খাদ্য নিরাপদ কিনা ভাবনায় এবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা
ফরিদা আখতার || Sunday 12 April 2015 ||জাতিসংঘের বেশ ক'টি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা রয়েছে, যারা নিজ নিজ কাজ স্বতন্ত্রভাবেই করে। এটা অনেকটা আমাদের দেশের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কাজের মতোই। সবকিছুই জনগণের জন্য করা; কিন্তু যার যার কাজ সে করে যাচ্ছে নিজের মতো করে। কারও সঙ্গে কারও কাজের সমন্বয় নেই। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার একেকটি বিভাগ তেমনই নির্দিষ্ট দায়িত্বের বাইরে খুব বেশি কাজ করে না। কেউ শান্তি রক্ষা করছে, কেউ উন্নয়ন করছে, কেউ শিশুদের রক্ষা করছে, কেউ মাতৃ স্বাস্থ্য রক্ষার চেষ্টা করছে ইত্যাদি। কিন্তু সবই যে ঘুরেফিরে এক জায়গার, একই পরিবার বা গোষ্ঠীর ব্যাপার হতে পারে, তা বোধহয় ভেবে দেখা হয় না। দেশে মানবাধিকার ক্ষুণ্ন হলে কথা বলে, কিন্তু সরকার সে কথায় কান না দিলে ভদ্র মানুষের মতো চুপ হয়ে যান।
তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসে (৭ এপ্রিল) এবার একটু ভিন্নতা এসেছে দেখে আমি খুশি। তারা মনে হয় এ প্রথম খাদ্য নিয়ে ভাবছেন এবং খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সঙ্গে একসঙ্গে মিলে নিরাপদ খাদ্যের প্রতিপাদ্য নিয়ে দিবসটি পালন করছেন। আমি জানি না, স্বাস্থ্য নিয়ে কোনো চিন্তা খাদ্যের বাইরে কেমন করে হতে পারে? মানুষ শুধু ক্ষুধা মেটানোর জন্য খায় না, সুস্থ থাকতে হলে খেতে হবে এবং সে খাদ্য নিরাপদ হতেই হবে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের দেশে খাদ্য উৎপাদন করেন কৃষক, তাদের দেখভাল করার দায়িত্ব কৃষি মন্ত্রণালয়ের। অথচ কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে খাদ্য উৎপাদনের মন্ত্র দেয়া হয় কীটনাশক-রাসায়নিক সার ব্যবহার করতে। অথচ এ কীটনাশক দিয়ে খাদ্য উৎপাদনের কারণে শত শত রোগের সৃষ্টি হচ্ছে। অথচ দেশে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে তা বন্ধ করার কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না। কৃষি মন্ত্রণালয় বলে, আমাদের কাজ অধিক খাদ্য উৎপাদন করা, যার আরেকটি নাম হচ্ছে 'খাদ্য নিরাপত্তা' (ইংরেজিতে food security) । সেটা করতে গিয়ে এমনসব কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে যার মধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১২টি কীটনাশককে আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ করে 'ডার্টি ডজন' কীটনাশক নাম দিয়েছে। দুর্ভাগ্য হচ্ছে, আমাদের দেশে সেই ডার্টি ডজন কীটনাশক দেদার ব্যবহার হচ্ছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও দেখে না, কৃষি মন্ত্রণালয়ও দেখে না। আর কৃষক বস্নক সুপারভাইজার বা কীটনাশক বিক্রেতার কাছে ফসলে পোকা লেগেছে বলতে গেলে এসব ক্ষতিকর কীটনাশক ধরিয়ে দিয়ে ব্যাপক মুনাফা লুটে নিচ্ছে। এ কীটনাশক ব্যবসায়ীদের এমন সুযোগ দেয়া হয় যে সরকারি প্রচারমাধ্যম বেতার ও টিভিতে কৃষক কোন কীটনাশক কখন ব্যবহার করবে, তা