“ভগিনীগণ! চক্ষু রগড়াইয়া জাগিয়া উঠুন”
ফরিদা আখতার || Monday 09 December 2013 ||প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেগম রোকেয়া পদক বিতরণী অনুষ্ঠানে একটি অতি সত্য কথা বলে ফেলেছেন, যদিও এক পক্ষীয়ভাবে, বিরোধী দলীয় নেত্রীকে দোষারোপ করে। তিনি বুঝেছেন যে দুই নেত্রীকে জনগণ গালি দিচ্ছে। তিনি বলছেন বিরোধী দলীয় নেত্রী হরতাল-অবরোধ দিয়ে মানুষ না মারলে ‘দুই নারী হিশেবে গালি খেতে হতো না’। হরতাল অবরোধ করে যদি শুধু বিরোধী নেত্রীর দোষ হতো তাহলে দুই নারীকে জনগণ গালি দেবে কেন? যিনি অন্যায় করছেন তাকেই দেবে। জনগণ এতো অবিবেচক নয়। কাজেই ব্যাপারটা প্রধানমন্ত্রী স্বীকার না করলেও সত্যি যে আচরণ, প্রতিহিংসাপরায়ণতা এবং দোষারোপ করার দিক থেকে তারা দুই নেত্রী তাদের জায়গা থেকেই মূল্যায়ন করে। তারা বিষয়টি ভালোভাবে নিচ্ছে না, তাই দুই নেত্রীকেই প্রধানমন্ত্রীর ভাষাতেই তারা ‘গালি’ দিচ্ছেন। ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে দেয়া টেলিভিশনে সরাসরি প্রচারিত শেখ হাসিনার বক্তব্য শুনেই লিখছি।
তবে রোকেয়া দিবস বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষা নারী অধিকারের পক্ষে ছিল, তাই তিনি কিছুটা বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার পক্ষেও অবস্থান নিয়ে বসেছেন। তিনি বলছেন বলা হয় দুই নারীর ঝগড়া, দুজন পুরুষ হলে এ কথা কেউ বলতো না। একেবারে সত্যি কথা! আমরা দীর্ঘদিন ধরে এই কথাটি দুজনকেই বোঝাবার চেষ্টা করছি যে আপনারা দুজন নারী দেশের একেবারে শীর্ষ অবস্থানে থেকে আজ নারীর রাজনৈতিক অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলেছেন শুধুমাত্র নিজেদের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটানোর কারণে। আপনারা এতোদিন কেউ কারো মুখ দেখতে চাননি, কোথাও একত্রে বসে কথা বলেন নি। এমন কি শেষ পর্যন্ত টেলিফোনে যে আলাপ হলো তাও সবাইকে হতাশ করলো।
কারো বক্তৃতার একটি বড় অংশ জুড়ে যদি অন্যের প্রতি বিরূপ মন্তব্য থাকে, জনগণ তা পছন্দ করে না। নেত্রীদের পর্যায়ে শুনতে চায় না। প্রধান মন্ত্রীর তো নয়ই। তবে আমার অনেক সময় মনে হয়েছে তাঁরা আসলে পরস্পরকে ভালবাসেন তাই সব সময় একে অন্যের কথা না বলে থাকতে পারেন না। দুজনে কে কী করে, তা উভয়ের জানা। বিশেষ করে প্রধান মন্ত্রী বিরোধী দলীয় নেত্রী কি খান, কখন কি করেন সে সব খোঁজটা একটু বেশিই রাখেন।
এবারের বেগম রোকেয়া দিবস পালিত হচ্ছে ঠিকই কিন্তু হরতাল অবরোধ থাকার কারণে খুব সাড়া জাগানোভাবে হচ্ছে না। রোকেয়া দিবস সরকারিভাবে পালিত হয় কিন্তু আমন্ত্রণ পত্র যায় কেবল দলীয় সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের কাছে। যারা সরকারি দল করে না তারা কি এদেশের নাগরিক হিশেবে বেগম রোকেয়া দিবসে সরকারি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন করতে পারেন না? এভাবে কি কোনো লিখিত নির্দেশ কোথাও দেয়া আছে? তাহলে মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয় কেন সকলকে আমন্ত্রণ জানান না? বেগম রোকেয়াকেও দলীয়করণ করা হয়।
