বীজ সঞ্চয়
এম এ সোবহান || Monday 25 November 2024 ||বীজ সঞ্চয় বলতে বীজ শুকানো এবং বীজ রাখার জন্য প্রয়োজনীয় সংরক্ষণ তাপমাত্রা ও সহযোগী পরিবেশ বোঝায়।বীজ সংগ্রহ থেকে পরবর্তী বপনের সময় পর্যন্ত সংরক্ষণ করা। বীজ সংগ্রহ থেকে পরবর্তী বপনের সময় পর্যন্ত সংরক্ষণ করা। প্রায় দশ হাজার বছর আগে মধ্যপ্রাচ্যে জমি চাষ শুরুর পর থেকে বীজ সঞ্চয় করে রাখা মানব সভ্যতার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে।
বীজ সঞ্চয়ের উদ্দেশ্য:
বীজ সঞ্চয়ের উদ্দেশ্য হলো বীজগুলিকে কার্যকর অবস্থায় বাঁচিয়ে রাখা। সে বীজ যাতে অঙ্কুরিত হতে পারে এবং সুস্থ্য সবল চারা হয়। চাষাবাদের জন্য বীজ কয়েক বছর ধরে রাখা যেতে পারে। তবে সাধারণত এক মৌসুম থেকে পরবর্তী মৌসুমে বপন সময় পর্যন্ত বীজ রাখা হয়।
বীজের প্রকার
সংরক্ষণের দৃষ্টিকোন থেকে বীজ তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন-অর্থোডক্স, রিক্যালসিট্রান্ট এবং মধ্যবর্তী।
অর্থডক্স: যে বীজ ক্ষতি ছাড়াই শুকানো যায়, কম আর্দ্রতায় (৫-১০% ), নিম্ন তাপমাত্রায় (২ থেকে ২০⁰C) রাখা যায়।আর্দ্রতা এবং তাপমাত্রা উভয়ই হ্রাসের সাথে তাদের আয়ু বৃদ্ধি পায়।
রিক্যলসিট্রান্ট: যে বীজ শুকানো যা না, দীর্ঘমেয়াদী সংরক্ষণের জন্য উপযুক্ত নয়, বায়ুরোধী পাত্রে সংরক্ষণ করা যায় না। সংরক্ষণ অবশ্যই হিমাঙ্কের উপরে হতে হবে। যেমন-আম, কাঁঠাল, লিচু ইত্যাদি।
মধ্যবর্তীঃ যে বীজ রিক্যালসিট্রান্টের চেয়ে শুকানোর প্রতি বেশি সহনশীল,যদিও অর্থডক্সের ক্ষেত্রে এই সহনশীলতা অনেক বেশী সীমিত। তারা সাধারণত কম তাপ মাত্রায় আরো দ্রুত কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে,যেমন আখরোট, ফার, পপলাস,স্যালিক্স ইত্যাদি।
বীজ সঞ্চয় পরিবেশ:
বীজ কৃষকের স্বপ্ন।কৃষির চাবি। বীজ কৃষি উৎপাদনের মৌলিক উপাদান। উৎপাদনশীল এবং স্বাস্থ্যকর ফসলের জন্য মান সম্পন্ন বীজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।বীজের গুণগত মান বজায় রাখার জন্য সঠিক সংরক্ষণ অপরিহার্য। দীর্ঘ সময় বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা ধরে রাখা কৃষি উৎপাদনের ধারাবাহিকতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রাণবৈচিত্র্য এবং টেকসই কৃষির জন্য বিশেষ করে বিরল এবং স্থানীয় বীজের জাত সংরক্ষণ আবশ্যক। সঠিক সংরক্ষণ পদ্ধতি রোগ এবং কীট-পতঙ্গ থেকে রক্ষা করে।বীজের গুণমান বজায় রাখা উৎপাদনকারীদের অর্থনৈতিক সুবিধা প্রদান করে।একটি দক্ষ উৎপাদনের চক্র অন্তবর্তী করে। বীজ সংরক্ষণ করার জন্য যে বিষয়গুলি বিবেচনা করা প্রয়োজন,
