কপ২৭: লস এন্ড ড্যামেজ সমঝোতা একমাত্র সমাধান নয়, আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে
ফরিদা আখতার || Tuesday 06 December 2022 ||লস এন্ড ড্যামেজ সমঝোতা করে যদি ধনী দেশগুলো মনে করে থাকে যে তারা ভুক্তভোগী এবং ক্ষতিগ্রস্ত দেশের প্রতি তাদের দায় সেরেছে তাহলে খুব ভুল হবে। জি-৭৭/চিন এর পক্ষ থেকে বলা হয়, উন্নয়নশীল দেশগুলো এখন মারাত্মক জলবায়ু দুর্যোগের শিকার; কাজেই তাদের অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্যে সহযোগিতা করার অর্থ কোন দয়া বা চ্যারিটি নয়, এটা জলবায়ু-ন্যায়বিচার।
বহুল আলোচিত জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত জাতিসংঘ ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনের (UNFCC) কনফারেন্স অব দ্য পার্টির ২৭তম সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। নভেম্বর মাসের ৪ থেকে ১৮ তারিখ পর্যন্ত হওয়ার কথা থাকলেও লস এন্ড ড্যামেজ তহবিল নিয়ে তুমুল দেন দরবার শেষে সময় বাড়িয়ে ২০ নভেম্বর ভোরে এক সমঝোতার মাধ্যমে শেষ হয়েছে। শেষ দিকে ১৬ নভেম্বর থেকে দেন দরবারে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের প্রতিনিধিদের সময় দিতে হয়েছে অনেক বেশি, ২০ তারিখ ভোরে প্রতিনিধিদের চোখ-মুখ ক্লান্তিতে ভরা ছিল। এই ক্লান্তির মধ্যেই সমঝোতা হয়েছে, কাজেই বুঝে নিতে হবে এখানে অনেক বিষয় অসম্পূর্ণ থেকে গেছে।
মিশরের শার্ম আল-শেখে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে বাংলাদেশ থেকে সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেছেন। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ভুক্তভোগী ১০টি দেশের মধ্যে অন্যতম। কিন্তু সম্মেলন থেকে ফিরে এসে সরকারি প্রতিনিধি দলের পক্ষ থেকে কোন সংবাদ সম্মেলন হয় নি, এমনকি বেসরকারি প্রতিনিধি যারা গেছেন তাদের দিক থেকেও কোন ব্রিফিং পাওয়া যায় নি। পত্র-পত্রিকায় শিরোনাম হয়েছে লস এন্ড ড্যামেজ সমঝোতা নিয়ে। কিন্তু বাংলাদেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো কতটুকু আমরা পেয়েছি বা কী পাইনি, তা জানা হয় নি।
তাছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন বা দুর্যোগ সৃষ্টির জন্যে দায়ী ধনী দেশগুলো কী সিদ্ধান্ত নেয় তা জানার ইচ্ছা আমাদের থাকে। এর সাথে বাংলাদেশের মানুষের জীবণ মরণ প্রশ্ন এর সাথে জড়িত। আমি নিজে এই সম্মেলনে যোগদান করি নি কিন্তু নিয়মিত থার্ড ওয়ার্ল্ড নেটওয়ার্কের দৈনিক আপডেট এবং দেশের পত্র-পত্রিকার ওপর নজর রেখেছি।
কপ২৭ এ কী সিদ্ধ্বান্ত হবে তা নিয়ে বৈশ্বিক পর্যায়ে পরিবেশবাদি সংগঠনের মধ্যে অনেক জল্পনা-কল্পনা ছিল। ধনী দেশগুলো ক্রমাগতভাবে ২০১৫ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত কপ ২১ এর ঐতিহাসিক প্যারিস চুক্তিতে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে চলেছে।
প্যারিস চুক্তির অধীনে প্রতিটি দেশ কার্বন নিঃসরণের মাত্রা হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় কী অভিযোজন ব্যবস্থা গ্রহণ করবে সেই পদক্ষেপসমূহ প্রকাশ করার কথা, যা আসলে বৈশ্বিক উঞ্চতা "প্রাক-শিল্প স্তরের তুলনায় ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে" নামিয়ে আনার ক্ষেত্রে একটি সম্মিলিত এবং সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণে সহায়ক হবে। সেসময় সরকারগুলো ২০৫০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক উঞ্চতা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে বজায় রাখার মতো একটি লক্ষ্যমাত্রাও নির্ধারণ করে।
