ভারতের পঁচা চালে কৃষকের সর্বনাশ
ড. এম. এ সোবহান || Monday 08 June 2015 ||গত বছরের তুলনায় এ অর্থবছরে (২০১৪-১৫) ১ জুলাই, ২০১৪ থেকে ৬ মে, ২০১৫ পর্যন্ত সময় চাল আমদানি তিনগুণ বেড়েছে। এ সময় বেসরকারী ভাবে ১৩ লক্ষ মেট্রিক টন চাল আমদানি হয়েছে। শুল্ক মুক্ত হওয়ায় ব্যবসায়ীরা ভারত থেকে চাল আমদানির আনন্দ উপভোগ করেছেন। স্থানীয় উৎপাদনে নিজস্ব চাহিদা পূরণের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আমদানি করা চালে বাজার সয়লাব হয়েছে।
পর পর গত কয়েক বছর বোরো এবং আমন ফসল ভাল হওয়া সত্ত্বেও ভারত থেকে শুল্কমুক্ত চাল আমদানি করার ফলে অনেক মিল মালিকের গত বছরের চাল এখনও অবিক্রিত রয়েছে। এ অবস্থায় মিল মালিকরা সরকারকে চাল আমদানি না করার জন্য দাবি জানিয়ে আসছেন। তবে উচ্চ পর্যায়ের কিছু সরকারী কর্মকর্তারা যুক্তি দেখিয়েছেন যে আমদানি করা নিম্ন মানের চাল পশু খাদ্য হিসাবে ব্যবহারের জন্য আমদানি করা হয়েছে।
এ বছর বোরো ধান কাটার পরে অবস্থা আরো প্রকট আকার ধারণ করে। ধান চালের দাম আরো কমে যায়। এ অবস্থায় ১০ মে, ২০১৫ তারিখে কৃষি মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ধান চাল আমদানির উপর ১০% হারে শুল্ক আরোপের সুপারিশ করেছে (দি ডেইলি ষ্টার ১১ মে, ২০১৫)।
তবে এ সিদ্ধান্ত অনেক দেরীতে হয়েছে। এ সিদ্ধান্ত যখন নেয়া হয়েছে তখন বোরো ধান কাটা প্রায় শেষ। অধিকাংশ কৃষক উৎপাদন খরচের প্রায় অর্ধেক দামে মন প্রতি (৪০ কেজি) মাত্র ৪৫০ টাকায় ধান বিক্রি করেছেন। সরকারী হিসাব মতেই এবার বোরো মৌসুমে একমন ধানের উৎপাদন খরচ হয়েছে ৮০০ শত টাকা।
উৎপাদন খরচ বিবেচনা করে কৃষকদের ন্যায্য মূল্য দিয়েই সরকারীভাবে খাদ্য শস্য সংগ্রহ করার কথা। ন্যায্য মূল্য বলতে বোঝায় নিদেন পক্ষে কৃষকের উৎপাদন খরচ এবং পরের মৌসুমে কৃষক যেন ধান চাষে নিরুৎসাহিত হয়ে না পড়ে তার জন্য খরচের পর কৃষকের জন্য বাড়তি কিছু আয়ের ব্যবস্থা করা। খাদ্য দপ্তর, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, কৃষক ও খাদ্য শস্য ব্যবসায়ীদের সাথে আলোচনা করে ধান, চাল, গম ইত্যাদি ফসলের সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণের বিধান রয়েছে। তবে বর্তমানে যুক্তিহীনভাবে মনগড়া অথবা বস্তাপচা তথ্যের উপর ভিত্তি করে সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
এ ক্ষেত্রে কৃষককে ন্যায্য মূল্য দেয়ার চাইতে খাদ্য শস্যের বাজার মূল্য কম দেখিয়ে রাজনৈতিক কৃতিত্ব জাহির করার প্রবণতা বেশী দেখা যায়। ফলে একদিকে যেমন কৃষক ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, অন্য দিকে আমদানির সাথে জড়িত সকল কর্মকর্তা ও মহাজনেরা লাভবান হচ্ছেন।
এক সময় কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে কৃষি অর্থনীতি গবেষণা শাখা ছিল ((Agro - Economic Research Section = AERS) । এ দপ্তর ধান, গম, পাটসহ বিভিন্ন ফসলের উৎপাদন খরচ ও অন্যান্য বিষয় কৃষকদের মাঠে গবেষণায় রত ছিল। এ দপ্তরের গবেষণার ফলাফল জনসাধারণের অবগতির জন্য প্রকাশ করা হত। তবে বর্তমানে এ দপ্তরের কোন অস্তিত্বই নেই। ফলে কৃষক পর্যায় ফসলের উৎপাদন খরচের গবেষণালব্ধ কোন তথ্য-উপাত্ত নেই।
