আমাদের ধানের বৈচিত্র্য
একটি প্রাথমিক তথ্য চিত্র
ভূমিকা
ধান নিয়ে এই প্রাথমিক তথ্যচিত্র আমাদের দীর্ঘ দিনের কাজের ফসল। প্রাথমিক বলছি এই কারণে যে আমাদের দীর্ঘ দিনের গবেষণায় বিস্তারিত তথ্য রয়েছে, কিন্তু এই তথ্যচিত্রে শুধুমাত্র প্রাথমিক তথ্য দেয়া হয়েছে, কারণ আমাদের দেশের অনেকেই জানেন না যে বাংলাদেশে কত হাজার জাতের ধান রয়েছে এবং ধানের বৈচিত্র্য তা রক্ষা করা এদেশের নাগরিক হিশেবে আমাদের সকলের কর্তব্য।
বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। এই দেশ ধান উৎপাদনকারী দেশ হিশেবেই বিশ্বে পরিচিত। ধান আমাদের পরিচয়, ধান আমাদের সংস্কৃতি। কিন্তু এতোটুকু বলা যথেষ্ট নয়। ছোট্ট দেশ হলেও এই দেশে ধানের এতো বৈচিত্র আছে যে অবাক হতে হয়। অথচ নতুন প্রজন্ম এই সবের তথ্য জানে না। কৃষির প্রতি শিক্ষিত সমাজের নেতিবাচক মনোভাবের কারণে ধান উৎপাদন এবং ধানের জাত নিয়ে আলোচনা হয় না। শিক্ষা কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত হয় না। ভাত, খিচুড়ি, পোলাও, মুড়ি, চিড়া সবাই খায় কিন্তু যে ধান থেকে এসব আসে সে ধান সম্পর্কে জানার বা জানাবার কোন চেষ্টাই নাই। ধান নিয়ে কথা বলতে গেলেই ধরে নেয়া হয় ধান নিয়ে জানবে গ্রামের কৃষক কিংবা শহরে যদি কারো জানার দায় থাকে তবে তা কৃষি বিজ্ঞানীর। অথচ ধান এবং ধানের জাত সম্পর্কে আমাদের সকলেরই জানা থাকা দরকার। ধানের বৈচিত্র আমাদের সম্পদ।
উবিনীগ ১৯৯০ সাল থেকে নয়াকৃষি আন্দোলনের মাধ্যমে কৃষকদের নিয়ে কাজ করছে। নয়াকৃষি আন্দোলন প্রাণবৈচিত্র নির্ভর কৃষি ব্যবস্থাকে বলা যায় জীবন ব্যবস্থা। প্রাণের সুরক্ষা ও বিকাশের মধ্য দিয়ে সমৃদ্ধি ও সম্পদ সৃষ্টি এর লক্ষ্য। কোন প্রকার রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও ভুগর্ভস্থ পানির ব্যবহার না করেই কৃষকরা ধানসহ নানা ধরণের ফসল আবাদ করছেন। নয়া কৃষির কৃষকরা শুরু থেকেই ধানের বৈচিত্র্য রক্ষা এবং মৌসুম ও এলাকাভেদে পরিবেশ অনুযায়ী ধানের আবাদ করার কথা বলছেন। তাঁরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে স্থানীয় জাতের ধানকে সরকারের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে গুরুত্ব দেয়া হয় না, শুধু আধুনিক কৃষির মাধ্যমে আসা কয়েকটি মাত্র উফশী ধানের জন্য সকল ধরণের সহযোগিতা দেয়া হয়। আর কৃষির সহযোগিতার অর্থই হচ্ছে রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও ভুগর্ভস্থ পানি তুলে সেচের ব্যবস্থা এবং উফশী বীজ সরবরাহ করা। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ কৃষকের স্বার্থে কাজ না করে কতিপয় কোম্পানীর ব্যবসায়িক স্বার্থে কাজ করছেন। দেশের মানুষকে খাওয়াবার দোহাই এবং খাদ্য ঘাটতি মেটাবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আধুনিক কৃষির নামে উফশী ধানের প্রবর্তন করা হয়েছিল, কিন্তু এখন তা ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে। তারা এখন হাইব্রীড ও জেনেটিক ইঞ্জিনীয়ারিং করা ধানের প্রবর্তনের জন্য নতুন যুক্তি খাড়া করছেন।
অথচ এখনও বাংলাদেশে কৃষকের নিজের উদ্যোগেই স্থানীয় জাতের ধান টিকে আছে এবং আমাদের খাদ্যর চাহিদা এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রয়োজন মেটাচ্ছে। দুঃখের বিষয় যে স্থানীয় জাতের ধানের প্রতি অবহেলা আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে। এই অবহেলার কারণে আমাদের ধানের জাত পাচার হয়ে চলে যাচ্ছে বিদেশে।
আমরা আরও দেখেছি, কৃষিতে নারীদের অংশগ্রহণ থাকা সত্ত্বেও তাদের অবদানের স্বীকৃতি নেই। আধুনিক কৃষি নারীকে ধান উৎপাদনের প্রক্রিয়া থেকেও উৎখাত করেছে। নারীর জ্ঞান স্থানীয় জাতের সুরক্ষা, সংগ্রহ, পুনরুৎপাদনসহ সকল ক্ষেত্রেই রয়েছে। ধানের বীজ রক্ষার পেছনে রয়েছে নারীর সক্রিয়তা ও সহজাত জ্ঞান।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেমন বন্যা, খরা এবং ঘুর্ণিঝড়েও দেখা গেছে স্থানীয় জাতের ধান টিকে যায়, কিন্তু আধুনিক জাতের ধানের ক্ষতি হয়, অথচ পত্র-পত্রিকায় বিষয়গুলো তুলে ধরা হয় না। বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের কথা বলে জেনেটিক ইঞ্জিনীয়ারীং করা ধানের প্রবর্তন করা হচ্ছে। অথচ আমাদের স্থানীয় জাতের অনেক ধান আছে যা আবহাওয়ার পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে টিকে থাকতে পারে। নিজেদের ধানের জাত সম্পর্কে না জানার কারণে আমরা কোম্পানীর প্রপাগান্ডায় বিভ্রান্ত হয়ে ভুল পদক্ষেপ নিয়ে ফেলি।
নয়াকৃষি আন্দোলনের পক্ষ থেকে এই প্রাথমিক তথ্য চিত্র আমরা তুলে ধরছি। আগেই বলেছি অনেক বড় বই আকারে প্রকাশ করার মতো তথ্য থাকলেও এখানে শুধু প্রাথমিক ভাবে জানার মতো তথ্য দেয়া হয়েছে। সরাসরি কৃষকদের সাথে কাজের মাধ্যমে ২০০০ সাল থেকে নয়াকৃষির কৃষকদের সংগৃহিত ধানের জাত এবং সাধারণ ভাবে পাওয়া যায় এমন ধানের জাত নিয়ে এই তথ্য চিত্র তৈরী হয়েছে। পরবর্তী পর্যায়ে আরও তথ্য চিত্র প্রকাশ করার ইচ্ছে আছে।
তথ্য সংকলন করেছেন গোলাম রাব্বি বাদল। সার্বিক পরিকল্পনায় ছিলেন উবিনীগের নির্বাহী পরিচালক ফরিদা আখতার। তথ্য যাচাই ও অন্যান্য কাজে সহযোগিতা করেছেন ডঃ এম এ সোবহান, জাহাংগীর আলম জনি, সীমা দাস সীমু, পলাশ বড়াল, রফিকুল হক টিটো, মোজাহেদুল ইসলাম প্রিন্স, রবিউল ইসলাম চুন্নু, আরফান আলী ও আজমিরা খাতুন। যারা আমাদের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন এবং যাদের সাথে কাজ করার কারণেই আমরা ধান সম্পর্কে এতো তথ্য পেয়েছি, তাঁরা হলেন নয়াকৃষির অগণিত কৃষক।
ফরহাদ মজহার; ব্যবস্থাপনা পরিচালক, উবিনীগ ও নয়াকৃষি আন্দোলনের সংগঠক; ৮ অগ্রহায়ণ, ১৪১৭/২২ নভেম্বর, ২০১০
ধানের কথা
বাংলাদেশের মানুষ ভাত ছাড়া কিছুই বোঝে না। তাই তাদের ভেতো বাঙালি বলা হয়। অবশ্য আমরা নিজেরাই নিজেদের নাম দিয়েছি ভেতো বাঙালি। এই ভাত হয় চাল থেকে এবং চাল হয় ধান থেকে। ধানের সঙ্গেই চলে আসে দূর্বা ঘাসের কথা। কেননা ধান আর দূর্বা একই পরিবারের সদস্য, যাকে সাধারণভাবে আমরা ঘাস বা তৃণ বলি। এই জন্য ধান গাছকে বলা হয় তৃণ। শস্যদায়িনী ঘাস বললেও ভুল হয় না।
ধান্য থেকে ধান। যার বিস্তৃত কৃষি নাই বা আপনা-আপনি অযত্নে জন্মে, সেই সকল ধান্য জাতীয় তৃণকেই ধান্য নামে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু কৃষিজাত তৃণই সাধারণত ধান্য বা ধান নামে উল্লেখিত হয়। এই ধান্যকেই তামিল ভাষায় শালি বলে। বাংলাদেশ-আসাম অঞ্চল থেকে শুরু করে পাঞ্জাব পর্যন্ত শালি ধান বলতে হেমন্তের ধান বা আমন ধান বোঝায়।
কৃষিজাত ঘাস বা ধান্যের ইংরেজি নাম হচ্ছে Paddy বা Rice। আর ধানের সাইন্টিফিক নাম হচ্ছে Oryza Sativa। সাধারণত এশিয়াতে Oryza Sativa গোত্রের নানা জাতের ধান চাষ করা হয়।
