সজিনা
Thursday 09 July 2015অন্যান্য স্থানীয় নাম: সজিনা
বৈজ্ঞানিক নাম : Moringa oleifera Lam পরিবার : Moringaceaeপ্রধান ব্যবহার :সবজি/ওষুধ
অন্যান্য ব্যবহার :
আরো পড়ুন
উবিনীগ মাঠ গবেষণার তথ্য
‘যাহা মুশকিল তাঁহাই আসান, এদেশে এমনি একটি কথা আকাশভিত্তিক প্রতিশ্রুতির লোককথার প্রচলন আছে; কিন্তু কাথাটার মূলে আছে একটি কৃত সমীক্ষা। সেটি হচ্ছে- স্থান, কাল প্রাত্র ভেদে প্রকৃতি পরিবর্তনীয় দেহে রোগ ও যেমন হয়, তার প্রতিষেধকও তেমনি প্রকৃতি সৃষ্টি করে আশেপাশে। তাই চরকে বলা হয়েছে ‘যাহার জন্ম যেখানে, তাহার ভেষজও সেখানে জন্মগ্রহণ করে; তাই বলা হয়ে থাকে-যাহাই মুশকিল তাঁহাই আসান। প্রাচীন মতে মুস্কিল অর্থ ভয়, অর্থাৎ ভয় যেখানে ভয়ের নিবারণও সেখানে। যেকোন প্রকার ভয়-নিবারকতাই ভেষজ। সেটি যেমন যমজ হ’য়েই জন্ম নেয় সুখ-দুঃখের মত। অর্থাৎ ভয়ের কাছে নির্ভয়কারী ও কাছেই থাকে। বসন্ত কালের প্রভাবে (একে মধুকাল ও বলা হয় ) শরীরের পিত্তশ্লেশ্মার যেমন উপদ্রব-তেমনি আবার বায়ু ও পার্থিব শক্তির প্রাধান্যজনিত কালধর্ম ব্যাধিও আর্বিভূত হয়- এই যেমন আসে হাম, বসন্ত প্রভৃতি রোগ; আবার এ সময়ে দেশের ভেষজ সবজি সজিনার ফুল ও তার খাঁড়া (ডাটা), এচোড় (কচি কাঁঠাল) উচ্ছেও প্রকৃতি জন্ম দেয়। পাতা ঝরা নিম গাছে আবার নতুন পাতাও আসে; এরা এই কালোদ্ভত রোগের প্রতিষেধক ও প্রতিরোধক; আয়ুর্বেদমতে এগুলি কফপিত্তের আধিক্য দূর করে । এইসব ভেষজ সবজি ওষুধিজ্ঞানেই এ সময়ে খাওয়া উচিত। এই গাছটির বহুলাংশেই গুণের অভাব নেই। তবুও আমরা কটাক্ষ ক’রে তুলনা দিয়ে থাকি যে, ‘লোকটা যেন সজনে কাঠ”, কারণ এই গাছটি যতই বিশাল ও প্রচীন হোক না কেন, গাছে এতটুকুও সার হয়না; তথাপি তার আভিজাত্য বৈদিক সাহিত্যের বেদমন্ত্রে ধারণ করা হয়েছে।
এছাড়া এই সজিনা দেহের শক্রর বিনাশ করে, সে শক্র হচ্ছে অর্শ ও ক্রিমি।
প্রাক-আর্যগোষ্ঠীররা সজিনার রসে দিয়ে মদ তৈরি করতেন। এর রস দিয়ে মত তৈরি করলে তাতে মত্ততা নাকি বেশ তীব্র হয়। এই সজিনা ছালের মদ সাঁওতাল, মুন্ডা, ভীল, লোধা এসব জাতির লোকজন খুব আগ্রহের সঙ্গে পান করে। বৈদিক সাহিত্যে দেখা যায়- অসুরদের মধ্যে সজিনারসের মতটি গ্রহণ করা হ’য়েছে। তবে বৈদিক ঋষিগণ সজিনার মধ্যে মদ্য–শক্তি ছাড়া, এর পাতা, ফুল, ফল, বীজ, এবং মূলের ও গাছের ছালেরও যে বিশেষ গুণ শক্তি আছে –সে সম্বন্ধেও তাঁরা গবেষণা ক’রে দেখেছেন। তাঁদের সেই সব বেদমন্ত্র অনুসরণ করেই পরবর্তীকালের সংহিতাকারগণের ব্যবহার-গত পরীক্ষা-নিরীক্ষা। প্রাক্-আর্যবংশীয়গণ আজো এই গাছের ছালের রস দিয়ে শরীরের বাহিরে কোন টিওমার Tumour পাকায়, ফাটায় এবং পরে তাতে নিসিন্দা Vitex nigundo পাতার গুড়ে দিয়ে সে ঘা শুকায়।
জাতি ও জ্ঞাতি: বৈদিকযুগে এক প্রকার সজিনারই উল্লেখ রয়েছে। পরবর্তীযুগে শ্বেত, রক্ত,ও নীল পুষ্প –বর্ণভেদে আরও তিন প্রকার সজিনার উল্লেখ দেখা যায়। তবে নীল ফুলের সজিনার গাছ বর্তমানে দুর্লভ। সাদা ফুলের সজিনার গাছই সর্বত্র দেখা যায়। বারোমাস যেটা পাওয়া যায় –তাকে নাজনা বলা হয়, কিন্তু এরা প্রজাতিতে একই বোটানিক্যাল নাম Moringa oleifera Lam. আর রক্ত পুষ্প সজিনা বাংলার মালদহ অঞ্চলে পাওয়া যেত তবে বর্তমনে পাওয়া যায় কিনা সেটা জানা যায়নি। তবে Moringa concanensis Nimmo প্রজাতির এক প্রকার সজিনা রাজপুতনায়, সমগ্র দাক্ষিনাত্যে, এমনকি বেলুচিস্থান ও সিন্ধু প্রদেশেও পাওয়া যায়। এর ফুল ও ফল (ডাটা) গুলি রক্তাভ। ফুলের রং ভেদে গাছের গুণেরও পার্থক্য আছে- একথাও প্রাচীন গ্রন্থে বলা হয়েছে।
দিল্লীর ও লোভনীয় সজনে ফুল: এই জন্যেই চাষ করা হয়েছে দেরাদুনের ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট থেকে। গাছে ফুল হলেই ডালগুলি কেটে ফেলা হয়, তারপর ঐ ফুল শুকিয়ে চালান হয়ে থাকে দিল্লীর ইউনানি চিকিৎসক সম্প্রদায়ের প্রয়োজনে।
বিভিন্ন অংশের ব্যবহার:
সজনের পাতা: সজনের পাতা শাকের মত রান্না করে (কিন্তু ভাজা নয়) খাবারের সময় অল্প পরিমাণে খেলে শরীরে শক্তি বাড়ে ও খাবারে রুচী ফিরে আসে। তবে যাদের পেটের সমস্যা তারা ঝোল করে অল্প খাওয়া ভাল। তবে হাঁ এটা গরিবের খাদ্যই বটে। কারণ এর মধ্যে আছে ভিটামিন এ, বি, সি নিকোটিনিক এসিড, প্রোটিন চর্বিজাতীয় পদার্থ, কার্বেহাইড্রেড এবং শরীরের পোষণ-উপযোগী আরও প্রয়োজনীয় উপাদান। এসব তথ্য কিন্তু নব্য বৈজ্ঞানিকের সমীক্ষার। এই শাক কোল, ভীম, মুন্ড প্রভৃতি আদিবাদিদের নিত্য দিনের প্রিয় শাক। তারা কিন্তু গুন জেনে খাচ্ছে না- আদিকালের সংস্কারেই খায়।
সজনে ফুল: শাকের মত রান্না ক’রে বসন্তকালে খাওয়া ভাল। এই ফুল বসন্ত রোগের প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে। তবে ইউনানি চিকিৎসক সম্প্রদায় শুকনা ফুল ব্যবহার করে সর্দিকাশির সমস্যায়, শরীরে পানি আসলে, লিভারের কার্যকারিতা শক্তি কমে গেলে, ক্রিমি থাকলে, এর টনিক একটি অন্যতম উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
সজনের ফল (ডাটা) সজনের ডাটাগুলি Amino acid সমৃদ্ধ, যেটা দেহের সাময়িক প্রয়োজন মেটায়। সর্বক্ষেত্রে সব দ্রব্যেরই ব্যবহার করা উচিত পরিমিত ও সীমিত। ইউনানি চিকিৎসকদের মতে বাতের রোগী ও যারা শিরাগত বাতের সমস্যায় ভোগেন তাদের খাবারের সংগে এটি ব্যবহার করা ভাল।
বীজের তেল: এই তেল এদেশে তেমন পাওয়া যায়না । আফ্রিকা থেকে আমদানি হয়। নাম বেন অয়েল’ । বাতের ব্যথায় মালিশে নাকি ভাল কাজ করে। এছাড়া গাছের ও মূলের (ত্বক) গুনের অন্ত নেই। এই গাছের গুণের কথায় অষ্টাদশ পর্ব মহাভারত রচিত হয়।
রোগ নিরাময়:
হাই ব্লাড প্রেসার (High Blood Pressure) নাফেন সংবাদ প্রতিষ্ঠানের একটি সংবাদে প্রকাশ-বার্মিজ চিকিৎসকগণের মতে –সজনে পাকা পাতার টাটকা রস (পানি দিয়ে বেটে রস করে ) সেই রস দুইবেলা খাবারের আগে ২ বা ৩ চা- চামচ করে খেলে এক সপ্তাহের মধ্যে প্রেসার কমে যায়।
সতর্ক: তবে যাঁদের প্রস্রাবে সুগার আছে অর্থাৎ ডায়বেটিক আছে তাদের খাওয়া নিষেধ।
অর্বুদ রোগ: (Tumour) ফোঁড়ার প্রথম অবস্থায় গ্রন্থিস্ফীতিতে (Glandular swelling) অথবা আঘাতজনিত ব্যথা ও ফোলায়-পাতা বেটে অল্প গরম ক’রে লাগালে ফোঁড়া বা টিউমার বহুক্ষেত্রে মিলিয়ে যায় এবং ব্যথা ও ফোলার উপশম হয়।
সাময়িক জ্বর বা জ্বরভাবে: জ্বর এর সাথে সর্দির সমস্যা থাকলে অল্প কিছু পাতা ঝোল করে বা রান্না করে খেলে উপশম পাওয়া যায়।
হিক্কা: ( Hiccup) কারো হিক্কা হতে থাকলে পাতার রস করে ২/৫ ফোঁটা করে দুধের সঙ্গে ২/৩ বার খেলে হিক্কা কমে যাবে।
অর্শ: (Piles) অর্শের যন্ত্রণা আছে, অথচ রক্ত পড়ে না-এক্ষেত্রে পায়ু পথে তিলতেল লাগিয়ে পাতা সিদ্ধ করে যে ঘনরস হবে সেটা লাগাতে হবে।
চোখের ব্যথা, জ্বল বা পিচুটি পড়া: এসব ক্ষেত্রে পাতা সিদ্ধ করে সেই পানি চোখে ঝাপটা দিতে হবে। বলেছেন বাগ্ ভট্।
দাঁতের মাড়ি ফোলায়: শ্লেশ্মাঘটিত কারণে দাতেঁর মাড়ি ফুলে গেলে পাতার রস মুখে রাখলে দাঁতের মাড়ি ফোলা ভাল হয়।
কুষ্ঠ (Leprosy): কুষ্ঠের প্রথম অবস্থায় সজনে বীজের তেল ব্যবহার করতে পারলে ভাল হয়। বীজের তেল না পাওয়া গেলে বীজ বেটে কুষ্ঠের ঘায়ের উপর প্রলেপ দিলেও হয়।(এটি সুশ্রুতের অভিমত)
অপচী রোগ (Scrofula) সজনেবীজ গুড়ো করে নস্যি নিতে হয়। (এটি সুশ্রুতের ব্যবস্থা)।
দাদ(Ring worm) সজনে গাছের শিকড়ের বেটে প্রলেপ দিলে দাদ ভাল হয়ে যায়। তবে এটা প্রত্যহ ব্যবহার ঠিক নয়।
জ্বর হলে সজিনা পাতার রস ৫ গ্রাম করে কিছুদিন খেলে শরীরে ঘাম হয়ে এবং প্রস্রাব হয়ে-শরীরের দুষিত পদার্থ বেরিয়ে গিয়ে জ্বর ছেড়ে যায়।
চোখে ব্যথা করে, চোখ দিয়ে পানি পড়ে, আবার ময়লা আসে রাতে চোখে আঠা লেগে থাকে, সেই সময় সজিনা পাতা তুলে ভাল করে পানি দিয়ে পরিস্কার করে ধুয়ে, পরিস্কার একটা পাতিলে আধা সের পানিতে পাতাগুলো সিদ্ধ করে একটু ঠাণ্ডা করে, সেই পাতা সিদ্ধ পানি কয়েকবার খেলে ও চোখে ছিটিয়ে দিলে চোখ ভাল হয়ে যায়। এবং ব্যথাও কমে যায়। পাতা ভর্তা, ভাজি করে খেলে রাতকানা রোগ ভাল হয়। এছাড়া গর্ভবতী মায়েদের চোখে সমস্যা দেখা দিলে বা চোখে কম দেখলে,সেই সময় সজিনা শাক ভেজে ও পাতা সিদ্ধ করে ভর্তা করে খেলে চোখের সমস্যা সেরে যায়।
দাঁতের মাড়ি ফুলে যায় পায়রিয়া হয়, সেই সময় পাতা সিদ্ধ করে সেই পাতা সিদ্ধ পানি গরম থাকা অবস্থায় কুলকুল করলে দাঁতের সেই সমস্যা সেরে যায়।
সজিনার আঠা বা (গদ) দুধের সাথে পিষে কপালে লাগালে মাথা ব্যথা ভাল হয়ে যায়।
হাঁটুতে বা কোমড় ব্যথায়-সজিনা গাছের ছাল ও সমপরিমান রসুন বেটে ব্যথার স্থানে প্রলেপ দিলে ব্যথার উপশম হয়।
প্রাথমিক পর্যায়ে উচ্চ রক্তচাপের রোগীরা সজিনার (পরিণত) পাতার রস দু’বেলা দু চামচ করে পান করলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে।
দাউদ হলে অল্প সজিনার ছাল নিয়ে বেটে দাউদে লাগালে দাউদ কমে যায়। একজিমায় লাগালে ভাল ফল পাওয়া যায়।
তথ্য সূত্র: চিরঞ্জীব বনৌষধি