শিল্পী ফিরোজা বেগমকে কি রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেয়া যেতো না?
ফরিদা আখতার || Friday 12 September 2014 ||শিল্পী ফিরোজা বেগম আর আমাদের মাঝে নেই। সেপ্টেম্বর মাসের ৯ তারিখে তিনি আমাদের ছেড়ে গেছেন চিরতরে, ঠিক যেমনি করে গেয়েছেন ‘আমি চিরতরে দূরে চলে যাবো তবু আমারে দেবো না ভুলিতে......’। তার এই গানের সুরের রেশ আমাদের কানে লেগে আছে এবং থাকবে। শুধু এই একটি গান নয় অনেক গান। বর্তমান কালের যারা আছেন তাদের কথা জানি না, অন্তত আমরা যারা ছোটবেলা থেকে রেডিওতে তাঁর গান শুনতে শুনতে বড় হয়েছি, তাদের কাছে নজরুল ইসলামের গান মানেই ছিল ফিরোজা বেগমের গান। তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কিছু নেই, ফিরোজা বেগম একজনই। অনেকে নাম দিয়েছেন নজরুল সঙ্গীত সম্রাজ্ঞী। আসলে তিনি তাই। টানা কয়েকবার সেরা নজরুল সঙ্গীত শিল্পী হিশেবে স্বীকৃত হয়েছেন তিনি। অর্থাৎ তিনি ছাড়া নজরুলের গান পুর্ণ মাত্রা পায় না। তাঁর আপ্রাণ চেষ্টা ছিল নজরুলের গানের শুদ্ধ্ব স্বরলিপি ও সুর সংরক্ষণের জন্য। অন্তত তাঁর কন্ঠে গাওয়া গান গুলো নজরুলের গানের শুদ্ধতা ধরে রাখবে।
তাঁকে শহীদ মিনারে সবাই গিয়ে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। আগণিত ভক্ত তাঁর। সরকারের পক্ষ থেকে সংস্কৃতি মন্ত্রী ও সচিব ফুল দেন, পরে অন্যান্য মন্ত্রী এবং রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধ্বাঞ্জলি জানানো হয়। যারা তাঁকে ভালবেসে ফুল দিতে গেছেন তাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে এই সব আনুষ্ঠানিক শ্রদ্ধাঞ্জলির পরে দেয়ার জন্যে। এরপর গুলশানের আজাদ মসজিদে জানাজার পর তাঁকে বনানী গোরস্তানে কবর দেয়া হয়। স্বামী কমল দাশ গুপ্ত (কামাল আহমদের) পাশে। কিন্তু এতো ভালবাসা দেখবার পরেও মনে হচ্ছে কোথায় যেন তার প্রতি অবহেলা হয়েছে। তাঁকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিয়ে সমাহিত করা হয়নি। কাজী নজরুল ইসলাম জাতীয় কবি। ফিরোজা বেগম বাংলাদেশে হয়তোবা একমাত্র শিল্পী যিনি সরাসরি কাজী নজরুলের কাছ থেকে গান শিখেছেন, কাজী নজরুল নিজে গান বাছাই করে তাঁকে দিয়েছেন রেকর্ড করার তাঁর মাত্র ১০ কি বার বছর বয়সে। কাজী নজরুল ইসলাম সে সময় অল ইন্ডিয়া গ্রামোফোন কোম্পানির প্রধান সঙ্গীত শিক্ষক ছিলেন। কাজী নজরুলের গানে যারা সুর দিতেন সঙ্গীত জগতের আরও দুই কর্ণ ধার চিত্ত রায় ও কমল দাস গুপ্তের কাছে তিনি গান শিখেছেন এবং তাদের নির্দেশনায় গান রেকর্ড করেছেন। তাঁরা ফিড়জাকে চিনতে ভুল করেন নি। ফিরোজা বেগম নজরুলের গানকে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছেন, পৌঁছে দিয়েছেন বিশ্বের দরবারে সঙ্গীত বোদ্ধাদের কাছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ৩৮০টি একক অনুষ্ঠান করেছেন যেখানে তিনি নজরুলের গান গেয়েছেন। ফিরোজা বেগমের নাম আর নজরুলের গান একাকার হয়ে গেছে । কাজী নজরুল আমাদের দেশের জাতীয় কবি, সেদিক থেকে বিচার করলে তিনি জাতীয় শিল্পীর মর্যাদা পাবার যোগ্য। তাঁকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা কি যেতো না? সেটা হয়নি কেনো, আমার কাছে বোধগম্য নয়। ফিরোজা বেগমকে নিয়ে এখন টেলিভিশনে অনেকে কথা বলছেন। নজরুল সঙ্গীত শিল্পীরা অনেক আফসোস করছেন কিন্তু তাঁরা কেউ দাবী করলেন না কেন যে এটা তাঁর প্রাপ্য। আমরা এমনই দুর্ভাগা দেশের মানুষ, বেঁচে থাকতেও কাউকে মর্যাদা দিতে জানি না, মৃত্যুর পরও প্রাপ্য সম্মান দিতে আমাদের কার্পণ্যের শেষ নেই।
বেসরকারি টিভি চ্যানেলে ফিরোজা বেগমের কয়েকটি সাক্ষাতকার দেখেছি, পড়েছি পত্র-পত্রিকায় তাঁকে নিয়ে লেখা। তিনি শুধু নজরুল সঙ্গীত করতেন না, আধুনিক গান, গজল, গীত, কাওয়ালি, ভজন, হামদ, নাত সবই করতেন। অন্যের সুরে শুধু গান করতেন তাই নয় তিনি নিজেও সুর করেছেন কবি জসিমউদ্দিনের গানে বা কবিতায়। আমার এ ঘর ভঙ্গিয়াছে যারা ...... জসিমউদ্দিনের এই গানে তিনি যে সুর করেছেন এবং কন্ঠ দিয়েছেন তাতে জসিমউদ্দিন নিজেই তাঁর চোখের পানি ধরে রাখতে পারেন নাই। আঝোরে কেঁদেছেন। গান নিজেও লিখেছেন। তিনি ছবিও আঁকতে পারতেন। শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরিকে তাঁর আঁকা ছবি দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন।
তিনি তিন পুত্র সন্তানের মা। তাঁর দুই ছেলে হামিন আহমেদ আর সাফিন আহমেদ ব্যান্ড সঙ্গীতের বিখ্যাত শিল্পী। এই প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা তাঁকে হামিন ও সাফিন কিংবা ‘মাইলস’ –এর মা হিশেবে চিনেছে। তিনি একটি সাক্ষাতকারে বলেছেন ‘আমাকে রাস্তায় দেখলে অনেকে বলে মাইলস-এর মা যাচ্ছে। আমার পরিচয় ছাপিয়ে আমাকে আমার ছেলেদের পরিচয়ে চিনেছে দেখে আমি খুশি হয়েছি”। এই ঘটনা মা হিশেবে ফিরোজা বেগম খুশি হতে পারেন, কিন্তু এই ঘটনা বর্তমান সময়ের ছেলে-মেয়েদের সঙ্গীত জগতের শিল্পীদের চেনার ক্ষেত্রে কত ঘাটতি রয়েছে তার দুঃখজনক পরিচয় পাওয়া যায়।
আরো অবাক হয়েছি, শিল্পী ফিরোজার মৃত্যুতে যেন শুধু শোকের ছায়া নেমেছে নজরুল সঙ্গীত শিল্পীদের। ইয়াসমিন মুশ্তারি, খায়রুল আনাম শাকিল, ফাতেমাতুজ্জ জোহরা, সাদিয়া আফ্রিন মল্লিক, খালিদ হোসেন – এঁরাই যেন কথা বলবেন অন্য বড় বড় শিল্পীদের কোন রকম কথা বলতে দেখলাম না। রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পীরাও নীরব। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট শহীদ মিনারে লাশ এনে সর্ব সাধারণের জন্যে শ্রদ্ধার ব্যবস্থা করে দিয়েই খালাশ! তাদের কি আর কোন দায়িত্ব নেই?
ফিরোজা বেগম স্বাধীনতা পদক, একুশে পদকসহ দেশে বিদেশে বহু পুরুস্কার পেয়েছেন। তার মধ্যে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র পুরস্কার, সত্যজিৎ রায় পুরস্কার, পশ্চিম বংগের মূখ্য মন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর কাছে পেয়েছেন বংগ সম্মান ২০১২ সালে। ইদানীং দেশে সরকারের পক্ষ থেকে তাকে স্বীকৃতি দিতে দেখা যায় নি।
রাষ্ট্রীয় সম্মান দিয়ে তাঁকে সমাহিত করলে আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলামকেও সম্মান দেয়া হোত। তা হোল না কেন? আমাদের জন্যে এই ঘটনা চির দিন মর্ম বেদনার কারণ হয়ে থাকবে। ফিরোজা বেগমের কোন ক্ষতি হয় নি, হয়েছে আমাদের।