প্রায় ৩৮ বছর আগে ১৯৯৬ সালে একবার আন্তর্জাতিক ধান বছর ঘোষণা করা হয়েছিল। সে সময় উচ্চফলনশীল ধান (উফশী) প্রবর্তন করাই ছিল প্রধান উদ্দেশ্য। অথচ আমাদের দেশীয় জাতের ধানের ফলন সম্পর্কে না জেনেই উফশী ধান প্রবর্তন করা হলো। এই নতুন প্রবর্তিত ধান কৃষকের ভাষায় নম্বরী ধান যেমন আই-আর-৮। একে বলা হোল ‘মিরাকল রাইস’ বা আলৌকিক শক্তিসম্পন্ন ধান। কিন্তু এই ধানের আলৌকিক কিছুই ছিল, এটা ছিল বামুন ধান। অর্থাৎ ধানের চারা ছোট হবে। এ ধান যারা উদ্ভাবন ও প্রবর্তন করেছিলেন তাদের উদ্দেশ্য ছিল ধান থেকে তারা খড় হতে দেবেন না। মানুষের খাদ্য চাই, গরুর খাদ্য না হলেও ক্ষতি নেই। ফলে অধিক খাদ্য উৎপাদনের কথা ফলাও করে প্রচার করলেও তাদের লক্ষ্য ছিল অধিক শস্য বা দানা পাওয়ার দিকে। ফলে গবাদি পশুর খাদ্য অনিশ্চিত হয়ে ওঠার ফলে গবাদিপশু যে খাদ্যের গুরুত্বপূর্ণ উৎস সেই দিকটা চরম ভাবে অবহেলিত হোল। এই ধরণের অধিক ফলন সম্পন্ন কৃষির নাম দেয়া হলে সবুজ বিপ্লব, কেউ বলে আধুনিক কৃষি।
প্রত্নতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক এবং ধান বিজ্ঞানীদের মধ্যে ধান জাতের বিবর্তন নিয়ে যথেষ্ট মতবিরোধ রয়েছে। তা সত্ত্বেও সবাই স্বীকার করেন যে, আদি ধান জাতের প্রথম আবির্ভাব ঘটে বর্তমান ভারত উপমহাদেশে, এখান থেকেই আদি ধান জাতের ক্রমবিকাশ ঘটতে থাকে। সৃষ্টি হয় ধানের ‘ওরাইজা’ গণের। বাংলাদেশের মধুপুর এবং বরেন্দ্রভূমি যথেষ্ঠ পুরাতন (মধ্য মায়েসীন থেকে প্লায়োসীন যুগ)। এ সব অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা হয়নি। এসব অঞ্চলে এখনও বুনো ধানের জাত পাওয়া যায়। প্রত্নতাত্ত্বিককরা চীনের জেমিয়াং প্রদেশের ইউইয়াও কাউন্টির হেমেডু গ্রামে ৭০০০ বছর পূর্বে ইন্ডিকা জাতের ধানের খোঁজ পান এবং প্রমাণ পান যে, সে সময়ে হ্যাংগঝু উপসাগরের কূলবর্তী অঞ্চলেই ইন্ডিকা ধানের আবাদ প্রচলিত ছিল। থাইল্যান্ড ও মায়ানমার সীমান্তে “ভুতের গুহা” নামে পরিচিত স্থানে ধানের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে ঐ গুহা প্রায় একহাজার বছরের পুরাতন এবং বাংলাদেশ অঞ্চলে ধান আবাদের আদিকাল প্রায় ৬০০০ বছরের পুরাতন বলে তাদের ধারণা।
ধানের ইংরেজি ‘রাইস’ শব্দের জন্ম
চীনের ব্যবসায়ীরা প্রাচীন যুগ থেকেই আরব-মিশর দেশের সঙ্গে স্থলপথে ব্যবসা করতেন। নানাবিধ পণ্যের মধ্যে চীনের রেশম বস্ত্র ও চাল বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে। চীনের নিংপো উপভাষায় ধানকে “উলিজ” বা “উলিস” বলা হতো। এই উলিজ শব্দকে আরবীয় “ওরাজ” নাম দেয়। যা পরবর্তীকালে গ্রীক ভাষায় ওরাইজা (Oryza) হয়ে যায় এবং তা থেকেই ফরাসী ভাষায় ‘রিজ’ এবং ইংরেজি ভাষায় ‘রাইস’ হয়ে যায়। ইংরেজিতে ‘রাইস’ বলতে ধান বুঝায় তবে আমাদের দেশে ‘রাইস’ মানে চাল; ধানের ইংরেজি শব্দ পেডি (Paddy) ।
ধান আবিষ্কারের একটি গল্প
বাংলাদেশে ধান আবিষ্কারের একটি গল্প এভাবে প্রচারিত রয়েছে যে অনেকদিন আগে কয়েকজন জেলে খুলনা জেলার ভাটিতে মাছ মারার সময় কালবৈশাখী ঝড়ে পড়েন। ঝড়ের তান্ডবে তারা বেঁচে যান বটে তবে নৌকা ও মাছ ধরার সাজসরঞ্জাম খুইয়ে কোন রকমে প্রাণে বেঁচে তীরে আশ্রয় নেন। ঘন অন্ধকার রাতে পথ চলতে না পেরে তারা নদীর তীরেই কোন রকমে রাত কাটিয়ে ভোর হতেই জনপদের উদ্দেশ্যে উত্তর দিকে হাঁটতে শুরু করেন। দুপুরের দিকে তারা পরিশ্রান্ত ও ক্ষুধা ও পিপাসায় কাতর হয়ে খাবার সংগ্রহে উদ্যোগী হয়ে নদীর তীরে ঝড়ে ভাসা কয়েকটি মাছ কুড়িয়ে নিয়ে তা খাওয়ার জন্য খড়কুটা সংগ্রহ করে আগুন জ্বালিয়ে মাছ পুড়িয়ে নিতে থাকেন। তখন আগুনে পোড়া খড়ের মাঝে কিছু বীজ ফুটে ওঠে। তা দেখে তারা ফুটে ওঠা বীজ সংগ্রহ করে খেয়ে দেখেন যে তা ভালই লাগে। ফলে মাছ ঝলসানোর সাথে সাথে সে সব ঘাস বীজ পুড়িয়ে খৈ করেও খান। খাওয়া শেষে তারা ঐ ঘাসবীজ সংগ্রহ করে নিয়ে পথ চলতে চলতে সন্ধ্যায় এক গৃহস্থ বাড়িতে ঠাঁই নেন। গৃহস্থ জেলেদের অসহায় অবস্থা দেখে তাদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করেন। খাওয়া শেষে জেলেরা গৃহস্থকে তাদের সংগ্রহ করা ঘাসবীজের আগুনে পোড়া খৈ-এর কথা বলেন। গৃহস্থ বধূ তা থেকে একমুঠো বীজ নিয়ে খোলায় ভাজতে গিয়ে বিস্মিত হন এবং বীজ ভেজে খৈ করে সবাইকে দেখান। তা সবাই চেখে খুশী হন। পরদিন ভোরে জেলেরা বিদায়লগ্নে ঐ গৃহস্থকে তাদের সংগৃহীত কিছু ঘাসবীজ দেন। বাকিটা তারা নিয়ে নিজের বাড়িতে বুনে দেন। এভাবেই সেই ঘাসবীজ থেকে যে ফসলের আবির্ভাব হয় তা-ই আদি ধান জাত।
লোকগল্প অনুসারে খুলনার বিখ্যাত ‘রায়েদা’ ধানের উৎপত্তি হয় সেই ঘাস বীজ থেকেই। ধানের এ গল্প অন্য জায়গায় শোনা গেলেও একে লোকগাঁথা বা কিংবদন্তী বলা যায় না। তবে এ ধরনের ঘটনা থেকেই আবিস্কারের কথা জানা যায়।
১. ড. এস. এম. হাছানুজ্জামান, এমেরিটাস সায়েনটিস্ট
ধানের মৌসুমঃ আউশ, আমন ও বোরো
বাংলাদেশ একটি বৈচিত্র্যপূর্ণ ফসলের দেশ। এ দেশ ষড় ঋতুর দেশ। বারো মাসে ছয় ঋতু। প্রতি দুই মাস এক একটি ঋতু। ছটি ঋতুর নাম হচ্ছে-গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত। এদেশের কৃষকরা সেই আদিকাল থেকে শস্যের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে শস্য চাষাবাদ তিনটি প্রধান কৃষি মৌসুমে করে থাকেন। এই মৌসুম অনুসরণ করে শস্য আবাদ বিভিন্ন কারণের মধ্যে রয়েছে আলো ও পানি প্রাপ্তি, বাতাসের আদ্রতা, উত্তাপের তারতম্য ইত্যাদি। সকল মৌসুমে সকল শস্য ভালো হয় না। বাংলাদেশে প্রধানত তিনটি কৃষি মৌসুমের নাম যথাক্রমে রবি মৌসুম, খরিপ-১ মৌসুম এবং খরিপ-২ মৌসুম।
সাধারণত বাংলা মাস অগ্রহায়ণ থেকে চৈত্র। ইংরেজি মাস- মধ্য নভেম্বর থেকে মধ্য এপ্রিল পর্যন্ত ‘রবি মৌসুম’ ধরা হয়, বাংলা মাস বৈশাখ থেকে শ্রাবণ। (ইংরেজি মাস-মধ্য এপ্রিল থেকে মধ্য আগষ্ট পর্যন্ত) ‘খরিফ-১ মৌসুম’ ধরা হয় এবং বাংলা মাস শ্রাবণ থেকে অগ্রহায়ণ। ইংরেজি মাস-মধ্য জুলাই থেকে মধ্য নভেম্বর পর্যন্ত ‘খরিফ-২ মৌসুম’
গড়ে পর্যায়ক্রমে প্রতি চার মাসে এক একটি মৌসুম ধরা হয়ে থাকে। তবে ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে মৌসুমের সামন্য হেরফের হয়ে থাকে। সারা বছরে এ দেশে যত রকমের শস্য রয়েছে সবগুলোই উল্লেখিত তিন মৌসুমের মধ্যেই চাষাবাদ করা হয়ে থাকে।
ধলামোটা আমন ধান
বাংলাদেশে যতগুলো শস্য রয়েছে তার মধ্যে ধান অন্যতম। ধান উৎপাদনের মৌসুম উল্লেখিত তিন মৌসুমের মধ্যেই তবে এ দেশের কৃষক সমাজ সেই আদিকাল থেকে বিভিন্ন রকম ধানের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে ধান চাষাবাদের মৌসুমের নাম নির্ধারণ করেছেন। যেমন- আউশ, আমন এবং বোরো মৌসুম। আউশ, আমন এবং বোরো কোন ধানের নাম নয়, ধান উৎপাদন বা চাষাবাদের মৌসুমের নাম।
আউশ
আউশ ধানের মৌসুম হচ্ছে- বাংলা মাস বৈশাখ থেকে শ্রাবণ। ইংরেজি মাস- মধ্য এপ্রিল থেকে মধ্য আগষ্ট পর্যন্ত ‘আউশ মৌসুমে’। আউশ ধান সাধারণত উঁচু এবং মাঝারি উঁচু জমিতে আবাদ করা হয়ে থাকে। এ ধান আবাদ করতে তুলনামূলক ভাবে অনেক কম পানির প্রয়োজন হয়। আউশ ধান কৃষকরা বীজধান ছিটিয়ে বপন করেন। আউশ মৌসুমে চাষ করা হয় সে সব ধানের মধ্যে রয়েছে- ধারিয়াল, দুলার, হাশিকলমী, কটকতারা, কুমারি, পানবিরা, কালামানিক, শনি, শংকবটি, ষাইটা, জাগল, কালোবকরি, ভইরা, মূলকে আউশ, ভাতুরী, দুধেকটকী, কাদোমনি, খরাজামরি ইত্যাদি।