সাধারণত: কৃষি মন্ত্রণালয়ের খাদ্য নীতি মনিটরিং ইউনিট (Food Policy Monitoring Unit) আন্তঃমন্ত্রণালয় সংক্রান্ত, খাদ্য পরিকল্পনা ও মনিটরিং কমিটির ((Food Policy Monitoring Committee) কাছে উৎপাদন খরচের উপর ১০-২০% লাভ ধরে মূল্য নির্ধারণের সুপারিশ করে। তবে কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রবণতা থাকে সংগ্রহ মূল্য কম ধরা। খাদ্য শস্যের বাজার মূল্য কম দেখিয়ে শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণির সমর্থন বহাল রাখা। কৃষি ও কৃষককে ক্ষতিগ্রস্ত করে শহরগুলোকে রাজনৈতিক বিক্ষোভ মুক্ত রাখা একটি পুরানা নীতি। কৃষক ও কৃষি সমাজের দুর্দশার এটা একটি বড় কারন।
অন্য দিকে খাদ্য মন্ত্রণালয় ব্যস্ত হয় সরকারী খাদ্য গুদাম শূন্য দেখাবার জন্য। তখন শূন্য গুদাম ভরতি করতে আমদানির জোরালো যুক্তি দাঁড় করানো যায়। সরকারী সংগ্রহমূল্য কম হওয়ার কারণে কৃষকরা সরকারী গুদামে খাদ্য শস্য সরবরাহ করতে নিরুৎসাহিত হয়। সরকারী খাদ্য শস্য সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা ব্যর্থ হয়। খাদ্য শস্য আমদানির যুক্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।
আমদানির সাথে সম্পৃক্ত কর্মকর্তা ও খাদ্য শস্য আমদানিকারকদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট। একদিকে যেমন কৃষক তার উৎপাদিত শস্যের দাম থেকে বঞ্চিত হয় অন্য দিকে দেশ খাদ্য শস্যের জন্য বিদেশ নির্ভর হয় এবং খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকিতে পড়ে।
এ অবস্থায় কৃষকদের উৎপাদিত বোরো ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত না করলে এ দেশের কৃষকরা ফসল উৎপাদনে নিরুৎসাহিত হবে, এটা নিশ্চিওত বলা যায়। এর ফল হবে আমদানি নির্ভরতা এবং খাদ্যের বাজার ক্রমশ অল্প কিছু দেশী বিদেশী কম্পানি, আমাদানিকারক ও সরকারী কর্মকর্তার নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। দেশের খাদ্য সার্বভৌমত্ব অর্জনের দিক থেকে তা হবে আত্মঘাতি।
বাংলাদেশের অর্থনীতি কৃষক, তৈরী পোশাক কারখানায় কর্মরত শ্রমিক এবং প্রবাসী শ্রমিকদের অবদানের উপরই প্রধানত নিভরশীল। এর মধ্যে কৃষকরা সব চেয়ে অবহেলিত অবস্থায় আছেন। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে তারা যে ফসলই উৎপাদন করেন তার ন্যায্য মূল্য পান না। ধান, পাট, গম গোলআলু, ভুট্টা শাকসবজি ইত্যাদির ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তি থেকে তারা সবসময়ই বঞ্চিত।
দুই
সব চেয়ে করুণ অবস্থা ধান চালের বাজারে। এক দিকে যেমন সরকার ঠিক সময় ধান চাল ক্রয় করেন না অন্যদিকে বেসরকারিভাবে ভারত থেকে ধান চাল আমদানী হচ্ছে। ফলে বাজারে নতুন ধান আসার সঙ্গে সঙ্গে দাম কমছে। ধানচাষীরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। বিশেষ করে দেশে যে ৭০ লক্ষ বর্গা চাষী আছেন তাদের অবস্থা খুবই করুন। কারণ জমির মালিকরা মৌসুমের শুরুতেই নগদ টাকা আগাম নিয়ে তবে জমি চাষ করতে দিয়েছেন। ধান চাষীরা ব্যাংক, ক্ষুদ্র ঋণ, এনজিও অথবা অন্য কোন উৎস খেকে ঋণ নিয়ে জমির মালিকদের টাকা দিয়েছেন। এখন তারা ধান বিক্রী করে ঋণ শোধ করবেন। কিন্তু এখন বাজারে ধান চালের দাম সর্বনিম্ন। ধানের বর্তমান বাজার মূল্য মন প্রতি ৪২০-৪৫০ টাকা (প্রথম আলো, ৩০ মে, ২০১৫)।