শেখানো হয়। আরও দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, কৃষিতে ভর্তুকি দেয়া হয় সার-কীটনাশক কেনার জন্য। রাজনৈতিক দলগুলো কৃষকের পক্ষে দাবি তোলেন, সার-কীটনাশক সহজভাবে সরবরাহের জন্য। বাম রাজনৈতিক দল যখন এ বিষয়ে সোচ্চার হতে দেখি, তখন লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায়। খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন মানে নিরাপদ খাদ্য নয়, এ পার্থক্য মানুষকে বুঝতে হবে। খাদ্য নিরাপত্তা উৎপাদন বৃদ্ধির কথা বলে। দেশে খাদ্য উৎপাদন বেড়ে গিয়ে যদি সব অনিরাপদ খাদ্য হয়, তাহলে নিশ্চয়ই তা কাম্য হতে পারে না।
কাজেই বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসে নিরাপদ খাদ্যের প্রশ্ন হচ্ছে সময়ের দাবিতে। খাদ্য নিয়ে যারা কাজ করেন, তারা স্বাস্থ্য নিয়ে নাও ভাবতে পারেন, আবার স্বাস্থ্য নিয়ে যারা কাজ করেন তারা নিরাপদ খাদ্যের ধারণার সঙ্গে পরিচিত নাও হতে পারেন। কিন্তু এখন আর সে পরিস্থিতি নেই। কারণ রোগের অনেক ধরনই সরাসরি খাদ্যের সঙ্গে জড়িত, যাকে বলা হয় food borne disease বা খাদ্যবাহিত রোগ। এসব রোগের সঙ্গে আমরা খুব পরিচিত এবং প্রতিরোধযোগ্য। বছরে ২.২ মিলিয়ন। (২২ লাখ) মানুষ ডাইরিয়াসহ খাদ্য ও পানিবাহিত রোগে মারা যাচ্ছে, যার মধ্যে অধিকাংশই শিশু। (১.৯ মিলিয়ন বা ১৯ লাখ)। একটি বিরাট সংখ্যার মানুষ প্রতিনিয়ত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে কোটি কোটি মানুষ। কাজেই স্বাস্থ্য রক্ষার দিক থেকে দেখতে গেলেও খাদ্য নিরাপদ রাখার বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
এবারের বিশ্ব খাদ্য দিবসে দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক পুনাম ক্ষেত্রপাল শিং এ বিষয়ে তার উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলছেন, খাদ্যের মধ্যে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, রাসায়নিক দ্রব্য এবং অন্যান্য দূষণমূলক পদার্থ প্রায় ২০০-এর বেশি রোগের সৃষ্টি করে, যার মধ্যে ডাইরিয়া থেকে শুরু করে ক্যান্সার রয়েছে। নিরাপদ খাদ্যের বিষয়টি এখন জলবায়ু পরিবর্তনের মতোই নতুন একটি হুমকি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক মার্গারেট চ্যান বলেছেন, 'একটি এলাকায় খাদ্য সমস্যা খুব দ্রুত আন্তর্জাতিক জরুরি অবস্থায় পরিণত হতে পারে। কারণ খাদ্য উৎপাদন এখন শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে এবং এর বাণিজ্য ও বিতরণ এখন বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে।'
খাদ্য যেখান থেকে উৎপাদিত হয় এবং খাবারের টেবিলে আসার আগ পর্যন্ত যত ধাপ পার হয়ে আসে তার মধ্যে অনেক কিছু যুক্ত হয়ে এ খাদ্যকে বিষাক্ত করে তুলছে। এতদিন আমরা জনস্বাস্থ্য বিভাগের একটি অন্যতম প্রধান কাজ হিসেবে খাদ্যে ভেজাল রোধের জন্য জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে পর্যবেক্ষণ করতে দেখেছি এবং খাদ্যবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ গ্রহণ করতে দেখেছি। কাজেই স্বাস্থ্য সুরক্ষার অংশ হিসেবে খাদ্য নিরাপদ কিনা, তাও দেখার কাজ নির্দিষ্ট করা আছে। আন্তর্জাতিকভাবেও Codex Aliment Arius Commission-এ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বৈজ্ঞানিক ও জনস্বাস্থ্য রক্ষার ভূমিকা বাড়ানোর প্রতি জোর দেয়া হয়েছে। কিন্তু জাতীয় পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা কাঠামো ও পরিকল্পনার মধ্যে রোগ নিরাময়ের জন্য যত ব্যবস্থা আছে এবং যত ব্যয় করা হয়, রোগ প্রতিরোধের জন্য সেই ধরনের পরিকল্পনা চোখে পড়ে না। জনস্বাস্থ্য বিভাগের কাজ শুধু ভেজাল খাদ্য বন্ধের উদ্যোগ নেয়াই যে যথেষ্ট নয়, তা এবারের প্রতিপাদ্য 'নিরাপদ খাদ্য' সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) যেভাবে ব্যাখ্যা করেছে তাতে পরিষ্কার হয়ে উঠেছে।
নিরাপদ খাদ্য বলে আলাদা কোনো খাদ্য নেই। যে কোনো খাদ্যই নিরাপদ হবে কিনা তা উৎপাদন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে বাজারে বিক্রি, ঘরে এনে রান্না ও পরিবেশন করা এবং খাওয়া পর্যন্ত প্রতিটি পদে 'নিরাপদ' করার ব্যাপার আছে। কোনো একটি পর্যায়ে এর বিঘ্ন ঘটলে তা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জন্য সেটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। খাদ্য উৎপাদন নিয়ে বিশেষভাবে কাজের দায়িত্ব জাতিসংঘের অপর প্রতিষ্ঠান খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (FAO)। এবারের (২০১৫ সালের) বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং খাদ্য ও কৃষি সংস্থা নিরাপদ খাদ্যের প্রশ্নে একত্রে কাজ করছে।
খাদ্য উৎপাদনকে শিল্পের মতো ব্যবহার করলে প্রথমত নষ্ট হচ্ছে প্রকৃতি প্রদত্ত খাদ্য গুণাবলি। যারা ব্যবসার জন্য খাদ্য উৎপাদন করে, তাদের কাছে খাদ্যের গুণ রক্ষার চেয়ে বেশি জরুরি হচ্ছে খাদ্য মার্কেটের শেলফে দীর্ঘদিন রেখেও যেন নষ্ট না হয় এবং দেখতে যেন সুন্দর চকচকে হয়, সেটাই নিশ্চিত করা। আর মধ্যবিত্ত ক্রেতারাও বিদেশের সুপার মার্কেট দেখে এতই মুগ্ধ যে, তাদের কাছে একটু বাঁকাতেড়া সবজি ভালো লাগে না, পোকায় একটু খেয়ে ফেললে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়। কাজেই কৃষক নয়, ব্যবসায়ীরাই এখন খাদ্যের বড় জোগানদার হয়ে গেছেন। আর ধীরে ধীরে ঢুকে পড়ছে বহুজাতিক কোম্পানি যেমন মনসান্তো, সিনজেন্তা ইত্যাদি। মনসান্তো বিজ্ঞানীদের ভাড়া করে মিথ্যা প্রচার চালাচ্ছে যে, বেগুনে পোকা লাগবে না এমন বেগুনের প্রযুক্তি তারা নাকি 'আবিষ্কার' করেছে, নাম দিয়েছে বিটি বেগুন। তাই আমাদের বিটি বেগুন চাষ করতে হবে এবং খেতে হবে। যদিও তারা নিজেরা খাবে কিনা, সন্দেহ রয়েছে। সিনজেন্তা বলছে, ভিটামিন-এ ধান (যার নাম দিয়েছে গোল্ডেন রাইস) খেলে রাতকানা রোগ হবে না। অথচ বেশকিছু সবজি ও ফলমূলের মাধ্যমেই এর সমাধান আমাদের রয়েছে। না, ওরা স্বাস্থ্যের নামেই এসব জিএম ফসল নিয়ে আমাদের দেশে ঢুকছে। তাই কীটনাশক ব্যবহারের ক্ষতির কথা একটু বলে জিএম ফসল প্রচারের চেষ্টা চলছে। চালাকি করে কীটনাশক ব্যবহার বন্ধ করার যথেষ্ট উদ্যোগ না নিয়েই জিএম ফসল প্রবর্তনের যে চেষ্টা হচ্ছে, আশা করি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সেদিকেও