প্রস্তুতিবিহীন এক ভূমিকম্পের অপেক্ষায়

নেপালের সাম্প্রতিক ভূমিকম্প থেকে অনেক কিছু শেখার আছে আমাদের
প্রকৃতি বাংলাদেশকে যথেষ্ট সতর্কবাণী দিয়েছে- ভূমিকম্প হতে পারে, শিগগিরই বড় আকারেই আসতে পারে। কারণ নেপালের পর উৎপত্তিস্থল ক্রমেই বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে আসছে। নেপালের ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা ৪ হাজার ছাড়িয়েছে; আহতের সংখ্যা কত তা বলে শেষ করা যাচ্ছে না। এসব দেখেও যেন আমাদের কোনো টনক নড়ছে না। নেপালের প্রেসিডেন্ট নিজেও রাত কাটাচ্ছেন তাঁবুতে। কারণ তার ঘরেও ফাটল ধরেছে। আমরা ব্যস্ত রয়েছি, সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে। ভূমিকম্পের বিষয়ে বাংলাদেশে আমরা সরকারের পক্ষ থেকে প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার কোনো উদ্যোগ দেখছি না। প্রস্তুতি নিয়ে রাখলে ভূমিকম্প না হলেইবা অসুবিধা কী? আমাদের প্রস্তুতি থাকলে অন্তত মানুষের ক্ষতি কমানোর চেষ্টা তো করা যাবে।
মাত্র তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে মিডিয়া এবং সরকারের পুরো প্রশাসন যেভাবে উঠেপড়ে লেগেছে, সেভাবে ভূমিকম্পের সম্ভাবনার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না। এ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারের ক্ষমতার কোনো পরিবর্তন হবে না, এমনকি ৫ জানুয়ারির নির্বাচনও নতুন করে কোনো বৈধতা পাবে না। তবুও যেমন করে হোক এ নির্বাচনে জেতা চাই। লাভের মধ্যে শুধু এটুকু যে, ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আওতায় থাকা ভোটাররা ভোট দেয়ার স্বাদটুকু নিতে পারবেন। আজ (২৮ এপ্রিল, ২০১৫) পত্রিকার প্রথম পাতা ভরে আছে শুধু সিটি করপোরেশন নির্বাচনের বিস্তারিত খবরে। পত্রিকার নানা শিরোনাম ‘গণতন্ত্রের অগ্নিপরীক্ষা আজ’, ‘উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় তিন সিটিতে ভোট আজ’, ‘ব্যালটে রাজনীতির লড়াই’ ইত্যাদি। ৬০ লাখের অধিক ভোটার দিয়ে নির্ধারিত হয়ে যাবে তিনটি সিটি করপোরেশনে কে কে মেয়র হচ্ছেন। কারা আবর্জনা পরিষ্কার করছেন। কিন্তু ভবনগুলো ঠিকমতো নির্মিত হচ্ছে কিনা তারা তা দেখবেন কিনা জানি না। সরকার মনে হয় ধরেই নিয়েছে, ভূমিকম্প হলেও তা নির্বাচনের পর হবে এবং নতুন মেয়র উদ্ধার কাজে সহায়তা করবে। ভোটের বাক্সটাই ভরাতে ব্যস্ত সবাই। দেখা যাক, গণতন্ত্র আসলেই রক্ষা হয় কিনা! ভবন রক্ষার বিষয়ে এখন কেউ ভাবছে না।
সরকার নীরব থাকলেও ভূমিকম্প নিয়ে অবশ্য কেউ নিজেদের প্রয়োজনীয় কাজ করছেন, যেমন সিমেন্ট কোম্পানি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিচ্ছে ‘ভূমিকম্প হলে কী করবেন’। ভালোই। তারা খুব ভালো করে জানেন, এত দিন হেলাফেলায় ঘরবাড়ি বানালেও এখন নির্দিষ্ট সিমেন্ট কিনে বাড়ি বানালে ভূমিকম্পের সময় তার বাড়ি অন্তত ভেঙে যাবে না!
