অভিযান-১০: দায়িত্বহীনতা ও কর্তব্যের অবহেলার আগুনে পুড়েছে মানুষ
ফরিদা আখতার || Tuesday 28 December 2021 ||কেন এত নিরীহ মানুষের এভাবে প্রাণ দিতে হলো, কেন মায়েরা তার সন্তানকে ধরে রাখতে পারলেন না; কেন পরিবারের সদস্যরা একে অপরের কাছ থেকে ছিটকে পড়লেন, কেউ লাশ হলো, কেউ রক্ষা পেল আর কেউ এখনো নিখোঁজ?
গত কয়েকদিন জুড়ে আমরা দেখছি এবং শুনছি কি করে অভিযান-১০ লঞ্চটি ঢাকা থেকে বরগুনা যাওয়ার পথে ঝালকাঠির গাবখানের কাছাকাছি সুগন্ধা নদীতে পানির ওপর থাকা অবস্থায় ভয়াবহ আগুনে পুড়েছে। প্রায় ৪১ জন মৃত্যুবরণ করেছেন, আহত হয়েছেন প্রায় দুই শতাধিক। নিখোঁজের সংখ্যা জানা নাই। মৃত্যুর সংখ্যা পরে আরও বেড়েছে।
ঘটনাটি ঘটেছে ২৪ ডিসেম্বর ভোর রাত ৩টার পর, তখন যাত্রীদের অধিকাংশ ঘুম ছিল। তারা ভাবতেও পারেননি যে তাদের গন্তব্যে পৌঁছানোর আর সম্ভাবনা নেই। আগুন টের পাওয়ার পর প্রাণ বাঁচানোর জন্যে কতভাবে চেষ্টা হয়েছে তা বেঁচে যাওয়া যাত্রীদের কাছ থেকে যা শোনা গেছে শিউরে ওঠার মতো।
পানিতে লাফ দিলে সাঁতরে উঠতে না পারার অনিশ্চয়তা আর ডেকে থাকলে পুড়ে যাওয়া – এই দুই হিসাবের মধ্যে সকলে সফল হতে পারেননি। নিজে একা লাফ দিলে তো হচ্ছে সাথে শিশুটি রয়েছে। তাকেও নিতে হবে। এভাবে পরিবারের সদস্যরা একে অপরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে। মায়েরা সন্তানকে ধরে রাখতে পারেননি; স্বামী বেঁচে গেলেও স্ত্রীকে হারাতে হয়েছে। আমরা জানি যে কোনো দুর্ঘটনায় নারী ও শিশুর নিহত হওয়ার সংখ্যা বেশি থাকে। এখানেও তাই হয়েছে নিশ্চয়ই, যদিও কোনো গণমাধ্যমে নারী-পুরুষ আলাদা করে সংখ্যা দেয়া হয়নি।
আহতদের বিভিন্ন হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে, কিন্তু সেখানেও চিকিৎসাধীন অবস্থায় প্রতিদিন কেউ না কেউ মারা যাচ্ছেন। শ্বাসনালী পুড়ে যাবার কারণে বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়েছে। জানাজা হয়েছে ২৩টি লাশের কফিনের সারি নিয়ে। কারণ এই হতভাগ্যদের লাশ নেয়ার কেউ ছিল না, বা তাদের শনাক্ত করা যায়নি। এইসব দৃশ্য টেলিভিশন ও পত্র-পত্রিকায় গত তিন চারদিন ধরে দেখছি আর বোঝার চেষ্টা করছি সমস্যাটা কোথায়? কেন এত নিরীহ মানুষের এভাবে প্রাণ দিতে হলো, কেন মায়েরা তার সন্তানকে ধরে রাখতে পারলেন না; কেন পরিবারের সদস্যরা একে অপরের কাছ থেকে ছিটকে পড়লেন, কেউ লাশ হলো, কেউ রক্ষা পেল আর কেউ এখনো নিখোঁজ?
