আফ্রিকার দেশ সেনেগালে 'জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কৃষি ধ্বংস এবং তাদের জীবন জীবিকার উপর মারাত্মক প্রভাব'

সোমবারের আড্ডায়:
২০ জুন, ২০২২ নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা, ৬/৮ স্যার সৈয়দ রোড, মোহাম্মদপুরে সোমবারের আড্ডার সদস্য ৩২ জন প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিলেন জলবায়ু বিষয়ে আলোচনার জন্যে। কারণ জলবায়ু দুর্যোগ এখন বাস্তব হয়ে উঠেছে। এই প্রসংগে আলোচনার জন্যে উপস্থিত ছিলেন ফরিদা আখতার। সম্প্রতি তিনি পশ্চিম আফ্রিকার দেশ সেনেগালে (২৭ মে থেকে ৪ঠা জুন, ২০২২) জলবায়ু বিষয়ে একটি সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে এসেছেন। সম্মেলনের আয়োজকরা হলেন, “গ্লোবাল ওয়াকিং গ্রুপ বিঅন ডেভেলপমেন্ট”। স্বাভাবিক আড্ডার চেয়ে সেদিন একটু আনুষ্ঠানিক আলোচন হয়ে গিয়েছিল। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন সীমা দাস সীমু।
ফরিদা আখতার সেনেগাল সম্মেলনের আলোচনা শুরুর আগে বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেন। বাংলাদেশে এখন যা ঘটছে এটাও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। আগে ৫ বছর পর পর এ ধরণের বন্যা হতো। এখন ঘন ঘন বন্যা, খরা হচ্ছে এবং বিশেষজ্ঞদের মতে আরো হতে থাকবে। এটা জলবায়ু পরিবর্তনের একটা বাস্তবতা। আমাদের চার পাশে ভারত ঘিরে আছে। একদিকে ফারাক্কা বাঁধ। যখন তখন পানি ছেড়ে দিলে বন্যা হবে। ভারতেও বন্যা হচ্ছে। মেঘালয়ে খুব বৃষ্টি হচ্ছে। ভারতের চেরাপুঞ্জিতে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি হচ্ছে যা ১২২ বছরে্ও এমন বৃষ্টি হয়নি। এখন ভারত তাদের যে সমস্ত নদীতে বাঁধ আছে সে সব গেট খুলে দিচ্ছে। যখন বাংলাদেশে পানির দরকার তখন ভারত পানি দেয় না আর যখন দরকার হয় না তখন ভারত পানি দেয়। এটা বাংলাদেশের মানুষের জন্য দুঃখের বিষয়।
ফরিদা আখতার বন্যার আলোচনায় অনেক ছবি দেখান যা ফেসবুক এবং ইন্টারনেট থেকে নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, বন্যা শুধু পানি ওঠা নয় এর সাথে জড়িয়ে আছে মানুষের জীবন, পরিবারের সদস্যদের প্রাণে বাঁচানোর আকুল চেষ্টা। শিশু, বৃদ্ধ প্রত্যেকেরই প্রাণ বাঁচাতে হবে; শুধু মানুষ নয়, গরু, ছাগল, কুকুর, বিড়ালও পরিবারের অংশ। ছবিতে দেখা যায় একটি পাতিলে বাচ্চাকে বসিয়ে রাখা হয়েছে। ঘরের চালের ওপর মানুষ বসবাস করছে। ছোট শিশুরা তাদের প্রিয় পোশা বিড়ালকে সাথে করে নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যাচ্ছে। মানুষ ঘাড়ে করে গরু, ছাগল নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে যাচ্ছে। করুন সব ছবি। এই গরু, ছাগল বিড়াল তাদের পরিবারেই অংশ।