আমন
আমন ধানের মৌসুম হচ্ছে- বাংলা মাস শ্রাবণ থেকে অগ্রহায়ণ। ইংরেজি মাস-মধ্য জুলাই থেকে মধ্য নভেম্বর পর্যন্ত ‘আমন মৌসুম’। আমন ধান সাধারণত নীচু জমিতে আবাদ করা হয়। পানি ছাড়া আমন ধান চাষ করা সম্ভব নয়। এ ধান আবাদ করার জন্য বীজতলায় ধানের চারা তৈরি করে মূল জমিতে রোপন করা হয়। আমন মৌসুমে চাষ করা হয় সে সব ধানের মধ্যে রয়েছে-দাদখানি, দুধসর, হাতিশাইল, ইন্দ্রশাইল, যশোবালাম, লতিশাইল, পাটনাই, ঝিংগাশাইল, তিলককাচারী, বাদশাভোগ, কাটারীভোগ, কালিজিরা, রাধুনিপাগল, বউআদুরী, চিনিগুড়া, মহোনভোগ, বড়চালানী, দিঘা, বাঁশফুল ইত্যাদি।
বোরো
বোরো ধানের মৌসুম হচ্ছে- বাংলা মাস অগ্রহায়ণ থেকে চৈত্র। ইংরেজি মাস- মধ্য নভেম্বর থেকে মধ্য এপ্রিল পর্যন্ত) ‘বোরো মৌসুম’। যে সব জমিতে প্রায় সারা বছর পানি জমে থাকে এবং রবি মৌসুমে অন্য কোন ফসল আবাদ করা যায় না সাধারণত সে রকম জমিতে বোরো ধানের আবাদ করা হয়ে থাকে। এ ধান সাধারণত বীজ তলায় চারা থেরি করে রোপন করা হয়। বোরো ধান আবাদ করার জন্য বেশী পানি সেচের জন্য প্রয়োজন হয়। বোরো মৌসুমে চাষ করা হয় সে সব ধানের মধ্যে রয়েছে খৈয়াবোরো, জাগলীবোরো, টুপাবোরো, মুখকালালী, গঞ্জালী, কালোসাইটা, সোনালীবোরো, তুফান, টেপাবোরো, বলংগা, ষাটেবোরো, বোয়ালীবোরো ইত্যাদি।
যে মৌসুমে, যে সব ধান আবাদ করা হয়ে থাকে, সেই সব ধানকে, সেই মৌসুমের ধান বলা হয়। উদাহরণ হিশাবে কেউ যদি বলেন, এটা আউশ ধান, তাহলে বুঝতে হবে সে ধানটি আউশ মৌসুমে চাষাবাদ করা হয়েছে। কেউ যদি বলেন এটা আমন ধান তাহলে বুঝতে হবে সে ধানটি আমন মৌসুমে চাষাবাদ করা হয়েছে। আবার কেউ যদি বলে এটা বোরো ধান তাহলে বুঝতে হবে এ ধানটি বোরো মৌসুমে চাষাবাদ করা হয়েছে। মৌসুমি নাম ধানের জাতের নাম নয়। এটা শুধু কোন মৌসুমে চাষ হয়েছে সেই কথাটার দিকেই ইঙ্গিত করে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন ভৌগলিক পরিবেশে ধানের বৈচিত্র্য
বাংলাদেশ ধানের দেশ। আয়তনের দিক থেকে ছোট হলেও হবে কি, এ দেশে রয়েছে হাজারো ধানের বৈচিত্র্য। ১৯৩০ সালের এক জরিপে জানা যায় যে সে সময় অবিভক্ত বাংলায় ভৌগলিক পরিবেশ অঞ্চল ভেদে পনের হাজার স্থানীয় ধানের জাত চাষাবাদ করা হতো। আমরা এখন অনেকেই সে সব ধানের নাম জানিনা। এমনকি সে সময়ে ধানের মৌসুমে ভৌগলিক পরিবেশ ভেদে কোন অঞ্চলের কৃষক ধানের কোন কোন জাত চাষাবাদ করছেন সে সম্পর্কেও তেমন জানি না। বাংলাদেশে যে ১৫০০০ জাতের ধানের চাষাবাদ হতো, তাদের সুন্দর সুন্দর নামও ছিল। সেসব স্থানীয় ধানের জাত বেশির ভাগই হারিয়ে গেছে। স্থানীয় ধানের জাত হারিয়ে যাবার প্রধান কারণ হচ্ছে তথাকথিত আধুনিক কৃষির নামে উফশী এবং হাইব্রিড ধানের প্রবর্তন। যেদিন থেকে উফশী ধানের চাষাবাদ শুরু হয়েছে তারপর থেকে স্থানীয় ধানের জাত হারিয়ে যেতে শুরু করে। বর্তমানে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের জিন ব্যাংকের সংগ্রহে স্থানীয় ধানের জাত রয়েছে ৩৭৮৪। অপরদিকে উবিনীগের নয়াকৃষি আন্দোলনের সংগ্রহে স্থানীয় ধানের জাত রয়েছে প্রায় ৩০০০। (২০১০ পর্যন্ত)
বাংলাদেশ ছয় ঋতুর দেশ কিন্তু এদেশে বর্তমানে মৌসুমের সঠিক নাগাল পাওয়া যায় না। এদেশে উফশী ধান প্রবর্তনের পূর্বে আষাঢ় শ্রাবণ মাসে সকল জমি বর্ষার পানিতে ভরে থাকতো। ফলে সিংহ ভাগ কৃষকই আলাদা ভাবে চারা তৈরী করে রোপা আমন ধানের চাষাবাদ করার সুযোগ পেতেন না। যার কারণে সেসময়ে তারা বোনা আমন ধানের চাষাবাদ করতেন। সে সময় অপেক্ষাকৃত উঁচু জমি, যেখানে বর্ষার পানি বেশি উঠতো না, কেবল সে সব জমিতে রোপা আমন ধানের চাষাবাদ হোত।
সেই সময় এদেশের কৃষকরা ধানের আবাদ প্রধানত আউশ মৌসুমের ধান এবং আমন মৌসুমে বোনা আমন ধানের চাষাবাদ করতেন। সে হিশাবে এদেশে বোনা আমনের স্থানীয় জাতের ধানের সংখ্যাই বেশী ছিল। এরপর ছিল আউশ ধানের স্থানীয় জাতের সংখ্যা। আর বিল-হাওরে এবং নিচু অঞ্চলে যেসব জায়গায় বারো মাস পানি থাকে সে সব জমিতে অন্য কোনো ফসলের চাষাবাদ করতে না পারায় সে সব জমিতে বোরো ধানের আবাদ করা হতো। সে হিশাবে বোরো ধানের স্থানীয় জাতের সংখ্যা তুলনামূলক ভাবে বোনা আমন এবং আউশের চেয়ে কম ছিল।
বর্তমানে সারা দেশের প্রায় সকল নদীতে বাঁধ দেয়া হয়েছে। এমনকি পানি শাসনের নামে হাওর অঞ্চলেও অপরিকল্পিত বাঁধ দিয়ে নানা ধরণের সমস্যা সৃষ্টি করা হয়েছে। বর্ষা মৌসুমে আর আগের মতো সকল জমি পানিতে টইটুম্বুর থাকে না, ফলে দিনে দিনে বোনা আমন ধানের চাষাবাদ কমে গেছে। অপরদিকে কৃষকদের রাতারাতি ধনী হবার লোভ দেখিয়ে উফশী ধানের ব্যাপক প্রবর্তন করা হলো। প্রথমদিকে জমির মাটি উর্বর থাকায় উফশী ধানের ফলন ভালো হয়। কৃষকরা উফশী ধানের আবাদ করতে গিয়ে নিজেদের স্থানীয় ধানের জাতগুলির চাষাবাদ বন্ধ করে দেয়। বর্তমানে আবহাওয়া জলবায়ু এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ পরিবর্তনের সাথে পাল্লা দিয়ে আধুনিক কৃষির উফশী কিংবা হাইব্রিড ধান আর টিকে থাকতে পারছে না। একদিকে খরা, অন্যদিকে ঢলের পানিতে বন্যা, অপরদিকে অধিক ঠান্ডায় উফশী ধান/হাইব্রিড ধান আবাদ করে কৃষকরা আর টিকে থাকতে পারছে না। বাস্তবতার কারণেই আজ বৈজ্ঞানিক, নীতিনির্ধারকরাসহ সবায় বলছে দেশী ধানের আবাদের দিকে ফিরে যেতে হবে।
ভৌগলিক পরিবেশ যে আঞ্চলিক ভেদ তৈরী করে তার পরিপ্রেক্ষিতে অঞ্চল ভেদে স্থানীয় ধানের জাতের যে কত রকমের বৈচিত্র্য ছিল তার উদাহরণ হিশাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন ভৌগলিক ধানের বৈচিত্র্যের চিত্র উপস্থাপন করা হলো। এখানে উল্লেখ থাকে, যে সকল ধানের নাম লেখা হয়েছে তার বেশির ভাগই উফশী ধানের আবাদ শুরু হওয়ায় হারিয়ে গেছে বা যাচ্ছে।
ধানের জাত
ভারত উপমহাদেশ থেকেই আদি ধান জাতের ক্রমবিকাশ ঘটতে থাকে, সৃষ্টি হয় ধান গণের (Genus)। ধান গণের নাম ‘ওরাইজা’ (Oryza) পরবর্তী কালে এই ওরাইজা থেকে সৃষ্টি হয় অনেকগুলো উপজাতের, যার মধ্যে রয়েছে ওরাইজা সেটাইভা (Oryza sativa) এবং ওরাইজা গ্লাবেরিমা (Oryza glaberrima)।
ধানের এই দুটি উপজাত পৃথিবীর দুই মহাদেশে ছড়িয়ে যায় ওরাইজা সেটাইভা চিরস্থায়ী হয়ে যায় এশিয়া মহাদেশে এবং ওরাইজা গ্লাবেরিমা সারা আফ্রিকা মহাদেশ জুড়ে রয়েছে।
জাতের ইংরেজি শব্দ হচ্ছে Variety। পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের নিকট একটি গাছ বা শস্য বিভিন্ন নামে পরিচিত। ফলে গাছের নাম বা পরিচিতি নিয়ে সমস্যা সৃষ্টি হয়ে থাকে। সেজন্য সকল ভাষাভাষী মানুষের কাছে গাছ-গাছালিকে পরিচিত করানোর জন্য একটি বৈজ্ঞানিক নাম দেওয়া হয়ে থাকে। এতে সুবিধা হচ্ছে গাছ/গাছালির আঞ্চলিক নাম যাই হোক, বৈজ্ঞানিক নাম পৃথিবী জুড়ে একটি। প্রতিটি বৈজ্ঞানিক নাম আবার দুই অংশে বিভক্ত। দুই অংশের সমন্বয়ে একটি গাছ/গাছালির নাম করণ করা হয়ে থাকে। গাছ/গাছালির দ্বিপদ নাম ল্যাটিন ভাষায় লেখা হয়ে থাকে। নামের প্রথম অংশ গণ (Genus) এবং দ্বিতীয় অংশটি প্রজাতি (Species)। উদাহরণ হিশাবে ধানের বৈজ্ঞানিক নাম ওরাইজা সেটাইভা (Oryza sativa) ওরাইজা গণ সেটাইভা প্রজাতি।