তাহলো: তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, আলো এবং অক্সিজেনের মাত্রা। বীজের গুণমান বজায় রাখার জন্য এই বিষয়গুলি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
তাপমাত্রা:
বীজ সংরক্ষণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মধ্যে একটি তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ। অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা বজায় রাখতে ৫-১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস আদর্শ।কিছূ বীজ দীর্ঘ মেয়াদী সংরক্ষণের জন্য হিমাগারে রাখা যায়। এ পদ্ধতি ব্যবহারকরতে হলে বীজ সঠিক ভাবে শুকাতে হবে।
আর্দ্রতা:
বীজ সংরক্ষণের জন্য আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কারণ উচ্চ আর্দ্রতায় ক্ষতিকারক অনুজীবের বৃদ্ধি হতে পারে এবং বীজ পচন ধরতে পারে। সংরক্ষণের আগে বীজ অবশ্যই সঠিক ভাবে শুকিয়ে নিতে হবে। সাধারণ ভাবে ৫-৮% আর্দ্রতায় রাখা যায়। বীজ শুকানোর জন্য ডেসিক্যান্ট হিসাবে সিলিকা জেল ব্যবহার করা যেতে পারে।
আলো:
আলোর উপস্থিতিতে বীজ নষ্ট হতে পারে। বিশেষ করে উচ্চ তেল সমৃদ্ধ বীজ।আলো প্রতিরোধী পাত্রে বা অন্ধকার ঘরে বীজ সংরক্ষণ করা যেতে পারে। এই পদ্ধতি রাসায়নিক গঠনের অবনতি প্রতিরোধ করে।
অক্সিজেন:
অক্সিজেন কিছু বীজের জন্য অবনতির কারণ হতে পারে। অক্সিজেন নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বীজ বেশি দিন সংরক্ষণ করা যায়।ভ্যাকুয়াম প্যাকেজিং করে অক্সিজেন কমিয়ে দেয়া যায়।
পরিশেষে আর্দ্রতা, তাপমাত্রা এবং অক্সিজেনের অনুপাত হলো মূল বিষয় যা বীজের ক্ষয় এবং কর্মক্ষমতা হ্রাস প্রভাবিত করে।বীজের আর্দ্রতা প্রতি ১% হ্রাসের জন্য (৫-১০% এর মধ্যে) এবং প্রতি ৫⁰ C হ্রাসের জন্য (০⁰ C এবং ৫০⁰ C এর মধ্যে)বীজের আয়ু দ্বিগুন হয় (হ্যারিংটন, ১৯৭২)। অর্থোডক্স বীজ সংরক্ষণের মূলনীতি হলো, নিম্ন আর্দ্রতা এবং নিম্ন তাপমাত্র। তাদের স্বল্পমেয়াদী সংরক্ষণের জন্য (<১৮মাস), শুকানো বীজের কার্যকারিতা রাখার জন্য ০⁰ C—৫⁰ C মধ্যে তাপমাত্রা যথেষ্ঠ।দীর্ঘ সময় রাখার জন্য বীজ —১৮⁰C থেকে —২০⁰ C তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা যায়। বীজ ৩—৭% আর্দ্রতায় শুকিয়ে বায়ু রোধী পাত্রে রাখা যায়।
স্বল্প মেয়াদে বীজ সঞ্চয়:
আশ-পাশের পরিবেশ যত ঠান্ডা হয়এবং শুস্ক হয় বীজ তত ভালো থাকে। আপেক্ষিক আর্দ্রতা যতটা সম্ভব কম। তাপমাত্রা ১৫⁰C এর নীচে হলে ভালো হয়।কম তাপমাত্রার স্তর বজায় রাখার চেয়ে ধারাবাহিকতা রক্ষা করা আরো গুরুত্বপূর্ণ।অন্ধকারে বীজ সঞ্চয়ের আর একটি পূর্ব শর্ত। আলো বীজের অঙ্কুরোদগম প্রক্রিয়াকে বাড়িয়ে দেয়। অন্ধকার সংরক্ষিত বীজের অঙ্কুরোদগম প্রক্রিয়া নিম্ন স্তরে রাখতে সাহায্য করে।