ছোট একটি মেয়ে তার ছোট ভাই বোনকে উচু করে ধরে পানি পার হচ্ছে। বয়স্ক মানুষ, অসুস্থ মানুষদের অনেক কষ্ট করে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এই ভয়াবহ বন্যার চিত্র দেখলে আৎকে উঠতে হয়। বন্যাকবলিত এলাকার মানুষ দুর্বিসহ জীবন যাপন করছেন। তাদের সহায়তা করার জন্য আমাদের এগিয়ে আসতে হবে। আড্ডার সদস্যদের উদ্যোগে এই সভা থেকে বন্যাকবলিত মানুষের জন্য টাকা সংগ্রহ করা হয়।
ফরিদা আখতার: জলবায়ু সম্মেলন, সেনেগাল,আফ্রিকা
সেনেগাল পশ্চিম আফ্রিকার একটি দেশ, রাজধানীর নাম ডাকার। আটলান্টিক মহাসাগরের তীরে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং গভীর সমুদ্র বন্দরের মেগাপ্রকল্প কি করে সেখানে মানুষের বিশেষ করে মাছ ধরার ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠির ক্ষতি করছে এবং জনগণ এর প্রতিবাদ করছে তা জলবায়ু সম্মেলন বিশেষভাবে আলোচনা হয়। আরও আলোচনা হয় সেনেগালের মানুষের জীবন জীবিকার অন্যতম প্রধান মাধ্যম সমুদ্রে নৌকা নিয়ে মাছ ধরা। সম্মেলনে ২ দিন সমুদ্রে গ্রামের মাছ ধরা মানুষের অবস্থা এবং বর্তমানে তাদের দূর্দশার কারণ এবং সংগ্রামের বিষয়গুলি গভীরভাবে আলোচনা হয়।
আটলান্টিক সাগরের পাড়ে যারা বসবাস করেন তাদের অবস্থা দেখার জন্য সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীরা গ্রামে সালোম নদীর তীরের একটি রিসোর্টের মত জায়গায় ছিলেন। সেখানে চারদিন বিভিন্ন দেশের অংশগ্রহণকারীরা মাছ ধরার ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠির দূভোগ ও তাদের জীবন-জবিকা নিয়ে নিবিড় আলোচনা করেন। আলোচনায় বিশেষভাবে স্থান পায় জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা করতে গিয়ে যে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে বা Transition হচ্ছে তা ন্যায্য বা Just হচ্ছে কি না। এর ফলে মানুষের জীবন-জীবিকার অধিকার ক্ষুন্ন হচ্ছে কি না। একই সাথে উন্নয়নের কথা বলে সরকার যেসব মেগাপ্রকল্প হাতে নেয় তা জনগণের জন্যে কি ক্ষতি হচ্ছে।
আসলে জলবায়ু পরিবর্তন হ্ওয়ার ফলে যে দুর্যোগ হচ্ছে তার কারনে সারা বিশ্ব এখন পরিবর্তন চাচ্ছে। বিশেষ করে পরিবর্তনটা চাচ্ছে যে, কার্বনডাইঅক্সাইডের যে নির্গমন হয় সেটা কি করে বন্ধ করা যায় বা কমানো যায়। কার্বনডাইঅক্সাইড নির্গমন প্রধানতঃ হয় জীবাষ্ম জ্বলানী নির্ভর কর্মকান্ডের জন্যে, যেমন ইন্ডাস্ট্রিয়াল কৃষি, সার, ডিজেল ইত্যাদি ব্যবহার করা, গাড়ীর ব্যাবহার, বিদ্যুৎ উৎপাদন ইত্যাদি। এই অবস্থার পরিবর্তন বা ট্রানজিশন করতে গিয়ে ধনি দেশগুলো আরেক ধরণের শোষণের পথ বেছে নিচ্ছে, তারা জীবাষ্ম জ্বালানী না কমিয়ে প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে কার্বন কমানোর ব্যবস্থা করছে। এই বিষয়গুলো পর্যালোচনা করার জন্যে এই ওয়ারকিং গ্রুপ তৈরী হয়েছে। তারা বলছে উন্নয়ন অতিক্রম করে আমরা কি চিন্তা করতে পারি। আমরা