এমনই অনেক প্রশ্ন আমাদের মনে জাগছে; জানি এই সব প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্যে কোন কর্তৃপক্ষ নেই। সংশ্লিষ্ট দায়ী ব্যাক্তি ও প্রতিষ্ঠান জানেন, গণমাধ্যমে এই প্রসঙ্গে খবর কমে গেলেই আর কারও মাথাব্যাথা থাকবে না ।
কিন্তু আমরা যতই খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করছি ততই দেখা যাচ্ছে, এর মধ্যে রয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতা, কর্তব্যের অবহেলা এবং দ্রুত মুনাফা কামাবার লোভ। এই দিক থেকে দেখলে এই ঘটনাকে দুর্ঘটনা বলা যায় না, এটা হত্যাকাণ্ড ছাড়া আর কিছু নয়।
কোনো বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে যে কাজটি সবার আগে হয়ে যায় তা হচ্ছে তদন্ত কমিটি গঠন। এখানেও তদন্ত কমিটি গঠনে কোন দেরি হয়নি, তিনটি কমিটি গঠিত হয়েছে। এই ব্যাপারে বাংলাদেশের মতো কেউ উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারবে না। কিন্তু সবাই বিভাগীয় বিষয়াদি নিয়ে দেখবেন। তদন্তের প্রতিবেদন কবে পাবো বা আদৌ পাবো কি না সেই প্রশ্ন জনগণের মধ্যে আছে। কারণ আগের দুর্ঘটনাগুলোর কোন সুরাহা এখনও হয়নি। কারো কোনো সাজা হতে আমরা দেখিনি, কিংবা কোনো ধরণের তদারকি বাড়ানোও হয়নি। কাজেই তদন্ত কমিটির ঘোষণা দিয়ে নয়, প্রতিবেদন দাখিল করে এবং যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমেই একমাত্র আস্থা অর্জন করা যাবে। দৃষ্টান্তমূলক সাজা এবং ব্যবস্থা নিতে হবে।
অভিযান-১০ সম্পর্কে যেসব তথ্য গণমাধ্যমে এসে গেছে তাতে বোঝা যায় এভাবে চলতে থাকলে যে কোনোদিন দুর্ঘটনার কবলে পড়তে পারতো। লঞ্চটি খুব পুরনো নয়; এর ফিটনেস সনদ অনুযায়ী, এমভি অভিযান-১০ লঞ্চটি ২০১৯ সালে নির্মাণ করা হয়। এর দৈর্ঘ্য ৬৪ মিটার ও গভীরতা ২ দশমিক ৮০ মিটার। লঞ্চটির রেজিস্ট্রেশন নম্বর ০১-২৩৩৯। তিন তলা। এরই মধ্যে কোন কারণে লঞ্চটির ইঞ্জিন বদল করা হয়েছিল কর্তৃপক্ষের অনুমতি না নিয়ে। পত্র-পত্রিকার খবর অনুযায়ী দুটো রিকন্ডিশন্ড ইঞ্জিন লঞ্চটিতে লাগানো হয়েছিল কিন্তু সেগুলো পূর্ণ আরপিএম (প্রতি মিনিটে ঘুর্ণন)-এ চাহিদামত গতি দিচ্ছিল না। আগের ইঞ্জিনের চেয়ে বেশি হর্সপাওয়ারের দুটি রিকন্ডিশন্ড ডাইহাটসু মেরিন ইঞ্জিন লাগানো হয়। ফলে মালিকপক্ষের সিদ্ধান্তেই ইঞ্জিন বদলানো হয়েছে যা কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়নি। অর্থাৎ আশা করা হচ্ছে যে মালিকপক্ষ অনুমতিবিহীন কাজ করে নিজেই কর্তৃপক্ষকে জানাবে?
একটি তথ্য পরিস্কার, লঞ্চটি তার স্বাভাবিক ধারণক্ষমতার বেশি যাত্রী নিয়ে যাচ্ছিল। সেদিনের যাত্রী সংখ্যা ছিল প্রায় ৮০০ যাত্রী, বিআইডব্লিউটিএ'র কর্তৃপক্ষ বলছে অনুমোদন দেয়া হয়েছে ৪২০ জন যাত্রীর। অর্থাৎ ধারণক্ষমতার প্রায় দ্বিগুন যাত্রী ছিল। এই অভিযোগ যাত্রীরাও করেছেন। অর্থাৎ আগুন না লাগলেও অন্য কোন দুর্ঘটনাও ঘটতে পারতো। লঞ্চ যাত্রার আগে কেউ কি দেখার ছিল যাত্রী বেশি নেয়া হচ্ছে কিনা? কেউ বিষয়টি দেখেনি।
ইঞ্জিন বদলানোর বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে জানানো না হলেও তাদের নিজে থেকে তদারকি থাকলে নিশ্চয়ই জানা যেত। শুধু ইঞ্জিন বদলানো হয়েছে তা নয়, কিছু গণমাধ্যমে এসেছে যে সেদিন ইঞ্জিনে ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও লঞ্চটি ছেড়েছে। ইঞ্জিন লাগানোর পর থেকেই নানা ধরণের সমস্যা ছিল। সে-কারণে মেকানিক দিয়ে ঠিক করানোর চেষ্টা ছিল। কিন্তু এই ত্রুটি সাধারণ মেকানিকের সারাবার পর্যায়ে ছিল না বলেই মনে হচ্ছে। মালিকপক্ষ নিজের গাফিলতি সম্পর্কে জানেন বলেই প্রথম থেকেই বলছেন, '"ঞ্জিনে কোনো ত্রুটি ছিল না।" তারা আগুনের উৎস সম্পর্কে যাত্রীদের দিকেই আঙ্গুল তুলছিলেন। অথচ বেঁচে যাওয়া যাত্রী, ফায়ার সার্ভিস ও র্যাবের কর্মকর্তাদের প্রাথমিক ধারণা, ইঞ্জিন থেকেই আগুনের সূত্রপাত হয়েছে।
শুধু তা-ই নয়, ইঞ্জিনরুম ছয় হাজার লিটার তেল ছিল, পাশেই ছিল ডিজেলের ব্যারেল। একই ফ্লোরে ছিল ক্যান্টিন যেখানে গ্যাসের সিলিন্ডার ছিল। এত দাহ্য পদার্থ থাকা অবস্থায় সামান্য আগুনে কি ভয়াবহ হতে পারে অভিযান-১০ তা-ই দেখিয়ে দিল। এই আগুন কি আর পানিতে নিভবে?
