাজ করে ফেরত আসছেন তারা ঋণ করে যাওয়ার খরচও হয়তো তুলতে পারেন নি।
ছোট বড় শহরে করোনার আগে নারীরা তাদের স্বল্প পুঁজি নিয়ে নানা ধরণের ব্যবসা শুরু করেছিলেন এবং মোটামুটি ভালই করছিলেন। বুটিক, ক্যাটারিং, খাদ্যসহ নানা ধরণের কাজে নারীরা জড়িত ছিলেন যা দেশের অর্থনীতিতে ক্ষুদ্র ও মধ্যম উদ্যক্তা (এসএম ই) হিসেবে পরিচিত হয়ে গিয়েছিল। তারা দেশের প্রায় ৬০ লাখ ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা জিডিপিত ২৫% অবদান রেখেছে, এবং ৭৮ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে। তাদের কারণে প্রায় ৩ কোটি মানুষের, (বেশির ভাগ নারী) জীবিকার সংস্থান হয়েছে। গত দেড় বছরে তাদের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেছে। প্রায় ৫২% উদ্যোক্তা তাদের ব্যবসা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। এবং তাদের সাথে যারা কাজ করতো তারাও বেকার হয়ে গেছে। অন লাইন ব্যবসাও করা কঠিন হয়ে পড়েছে কারণ সেটা চালাতে হলেও যে উৎপাদন করা দরকার তা তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না।
ভ্যাক্সিনে কি নারী-পুরুষ সমতা আছে?
ভারতের সেরাম ইন্সটিটিউট থেকে আনা ভ্যাক্সিন দেয়া শুরু হয়েছে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে। এ পর্যন্ত সবার দুটি ডোজ দেয়া সম্পন্ন হয় নি। একটি ডোজ নিয়েছেন ৫৪,৭০,১৩১ জন পুরুষ (৫৪%) এবং ৩৫,৮৫,১০১ জন নারী (৩৬%)। দুটি ডোজ পেয়েছেন ২৭,৮৯,৭৫৪ জন পুরুষ (৬৩%) এবং ১৫,৮০,২৩০ জন নারী (৩৬%) ডোজ নিয়েছেন। চার ধরণের ভ্যাক্সিন এখন দেশে এসেছে, এস্ট্রাজেনিকা, ফাইজার, সিনোফার্ম এবং মডার্না। তবে ফাইজার এবং এস্ট্রাজেনেকার ভ্যাক্সিন এখন খুব হাতে নেই। সিনোফার্ম এবং মডার্নার ভ্যাক্সিন দেয়া হচ্ছে।
সাধারণ নারীদের জন্যে ভ্যাক্সিনের নিবন্ধন থেকে শুরু করে ভ্যাক্সিন দিতে যাওয়ার প্রক্রিয়া খুব সহজ নয়। নারীদের জন্যে আলাদা করে কোন ব্যবস্থাও করা হয় নি। ভোটের লাইনের মতো নারীদের ভ্যাক্সিন নেয়ার আলাদা লাইন আছে বটে, কিন্তু ঝুঁকিপুর্ণ নারীদের, যেমন বয়স্ক নারী, গর্ভবতী নারী ইত্যাদী, তাদের জন্যে আলাদা কোন উদ্যোগ নেই। ভ্যাক্সিন দেয়াই যদি কোভিড ১৯ সংক্রমণ এবং ঝুঁকি কমানোর অন্যতম প্রধান উপায় হয়ে থাকে তাহলে নারী এই দৌড়ে পিছিয়ে থাকছে নিয়মের কারণে এবং নারীর সুবিধা অসুবিধার কথা বিবেচনায় না আনার কারণে।
করোনায় অসমতা বৃদ্ধি?
আমরা জানি, যে কোন মহামারী বা অতিমারী বিদ্যমান অসম অবস্থাকে প্রকট করে তোলে। ধনি-গরিব, নারী-পুরুষ, ধর্মীয়, বর্ণ ও জাতি গোষ্টির অসমতা, শ্রমিক-মালিক, প্রতিবন্ধিতার শিকার মানুষ, বয়স্ক-তরুণ ইত্যাদী নানা ধরণের অসম যা প্রকাশ্যে বা অপকাশ্য ছিল তা ফুটে উঠছে। আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা, অপ্রতুল টেস্ট করার সক্ষমতা, খাদ্য, ভ্যাক্সিন – এসব কিছুই কি আমরা সমান ভাবে এবং প্রয়োজন অনুসারে সকলকে দিতে পারছি? বা সে চেষ্টা কি আছে? ভ্যাক্সিনের ক্ষেত্রেই দেখা যাক না কেন। প্রথম যেভাবে দেয়া হয়েছে তা মূলত মধ্যবিত্ত, যারা অন-লাইন রেজিস্টার করতে পেরেছ্ তারাই পেয়েছে। আর যখন সীমিত সংখ্যক টিকা নিয়ে “গণটিকা” দিচ্ছে তখন তা এমনই গণ হয়েছে যে ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে টিকা ছাড়াই বাড়ী ফিরতে হয়েছে হাজার হাজার মানুষকে, নারীকে তো বটেই। তবে আশংকার বিষয় হচ্ছে তারা করোনা নিয়ে ফেরেনি এমন নিশ্চয়তা কি দিতে পারছেন?
আমাদের দেশে করোনা সংক্রমণ থেকে মুক্ত থাকতে হলে অন্তত ৭০% মানুষকে টিকার আওতায় আনতে হবে, সেখানে আমাদের টিকা দেয়া হয়েছে মাত্র ৩%। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর (১০ আগস্ট, ২০২১) জানাচ্ছে, টিকার প্রথম ডোজের আওতায় এসেছে ১ কোটি, ৪৭ লাখ, ৬৯ হাজার ৪৪৭ জন, টিকার ২য় ডোজের আওতায় এসেছে ৪৯ লাখ, ২ হাজার ১৭৩ জন। এটা সবাই জানে টিকার দুটি ডোজ সম্পন্ন না করা হলে গ্রহীতার শরীরে এন্টিবডি তৈরি হবে না, ফলে টিকা দিয়ে যে সুরক্ষা পাওয়ার কথা ছিল তা অর্জন করা যাবে না। নিজ দেশে টিকা উৎপাদনের কোন উদ্যোগ না থাকায় ভারত, চিন, যুক্ত রাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভ্যাক্সিন উপহার, দয়া বা কিনে আনতে হচ্ছে। আমাদের প্রয়োজন কয়েক কোটি ডোজ টিকার, আমাদের টিকা আসছে মাত্র কয়েক লাখ। ভারতের সেরাম ইন্সটিটিউট থেকে অর্ডার করা ৩ কোটি ডোজ COVISHIELD ভ্যাক্সিনের মধ্যে মাত্র ৫০ লাখ ডোজ পেয়েছে, এর সাথে ভারত উপহার হিসেবে দিয়েছে ২০ লাখ ডোজ। চিন থেকে ৫ লাখ ডোজ সিনোফার্ম ভ্যাক্সিন উপহার হিসেবে এসেছে। GAVI vaccine alliance থেকে বাংলাদেশ ৬ কোটি ৮০ লাখ ডোজ পাবে বলে আশ্বাস দেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে মডার্না, ফাইজার, জনসন এন্ড জনসনের ভ্যাক্সিনও সীমিতভাবে এসেছে এবং দেয়া হয়েছে। সব যোগ করলেও বাংলাদেশের প্রয়োজনীয় সংখ্যক ভ্যাক্সিন হবে কিনা সন্দেহ রয়েছে। অথচ দেশে ভ্যাক্সিন উৎপাদনের জন্যে যে উদ্যোগ নেয়া দরকার তা না করে ভ্যাক্সিন কুটনীতির আশ্রয় নেয়া হচ্ছে যা ভিক্ষা করার সামিল।
অথচ ভ্যাক্সিন উৎপাদনের জন্য এই মহামারীতেও ভ্যাক্সিনের Intellectual Property Rights Agreement (TRIPS) বিশ্বের বড় বড় ওষুধ কোম্পানিগুলো তাদের হাতে রেখে দিয়েছে যেন তারা এই ভ্যাক্সিনের ব্যবসা করে মুনাফা করতে পারে। ইতিমধ্যে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় ভ্যাক্সিনের ওপর TRIPS সাময়িকভাবে শিথিল করে উন্নয়নশীল দেশ সমূহকে নিজ দেশে উৎপাদনে সহায়তার দাবি উঠেছে। তাহলে সকল দেশ স্বল্প খরচে ভ্যাক্সিন উৎপাদন করে মহামারি মোকাবেলা করতে পারবে। ভ্যাক্সিন নিয়ে ব্যবসা ও রাজনীতির বিরুদ্ধ্বে অনেকেই দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে “Feminists for People’s Vaccine” । বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নারীবাদীদের নিয়ে গড়ে ওঠা এই জোট কোভিড-১৯ নিয়ে যে জাত, বর্ণ, লিংগ, ধর্ম, সহ নানা রকম বৈষম্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছে।
তথ্য সংগ্রহ, গবেষণা এবং তার ভিত্তিতে সঠিক নীতি ও কৌশল গ্রহন করবার কোন কার্যকর প্রতিষ্ঠান আমরা সরকারি বা বেসরকারি কোন পর্যায়েই গড়ে তুলতে পারিনি। এর কুফল জনগণ ভোগ করছে। এর অবসান কিভাবে হবে কে জানে!
১২ আগস্ট, ২০২১