সরকারের পক্ষ থেকে মনে হয় এখনও বিশ্বাস করছে না যে, আদৌ ভূমিকম্প হতে পারে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর থেকে দায়সারা গোছের রঙিন জরুরি বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে ‘ভূমিকম্পের সময় আপনার করণীয়’। নানাভাবে করণীয় বোঝানোর পর শেষ কথা বলা হয়েছে ‘বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মাণ করুন’। এটা খুবই হাস্যকর। এটা কি আজকালের মধ্যে ভবন নির্মাণের বিষয়, নাকি সরকার খুব দ্রুত ঘোষণা দেবে যে, ঢাকা শহরে যে ভবন রয়েছে তার মধ্যে কতগুলো ঝুঁঁকিপূর্ণ এবং কারা বিল্ডিং কোড মেনে ভবন বানায়নি তাদের তালিকা করার। তাদের বিষয়ে বিশেষ সতর্কবাণী দিয়ে সেই ভবনের মানুষগুলো কী করবে তার নির্দেশনা দেয়া। না, সেসব কিছুই নেই। কালের কণ্ঠ পত্রিকায় (২৬ এপ্রিল) বলা হয়েছে, ঢাকার ঝুঁকিপূর্ণ ভবন নিয়ে সার্বিক তথ্য নেই সংশ্লিষ্টদের হাতে। সরকারের একাধিক সংস্থার এক দশক ধরে ঝুঁঁকিপূর্ণ ভবন নিয়ে জরিপ কাজ করার কথা থাকলেও তা হয়নি। কেবল বাহ্যিক দিক দিয়ে ঝুঁঁকিপূর্ণ মনে করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ৩২১টি ভবন চিহ্নিত করেছে। সতর্কতার কথা যতটুকু আসছে তাতে মনে হচ্ছে, ভূমিকম্প শুধু ঢাকা শহরে হবে এবং অফিস-আদালত এবং ভবনের মানুষেরই জানার বিষয় রয়েছে কী করতে হবে। ঢাকা শহরে বস্তিবাসীর জন্য আলাদাভাবে কোনো সতর্কতা নেই। ক’দিন আগে একটি দুইতলা টিনের বস্তি ধসে মারা গেল অনেক মানুষ। সে ধরনের বস্তি আরও আছে। অথচ তাদের ব্যাপারে কিছু বলা হচ্ছে না। ঝুঁকিপূর্ণ বস্তিতে যারা রয়েছেন তাদের ব্যাপারে দ্রুত উদ্যোগ নেয়ার কী ব্যবস্থা হয়েছে, আমরা জানি না। একজন মেয়র প্রার্থীকে দেখলাম না তিনি এ বস্তিবাসীকে ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করার জন্য কী করবেন, সেই বিষয়ে কিছু প্রতিশ্রুতি দিতে।
নেপালে শনিবার (২৬ এপ্রিল) ভূমিকম্পের পর বাংলাদেশে তিন দিনে মাঝারি থেকে মৃদু ভূকম্পন অনুভূত হয়েছে কয়েকবার। সর্বশেষ গত রাতে (২৭ এপ্রিল) সন্ধ্যায় ভূকম্পন অনুভূত হয়েছে এবং ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থলও অনেক কাছে এসে পড়েছে। নির্বাচনের ডামাডোল না থাকলে এ নিয়ে অনেক আলোচনা হতো, পত্রিকার শিরোনাম হতো। অবাক হয়ে দেখলাম আজ (২৮ এপ্রিল) দেশের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকাগুলোতেও এর কোনো উল্লেখ প্রথম বা শেষ পাতায় নেই। নেপালের কিছু খবর থাকলেও শুধু সিটি করপোরেশন নির্বাচনের নানা জাতের খবর দিয়ে ভরা হয়েছে পত্রিকার পাতা। ভূমিকম্প যদি আরেকবার হয় এবং বড় ধরনের আঘাত হানে তা হলে সারা দেশে মানুষের জন্য কী সতর্কবাণী সরকার দিচ্ছে? শিলিগুড়িতে এসে ৫.১ রিখটার স্কেলে ভূমিকম্প উৎপত্তিস্থল হিসাবে হয়েছে, অর্থাৎ বাংলাদেশের একেবারে কাছে চলে এসেছে।