ইতোমধ্যে সরকার ধান চালের সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ করেছে। ধান প্রতি কেজি ২২ টাকা এবং সেদ্ধ চাল কেজি প্রতি ৩২ টাকা। তবে সরকারী ক্রয় কেন্দ্র কৃষকদের নিকট থেকে ধান চাল না কিনে ব্যবসায়ীদের নিকট থেকে ক্রয় করছে। কৃষকরা ধান চালের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন (বাংলা মিরর, ২৪ মে, ২০১৫)। এ অবস্থা চলতে থাকলে কৃষকরা দেউলিয়া হবেন। পিতৃপুরুষের পেশা হারিয়ে বাড়ী-ঘর ছেড়ে পরিবার পরিজন নিয়ে নৌকায় চড়ে অজানার পথে জীবিকার সন্ধানে পাড়ি জমাবেন।
এ অবস্থায় কৃষকদের রক্ষা করতে হলে সরকারী ব্যবস্থাপনায় কৃষকদের কাছ থেকে উপযুক্ত মূল্যে ধান চাল সংগ্রহ নিশ্চিত করতে হবে। অন্যন্য ফসলের ক্ষেত্রেও মধ্যস্বত্বভোগীদের হাত থেকে কৃষকদের রক্ষা করার জন্য উৎপাদিত ফসলের লাভজনক মূল্য প্রদানের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
গত কয়েক বছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় পর পর কয়েক বছর ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। ফলে দেশ ধান চালে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। ভাবতে ভালই লাগে। কিন্তু একি দেখছি! দেশে খাদ্য ঘাটতি নেই। অথচ ব্যাপক হারে নিম্নমানের চাল ভারত থেকে আমদানি হচ্ছে। কম দামের পচা চালে বাজার সয়লাব। জন মনে নানা প্রশ্ন। কেন এ আমদানি? কার স্বার্থে? কারা এ আমদানি করছে? এ সব দেখার কি কেউ নেই?
আমদানি করা এ চালের দামও কম। আমদানি কারক এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ব্যবসায়ীরা মহা আনন্দে আছেন। বলাই বহুল্য তাদের লাভ ভালই হচ্ছে। কিন্তু স্থানীয় মিল মালিক এবং কৃষকরা দিশেহারা। চাতাল বন্ধ। শ্রমিক বেকার। কৃষক উৎপাদন খরচের অর্ধেক দামে ধান চাল বিক্রি করছেন। তবে এ অবস্থা চলতে থাকলে স্থানীয় ধান চাল উৎপাদন ব্যাহত হবে। কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। কৃষি শ্রমিক ও চাতালে কর্মরত শ্রমিকরা বেকার হবেন। ধান চালের উৎপাদন দ্রুত কমবে। দেশের খাদ্য ও খাদ্য নিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে।
বর্তমানে দেশ যেহেতু ধান চালে স্বয়ংসম্পূর্ণ তাই অবিলম্বে বিদেশ থেকে ধান চাল আমদানি সম্পূর্ণ ভাবে বন্ধ করতে হবে। নতুবা এ দেশের ধান চাল উৎপাদন ব্যবস্থায় ধস নামবে।
সাম্প্রতিককালে বাণিজ্য উদারীকরণের ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরূপ বিপর্যয় ঘটেছে। উদাহরণ স্বরূপ নেপাল ও ক্যারেবিও দেশ হাইতির ধান উৎপাদনের ক্ষেত্রে মারাত্বক অবস্থার কথা সকলেরই জানা (Rice Dumping in Haiti and Development Box Proposal) । এই দু’ দেশের উদাহরণ আমাদের জন্য যথেষ্ট সতর্ক বার্তা বহন করে। পাশের বড় দেশের উচ্চহারে সাবসিডি প্রাপ্ত খাদ্য শস্য প্রতিবেশী ছোট দেশে ডাম্প করা হয়েছে সুকৌশলে। অনিয়ন্ত্রিত আমদানির ফলে স্থানীয় উৎপাদন ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। তাই অবিলম্বে ধান চাল আমদানি সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে। নিজস্ব উৎপাদন ব্যবস্থা বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থেই তা করতে হবে।