নজর দেবে। আমাদের দরকার কীটনাশক বন্ধ করা, একইসঙ্গে জিএম ফসলের আগ্রাসনও প্রতিরোধ করা। কারণ এর কোনোটাই স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়। ৭ এপ্রিল থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাদের খাদ্য নিরাপত্তা প্রচারাভিযান শুরু করবে। প্রচারাভিযানে খামার থেকে প্লেট পর্যন্ত খাবার নিরাপদ রাখার বিষয়ে বিভিন্ন পরামর্শ দেয়া হবে। আমরা আশা করব, একইসঙ্গে জিএম খাদ্য নিরাপদ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত এদেশে ব্যাপক চাষের ব্যাপারে তারা সুনির্দিষ্ট বক্তব্য দেবেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস মূলত স্বাস্থ্য সুরক্ষার দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন হিসেবে সবসময় পালন হয়ে আসছে। আমরা স্বাগত জানাচ্ছি যে, স্বাস্থ্য সুরক্ষার পরিধি আরও বেড়ে যাচ্ছে, কারণ এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্যতম প্রধান উপাদান 'খাদ্য'। আমরা দাবি করি, খাদ্য উৎপাদনে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করার পদ্ধতির সঙ্গে খাদ্যকে নিরাপদ করার পদ্ধতি যুক্ত হবে। বেশি উৎপাদনের নামে খাদ্যকেই যেন বিষাক্ত না করা হয়। উৎপাদন থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াজাতকরণ, দোকানে রাখার মধ্যে খাদ্য নিজেই স্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। এমনকি ঘরে এনে রাখার যে উপায়গুলো আছে তার মধ্যেও রয়েছে অনেক গলদ। খাদ্য প্লেটে সুন্দরভাবে উপস্থাপিত হলেই তা নিরাপদ হয় না, এমন কিছু সত্য এবারের বিশ্ব খাদ্য দিবসে জনগণের কাছে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে দিবসটি পালন সার্থক হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নিরাপদ খাদ্যের প্রশ্নে শুধু উৎপাদনের কথা বলছে না, তারা পাঁচটি 'চাবিকাঠি' (Five Keys to Safer Food) দিয়েছে। ভোক্তাদের পক্ষে উৎপাদন পর্যায়ে খাদ্য নিরাপদ করার সুযোগ কম বা তাদের নিয়ন্ত্রণে নেই, কিন্তু তাদের সচেতনতা উৎপাদকদের নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে বাধ্য কিংবা উৎসাহিত করতে পারে। ভোক্তারা নিজেদের আচার পরিবর্তনের মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদনকে নিরাপদ করতে পারেন। ফরমালিনের যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল তাতে গত বছর অনেকে আম খায়নি। এবার বাজারের তরমুজ খাচ্ছে না, কারণ তরমুজেও নানা ধরনের রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হচ্ছে।
নাগরিক জীবনযাত্রার মধ্যে এখন আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার খাদ্য সংরক্ষণ, রান্না ও খাওয়ার মধ্যে অনেক পরিবর্তন এনেছে, যা খাদ্য নিরাপদ রাখার ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করছে কিনা প্রশ্ন উঠেছে। ব্যবহারকারীদের পর্যায়ে প্রযুক্তির ওপর অগাধ বিশ্বাস এবং তথ্যের অভাব তার অন্যতম কারণ।
খাদ্য নিরাপদ হোক, ব্যবসা নয় মানুষের স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য হোক খাদ্য উৎপাদন।