দেশের বা রাষ্ট্রের ব্যবস্থাটাকে বদলাবো। দু’একটা প্রযুক্তি ব্যবহার করে পরিবর্তন হবে না। সেনেগালের রাজধানী ডাকার এর University Cheikh Anta Diop তে যে মিটিং হয়েছে সেখানে এই আলোচনা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি এখানে ভিষণভাবে দৃশ্যমান। আমরা এখনও জলবায়ু বিপর্যয় পুরোপুরি অনুধাবন করতে পারি নি কিন্তু ওখানে তা দেখা যায়। এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা, ইওরোপ এবং আমেরিকার প্রতিনিধিরা ছিলেন এই সভায়।
ছবিতে সেনেগালের বিভিন্ন দৃশ্য দেখানো হয়। সেনেগালের একটি অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে বায়োবাব (Baobab) গাছ। বায়োবাব গাছটি সেনেগালের মানুষের কাছে অত্যন্ত সম্মানের গাছ। কেউ গাছটি লাগায় না এমনিতেই রাস্তার পাশে, জমিতে হয়। কারো বাড়িতে যদি এ গাছ হয় সে খুব সম্মানিত বোধ করে। কারো অসুখ হলে এই গাছের নীচে রোগীকে শুইয়ে রাখে। বড় গাছ হলে তার নীচে খাবার দিয়ে যায়।
একটি অতি প্রাচীন বায়োবাব গাছ, ৮ শত বছরের পুরোনো দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। ৩২ মিটার চ্ওড়া পিছনে বড় খোপ আছে। চাইলে মানুষ ভিতরে ঢুকতে পারে। কেউ যদি রাস্তা দিয়ে যায় এই গাছটি দেখার জন্য একটু হলে্ও থামবেই। রাস্তার আশে-পাশে তেমন কোন গাছপালা নাই। শুধু বায়োবাব (Baobab) গাছ আছে। আকন্দ গাছ, নিম গাছ, বেশি হয়। দুটিই ওষুধি গাছ।
সেনেগালে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাদের কৃষি ব্যবস্থার উপর কি ধরণের প্রভাব পড়েছে তা ছবি দেখিয়ে আলোচনা করা হয়।
সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে বলে সমুদ্র পাড়ের ঘরবাড়ি ভেঙ্গে যাচ্ছে। সাগর এখন বাড়ির কাছে চলে এসেছে। অন্যদিকে কাছাকাছি এলাকায় কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, রাসায়নিক সার কারখানা, সিমেন্ট কারখানা স্থাপন করে তাদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। এখানকার প্রায় ২০,০০০ পরিবার এই এলাকা ছেড়ে কোথা্ও যাবে না বলে দিয়েছে।
এখানকার ৫০% মানুষ দরিদ্র সীমার নীচে বাস করছে। বেশির ভাগ মানুষের কাপড় চোপড় সব সিনথেটিক। আগে তাদের কৃষি ব্যবস্থা খুব ভাল ছিল। এখন জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য কৃষি জমি সব লবণাক্ত হয়ে গেছে।
তারা বীজ প্রায় হারিয়ে ফেলেছে। আগে ধান, গম, বাদাম, মিলেট উৎপাদন করতো এখন এসব ফসল নাই। এখন ৭০% চাল বাহির থেকে আমদানি করতে হয়।
ফসলি জমির মাটির রং লালচে। ছাগল পালন অনেক দেখা গেছে কিন্তু কালো কোন ছাগল দেখা যায় নাই, সব ছাগলই ছিল সাদা। সেখানে অনেক মসজিদ আছে, ৫ ওয়াক্ত আজানের শব্দ শোনা যায়। মুসলিম দেশ হলে্ও মেয়েদের বোরকা পরতে দেখা যায় নি। তবে সবাই মাথা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখে, সেটা আফ্রিকার ট্রাডিশন। সেনেগালের একজন অংশগ্রহণকারী আয়শাতু বলেন, সেনেগালে সোনার খনি আছে। কিন্তু দেশের সোনার কোন দোকান নেই্। সব সোনা রপ্তানী হয়। মেয়েরা সোনার গহনা পরতে পারে না।