কিন্তু তার জন্যে যে পদক্ষেপ নিতে হবে তার মধ্যে অন্যতম প্রধান ছিল কার্বন নিঃসরণের মাত্রা কমিয়ে আনা এবং বিশেষ করে জীবাশ্ম জ্বালানী ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা। যুক্তরাষ্ট্র, ইওরোপ, জাপান, ভারত, চিন, রাশিয়াসহ ধনী দেশ বিশ্বের মোট কার্বন নিঃসরণের চার ভাগের তিন ভাগ, বাকি একভাগের জন্যে দায়ী অন্যান্য সকল দেশ। কাজেই কার্বন নিঃসরণ কমাবার দায় ধনী দেশেরই বেশি, কিন্তু সেদিকে ধনী দেশগুলোর আগ্রহ দেখা যায় নি। এমনকি যারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তাদের আর্থিক ক্ষতিপুরণ দেওয়ার ক্ষেত্রেও কপ২৬ সম্মেলনেও তাদের অনীহা দেখা গেছে। যেন বা তারা দয়া করছে। গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত কপ২৬ কার্যত উন্নয়নশীল দেশসমুহের জন্যে চরম হতাশার ছিল।
কপ২৭ এর প্রেক্ষিত এবার একটু ভিন্ন ছিল। সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়েছে মিশরে, যা আফ্রিকা মহাদেশের উত্তর-পূর্ব কোণে ও এশিয়া মহাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে অবস্থিত একটি আন্তঃমহাদেশীয় ভূমধ্যসাগরীয় রাষ্ট্র। রিভিউস অব জিওফিজিক্স সাময়িকী অনুযায়ী, বিশ্বে উষ্ণতা বৃদ্ধির গড় হারের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ গতিতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় উষ্ণতা বাড়ছে। মধ্যপ্রাচ্য ও পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে প্রতি দশকে গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার ০.৪৫ ডিগ্রি, বিশ্বে ০.২৭ ডিগ্রি।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে আফ্রিকার দেশগুলো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং এশিয়াতেও ২০২২ সালে বন্যা, খরা, ঘুর্ণিঝড় একাধিকবার হয়েছে এবং ব্যাপক ক্ষতি করেছে। পাকিস্তানের ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ৩ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষ। তাই ধনী দেশগুলো যে আচরণ কপ২৬ এ করতে পেরেছে এবার সেটা কঠিন ছিল, কারণ ১৩০টির বেশি উন্নয়নশীল দেশের জোট জি-৭৭ তাদের দেশের ক্ষতি সম্পর্কে খুব জোরালো দাবি তুলেছে। তারা লস এন্ড ড্যামেজ তহবিল গঠনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল এবং প্রথমবারের মতো কপের অফিসিয়াল অ্যাজেন্ডায় এই বিষয়টি যুক্ত করতে পেরেছিল। জি-৭৭ জোটের বর্তমান প্রধান পাকিস্তানের নেতৃত্বে দক্ষিণ এশিয়া উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য জলবায়ু তহবিল গঠনের লড়াইয়ে মাঠে নামে।