ধানের জাত বলতে, ধানের বৈচিত্র্যকে বুঝানো হয়ে থাকে। উদাহরণ হিশাবে যদি আমরা ‘আমের’ কথা ধরি তাহলে আমের বিভিন্ন নাম রয়েছে। যেমন গোপালভোগ, ল্যাংড়া, হিমসাগর, মালতী, ক্ষীরসাপাত ইত্যাদি। নির্দিষ্ট নামের ‘আম’ আমের এক একটি জাত বা বৈচিত্র্য। প্রতিটি জাতের আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। অনুরূপ ভাবে ধানের অনেক জাত রয়েছে। তাদেরও আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। অতীতের ধান গবেষণা তথ্যে জানা যায়, এদেশে এক সময় বিভিন্ন মৌসুমে ১৫ হাজার জাতের ধান চাষাবাদ হতো। আধুনিক কৃষি, সামাজিক ও আর্থ-রাজনৈতিক পরিবর্তনের কারণে অনেক ধানের জাত বর্তমানে বিলুপ্তির পথে। এখানে স্থানীয় ধানের জাতের কতিপয় নাম দেয়া হলো- রায়েদা, লক্ষ্মীবিলাস, হনুমানজটা, নোনাকুর্চি, পাকড়ী, ঝিংগাশাইল, লালঢেপা, যশোয়া, তিলকাবুর, চিনিসাগর, সোনামুখী, কালোমেখী, সূর্যমুখী, খেজুরঝুপি, কলসকাটি, দুলাভোগ, পোড়াবিন্নি, শিলগুড়ি, কাটারীভোগ, দাদখানি, রাধুঁনিপাগল, মহিষদল, মাটিচাক, বটেশ্বর, ফুলবাদাল, হরিলক্ষ্মী, সরিষাজুরি, মধুশাইল, ফুলমালা, বাঁশফুল, কটকতারা, সরিষাফুলি, বাইলাম, ঘিগজ, রাজাশাইল, মধুমালতী, যাত্রামুকুট, বাবইঝাঁক, জলকুমারি, গান্ধীভোগ, লেবুশাইল, ফুলমুক্তা, বেনামুড়ি, পাটজাগ, কালামানিক, হরিঙ্গাদিঘা, আরও কত শত সুন্দর সুন্দর ধানের জাতের নাম রয়েছে।
বাংলাদেশের ভৌগলিক পরিবেশে স্থানীয় ধানের বৈচিত্র্য বন্যাপ্রবন অঞ্চল, বরেন্দ্র অঞ্চল, হাওর অঞ্চল, উপকূলীয় অঞ্চল চরাঞ্চল
ভৌগলিক পরিবেশ অঞ্চল (সবুজ রংয়ের নামগুলো নয়াকৃষির সংগ্রহ আছে)
বন্যা প্রবন অঞ্চল
আউশ ধানঃ সংখ্যা - ৮১
নয়াকৃষিতে সংগৃহীত ধান - ২৮
সাইটা, ভাতুরী, কালামানিক, ঘুনি, সোনামুখী, পারঙ্গী, সূর্যমুখী, সাত্তাভোগ, পঙ্খীরাজ, বিন্যাফুল, সরিষাফুল, দুধেকটকি, কটকতারা, করচামুড়ি, হাইটা, কাউরা, কালাভাতুরী, ঘৈরাল, কানাইভোগ, চাপিলা, বাদামফুল, ধলাবকরী, ছিটকাধান, আশাকুমরি, হুয়াফুল, মশরুম, নারিকেলঝোপা, হাঁসফুল।
অন্যান্য ধান - ৫৩
হাসাকুমারী, ধইরাইল, বাইলাবকরী, মাধবজাত, মাটিয়া, নারিকেলবাদি, কাটাখড়ি, চাপালো, ফুল চাপালো, জামিরসোপ, ফুলবাদাম, আগল, কইয়াজুরী, বাইশমুন্ডরী, লাঙ্গিজটা, মানিকমন্ডল, হাঁসকুমর, চাঁনমানিক, মাটিচাক, লক্ষ্মীলতা, কালিতারা, বীমন্ডল, বোয়ালিয়া, ঝটা, গয়াল, সবরিভোগ, কাচিলন, কাথবগি, কয়রাপরাঙ্গী, ভাঙ্গাপরাঙ্গী, কৈঝুড়ি, বৌপাগল, কুমচারাল, সন্ধ্যামনি, মানিকমোড়ল, বলিয়ান, গাজল, গাড়িয়া, মহিষদল, পাজরা, হাসাবোয়ালিয়া, সেচিমোলকি, ভাঁগচাপরী, ভাগরকতুলী, বৈলাম, বিন্নামুড়ি, মতিচাক, ধলিসাইটা, বীরকোনা, জামির মাতচাল, দত্তরভোগ, পোখরাজ।
বোনা আমন ধানঃ সংখ্যা - ১৬৪
নয়াকৃষিতে সংগৃহীত ধান - ৬২
চামারাদিঘা, হরিঙ্গাদিঘা, বাওইঝাক, মরিচফুল, মধুশাইল, লোহাডাং, কার্তিকশাইল, ভাওয়ালিয়া, বাঁশীরাজ, ঝুলদিঘা, সোনাদিঘা, ভাওয়ালিয়াদিঘা, মালভোগ, বকঝুল, সাদাবাজাল, বাজাল, বাওয়াল, কালোবাজাল, ইঞ্জলদিঘা, সোনাজলি, পাটনল, ঢেপা, ধলামোটা, জলঢেপা, দুধবাজাল, ঢেপাশাইল, লালচামারা, পানিশাইল, সোনাআঞ্জল, কালোঢেপা, লক্ষ্মীদিঘা, অশানি, ডিঙ্গামতি, মোরাবাজাল, ভাওয়াল, পানিয়ামোটা, বাঁশনল, দুধশাইল, বাঁশমোটা, পানিডাঙ্গা, দুধরাজ, গনকরায়, বাঁশমালতি, ওমরচামারা, লালঢেপা, আড়াইরাল, হিয়াল, খমন. গোরি, কাজল, কার্তিকঝুল, লানি, দুলন, বিলডুবি, মালিকাশাইল, সোনাগিরি, কাজলগিরি, ডুমরাজ, জলডুবি, বাসনা, লতামোটা, লাইটা।
অন্যান্য ধান - ১০২
হরহরী, ইজল, রাজামোড়ল, হামুজতা, কইতরমনি, ধলাদিঘা, জলিবরন, কইয়ামুগরী, গনকরায়, সোনানজুল, রাজালাল, বেনীজাল, বারোগাদি, রাজদীঘা, লক্ষ্মীকাজল, রাজভোগ, দুলিয়াবরন, বনহেস, বোগাহুল, আশফুল, ডুবরাজ, কিরণদিঘা, মইরস, ঢেপা, কৈকা, অঞ্জল, নলোজ, যাত্রামুকুট, গদামন, অলিরাজ, কাজলা, আঁড়াইল, হালই, জলঢেপা, রাজামন্ডল, হরিলক্ষ্মী, বাওয়ালিয়া, তিলবাজাল, নেপা, খামা, দুলাই, আশমতি, হেচিআমন, হলুদজারন, শামুকাটা, বগঝুল, ইজলদিঘা, কাইকা, হলদেকাটা, বাইলাবেত, মেঘশাইল, কেচলাবরন, লোচিবরন, মোল্লাদিঘা, গোদাআমন, বাজাইল, লইটা, খাঁদি, আসিনা, আজলদিঘা, বোরন, সরসরি, দুধকলম, মালভোগ, ঝিংগাশাইল, ডালকচু, মুক্তার, গিলামাতিয়া, গৌরকাজল, বুড়ালক্ষ্মী, কাহিয়া, বেড়াজাল, বিল্লামুড়ি, ওকরাশাইল, লেতপাশা, বেতক, লোথা, বেতলী, বানরজটা, ধলাদিঘা, হিজলদিঘা, কেরানীশাইল, খৈয়ামুগরী, পালাবীর, মধুমালা, আশ্বিনাদিঘা, শিয়াললেজী, কাফিদিঘা, রায়েদা, কাউয়াঝুড়ি, রাঙ্গাদিঘা, ভোজনকুরকুরি, কালাদিঘা, ভরলতা, কুমারভোগ, কমলভোগ, লোকীদিঘা, কৈয়ামটর, গিলামেথী, গাজীভোগ, মুকতারা, বনগাঁজা।
রোপা আমন ধানঃ সংখ্যা - ১২৮
নয়াকৃষিতে সংগৃহীত ধান - ৭৩
চিনিসাগর, আবছায়া, পাটিশাইল, লালবিন্নী, তুলসীমালা, শালি, পানকাইচ, তিলকাজল, চিকনল, জেলাগঞ্জ, ইকনল, চাপামনি, দুধকচু, পাটজাগ, ধলাশাইল, বাঁশফুল, আরগোল, আরিয়া, রাজাভোগ, সোনাজলি, মানিক, আগরসন্ধি, যশা, শুংদাওয়াই, গোপালভোগ, লালবুচকা, কাইকা, মটুঙ্গা, কানাইবাঁশ, সোনাগড়াই, দুধশাইল, সাদাবিন্নি, হিরাচিকন, লুঙ্গা, লতা, কাদিশাইল, আলই, সাদাশাইল, মালামোটা, ফুলমতি, ফুলগাইন, লাসিম, লালগাছি, রূপস্বর, গুতক, মাটিসল, চিনিকাবাই, বউজামাই, বাঁশমতি, কদমফুল, গিরিনশাইল, রাজামন্ডল, মুকুটশাইল, পাইজাম, সোমাগঞ্জল, মিপল, মহারাণী, মোটাযশোয়া, বাঁশফুল, সুরমাশাইল, জবসিরি, মধুমালা, দলকচু, কালিজিরা, সালই, বাঁশিরাজ, রঘুশাইল, বকুলবিচি, কাইসাফুল, ময়নামতি, রসুনভোগ, কৃষ্ণচুড়া, সীতাভোগ, লতিশাইল।
অন্যান্য ধান - ৫৫
পাটজাগ, কইকী, গাতিশাইল, চিনিগুড়ি, গহিঞ্জা, গৈঞ্জা, হালই, গুয়ামুড়ি, মালতী, চপল, মালঞ্চী, গারোবিন্নি, কৈয়াসাগুন, জলকুমরী, দুধসাগর, কাঁশিয়াবিন্নী, জলদুসরী, আসন, বুচী, সকালমুখী, জমা, রায়মুখী, যশা, কুমারী, ধয়নুস, গোলাপী, চাকলী, লক্ষ্মীদিঘা, লোহাগড়া, নোয়াটি, বাঁশীরাজ, নুনিয়া, দুধসাগর, দুধলতিয়া, শ্যামরস, কালিজিরা, সাদাচিকন, দুধশাইল, চিকন ধান, রোপামোটা, কার্তিকশাইল, কলম, বাঁশপাতা, ঢেপাশাইল, সোনাশাইল, চিনিচক্র, বাদশাভোগ, মুগী, পাকরী, মালশিরা, শীলফসল, সাদাভোগ, লালভোগ, বাঁশীকোলন।
বোরো ধানঃ সংখ্যা - ৩৪
নয়াকৃষিতে সংগৃহীত ধান - ৭
ঘিটকা হাইটা, বোরোজবা, বোরোচালান, বোরোচিকন, বোয়ালীবোরো, বেরো ভাওয়া, বাওলাআউশ।
অন্যান্য ধান - ২৭
জাগলীবোরো, লাইকইল, বরবোরো, বোয়ালীবোরো, কুনাইল, আমবোরো, সাদাবোরো, কালীবোরো, খেয়ালীবোরো, চন্দন, টেপীবোরো, খৈল, নরশাইল, কুইনাল, বাঁশফুল, বগলী, জামির, লাকী, বৈশাখী, খইয়া, কাউকাবোরো, কাকুয়াবোরো, খৈয়াবোরো, শাইলবোরো, সোনালীবোরো, গেমামুড়ি, কাঁচাবোরো।
বরেন্দ্র অঞ্চল
আউশ ধানঃ সংখ্যা - ৫৬
নয়াকৃষিতে সংগৃহীত ধান - ২৩
শনি, সাইটা, ভইরা, কালাবকরী, ঠাকুরভোগ, লক্ষ্মীবিলাস, বিন্নাফুল, কর্চামুড়ি, দুধকটকী, খরাজামরী, মুলকে আউশ, শংকপেটি, কাদোমনি, কানাই বকরী, সাদাবকরী, জাগল, কটকবিচি, সাদাআউশ, বুড়িরতন, জামিরশাইল, পঙ্খীরাজ, নয়নমনি, সাদাবকরী।
অন্যান্য ধান - ৩৩
কুচি, কুমরি, ভাদই, সলই, শংকবটি, কালোবজরা, মানিকজোড়, চৈলদম, লেচামনি, লালজামির, গর্ভা, কইতুরমনি, কবুলত, কমরভোগ, কাঁচানলী, ইন্দা, ভোরা, হরিণজলা, লরই, পিঁপড়াশাইল, হিজলি, সন্ধ্যামনি, চাকলাগরি, দুধিচাকলা, কটকী, লক্ষ্মীপুরা, জবাফুল, কালাপাকরী, কুমড়া, পাথরকুচি, সোনাবটি, খুঁইদাবরন, চকোলতোয়া।
বোনা আমন ধানঃ সংখ্যা - ৫৪
নয়াকৃষিতে সংগৃহীত ধান - ১৩
কালিরায়, লাউজান, কালোকচু, বেতো, জটা, মাটিয়া, বেতি, আজলদিঘা, ধলামোটা, মোল্লাদিঘা, আশ্বিনা, ভাদুই, ঝিংগাশাইল।
অন্যান্য ধান - ৪১
চেংগুল, উজল, নাড়াআমন, শুংগলা আমন, জগদলা, গরল, শুলি, আশনাদিঘা, জনাডালা, মুক্তাহার, রাঙ্গলদারি, শুলনজটা, উরিরাজ, চান্দাআমন, কাটমারা, মাইটা গরাল, কালার, লালকালারা, ভরিয়ালতা, কালোবয়রা, কেদারাদন, মইশবাদাম, কাজলগর, দুলাই, ধলাগোটা, কালিআমন, গুয়াশুলি, ঝামরাজা, উড়াবেত, হাঁসকোল, ভজনকর্পূর, বধুশাইল, বোরনী, রাজাবদল, হরিগাছি, করঞ্জা, ধরারাজ, মৈতগড়ল, কিচর।
রোপা আমন ধানঃ সংখ্যা - ১১২
নয়াকৃষিতে সংগৃহীত ধান - ৫৬
দুধসর, হিয়ালী, চিনিআতব, ইন্দুশাইল, চিনিসাগর, বাওইঝাক, কনকচুড়, চিনিসাক্কর, রঘুশাইল, জটাবাঁশফুল, সোনাশাইল, পাকরী, বাদশাভোগ, চিনিগুড়ি, মোহনভোগ, নাজিরশাইল, ময়নাগুড়ি, বেগুনবিচি, লক্ষ্মীবিলাস, লালহিদা, বুচি, মোহিনি, নয়ারাজ, বকশাইল, বাঘাই, কাটাখালি, সাপাহার, মালতি, কানাইফুল, পাটনাই, গঙ্গামানিক, বিরুপাক, বকমালতি, দুধলতি, মাধবলতা, দাদখানি বাঁশকলম, কার্তিকা, মরিচবিচি, খুশবুচিকন, কাচিপানা, মুক্তাহার, ধলবদল, হিলিমতি, বেতিশাইল, সোনাজলি, বেগুনবিচি, ঝিংগাশাইল, ক্ষিরসাপাত, রাধুনিপাগল, বিরই, বিরুপাক, ভবানীভোগ, হিদা, চিনিসর।
অন্যান্য ধান - ৫৬
করোগদী, বালাশোলী, দমফেরো, মুগী, খাটোচালানী, বগঝুল, বড়চালানী, ছোটচালানী, বাতরাজ, কাজলকুঁড়ি, মেঘী, সাদাবোচা, কোলামুচা, হিদা, কালপত, কেকী, কাজলগৌরি, তিলকাউর, বোটাকলম, বিলাসকলম, পাথরকুচি, হরমা, ঝুলন, গুজিএলাই, নাঙ্গাবাঁশফুল, উকুনমধু, মালসারা, কাইশাফুলি, চেঙ্গুল, ভাসামানিক, পারিজাত, কালোজিরা, রাধুনিপাগল, সোনাকাঠি, সোনাশাইল, বোটাশাইল, নিদানশাইল, আশরিশাইল, গুচিরোপা, লালগুচি, খেজুরঝুপি, গান্ধিরোপা, ঢেঁকিশাইল, বানকলম, কদমশাইল, টেপী, বনজিরা, পশুশাইল, বেতোশুলি, খেজুরদিঘা, মোল্লাদিঘা, রঙ্গবদল, মালবয়, কাটারীভোগ, বেত, জিরাশাইল।
বোরো ধানঃ সংখ্যা - ২৪
নয়াকৃষিতে সংগৃহীত ধান - ৬
রাতা, বোরোআরজা, টেপিবোরো, হেয়ালীবোরো, বোরোজবা, জাগলিবোরো।
অন্যান্য ধান - ১৮
ধুসরিবোরো, সাদাবোরো, দেশীবোরো, মিঠাবোরো, সাটিবোরো, কৌলি, বোরোআতব, বোয়ালগারি, কলিমপং, নাড়াবোরো, সান্ধাবোরো, তুলাটেপী, ইতালী, কালজটা, সাইটাবোরো, টেপী, খৈয়াবোরো, বনজিরা।
হাওর অঞ্চল
আউশ ধানঃ সংখ্যা - ২৭
নয়াকৃষিতে সংগৃহীত ধান - ৪
সূর্যমুখী, খইয়ামকরি, খইরা, খুমরি।
অন্যান্য ধান - ২৩
বোয়ালিয়া, গোয়াই, জামিরশাইল, গোয়ালমুরি, আবজাই, চেংরীমুরলী, কচিলুইন, দুবাই, মুরালি, উষা, রাইমুরলী, তেরপলি, হলদিমোরা, মুনশীমুরলী, খইয়ামনি, আড়াই, বউরাশ, কালাচেংরী, তারাবালি, ডুমাই, কাচালতা, কালাআড়াই, হরিনাআড়াই।
বোনা আমন ধানঃ সংখ্যা - ৪৬
নয়াকৃষিতে সংগৃহীত ধান - ১৬
বাদল, পানিতরঙ্গ, ভাসান, জলকুমড়, হোগলাপাতা, জলঢেপা, খাগা, খামা, গঙ্গাসাগর, পাটনল, লারনল, রঙ্গিখামা, দিগমালতী, লতিরাজ, হাতিয়ামোটা, লক্ষ্মীদিঘা।
অন্যান্য ধান - ৪০
পানিতারং, চাপলাশ, পানিলডি, আশকল, পুথিবিরণ, ঝড়াবাদল, নাপতা, মুকবাদল, কটকটিয়া, খামা, খাগা, জোয়ালভাংগা, কালামাকানি, ধলামাকনি, লাকিআমন, কালোকোডা, কালিমিকরী, চিত্রাকচু, মোরাবাদাল, মোপাইয়া, বাগদা, চিরমুইন, পলিনলি, ঋতুবালাম, গোয়ালগাদা, জলবাগদান, খোসালত, আফগাচিয়া, লালবিরন, সাদাবিরন।
রোপা আমন ধানঃ সংখ্যা - ৬৬
নয়াকৃষিতে সংগৃহীত ধান - ২৬
মধুমাধব, নুনিয়াশাইল, ফুলমালতী, তুলসীমালা, মধুমালতি, খইয়াশাইল, ঠাকুরভোগ, মালতি, ময়নাশাইল, গঙ্গামালতি, আলাই মালতি, লাঠিশাইল, জলকুমারী, খিরনলী, লাউজান, আলিফ, আরগোল, জলমোটা, হাতিবান্ধা, শৈবাল, ময়নাগুড়ি, কনকমালতি, জয়ামালতি, ঝুলমালতী, কমল।
অন্যান্য ধান - ৪০
যদুবিরন, মধুবিরন, গান্ধীশাইল, লোটাংগ, হালিনদামেথী, পুতিবিরন, হলদেমন, কলাহিরা, সোনারঝড়ি, হাতকড়া, বেতিশাইল, লাতমা, ধোলমেঘ, হাতিরমোডা, বিরইল, ইকরা, ঝরিয়া, আরফা, নাগরাশাইল, পাটিশাইল, বিরুইন, বাংগাজিরা, শাবেলশাইল, মনিপুরি, চক্কশাইল, বথুবালাম, মুলাশাইল, ধুরিশাইল, তেরফনি, আচরাবালাম, মতিচিকন, মনবিরইন, বিনকাজল, জুয়ারচর, ঢেঁকীশাইল, মটরশাইল, মিয়াফুল, কইরং, চোনধোয়া, নিআলু।
বোরো ধানঃ সংখ্যা - ২৩
নয়াকৃষিতে সংগৃহীত ধান - ৬
রাতাবোরো, জাগলীবোরো, টেপী বোরো, লালবোরো, বোরোভাওয়া, বোরোমোটা।
অন্যান্য ধান - ১৭
খইয়াবোরো, রাতা, কন্দীবোরো, বিচিবোরো, জাগলীবোরো, সাধুটেপী, নলবিরন, সোনারাতা, গচি, বোনাভাত, লতাবোরো, কইয়াবোরো, নিমুরিয়া, পাকনাই, টেপী, পাশাইল, বাউশ।
উপকূলীয় অঞ্চল
আউশ ধানঃ সংখ্যা - ২৯
নয়াকৃষিতে সংগৃহীত ধান - ১৩
বড়ধান, চিন্নাল, সোনামই, খোয়াশ, চাকুলে, চমকা, হাসনাচিকন, তোতামনি, সোনালী পাইজার, বউআদুরী, মুখকালালী, নারিকেলঝোপা।
অন্যান্য ধান - ১৬
চিকনল, বৈলাম, ডালিআউশ, লুমাব্রো, কেরনদল, গুটিরইলাম, ফুলবাদাম, আউশখেসরী, আউশবালাম, নরই, বাওই, লেবুষৈল, বোলন, ইয়াসিন, চিরতী, মহিষদল।
আমন ধানঃ সংখ্যা - ১০১
নয়াকৃষিতে সংগৃহীত ধান - ৫১
আশাইল, লেম্বুরু, খন্ডেইল্ল্যা, নোনাশাইল, নাগপেচী, লাতুরী, লালমতি, দুধরাজ, কালোমেঘ, মইধান, নাতিজি, চিকনল, চাবিচি, গড়া, মিজরী, লালবিন্নি, মোগিচিকন, মসলাচিকন, রায়চিকন, বালাম, রাজকুমারচিকন, সড়কী, কুমড়াবৈলাম, চককল, চাঁদমনি, দুলবেতি, সাদাবিন্নি, পর্বা, লালমোটা, হিয়ালীবরন, স্বাক্ষরখোড়া, জুটিবালাম, জামরুল, সোনামুখী, সাহেবচিকন, বেলেম্বু, গাইঞ্জলী, বেতিবালাম, মোতাধান, বরিশাল, নোয়াখালী, রাজাশাইল, আশানল, জামাইআদুরী, খিরনলী, পোলাও, রাইচালাল, গোপালভোগ, লালধান, বাতনখিজ, কাঁচামোটা।
অন্যান্য ধান - ৫০
মনডুলাচিকন, জগাবেতি, হোসনাচিকন, চপ্পল, ঝামগাবিথী, কাঁচাবিথী, কাঁগাইট, আজববিথী, গোড়াধান, গইটাচিকন, জামাইচিকন, গেলন, লেমবুড়া, চক্কল, কানগৈদে, খাঁদোলাচিকন, রায়চপ্পল, লাডুম, ভিয়াগধান, গিরিধান, কষ্টমনি, জিরাধান, গাচা, রাজভোগ, সাহেবচিকন, ধুলরবীজ, সুন্দরশাইল, ক্ষেতকুমরা, বোয়ারা, আকুন্দি, হরিভোগ, সরকচু, গোপালভোগ, রাঙ্গহোগলা, চুনসী, কইজুড়ি, বুকডা, চিনিকলাই, কাঁকনচরকী, লালু, বতরা, গরামুড়ী, বুয়ারবত, নেরাসিডিয়ার, হলুদগোতা, শৈলেরপানা, আমলজুর, মঈদল, দুইধাভোগ, চন্দ্রহার।
রোপা আমন ধান: সংখ্যা-৬০
নয়াকৃষিতে সংগৃহীত ধান -২৮
লাডুম, চপ্পল, ঢলুচিকন, বাচাধান, আজববেতি, লেইঙাচিকন, গোবিন্দভোগ, থাম্বুর, রাই, কালিমন্ড, দুধকমল, জামাইচিকন, শ্যামলাই, আইলচিকন, মংখই সাদা, রাইচিচা, লংপাং সাদা, মংথন সাদা, মিপাজং, গংসি, মুংশাইল, চুংগি, মাকনেটিং, ছিংজোড়া, সাদা সচখ, মহাকা, চাকলিমোটা।
অন্যান্য ধান -৩২