এখানকার ভাষা হল ফরাসি। সাধারণ মানুষের স্থানীয় ভাষা ওলোফ। যুবক ছেলেরা একটু ইংরেজী শিখেছে। ছবিতে দেখা যায় ফাতেমাতু নামে একটি মেয়ে সে একটি সংগঠনের দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন কর্মী। সে আমাদের সব দেখিয়েছে।
মহিলা জেলে আছে নদীর পাশে তারা বসে থাকে। ট্রলারে মাছ আসার পর সেখান থেকে তারা মাছ নিয়ে যায়। গাধা হচ্ছে তাদের বাহন। গাধার পিঠে করে মাছ নিয়ে যায়। মাছ নিয়ে তারা প্রসেস করে। এই জায়গাটা আর বেশি দিন তারা ব্যবহার করতে পারবে না। কারণ এখানে সার কারখানা এবং বিদ্যুৎ কেন্দ্র হবে। তখন মাছ প্রসেস করার জায়গা থাকবে না। তাদের উৎখাত করা হবে। এটা তাদের জীবণ জীবিকার জন্য একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে।
মাছ ধরা কমে যাচ্ছে ভারত এবং চীনের বড় বড় ট্রলার এসে গভীর সমুদ্র থেকে এসে মাছ ধরে নিয় যায়্। গভীর সমুদ্র বন্দর করছে। উন্নয়নের নামে মানুষের জীবন জীবিকা কেড়ে নেয়া হবে।
সেনেগালের ম্যানগ্রোভ বন অত্যান্ত বিখ্যাত। এখানে ৪ জাতের ম্যানগ্রোভ হয়। ১৮৫,০০০ হেক্টর জায়গা জুড়ে ম্যানগ্রোভ। ক্রমাগতভাবে খরা, বন ধ্বংস, রাস্তা ঘাট নির্মাণ,কৃষিকাজের জন্য বন ধ্বংস করার কারণে ম্যানগ্রোভ হুমকির মুখে পড়েছে। এই ম্যানগ্রোভ থেকে মানুষ মধু সংগ্রহ করে জীবন জিবিকা নির্বাহ করতো। ইউনেসকো global heritage ঘোষণা দিয়েছে জনগণ আর সেখানে যেতে পারবে না। ফলে মানুষের একটি জীবিকার পথ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তাদের জীবন জীবিকা অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে। তবু্ও তাদের মুখে হাসি ফুটে আছে। সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীদের তারা নাচ, গান দিয়ে সংবর্ধনা জানান।
একটি ছবি যা অনেক দূর থেকে তোলা, সাগরের মাঝে গোরী নামে একটি দ্বীপের। সেখানে ১৬৭৭ সালে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে মানুষ ধরে এনে এই দ্বীপে রাখা হোত। ওখান থেকে তাদের ইউরোপ, আমেরিকায় নেয়া হতো দাস হিসেবে। সেনেগালে এক সময় ফ্রান্স কলোনি ছিল।
গ্রামে যাতায়ত পরিবহন হচ্ছে ঘোড়ার গাড়ি, মোটর সাইকেল। এখানে বাবলা গাছ আছে, আম গাছ আছে। তবে ডাকারের সুপার মার্কেটে বাংলাদেশের আম পা্ওয়া যায়। অনেক জাতের লবণ হয় সেনেগালে।
সেনেগালে নারীদের নামের শেষে তু ব্যবহার করার একটি ব্যাখা দেন সেমবারের আড্ডার সদস্য ফাতেমা খান। ফ্রাসী ভাষায় সাধারণত প্রতিটি জিনিষের মেসকুলিন ও ফেমেনিন থাকে। মহিলা ও পুরুষকে বুঝাতে এই শব্দ ব্যবহার করা হয়, মেয়েদের নামের শেষে তু ব্যবহার করা হয়।