ধনী দেশ, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের দেশ কার্বন নিঃসরণ কমানোর প্রশ্নে এখনো কোন যুক্তিসংগত প্রস্তাব দেয় নি কারণ এতে তাদের নাগরিকদের জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভর জীবন যাত্রার পরিবর্তন আনতে হবে, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফুড প্রডাকশান বন্ধ করে প্রাণ প্রকৃতি রক্ষা করে কৃষক-নির্ভর খাদ্য উৎপাদন করতে হবে। ধনী দেশের প্রতিনিধিদের পেছনে রয়েছে তেল, কয়লা, গ্যাস কোম্পানি, রয়েছে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফুড, যেমন মাংস উৎপাদনকারী কোম্পানি ইত্যাদি। মাংস উৎপাদনের জন্যে ব্রাজিলের আমাজন বন কাটা হচ্ছে। জীবাশ্ম জ্বালানীর ব্যবহার তাদের লাগবেই, কাজেই কার্বন নিঃসরণ কমাবার কোন প্রতিশ্রুতি তারা দিতে চায় না।
অন্যদিকে ধনী দেশসমূহের উচ্চ মাত্রায় কার্বন নিঃসরণের কারণে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বেড়ে যে জলবায়ু দুর্যোগ হচ্ছে তার শিকার হচ্ছে উন্নয়নশীল দক্ষিণের দেশগুলো। তারা কপ এর সম্মেলনগুলোতে ক্ষতিপুরণ দাবি করে এসেছে। কপ ২৬ পর্যন্ত ধনী দেশগুলো ক্ষতিপুরণ দেওয়ার তহবিল গঠনে গড়িমসি করেছে, কারণ তাদের ধারণা একবার ক্ষতিপুরণ দিতে শুরু করলে তা দিয়েই যেতে হবে। এই তহবিলের অর্থ কি ঋণ হিসেবে দেবে নাকি অনুদান হবে তা নিয়েও বিতর্ক হয়েছে বিস্তর। লস এন্ড ড্যামেজ সমঝোতায়ও বিষয়টি পরিস্কার হয় নি। ধনী দেশগুলো বন্ড, ইন্স্যুরেন্সসহ নানা পদ্ধতির প্রস্তাব করেছে, কিন্তু উন্নয়নশীল দেশ তা চায় না। তারা অনুদান ছাড়া অন্য কোন কিছু নিতে চায় না। ঋণের বোঝা বাড়ানোর কোন সুযোগ নেই।
শেষ পর্যন্ত কপ২৭ লস এন্ড ড্যামেজ সংক্রান্ত তহবিল গঠনের এক সমঝোতার এসেছে। এই 'লস অ্যান্ড ড্যামেজ' তহবিল বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাব কমাতে কোন সাহায্য করবে না, মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের তাৎক্ষণিক প্রভাব ও ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় ক্ষতিগ্রস্ত গরিব দেশগুলোকে সহায়তা দেবে। অনেকটা গরু মেরে জুতা দানের মতো। এই তহবিল গঠনের সিদ্ধ্বান্ত বৈশ্বিক তাপমাত্রা কমানোর উদ্যোগ নেয়ার কোন সিদ্ধ্বান্ত নয়; ২০৫০ সালে গিয়ে ১.৫ ডিগ্রীর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হবে কিনা তারও কোন প্রতিশ্রুতি নয়; শুধুমাত্র যারা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে তাদের সাহায্য করা। এটাও ধনী দেশগুলো মানছিল না।
পরিবেশবাদীরা তাই এই সমঝোতাকে কপ সম্মেলনের সাফল্য মাপার "লিটমাস টেস্ট" হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। থার্ড ওয়ার্ল্ড নেটওয়ার্ক প্রতিদিনের যে আপডেট বের করেছে তাতে বলা হয়, অনেকটা অসম্ভব একটি কাজের এই সাফল্য সম্ভব হয়েছে জি-৭৭, চিন এবং কপ ২৭ এ মিশরের সভাপতির দৃঢ়তার কারণে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র এই তহবিল গঠনে ক্রমাগতভাবে বাধা দিয়ে আসছিল, সেক্ষেত্রে সিভিল সোসাইটি গ্রুপ চাপ সৃষ্টি করতে পেরেছে। উল্লেখ্য যে জি৭৭ হিসেবে পাকিস্তানের ভূমিকা শক্তিশালী ছিল, কারণ সেখানে যে ভয়াবহ বন্যা হয়েছে সেটা কপ২৭ এর প্রতিনিধিদের ওপর নৈতিক চাপ সৃষ্টি করেছে।
লস এন্ড ড্যামেজ তহবিল সমঝোতা চুক্তি হলেও কপ২৭ এ বেশ কয়েকটি প্রশ্ন অমীমাংসিত রয়ে গেছে। যেমন ক্ষতিগ্রস্ততার সংজ্ঞা কী হবে? কারণ জাতিসংঘ যেভাবে তার সদস্য দেশগুলো গ্রুপিং করে, যেমন ক্ষুদ্র দ্বীপ উন্নয়নশীল রাষ্ট্র (SIDS) কিংবা স্বল্পন্নোত দেশ ((LDC) তার আওতায় না হলে সে দেশ জলবায়ু দুর্যোগের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হলে কি এই সহায়তা পাবে?