একটি বিষয় বোধগম্য হচ্ছে না, লঞ্চের ড্রাইভার আগুন লাগার সাথে সাথেই পাড়ের দিকে না ভিড়িয়ে আরো ১০-১২ কিলোমিটার পথ কেন অতিক্রম করলেন। রাত ৩টায় যখন আগুন লেগেছিল তখন ঝালকাঠি টার্মিনাল থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরে ছিল। একটি পত্রিকার খবরে জানা গেছে সে সময় লঞ্চের ক্যাপ্টেন হুইলের কাছে ছিলেন না, ফলে লঞ্চ নিজে নিজেই এগিয়ে যায়। নিয়ন্ত্রণ করার কেউ ছিল না। সময়মতো কুলে ভিড়লে যাত্রীরা কুলের কাছে গিয়ে লাফ দিয়ে প্রাণ বাঁচাতে পারতেন। নিঃসন্দেহে হতাহতের ঘটনা অনেক কম হতো। লঞ্চটি পানির ওপরে থেকেই আগুনে পুড়ে ছারখার হোল। নীচে পানি, ওপরে আগুন। এমন একটি দুর্ভাগ্যজনক অবস্থা। অন্যান্য আগুনের বেলায় পানির অভাব ঘটে, অথচ এখানে পানির কোন অভাব ছিল না। কিন্তু অভাব ছিল অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার।
এখানে উল্লেখ করতে হয় যে, এই অবস্থায় স্থানীয় মানুষরা এই শীতের রাতে পানিতে ঝাঁপ দিয়ে লঞ্চের যাত্রীদের কুলে তুলে এনেছেন। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন ৩৫ বছর বয়সি ট্রলারচালক মিলন খান, যিনি ৩০০ যাত্রীকে উদ্ধার করে পাড়ে পৌঁছে দেন। তীরে পৌঁছে স্থানীয়দের সহায়তায় গরম কাপড়সহ কাউকে খাবারের ব্যবস্থা করেন। কাউকে হাসপাতালের পথ পর্যন্ত এগিয়ে দেন। একদিকে দায়িত্বহীনতা অন্যদিকে সাধারণ মানুষের মানবিকতা দেখে আশা জাগে।
লঞ্চে অতিরিক্ত যাত্রী বহন করা নতুন কোনো ঘটনা নয়। যাত্রী বেশি হলে মুনাফা বেশি হবে এই সহজ অংকেই মালিকরা বিশ্বাস করেন। সেটা সড়ক পরিবহনেও হয়। এতে অনেক দুর্ঘটনা ঘটে কিন্তু আজ পর্যন্ত এই বিষয়টির কোন নিয়ন্ত্রণের আওতায় আনা যায়নি। অভিযান-১০ এর ক্ষেত্রে এত আলোচনার পরও মনে মালিক পক্ষ বা তাদের সংগঠন এখনো বিশ্বাস করছেন না যে তাদের দিক থেকে মারাত্মক ত্রুটি ছিল। টেলিভিশন টকশোগুলোতে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সমানে সাফাই গেয়ে যাচ্ছেন। এবং নিজেদের দিক থেকে যে তদারকির অভাব ঘটেছে তা বুঝছেন না বা বুঝতে চাইছেন না।
অন্যান্য দেশে আমরা দেখি এমন ঘটনায় দায় স্বীকার করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সোজা পদত্যাগ করেন। কিন্তু এখানে আমরা দেখছি সংশ্লিষ্টরা দায় এড়িয়ে যাচ্ছেন। নৌ মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী, বি আই ডব্লিউটিএ-র উর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট যারা- তাদের পদত্যাগ করা উচিত ছিল, কারণ তাঁরা দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন।
ইঞ্জিনের ত্রুটির তদন্ত প্রতিবেদন হয়তো আমরা পাবো, কিন্তু দায়িত্বহীনতা এবং অবহেলার দায় কি কেউ স্বীকার করবেন না? তদন্ত রিপোর্ট কি সেটা উল্লেখ করবে? কোনো ব্যবস্থা কি নেয়া হবে? নৌপথে যাতায়াত সহজ এবং এটাই দক্ষিনের সাধারন মানুষের প্রধান অবলম্বন। এত মৃত্যু কি মেনে নেয়া যায়? যারা বেঁচে গেছেন কিন্তু শরীরে আংশিক পুড়ে গেছে তাদের বাকি জীবন কেমন হবে সে খোঁজ কি সরকার রাখবে?
এই লেখাটি ২৭ ডিসেম্বর ২০২১ তারিখে 'অভিযান-১০: দায়িত্বহীনতা ও কর্তব্যের অবহেলার আগুনে পুড়েছে মানুষ' এই শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে।