নয়াকৃষি বনাম আধুনিক কৃষি
এম এ সোবহান || Sunday 01 December 2024 ||নয়াকৃষি:
বাংলাদেশের কৃষকরা নয়াকৃষি আন্দোলন শুরু করেছেন সময়ের প্রয়োজনে। ১৯৯০ সাল থেকে শুরু হয়েছে এই আন্দোলন। নয়াকৃষি একান্তই কৃষকদের গবেষণার ফল। জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগতে বাংলাশের কৃষকদের নিজস্ব অবদান। নয়াকৃষি একান্তই কৃষকদের গবেষণার ফল। জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগতে বাংলাদেশের কৃষকদের নিজস্ব অবদান। হাজার হাজার কৃষক পরিবার এই আন্দোলনের সঙ্গে আজ সরাসরি যুক্ত। ২০২৪ সালে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৫০,০০০ (তিন লক্ষ পঞ্চাশ হাজার) কৃষক পরিবার। অনুরাগী ও সমর্থক তো আছেনই। এ সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছে।
বীজ ও প্রাণবৈচিত্র্য নয়াকৃষির বিশেষ বৈশিষ্ট্য। সার ও বালাইনাশক মুক্ত অন্যান্য জৈব চাষাবাদ পদ্ধতির সঙ্গে নয়াকৃষির পার্থক্য হচ্ছে নয়াকৃষি শুধু জৈব চাষাবাদই নিশ্চিত করে না। একই সঙ্গে এই পদ্ধতি (১) প্রাণবৈচিত্র্য নির্ভর, (২) বাংলাদেশের কৃষকের ঘরে হাজার বছর ধরে বিকশিত করে তোলা অতি উন্নতমানের বীজ ব্যবহার করে, (৩) ফলে নয়াকৃষির ফসলের গুণ অপরিসীম,স্বাদে গন্ধে পুষ্টিতে অতুলনীয় এবং নিরাপদ, (৪) প্রাকৃতিক শক্তির সঙ্গে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সমন্বয় ঘটিয়ে উন্নত পদ্ধতিতে চাষাবাদের ফলে নয়াকৃষি সুদক্ষ এবং (৫) গুণ ও মানে অতুলনীয় হবার কারণে ভোক্তার কাছে আদরনীয়।
আধুনিক কৃষি:
কৃষির ইতিহাস প্রায় দশ হাজার বছরের। তবে আধুনিক কৃষির যাত্রা গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকের মাঝামাঝিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে মিত্র পক্ষের জমানো গোলাবারুদ, রাসায়নিক দ্রব্য দিয়ে কৃষকের মাঠে কীট-পতঙ্গের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। আধুনিক কৃষির সাথে যুক্ত কৃত্রিম সার, বালাইনাশক, ছত্রাক নাশক, এবং আগাছানাশক। কৃষি রাসায়নিকের সাথে মানুষের স্বাস্থ্যগত প্রভাব দেখা যায়, যার মধ্যে রয়েছে দীর্ঘস্থায়ী নিউরোটিক্সিসিটি, ফুসফুসের ক্ষতি, ক্যান্সার ইত্যাদি।
আধুনিক কৃষি অনেক পরিবেশগত অবক্ষয় ঘটায় যার মধ্যে রয়েছে: জলবায়ু পরিবর্তন, বন উজার, প্রাণবৈচিত্র্য ক্ষতি, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, সেচ সমস্যা, পানি, দূষণ, মাটির অবক্ষয়, বর্জ্য এবং গ্রীণহাউজ গ্যসের প্রভাব। জৈব জ্বালানী পরিবেশে অসহনীয় বোঝা। আধুনিক কৃষি অল্প সংখ্যক উচ্চফলনশীল জাত, হাইব্রিড এবং জিএমওর উপর নির্ভরশীল এবং এর সম্প্রসারণের ফলে বিশ্বব্যাপী প্রাণবৈচিত্র্যের উল্লেখযোগ্য ক্ষতি হয়েছে।প্রাণবৈচিত্র্যে ক্ষতির ফলে ফসলের উৎপাদনশীলতা কমে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার তথ্য অনুসারে, বিশ্বব্যাপী কৃষিতে কাজ করে এমন লোকের সংখ্যা ১৯৯১ সালে ৪৪% থেকে ২০২০ সালে ২৬% এ নেমে এসেছে। এটি একটি বড় সমস্যার দিক নির্দেশ করে যে অনেক লোক আর এখন কৃষি কাজ করতে চায় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক উন্নত দেশে কৃষকের গড় বয়স ৬০ বছর।বিশ্বব্যাপী কৃষকদের গড় বয়স বাড়ছে,কারণ গ্রামীণ যুবকরা শহরে জীবন খোঁজার জন্য তাদের দেশের শিকড় থেকে বেড়িয়ে আসছেন।
নয়াকৃষি বনাম আধুনিক কৃষি:
এখানে সার্বিক বিবেচনায় দশটি নীতির আলোচনাকে নয়াকৃষি ও আধুনিক কৃষি পাশাপাশি আলোচনা করা হলো:
নীতি ১: নয়াকৃষি কোনো প্রকার বিষ ব্যবহার করে না।
নয়াকৃষির কৃষকরা স্থানীয় বীজ ব্যবহার করেন। কারণ স্থানীয় বীজের রোগবালাই প্রতিরোধ ক্ষমতা অসামান্য।
পক্ষান্তরে, আধুনিক কৃষি বালাইনাশক, ছত্রাকনাশক, আগাছা নাশকসহ বিভিন্ন প্রকারের বিষ ব্যবহার করে। ফলে খাদ্য বিষাক্ত, পানি বিষাক্ত, এবং জীবন চক্রে বিষ ঢুকে গিয়েছে। বিষে প্রাণবৈচিত্র্য ও পরিবেশ ধ্বংস হচ্ছে।
নীতি ২: কৃষকের হাতে, ঘরে, ও মাঠে বীজ।
বীজ এবং প্রাণসম্পদ কৃষকের ঘরে কিম্বা মাঠে নারীদের নিয়ন্ত্রণে থাকে।
অন্যদিকে আধুনিক কৃষির কৃষকরা বীজের জন্য বাজারের উপর নির্ভরশীল।বাজারের বীজের মানের নিশ্চয়তা নাই, গজানোর নিশ্চয়তা নাই, ফলনের নিশ্চয়তা নাই, এছাড়া রোগবালাই দ্বারা আক্রান্ত হবার অশঙ্খা অবশ্যই আছে।
নীতি ৩: নয়াকৃষিতে রাসায়নিক সার প্রয়োজন নাই।
নয়াকৃষি চাষাবাদের লক্ষ্য হচ্ছে মাটি যেন নিজেই নিজের পুষ্টি ও সার নিজেই তৈরি ও রক্ষা করে ক্রমে ক্রমেউর্বর হয়ে উঠতে সক্ষম হয় সেই চাষ পদ্ধতি অনুসরণ করে। কম্পোষ্ট ও সবুজ সার ব্যবহার করে। জমিতে বসবাসকারী কেঁচো, অন্যান্য জীব ও অণুজীব রক্ষা, নীলসবুজ শ্যাওলা জন্মানোর পরিবেশ তৈরী করা এবং একটি পর্যায়ের পর জমিতে কোন সার দেবারই প্রয়োজন পড়ে না।
আধুনিক কৃষি মূলত রাসায়নিক সারের উপর নির্ভরশীল।রাসায়নিক সার সাময়িক উৎপাদন বৃদ্ধি করে কিন্তু পরিনামে মাটি শক্ত করে, মাটির উর্বরতা শক্তি হ্রাস করে, বায়ু, পানি ও মাটিকে দূষিত করে, এবং পরিবেশের জন্য বিপদ ডেকে আনে।
নীতি ৪: নয়াকৃষি মিশ্র ফসল চাষ করে।
মিশ্র ফসল প্রাণ সম্পদের বিকাশ ঘটায়। মিশ্র ফসলে উৎপাদন খরচ কম, ফলন বেশি।শস্য কীট পতঙ্গ ও রোগ-বালাই মুক্ত থাকে।
আধুনিক কৃষির সবচেয়ে বিতর্কিত বিষয়গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে একক চাষ,এককাট্টা ফসল আবাদ বা মনোকালচার।একক ফসল চাষ করা সহজ তবে যে সকল কৃষক একক চাষে লেগে থাকে তাদের জমিতে কীটপতঙ্গের উপদ্রবের সাথে লড়াই করার ক্ষেত্রে আরো সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। অধিক পরিমানে কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়। মাটির অবক্ষয় এবং উর্বরতা হ্রাস পায়। সার ও পানি বেশি ব্যবহার করতে হয়। প্রাণবৈচিত্র্য হ্রাস পায়। অর্থনৈতিক ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।
নীতি ৫: নয়াকৃষি ফসল উৎপাদনের ধরনই এমন হয় যেন একই সঙ্গে জমিতে প্রচুর অনাবাদি ফসলও পাওয়া যায়।
আধুনিক কৃষিতে কুড়িয়ে পাওয়া খাদ্য প্রায় সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায়, বিশেষত বিষ ও আগাছা নাশকের কারণে ছোটমাছসহ কুড়িয়ে পাওয়া শাক, ফল, ও অন্যান্য খাদ্য পাওয়া যেমন কঠিন একইসঙ্গে তারা বিষাক্ত হয়ে যাবার কারণে খাদ্য হিসাবে তাদের আর ব্যবহার করা যায় না।
নীতি ৬: নয়াকৃষি মাটির তলার পানির সুরক্ষা নিশ্চিত করে। অথচ আধুনিক কৃষি শুধুমাত্র ইরি, ব্রিধান চাষের জন্য ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবস্থার ফলে বাংলাদেশ এখন ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্মুখিন। বিস্তীর্ণ চাষের জমির মধ্যে মরুভূমির চরিত্র দেখা দিয়েছে, লবনাক্ততা বৃদ্ধি এবং পানিতে আর্সেনিক দূষণ ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের ফল ।
নীতি ৭: নয়াকৃষি এক ফসলের হিসাব দিয়ে চাষাবাদের সামগ্রিক লাভালাভের হিসাব করে না সামগ্রিক ফলনের লাভালাভ এবং প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা ও বিকাশের মধ্য দিয়ে জনগোষ্টির পরিবেশগত ও আর্থিক লাভের হিসাব করে।
আধুনিক কৃষিতে কৃষকের ক্ষতি হয়, উৎপাদিত ফসল চাষের খরচ ওঠেনা, কৃষক দিনে দিনে গরিব হয়।অথচ লাভ হয় সার, বীজ, বিষ কোম্পানির ও সুদের মহাজনের।
নীতি ৮: গরু, ছাগল, হাঁস মুরগীসহ পরিবারের গৃহপালিত পশুপাখি নয়াকৃষি পরিবারের সদস্য। স্থানীয় হাঁস-মুরগী, গরু-ছাগল, লালন পালন সহজ এবং লাভজনক।
আধুনিক কৃষিতে গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির শিল্পের বিকাশের ফলে সৃষ্ট পরিবেশের দূষণ সমস্যা ক্রমশ: গুরুতর হয়ে উঠছে। হাঁস-মুরগি ও পশু পালনে ব্যাপক হারে রাসায়নিক দ্রব্য ও এন্টিবাইওটিক ব্যবহার করা হয়। দূষিত হাঁস-মুরগি ও পশুর মাংস সেবনের ফলে মানুষের শরীরে বিষক্রিয়া দেখা দেয়। মানব দেহে এন্টিবাইওটিকের কার্যকারিতা হ্রাস পায়।
নীতি ৯: মাছসহ সকল জলজ প্রাণের সংরক্ষণ ও বিকাশ নয়াকৃষির উদ্দেশ্য। জেলে-চাষীসহ সকল জীবিকার সমন্বয় ঘটিয়ে নয়াকৃষি উন্নত জীবন গড়ে তোলে।
আধুনিক কৃষিতে বালাইনাশক এবং রাসায়নিক সারের অত্যাধিক ব্যবহারের কারণে বেশিরভাগ কৃষি কার্যক্রম পানি দূষণের জন্য দায়ী। যা শেষ পর্যন্ত ভূগর্ভস্থ পানিতে মিশে যায় এবং ভূপৃষ্ঠের পানিতে চলে যায়, পানির সার্বিক পরিবেশের ক্ষতি করে।
নীতি ১০: নয়াকৃষি গ্রামের প্রাকৃতিক সম্পদ বৃদ্ধি করে জীবিকার নিশ্চয়তা বৃদ্ধি ও আয় উন্নতির সুযোগ বাড়ায়।কৃষি বনায়ন, জ্বালানি কাঠ, সম্পদ রক্ষা, বহুবিধ ব্যবহার উপযোগী গাছ, ওষুধি গাছ, শাক-সবজিসহ দৈনন্দিন জীবনের সার্বিক চাহিদার নিরিখেই কৃষি কাজ করে।
আধুনিক কৃষিব্যবস্থাপনায় এ যাবৎ বাংলাদেশে ৬৯টি আক্রমণাত্বক এলিয়েন প্রজাতির প্রবর্তন করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪৬টি উদ্ভিদ, ১৬টি মাছ এবং ৫টি কীটপতঙ্গ প্রজাতি।
প্রবর্তিত আক্রমণাত্বক এলিয়েন প্রজাতিগুলি ক্রমবর্ধমানভাবে স্থানীয় উদ্ভিদ, প্রাণীজগৎ ও বাস্ততন্ত্রের জন্য হুমকি স্বরূপ।
পরিশেষে, নয়াকৃষি বনাম আধুনিক কৃষির একটি একাডেমিক ফলাফলে দেখা যায় যে নয়াকৃষি (ইকোলজিক্যাল কৃষি), অপেক্ষাকৃত বেশি টেকসই এবং আধুনিক কৃষি (কনভেনশনাল কৃষি) ব্যবস্থার, একটি অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত ভাবে কার্যকর বিকল্প হতে পারে নয়াকৃষি। (গোলাম রসুল, গোপাল বি থাপা, ২০০৩)।