বীজের প্রজাতি থেকে প্রজাতিতে সংরক্ষিত স্থানে বেঁচে থাকার ক্ষমতার মধ্যে পার্থক্য আছে। কিছু প্রজাতি সব পরিস্থিতিতে দীর্ঘ সময় বেঁচে থাকতে পারে। শুধুমাত্র নতুন, পরিস্কার, স্বাস্থ্যকর এবং ভালো শুকানো পাত্রে বীজ সংরক্ষণ করতে হবে। শুস্ক এবং শীতল জায়গায় বীজ ভালো থাকে।বীজ সহজেই আর্দ্রতা শোষণ করে তাই শুস্কতা বজায় রাখতে বীজ বায়ুরোধী পাত্রে সংরক্ষণ করতে হবে। রাখার সময় জাতের নাম, সংগ্রহের স্থান, সংরক্ষণের তারিখ ইত্যাদি লিখে পাত্রে লেবেল দিতে হবে। সম্ভব হলে বীজের অঙ্কুরোদগম শতাংশ লিখে রাখতে হবে।ছত্রাক,পোকামাকড়,ইঁদুর ও পাখি থেকে বীজ রক্ষা করতে হবে।
বীজ রাখার পাত্র:
বীজ রাখার পাত্র সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।বীজপাত্র বীজকে আর্দ্রতা,আলো,এবং কীটপতঙ্গ থেকে রক্ষা করে। বীজ পাত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে: কাঁচের জার, প্লাষ্টিক পাত্র, ধাতব পাত্র, মাটির পাত্র, চটের বস্তা, কাপড়ের ব্যাগ, কাগজের প্যাকেট, বাঁশের ডোলা ইত্যাদি।
বীজ ঘরের প্রকার:
শুকনো ঘর—অর্থডক্স বীজের জন্য ভালো,কয়েক সপ্তাহ, বা মাস ঘরের তাপমাত্রায় বীজ রাখা যায়। এবং কম আর্দ্রতাসহ শীতলঅবস্থায় ভালো থাকে।
আর্দ্রঘর—রিক্যালসিট্রান্ট বীজের জন্য ব্যবহারকরা হয়, অল্প সময়ের জন্য ব্যবহার করা যায়,ভাল বায়ু চলাচল, বীজ আর্দ্র মাধ্যমের সাথে যেমন বলি কাপড়, কাঠ কয়লা বা করাতের গুড়ার সাথে মেশানো হয়। আর্দ্রতা ১১-৪০% এবং তাপমাত্রা ০⁰—২২⁰ C।
বীজের কর্মক্ষমতা পরীক্ষা:
সময়ের সাথে সাথে সংরক্ষিত বীজের গজানোর ক্ষমতা হ্রাস পেতে পরে। বীজ এখনও রোপনের জন্য ভাল তা নিশ্চিত করতে, অঙ্কুরোদগম পরীক্ষা করতে হবে। একটি ঢাকনা যুক্ত পাত্রে কাগজ দিয়ে আর্দ্র করে, এতে কয়েকটি বীজ রাখতে হবে এবং একটি উষ্ণ ভালভাবে আলোকিত জায়গায় রাখতে হবে।দুই থেকে চারদিন পর, কত বীজ অঙ্কুরিত হয়েছে তা গণনা করতে হবে। যদি অঙ্কুরোদগম হার তখনও বেশি (৮০% এর উপরে), বীজ কার্যকর এবং রোপনের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।
নিয়মিত পর্যবেক্ষণ:
সংরক্ষিত বীজের পর্যায়ক্রমিক পরীক্ষা/চেক অপরিহার্য। কীট পতঙ্গের লক্ষণগুলির জন্য পাত্রগুলি পরিদর্শন করতে হবে। বিবর্ণতা, অস্বাভাবিক গন্ধ বা অন্য কোন রকমখারাপ লক্ষণ দেখা যেতে পারে। যদি কোন সমস্যা খুঁজে পাওয়া যায়, তাদের সংশোধন করার জন্য অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে হবে।