চাঁদমনি, রাংঙামনি, চন্তল, সালবীচি, বরবরা, চিটগানারী, গাতচাল, রাক্সবতি, বড়ভোগ, মাতাহারি, লালমতি, জালাল বাই, বাঁচা, তুলবলি, গজালি, তম্বর, চাংমনি, গোয়েন্দাঘোষ, রায়চিয়ন, বাদশাবটি, পেডি, পুলবিনি, ধুয়াচিয়ন, কুচলীচিয়ন, ঝামাবেতী, কমালিয়া, কেলাবেইলী, মুঁইধান রোইন্না, রাইধান, নাক্রিংসি।
চরাঞ্চল
আউশ ধান: সংখ্যা -১৫
নয়াকৃষিতে সংগৃহীত ধান -৪
বকরী, কালামানিক, মাটিচাক, বাদামফুল।
অন্যান্য ধান -১১
দুংরা, চাপানো, চৈতোন, ভুশরী, বকরী, দয়রুজ, কালামানিক, কেরণদল, মাটিচাক, কালোশাইটা, ফুলবাদাম
বোনা আমন ধান: সংখ্যা ১৬
নয়াকৃষিতে সংগৃহীত ধান -১৩
বেতো, হিজলদিঘা, বড়দিঘা, বকঝুল, কার্তিকঝুল, লালঢেপা, হুরহুরি, লাল ভাওয়ালিয়া, মালভোগ, সাদাদিঘা, সাদা ভাওয়ালিয়া, ভাসাদিয়া,
অন্যান্য ধান -৩
কাশাহাম, সংরাজ, লেমু।
রোপা আমান ধান: সংখ্যা - ২৮
নয়াকৃষিতে সংগৃহীত ধান -১০
নয়ারাজ, গঞ্জিয়া, কাজলশাইল, রাজাশাইল, কার্তিকশাইল, লালমোটা লালসরু, জোসুয়া, খিরসাপাত, যশোর।
অন্যান্য ধান ১৮
পানিশাইল, বিদিপাকরী, সাভিরা, খিরশাপাত, জাসোয়া, বচি, শুলকুমার, লালচিকন, পরজা, তালচিড়া, চাপলাইস, গরচা, লোটা, সাকরমোড়ল, কুটিআগুনি, নাকপেচী, কালগরু, বকঝুল।
বোরো ধান: সংখ্যা - ৬
নয়াকৃষিতে সংগৃহীত ধান -২
সাদাবোরো, কালাবোরো
অন্যান্য ধান - ৪
কাশাহাস, বেতো, সংরাজ, লেমু,
তথ্যসুত্র: দেশী ধান, বাংলাদেশ ধান গবেষণা (১৯৭৪) কর্তৃক প্রকাশিত।
স্থানীয় ধানের উৎপাদনশীলতা
বাংলাদেশে স্থানীয় ধানের উৎপাদনশীলতা নিয়ে বহু প্রশ্ন রয়েছে। বলা হয় জনসংখ্যা বেড়ে গেছে কিন্তু স্থানীয় জাতের ধানের ফলন কম সে কারণে উফশী এবং হাইব্রিড ধান ছাড়া নাকি দেশের মানুষের খাদ্য যোগানো সম্ভব হবে না। আধুনিক কৃষিতে শুধুমাত্র ধান এর ফলন হিসাব করা হয় কিন্তু খড়ের কোন হিসাব করা হয় না। একটি বিষয় অবশ্যই মনে রাখতে হবে কৃষক পরিবারে গবাদি পশু, হাঁস-মুরগি থাকে তাদের খাবার আসবে কোথায় থেকে? এছাড়া কৃষক ধুনি নয় তার বাড়ি-ঘর মেরামতের প্রয়োজন পড়ে। সে কারণে কৃষকরা ধানের ফলন হিসাব করার সময় খড়সহ ধানের হিসাব করে থাকেন।
নয়াকৃষির কৃষরা উৎপাদনের কথা মাথায় রেখে এই ধরনের স্থানীয় জাতের ধানের চাষাবাদ করে আচ্ছেন।
নয়কৃষির কৃষকরা নিজেদের ক্ষেতে আবাদ করে দেখেছেন স্থানীয় জাতের ধানের মধ্যে অনেক জাত রয়েছে যেসব অধিক ফলন দিয়ে থাকে। এখানে সে সব ধানের উদাহরণ দেয়া হলো:
১. অধিক ফলনশীল স্থানীয় জাতের আমন ধান
স্থানীয় ধানের জাতের নাম | ফলন কেজি/হেক্টর | |
ধান |
খড় | |
চান্দমনি | ৬৪৮৭ | ৮৪৮৬ |
ইন্দশাইল | ৫১৯৮ | ৭৫১১ |
রাজাশাইল | ৫৭৫১ | ১৪২৬৪ |
ঝিংগাশাইল | ৭০৬৭ | ৮০৯৪ |
বাঁশি আমন | ৬১৯৪ | ১০৩৩৭ |
কালোভোগ | ৭৬১৪ | ১৩৮২৮ |
ঢেপা | ৫৪৬৩ | ১২৩১৬ |
লালঢেপা | ৬০৬৬ | ১৮০৯৪ |
ভোগধান | ৭২৬১ | ১৫৩৪২ |
ওমর চামারা | ৬৭৫২ | ১৮০৫৩ |
ঢেপাশাইল | ৬৩৫৪ | ১৯৩৫১ |
দুধরাজ | ৬৭৪২ | ১৭৪৩৩ |
হিমবলি | ৫৪২০ | ১৫১৪০ |
হোগলাপাতা | ৫৩৮০ | ১২২৯০ |
সাদামোট | ৫৩২০ | ১৩৯২০ |
বাজাইল | ৫৭৪২ | ১২০৫৩ |
দিঘা | ৬৭৫২ | ১৭২৫৩ |
লাল আমন | ৫৭৪২ | ১৬১৭৯ |
চান্দমালতি | ৫৪২০ | ১৫৯২০ |
আশাইললেম্বুরু | ৬১৭৫ | ১৮৩৪০ |
২. অধিক ফসনশীল স্থানীয় জাতের বোরো ধান
স্থানীয় বোরো ধানের নাম | ফলন কেজি/হেক্টর | |
ধান |
খড় | |
টেপাবোরো | ৬৯৩৩ | ১৮১৫৯ |
বলংগা | ৬৩০০ | ১৬২৭০ |
সোনালী বোরো | ৬৮৫০ | ১৬৮৪০ |
কালোসাইটা | ৫৪৫০ | ১৬২৭৬ |
বোয়ালী বোরো | ৫৮৫০ | ১৫৭৬০ |
তুফান | ৫১২০ | ১৫২৩০ |
বোরোধান | ৫৩৮০ | ১৫৪৩০ |
জাকিবোরো | ৩৮০০ | ১৪৩৬০ |
লাহাইয়া | ৪৫৪০ | ১৫১০০ |
৩. উচ্চ ফলনশীল চিকন ও সুগন্ধি ধান
স্থানীয় বোরো ধানের নাম | ফলন কেজি/হেক্টর | |
ধান | খড় | |
রাধুনী পাগল | ১৪৯২ | ৪৩৪৭ |
কালিজিরা | ২০২৪ | ৫৫৪৬ |
বেগুনবিচি | ১৯৩৭ | ২৩৪৫ |
বউআদুরী | ১৭৭৮ | ২৯৬৪ |
চিনিঅতব | ২০৯৭ | ৬০২৩ |
পোলাও | ৫৭৪২ | ৮২০৫ |
পাকরী | ৪৮৪১ | ৫৮০৯ |
কাটারীভোগ | ৩৯৫৭ | ৫৭৫৮ |
চিনিগুড়ি | ২৬৬২ | ৪৩৬৮ |
বাদশাভোগ | ২০১৯ | ৪৭৫৯ |
মোহনভোগ | ৪৭৬২ | ৬৪৫৬ |
সাহেবচিকন | ৩৬৮৭ | ৬৪৬৪ |
বিরই | ৪২২১ | ৬১৬২ |
চিলমারীর গাঞ্জিয়া ধান
এ দেশের ভৌগলিক পরিবেশ ভেদে স্থানীয় জাতের এক একটি ধানের বৈশিষ্ট্যের বৈচিত্র্য যে কত রকমের তার হদিস করা কঠিন। কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী উপজেলার একটি ধানের নাপম নাম গাঞ্জিয়া। স্থানীয় জাতের ধান এই গাঞ্জিয়া আর সব হারিয়ে যাওয়া স্থানীয় ধানের সঙ্গে প্রায় হারিয়ে গিয়েছিল। নয়াকৃষির কৃষকরা অত্যন্ত মেহনত করে হারিয়ে যাওয়া গাঞ্জিয়া ধানকে আবার ফিরিয়ে এনেছেন। বর্তমানে এলাকায় জনপ্রিয় ধানের মধ্যে গাঞ্জিয়া অন্যতম। চিলমারী চরের কৃষকরা এ ধান চাষাবাদ করতে খুবই পছন্দ করেন। কেননা স্থানীয় জাতের এ ধানটি তাড়াতাড়ি ঘরে আসে। আর একটি বড় কারণ হচ্ছে এ ধান আবাদ করার জন্য কোন রাসায়নিক সার, বিষ তো লাগেই-না, এমনকি জৈবসারও লাগে না, নিড়ানি দেবারও প্রয়োজন পড়ে না। জমিতে ব্রহ্মপুত্র নদের পলি পড়ে। গাঞ্জিয়া ধানের ফলন নেহাত কম নয় প্রতি হেক্টরে ৩২১১ কেজি এবং খড় হয় ৮৬৩৩ কেজি। এ ধানের চাল চিকন। বাজর দরও ভালো। মৌসুমে প্রতি মণ ৯০০.০০টাকা থেকে ১০০০.০০টাকা। ধানের মৌসুম ছাড়া এ ধানের দাম আরো বেড়ে যায়, এর চাহিদা বেশি। এ ধানের চাল থেকে পিঠা তৈরির জন্য চালের গুড়া, খই, চিড়া তৈরি করা যায় কিন্তু মুড়ি ভালো হয় না, অর্থাৎ চিকন হয়।
আদিবাসিদের বিন্নি ধান
বিন্নি ধানের কথা বললেই বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তা বা যাদের আমরা সাধারণত ‘আদিবাসি’ বলে থাকি তাদের কথা সবার আগে চলে আসে। বিন্নি ধান মানেই আদিবাসিদের ধান। পাহাড়ী এলাকার স্থানীয় ধানের জাতের মধ্যে বিন্নি ধান আদি ধান। বাংলাদেশের বিশেষ করে নেত্রকোনায় বসবাসকারি আদিবাসী হাজং, গারো, রাংসা, সাংমা, মান্দা, দারিং আদিবাসীরা দলবদ্ধ ভাবে এ ধান চাষাবাদ করে থাকেন। এ ধান পাহাড়ী এলাকার উঁচু নিচু সব ধরণের জমিতেই হয়ে থাকে। এ ধান চাষাবাদ করতে কোন রাসায়নিক সার বা বিষের প্রয়োজন হয় না। আদিবসিরা বিন্নি ধানের প্রতি খুবই গুরুত্ব দিয়ে থাকে। কেননা প্রধানত বিন্নি ধান না হলে আদিবাসিদের কোন বিয়ের প্রস্তাব গৃহিত হবে না। বিভিন্ন ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কাজে বিন্নি ধান না হলে আদিবাসিদের চলবে না। এছাড়া বিন্নি ধান তাড়াতাড়ি ঘরে আসে অর্থাৎ ধান লাগানোর দুই মাসের মধ্যেই কাটা হয়। বিন্নি ধানের খড় গবাদি পশু ভালো খায় এবং আদিবাসিরা ঘর ছাউনির কাজে ব্যবহার করেন। ফলে এ ধানের খড়ের চাহিদা বেশ রয়েছে। বিন্নি ধানের চালের গুড়া দিয়ে সকল ধরণের পিঠা তৈরি করা যায়, সে পিঠা অন্যান্য ধানের চালের গুড়ার পিঠার চেয়ে নরম হয়। ভাত হিসেবেও বিন্নি ধানের চাল আদিবসিদের কাছে খুবই পছন্দের।