জলবায়ু পরিবর্তনের আলোচনায় জলবায়ু প্রশমন বা মিটিগেশন কার্যক্রম নিয়েও প্রচুর বিতর্ক হয়েছে। প্যারিস চুক্তি অনুযায়ি কার্বন নিঃসরণের মাত্রা ঠিক করার জন্যে রুদ্ধদ্বার বৈঠকও হয়েছে। তাদের মূল আপত্তি ছিল Common but different responsibilities (CBDR) কথাটি নিয়ে। কারণ যারা বেশি কার্বন নিঃসরণ করছে তাদের নিঃসরণ কমাবার টার্গেটও বেশি দিতে হবে। এমনকি Major emitters অর্থাৎ প্রধান দূষণকারী কথাটিও টেক্সট থেকে গায়েব করে দিয়েছে। ফলে এই নিয়ে বিতর্ক হয়। তারা ১.৫ ডিগ্রী তাপমাত্রা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণেরও বিরোধিতা করে, বিশেষ করে যখন কার্বন নিঃসরণের ইকুয়িটি প্রশ্ন তোলা হয়। রাশিয়া এক পর্যায়ে বলে ফেলে, "ইকুয়িটি বলতে কী বোঝায় তা তারা বুঝতে অক্ষম"। সেটা তো হবেই; কারণ ইকুইটি বুঝলে তো কার্বন নিঃসরণের যার যতো অবদান সেই মতো নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
লস এন্ড ড্যামেজ সমঝোতা করে যদি ধনী দেশগুলো মনে করে থাকে যে তারা ভুক্তভোগী এবং ক্ষতিগ্রস্ত দেশের প্রতি তাদের দায় সেরেছে তাহলে খুব ভুল হবে। জি-৭৭/চিন এর পক্ষ থেকে বলা হয়, উন্নয়নশীল দেশগুলো এখন মারাত্মক জলবায়ু দুর্যোগের শিকার; কাজেই তাদের অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্যে সহযোগিতা করার অর্থ কোন দয়া বা চ্যারিটি নয়, এটা জলবায়ু-ন্যায়বিচার (Cilmate justice)।
বাংলাদেশেও আমাদের মনে রাখতে হবে লস এন্ড ড্যামেজের অর্থ পাওয়ার জন্যে চেয়ে থাকলে হবে না, খুশিতে ডুগডুগি বাজালে হবে না; কার্বন নিঃসরণের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। ২০৫০ সালের মধ্যে ১.৫ ডিগ্রীতে তাপ মাত্রা বৃদ্ধ্বি ঠেকাতে না পারলে হাশরের মাঠ হবে সারা বিশ্ব। পুড়ে মরবো অথবা আমরা ডুবে যাবো। তাই আমাদের দেশের পরিবেশ প্রকৃতি রক্ষা করাও আমাদের অন্যতম প্রধান কাজ হওয়া উচিত।
বিশেষ দ্রষ্টব্য
এই লেখাটি ৫ ডিসেম্বর, ২০২২ তারিখে 'কপ২৭: লস এন্ড ড্যামেজ সমঝোতা একমাত্র সমাধান নয়, আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে' এই শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও মানবাধিকার কর্মী