রোকেয়া দিবসে আজ নারীদের সাফল্য ও সংগ্রামের কথা থাকবে, কিন্তু লক্ষ্য করলাম প্রধান মন্ত্রী নিজ দলের গুন গাইলেন এবং বিরোধী পক্ষকে দোষারোপ করলেন। এখানেই তো তিনি রোকেয়ার আদর্শের বাইরে চলে গেলেন। তিনি বললেন, নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন হয়েছে। বিশজন নারী জাতীয় সংসদে সরাসরিভাবে নির্বাচিত হয়ে এসেছেন। খুব ভালো কথা। আমরা খুবই খুশি। স্পিকার, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সংসদ উপনেতা সবই পেয়েছিলাম, কিন্তু গর্ব করার অবস্থায় তাঁরা আমাদের থাকতে দিলেন না। তাঁরা নারীদের পক্ষে কাজ করেছেন এমন কোন নজির নেই, বরং তাঁদের কোনো নারী সংগঠনের কর্মসুচিতেও দেখা যায় নি।
কৃষিমন্ত্রী খুব সফল হিশেবে সুনাম অর্জন করলেও তাঁর মাধ্যমে আফ্রিকার নেরিকা ধানের চাষ করতে কৃষকদের বাধ্য করা হয়েছে, এবং কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। হাইব্রড বীজে দেশ ভরে গেছে। এতে নারী কৃষকদের ক্ষতি হয়েছে কি না সে খোঁজ তিন নেননি। বহুজাতিক কোম্পানি অবাধে এদেশে জেনেটিকালি ইঞ্জিনিয়ার্ডলি ফসল (জিএমও) আনার সুযোগ পেয়েছে। বিটি বেগুন নামের মন্সান্তো-মাহিকোর জিএম বেগুন প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে চাষের অনুমোদন দিয়ে দেয়া হয়েছে, শুধুমাত্র কোম্পানি স্বার্থে। এর ফলে দেশের স্থানীয় জাতের বেগুন ক্ষতিগ্রস্ত হবে, পরিবেশের ক্ষতি হবে এবং ভোক্তাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি সৃষ্টি হবে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করা হলেও তিনি তাতে কর্ণপাত করেননি। এখন এর ফলে বাংলাদেশের সব্জি রফতানি ৬৫০ মিলিয়ন ডলারের বাজার ইওরোপ-আমেরিকায় নষ্ট হতে বসেছে, দেশের কৃষকদের ক্ষতির পরিমান আরও অনেকগুন বেশী হবে। নারী কৃষিমন্ত্রী পেয়ে তাহলে আমরা দেশের সবচেয়ে জরুরি একটি খাদ্য রক্ষারও সুযোগ পেলাম না!
রোকেয়া দিবসে তাই এই সব আক্ষেপ করছি। দুই নারীকে নেত্রী হিশেবে মেনে নিয়ে এদেশের মানুষ ১৯৯১ সাল থেকে অনেক উদার মনের পরিচয় দিয়েছে। যেখানে বিশ্বব্যাপী প্রচার রয়েছে যে বাংলাদেশে মৌলবাদী শক্তির উত্থান ঘটছে, এখানে নারীর স্বাধীনতা নেই, নারী নির্যাতনের শিকার; সেখানে প্রধানমন্ত্রী হিশেবে নারী রয়েছেন। শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়া উভয়ে এদেশ চালিয়েছেন এই ধরণের আন্তর্জাতিক প্রচারের বিরুদ্ধে মোকাবেলা করে। এখানে দুই নারী নেত্রীর কৃতিত্ব স্বীকার করতে হবে যে একটি মুসলিম প্রধান দেশে তারা দাপটের সাথে রাজনৈতিক মাঠে টিকে আছেন। বরং দেখি আগের বাঘা বাঘা পুরুষ নেতারাই কাঁদো কাঁদো স্বরে কথা বলেন, নেত্রীর কথা (অযোক্তিক হলেও) মেনে নেন। শেষ পর্যন্ত সবাই ‘শক্তের ভক্ত, নরমের যম’ – দুই নেত্রীর হাতে যে ক্ষমতা রয়েছে তার কাছেই নতি স্বীকার করেন, তাও আবার নিজেদেরই ব্যক্তি স্বার্থে।
দেশে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে, তার জন্যে দুই নেত্রী দায়ী সন্দেহ নেই। প্রত্যেকেই তাই বলছেন। জনগণ বিরক্ত হয়ে গেছে। এক-এগারোর সময় যখন মাইনাস টু করতে চেয়েছিল তখন জনগণ দুই নেত্রীর পক্ষে ছিল, কিন্তু এখন তারা সেভাবে নেই। দেশের শান্তির জন্যে দুই নেত্রীর মধ্যে যদি এরূপ পাল্টা-পাল্টি চলতে থাকে তার পরিনাম যে খারাপ হবে তাই আশংকা করে আমরা সবাই আতঙ্কিত।
বেগম রোকেয়া দিবসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার “নারী” হিশেবে উপলবদ্ধিতে একটু আশ্বস্ত হতে চাচ্ছি। শুধু বিরোধী দলের নেত্রীকে জ্বালাও-পোড়াও বন্ধ করার উপদেশ না দিয়ে তিনি নিজে যা করলে দেশে শান্তি আসবে এমন একটি উদাহরণ কি সৃষ্টি করতে পারেন না? নিশ্চয়ই পারবেন।
অতএব, বেগম রোকেয়ার ভাষাতেই বলি, “ভগিনীগণ! চক্ষু রগড়াইয়া জাগিয়া উঠুন – অগ্রসর হউন”।
ফরিদা আখতার: নির্বাহী পরিচালক, উবিনীগ