আদিবাসীরা ছাড়াও বিন্নি ধানের ব্যবহার আছে। যেমন বিন্নি ধানের খই না হলে তাঁত শিল্পীদেরও চলে না। তাঁত শিল্পীদের কাছে বিন্নি ধানের খই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাঁত শিল্পীরা সুতা এবং কাপড় কাটা করা অর্থাৎ মাড় দেবার জন্য বিন্নি ধানের খই ব্যবহার করে থাকেন। ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সঙ্গে একটি গবেষণায় উবিনীগ দেখেছে প্রতি হেক্টরে বিন্নি ধানের উৎপাদন প্রায় ২৫০০ থেকে ৪০০০ কেজি এবং খড় হয় সাড়ে পাঁচ থেকে ৬ হাজার কেজি। একটি বিশেষ জাতের বিন্নি ধান পাওয়া গিয়েছে প্রায় ২৮৬৫.৭০ কেজি এবং খড় ৫৫৩৭.৪১ কেজি। বিন্নি ধানের বিভিন্ন জাত রয়েছে। যেমন, চন্দন বিন্নি, গেং গেং বিন্নি মৌ বিন্নি, দুধ বিন্নি, রাঙা বিন্নি, আসানিয়া বিন্নি, ছৎছেং বিন্নি, বিজাবিরাং বিন্নি, কুৎচিয়া বিন্নি, আগুনিয়া বিন্নি, কাক্কুয়া বিন্নি, চিচাও বিন্নি, লেদার বিন্নির নাম উল্লেখযোগ্য। বর্তমানে আধুনিক কৃষির উফশী ধানের কারণে বিন্নি ধান হুমকির মুখে রয়েছে।
এখানে উল্লেখ করা দরকার যে ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলো তাদের ধানের জাতগুলো হারিয়ে ফেলছে। নয়াকৃষি আন্দোলন বিন্নি ধানের জাত রক্ষার জন্য আদিবাসীদের পাশে দাঁড়িয়ে সংগ্রাম করছে।
খরা প্রবণ আউশ: কালাবকরী ধান
ধানের নাম কালাবকরী। ধানের নামের মধ্যেই এর বৈশিষ্ট্য লুকিয়ে রয়েছে। বকরী অর্থ ছাগল। ছাগলগ্রীষ্ম প্রধান অঞ্চলের প্রাণি হবার কারণে সে অধিক খরা ও তাপ সহ্য করার ক্ষমতা রাখে। ঠিক তেমনি কালাবকরী বাংলাদেশের খরা প্রবণ অঞ্চলের আউশ ধান। এ ধানটি চাপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, নওগাঁ এবং পাবনা জেলার কৃষকদের প্রিয় ধান। এ ধানটি কেন এসব এলাকায় জনপ্রিয় সে সম্পর্কে চাপাইনবাবগঞ্জের কৃষক রমজান আলী বলেন, এ বছর (২০১০) ভয়ানক খরা হয়েছিল-একদিকে বৃষ্টি নেই অপরদিকে প্রচন্ড রোদ - ধান গাছের পাতাগুলো কুচকে নূয়ে পড়ে। এ অবস্থা দেখে মনে হয়েছিল, এবছর বুঝি আউশ ধান পাবো না। কয়েকদিন পর হঠাৎ করে বৃষ্টি হলো। এ বৃষ্টির পানি পেয়ে ধান গাছ বেশ মোটা তাজা হয়ে ক্ষেত সবুজ হয়ে গেল। ধানের ফলন এ বছর ভালো হয়েছে। অবাক হবার মতো বিষয় হচ্ছে-এতো খরার পরও ধানে চিটা হয় নাই। প্রতি ছড়ায় ৪/৫টি মাত্র চিটা ধান। কালাবকরী ধান প্রাকৃতিক ভাবে বৈরি আবহাওয়া, অনাবৃষ্টি ও প্রখর রোদের তাপ সহ্য করতে পারে। আধুনিক কৃষির কোন উফশী জাত বা হাইব্রিড জাত এতো খরা কোন ভাবেই সহ্য করতে পারে না। এ ধান ছিটিয়ে বপন করা হয়। কালাবকরী ধান আবাদ করতে কোনো রাসায়নিক সার ও বিষ ব্যবহার প্রয়োজন পড়ে না। রোগ-বালাইয়ের আক্রমণ হয় না বললেই চলে। এমন কি এ ধানে কোন সেচ দেবারও প্রয়োজন পড়ে না। কালাবকরী ধান থেকে মুড়ি, চিড়া, খই বেশ ভালো হয়। ভাত খেতে বেশ স্বাদ এবং পুষ্টিকর। এ ধানের খড় মিঠা এবং নরম হবার জন্য গবাদিপশু বেশ পছন্দ করে। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে আউশ ধান এ অঞ্চলের গ্রামীণ সমাজে আজও গুরুত্বপুর্ণ। আউশ ধান ঘরে এলে প্রথমে ক্ষীর অথবা খিচুড়ি রান্না করে বাড়ির আশে পাশের প্রতিবেশি মুরুব্বী ও ছেলে মেয়েদের দাওয়াত দিয়ে কৃষকরা খাওয়ান। এরপর মেয়ে-জামাই নাইয়রে এনে নানা রকমের পিঠা তেরি করে খাওয়ান এবং মেয়ে শ্বশুড়বাড়ি যাবার সময়ও বেঁধে দেয়া হয়। স্থানীয় জাতের কালাবকরী আউশ ধানে পুষ্টি বেশি থাকায় এর চালের ভাতে কৃষকদের স্বাস্থ্য ভালো থাকে, তেমনি তারা কাজে বল পান। এছাড়া স্থানীয় জাতের চালে পুষ্টিমান বেশি থাকায় স্বাভাবিক ভাবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে যায়। কালাবকরী আউশ ধান হিশাবে প্রতি হেক্টরে প্রায় আড়াই হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার কেজি এবং ৫ থেকে ৬ হাজার কেজি খড় হয়। নয়াকৃষির একটি গবেষণায় দেখা গেছে চরম খরার সময়েও কালাবকরী ধান ২৫১১.৯৯ কেজি এবং খড় ৪৫৬৯.৩৫ কেজি ফলন হয়েছে। কৃষকদের প্রিয় এই জাতের ধান রক্ষা করা কি আমাদের কর্তব্য নয়?
বিশেষ আবহাওয়ায় ও জলবায়ু পরিস্থিতিতে ধানের জাত
(বেশী পানি সহনশীল (দীর্ঘদিন পানির নীচে থাকতে পারে, খরা সহনশীল ধানের জাত, লবনাক্ততা সহনশীল, ঠান্ডা সহনশীল)
বর্তমানে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর সকল দেশেই আবহাওয়া এবং জলবায়ু পরিবর্তন নিত্যনৈমত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ ছয় ঋতুর দেশ। বাংলাদেশে এই ছয় ঋতু কখন আসে আর কখন যায়, বর্তমানে বুঝে ওঠা বেশ কষ্টকর। কৃষির দিক থেকে প্রধানত তিনটি ঋতুকেই বড় দাগে দেখা যায়। মৌসুমে ঋতুগুলি আসে এবং যায় কিন্তু তাদের বৈশিষ্ট্য বুঝা এখন মুশকিল।
সময়ের বৃষ্টি দেখা নেই, অসময়ে বৃষ্টি হচ্ছে তো হচ্ছেই। যদি বৃষ্টি হয় তো ছাড়াছাড়ি নেই, তার সঙ্গে সারা আকাশ মেঘলা। শীতকালে যে সময় ঠান্ডা পড়ার কথা সে সময় ঠান্ডা নেই। অসময়ে প্রচন্ড ঠান্ডা দীর্ঘায়িত হয়ে থাকে। কোন কোন বছর আবার শীতের সময় তেমন শীতই পড়ে না। গ্রীষ্মকালে এমনি খরা হয়ে থাকে যে, এক ফোঁটা বৃষ্টি তো দূরের কথা তিব্র তাপদাহে সবায় যেন অতিষ্ট, তার সঙ্গে রয়েছে লু হাওয়া। কোন কোন বছর এ অবস্থা দীর্ঘায়িত হয়ে থাকে। বর্ষা মৌসুমে বাংলাদেশের বাহির থেকে পানির ঢল এসে সারা বাংলাদেশ প্লাবনে ভাসিয়ে দেয়। বাংলাদেশের আবহাওয়া এবং জলবায়ু আর আগের মতো নেই। বাংলাদেশে আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের লক্ষণগুলি যদি শনাক্ত করি তাহলে দেখা যায়-
১. বাংলাদেশে উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণাঞ্চলসহ প্রায় সারা দেশে খরার প্রবনতা বেড়েছে। এর অর্থ তাপমাত্রা বাড়া, বৃষ্টিপাত কম হওয়া
২. ছোট এবং বড় আকারের বন্যা বা প্লাবনের সংখ্যা বেড়ে গেছে।
৩. বর্ষা মৌসুমে মাত্রাতিরিক্ত বৃষ্টি হয়ে থাকে অথবা একেবারে কম বৃষ্টি হয়। এমনও দেখা যায়, পাশের দেশের ঢলের পানি বাংলাদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে প্লাবনের সৃষ্টি করে।
৪. শীত মৌসুমে শীতের তিব্রতা পূর্বের তুলনায় কমে গেছে। আবার হঠাৎ করেই শীতের মাত্রা বেড়ে যায়, তার সঙ্গে যুক্ত হয় শৈত প্রবাহ এবং ঘন কুয়াশা।
৫. ফসলের উৎপাদন তুলনামূলক ভাবে কমে গেছে, রোগ-বালাই এর পরিমাণ বেড়ে গেছে। বাংলাদেশের কোন কোন অঞ্চলের ফসল চক্র পরিবর্তন হয়ে গেছে। বর্তমানে আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে ধান চাষীদের প্রধানত চার ধরণের সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। সমস্যাগুলো হচ্ছেÑ বন্যা, খরা, লবনাক্ততা এবং ঠান্ডা। এ সকল প্রাকৃতিক দূর্যোগের কারণে ধান চাষীরা, ধান আবাদ করে ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।
প্রাকৃতিক দূর্যোগের কারণে ধান চাষীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবার প্রধান কারণ হচ্ছে উফশী অথবা হাইব্রিড ধান আবাদ করা। অথচ বিরূপ আবহাওয়া ও জলবায়ুর পরিস্থিতিতে বেশী পানি সহনশীল, খরা সহনশীল, লবনাক্ততা সহনশীল এবং ঠান্ডা সহনশীল স্থানীয় জাতগুলো ব্যবহার করা হলে বিরূপ আবহাওয়া ও জলবায়ুতেও ধান চাষী ধান চাষাবাদ করে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবেন না।