তাহলে বাংলাদেশের কোনো কোনো এলাকা বেশি ঝুঁঁকিপূর্ণ এবং তাদের জন্য কী প্রস্তুতি সরকারের রয়েছে আমরা জানতে পারছি না। শিলিগুড়ি হলে উত্তরবঙ্গের মানুষদেরও কিছু জানানো হচ্ছে না। অথচ সেখানে মানুষ ভূমিকম্প অনুভব করে যাচ্ছে, কারও বাড়িতে ফাটল ধরেছে, তারা ভয় পাচ্ছে। কিন্তু কার কাছে গিয়ে জানাবে তাদের এ ভয়ের কথা? এর আগে উৎপত্তিস্থল যখন নেপালে ছিল তখন বাংলাদেশে পাবনা, বগুড়া, দিনাজপুর, নীলফামারী জেলার লোকজন অনেক বেশি অনুভব করেছে। আবার এদিকে কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ এসব এলাকায়ও যথেষ্ট অনুভূত হয়েছে। এসব এলাকার লোকজন ভয়াবহভাবে আক্রান্ত হলেই কি সরকারের রিলিফ কাজ শুরু হবে? অনেক মানুষকে মৃত্যুর ঝুঁকি থেকে বাঁচানো যায় তাদের সময়মতো সতর্ক করে দিলে। কিন্তু সে ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
নেপালে যেদিন ৭.৮ রিখটার স্কেলে ভূমিকম্প হয়েছিল সেদিন ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ৭০০ থেকে ৭৫০ কিলোমিটার দূরে। সেদিন বাংলাদেশে বড়জোর ৪ থেকে ৫ রিখটার স্কেলে হয়েছে, তবুও আমরা ভালোই বুঝতে পেরেছি, ভূমিকম্প কেমন। মাথা ঘুরেছে অনেকের, আতঙ্কিত হয়ে দুই-একজন মারাও গেছে। অবাক হয়েছি সেদিন কী মাত্রায় ভূমিকম্প বাংলাদেশে হয়েছিল, আমাদের আবহাওয়া দফতরের ঠিকমতো বলতে অনেক সময় লেগেছে। অর্থাৎ তাদের ভূমিকম্পের মাত্রা জানার মতো প্রস্তুতিও নেই। সেদিনের পর থেকে যখন বারবার প্রতিদিন ভূকম্পন হচ্ছে, আবহাওয়া অধিদফতরের পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য দেখা যাচ্ছে না কেন? তাদের সহায়তা নিতে হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের জিওলজিক্যাল সার্ভের (USGS)। রোববার উৎপত্তিস্থল নেপালে থাকলেও বাংলাদেশের আরও কাছে চলে এলো ৬১২ কিলোমিটার দূরে। এখন নেপাল ছেড়ে চলে এসেছে দার্জিলিংয়ের কাছে, শিলিগুড়িতে। বলতে গেলে বাংলাদেশের একেবারে ধারে কাছে, ৫৬৮ কিলোমিটার দূরে; কিন্তু আমাদের উত্তরবঙ্গের জেলা যেমন পঞ্চগড়, দিনাজপুর বলতে গেলে পাশেই। উত্তরবঙ্গের জন্য সেই হিসেবে একটা বড় ঝুঁকি সৃষ্টি করছে। আমাদের সরকার নিশ্চুপ। নিশ্চুপ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় যারা সক্রিয় থাকেন তারা সবাই। এটি ঢাকা হলে নিশ্চয়ই এত চুপ থাকতে পারতেন না।
বাংলাদেশ ভূমিকম্প থেকে নিরাপদে থাকুক, এটাই চাই। কারণ আমাদের কোনো প্রস্তুতি নেই। আমরা অন্যদের দেখেও শিখি না। মরলে এ সাধারণ মানুষই মরবে, ধনীরা বেঁচে যাবেন- এমন কোনো গ্যারান্টি অবশ্য নেই। আমাদের সরকার জেগে জেগে ঘুমাচ্ছে। ভবন ধস হলে কী হয় রানা প্লাজার পর আর বুঝিয়ে বলার দরকার নেই। দিনের পর দিন টেলিভিশনে উদ্ধার কাজ দেখেছি একটি ভবনে। কত কষ্ট হয়েছে তা অনুভব করেছি। ভূমিকম্প হলে দেশব্যাপী হবে, কে কাকে দেখবে?
নেপালের লোকজন যেন দ্রুত এ বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে পারেন আর বাংলাদেশকে যেন এ দুর্ভোগের মধ্যে না পড়তে হয়- এ কথা ছাড়া আর কিছুই বলার নেই।
ভালো থাকুন।
২৮ এপ্রিল, ২০১৫