আমরা অনেকেই খোঁজ রাখি না বাংলাদেশে ভৌগলিক অবস্থান ভেদে আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিস্থিতি মোকাবেলায় বহু- বেশী পানি সহনশীল স্থানীয় ধানের জাত, খরা সহনশীল স্থানীয় ধানের জাত, লবনাক্ততা সহনশীল স্থানীয় ধানের জাত এবং ঠান্ডা সহনশীল স্থানীয় ধানের জাত রয়েছে। এখানে আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে সক্ষম সে সব স্থানীয় ধানের জাতের উদাহরণ দেয়া হলো-
বেশী পানি সহনশীল স্থানীয় জাতের ধানের নাম | খরা সহনশীল স্থানীয় জাতের ধানের নাম | লবনাক্ততা সহনশীল স্থানীয় জাতের ধানের নাম | ঠান্ডা সহনশীল স্থানীয় জাতের ধানের নাম |
জলচামারা, দিঘা,পানিশাইল, বাহারী, কলামোচা, বরন, হিজলদিঘা, ফুলগাইন, গদা ডেঙ্গা, ধলামোটা, বওয়ালিয়া, পানি ভাঙ্গা, পাটজাগ, পানি লাল, আজল দিঘা, মোলী, হলদিয়া রাম, দুধসর, হরহরী বনগজা, জটা, শাইলজটা, তিল বাজাল, মুরা বাজাল, বাইশবিশ, বাজাল, পারঙ্গী, হরিঙ্গাদিঘা, বকঝুল, রাজদীঘা, লক্ষ্মীকাজল, সোনানজুল,ঈজল, বোগাহুল, ডুবরাজ, পানিতরঙ্গ, ফুলবাদাম, হাঁসকুমর, ইত্যাদি। | কার্তিক শাইল, গর্ভা, কালামানিক, দোয়াশী, শনি, সোনাশাইল, শংকবটি, ষাইটা, জাগল, ভইরা, কালাবকরী, চালানী, চৈতোন, হরিণ কাজলি, বলুন, গোরিয়া, বোলা, দরকী, দুধেকটকী, খরাজামরী, মূলকে আউশ, জবাফুল লক্ষ্মীবিলাস, কতুরমনি, পাথরকুচি, কালাপাকরী, কটকী, সন্ধ্যামনি, বিন্নাফুল, সলই, কমরভোগ, কাঁচনলী ইত্যাদি। | আশাইল লেম্বুরু, খইন্ডাইল্যা, আশাইল, লেম্বুরু, হাসনা চিকন, বাইনা চিকন, মুখকালালী, নোনাশাইল, চিনিকানী, খাসকানী, সবিতা পাটনায়, জুটি বালাম, বেলেম্বু, জামরুল, রাজাশাইল, আগুনশাইল, লালধান, মইদল, গিরিধান, জিরা ধান, ইত্যাদি। | কালামোটা, সাদা বাজাল, কার্তিক ঝুল, মোটা যশো, ফুলবাতি, বোয়ালী বোরো, ইছামতি, টাপো আমন, লাল চামারা, সান্দিক শাইল, নারিকেল বাদি, ময়না, ধলা বোরো, কালোবোরো, খেয়াই, নাতুয়া, শিলকলন, চন্দন, রাতা, ইত্যাদি। |
ধানের বিভিন্ন ব্যবহার
ধান থেকে চাল হয়, চাল পানি দিয়ে সিদ্ধ করে ভাত হয়, এটা বাংলাদেশের মানুষের নিকটে অজানা নয়। কিন্তু ধান থেকে শুধু ভাত হয় না, এদেশে ধানের বিভিন্ন রকম ব্যবহার রয়েছে। ধানের বিভিন্ন রকম ব্যবহার বলতে ধান থেকে কত রকমের, কত নামের খাদ্য তৈরী হয়ে থাকে সে সম্পর্কে বুঝানো হয়েছে।
ধান সম্পর্কে এদেশে কত রকমের প্রবাদ রয়েছে- যেমন ‘মাছে ভাতে বাঙ্গালী’ ‘ ভেত বাঙ্গালী’ ‘ডাল ভাতে বাঙ্গালী’ আরো ক-ত কি! তবে বাংলাদেশের মানুষরা শুধু ধান থেকে চাল তৈরী করে ভাতই খায় না; আরো বিভিন্ন ধরণের রকমারি খাদ্য তৈরী করে খায়। উদাহরণ হিশাবে বলা যায়- মুড়ি, চিড়া, খৈ, বিভিন্ন রকমের পিঠা, ভাপা পিঠা, পাকান পিঠা, পুলি পিঠা, চিতই পিঠা, দুধ পিঠা ইত্যাদি, আবার মুড়ির মোয়া, চিড়ার মোয়া, খৈয়ের মোয়া, চালের পাপড়, চাল ভাজার নাড়ু–, পোলাও, বিরিয়ানী, তেহারী, ফিন্নী, পায়েস ইত্যাদি।
এ সকল খাদ্য যেকোন ধানের চাল, চালের গুড়া/আটা থেকে যেমন হয় না তেমনি যেকোন ধানের চাল থেকে পোলাও, বিরিয়ানি, ফিন্নি, পায়েস হয় না। বিভিন্ন ধরণের পিঠা, পোলাও, বিরিয়ানী, ফিন্নি, পায়েস বিশেষ জাতের ধানের চাল দিয়ে তৈরী করা হয়। বিশেষ করে ঢাকা শহরের মানুষের ধারনা ‘বুঝি যে কোন ধান থেকেই সুন্দর সুন্দর মুড়ি, খৈ, চিড়া, পোলাও, বিরিয়ানী, ফিন্নি, পায়েস সকল খাদ্য তৈরী হয়ে থাকে। এ ধারনাটা মোটেও ঠিক নয়। এমন কি যেকোন ধানের চাল থেকে খাবার উপযোগী ভাতও হয় না। ধান থেকে প্রত্যেকটি খাদ্য তৈরী করার জন্য আলাদা আলাদা জাতের ধান বা ধানের চাল ব্যবহার করে নির্দিষ্ট খাদ্য তৈরী করা হয়ে থাকে। যেমন ‘মুড়ি’ তৈরী করার জন্য নির্দিষ্ট কিছু ধানের জাত রয়েছে, অনুরূপ ভাবে চিড়া এবং খৈ তৈরী করার জন্য নির্দিষ্ট কিছু ধানের জাত রয়েছে আবার পোলাও, বিরিয়ানী, ফিন্নি, পায়েস এবং পিঠা তৈরী করার জন্য নির্দিষ্ট ধানের জাত রয়েছে। যেকোন ধান বা ধানের চাল থেকে সকল ধরনের খাদ্য তৈরী করা সম্ভব হয় না। আর তৈরী করা গেলেও ভালো মানের হয় না। যে সব ধান বা ধানের চাল থেকে মুড়ি, চিড়া, খৈ, পিঠার জন্য চালের গুড়া, পোলাও, ফিন্নি, বিরিয়ানী, তৈরী করা হয়ে থাকে সে সকল ধানের একটি তালিকা এখানে দেয়া হলো-
ব্যবহার ভিত্তিতে ধানের নাম
ধানের ব্যবহার | ধানের নাম |
মুড়ির ধান | ১. নারকেল ঝোপা, ২. সাদাপেকরাজ, ৩.পারমা, ৪.লালগাইচা, ৫. ঘিগজ, ৬. করচা মুড়ি, ৭. দুধরাজ, ৮. রঙ্গীখামা, ৯. আদুল জরা, ১০. লাল হাইল, ১১. শংকরবটি, জাগল ইত্যাদি। |
চিড়ার ধান |
১. চান্দামতি, ২. তেনজাল, ৩. চাপামনি, ৪. রূপসি, ৫. মালিয়া, ৬. মটকি, ৭. জোলাকোয়া, ৮. কলামোচা, ৯. তিলকাজুর, ১০. মার্চিরুলা, ১১. দুধবিন্নি, ১২. মধুশাইল, ১৩. লাল সরু, ১৪. জাগল ইত্যাদি। |
খৈয়ের ধান | ১.নাগরা সোনা, ২. এলাচি, ৩. হিলল, ৪. ঝিংগাপোড়া, ৫. যশরা, ৬. মনাশাইল, ৭. সোনালী বরন, ৮. মোটাশাইল, ৯. গচি, ১০. গাবি. ১১. কালিতারা ১২. বাজাইল, ১৩. সীতাচিকন, ইত্যাদি। |
সুগন্ধি ধান | পোলাও/বিরিয়ানী/ ফিরনির জন্য ব্যবহার করা হয়। ১. কালোজিরা, ২. পোড়াবিন্নি, ৩. চিনিগুড়ি, ৪. কালিগুড়া, ৫. আসম্বর, ৬. রাধুনিপাগল, ৭. কাটারীভোগ, ৮. মোহনভোগ, ৯. বউ আদরী, ১০. বাদশাভোগ, ১১. রাইচিকন, ১২. বিরই, ১৩. সাহেব চিকন, ইত্যাদি। |
পিঠার ধান | ১. শনি, ২. চমকসাদা, ৩. সাদাঢেপা, ৪. গঙ্গামানিক, ৫. মুক্তাহার, ৬. কালরাজ, ৭. মালাকা, ৮. বাজাল, ৯. চেমন, ১০.রুবশা, ১১. লুঙ্গা, ১২. বউআদুরী, ১৩. সাহেব চিকন, চিনিআতব, চিনিসাক্কর, ইত্যাদি। |
ঢেঁকি ছাটা ধান থেকে কি কি হয়
১ মন ধান হিসাবে, চাল -২৪ কেজি, তুষ -৯ কেজি, কুড়া -৩ কেজি, খুদ -২ কেজি, মোট-৪০ কেজ।
চাল: ভাত, পোলাও, পায়েশ, ফিরনী, পিঠা, খই, মুড়ি, চিড়া।
তুষ: ঘরলেপা, রান্নার কাজে ব্যবহার, গরুর ঘরে ধোয়া দেওয়া, শীতকাল আসলে আগুন তোলাতেব্যবহার (বেশি সময় পাত্রে আগুন থাকার জন্য ঘরের মধ্যে ব্যবহার করে) চুলা লেপা এবং কাদার সাথে মিশ্র করে চুলা তৈরি করা। তুষ দিয়ে লম্বা কাঠি তৈরি করে চায়ের দোকানে জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার। গোবর এবং তুষ মিশ্র করে কাঠি তৈরি করে জ্বালানির জন্য। গোবর ও তুষ মিশ্র করে ধান মলার উঠানে লেপ দেওয়া হয়। মুরগীর খামারে তুষ ব্যবহার। আতর ঘরে তুষের ধোয়া দেওয়া। মুরগীর বাচ্চা ফোটানোর জন্য তুষের উপর ডিম দিয়ে মুরগী তা দেওয়া। তুষের ছাই দিয়ে গ্রামের লোক দাঁত মাজার কাজ করে। দুর থেকে ডিম আনতে হলে তুষের মধ্যে করে আনে। সফেদা ফল, নোনাফল, আতা ফল পাকানোর জন্য তুষ ব্যবহার করে। তুষের ছাই দিয়ে হাড়ি পাতিল মাজা ঘষা করে। গ্রামের লোক যারা হুকা খায় তারা বেশিক্ষণ আগুন থাকার জন্য গোবরের ঘসি ও তুষ ব্যবহার করে।
কুড়া: গরুর খাবার, হাঁস, মুরগীর, ছাগল,মাছের খাদ্য হিসাবে ব্যবহার। কুড়া ও গোবড় দিয়ে ধান রাখার গোলা লেপদেয়। গ্রামের লোক বৎসরে একবার আতপ চালের কুড়া দিয়ে চিতই পিঠা তৈরি করে খায়।
খুদ: খুদের ভাত, ছাতু, খুদের মোয়া, খুদের চাপড়ি, খুদের মুইটা পিঠা,বউ খুদা রান্না করে খায়, কাটাখুড়ে গাছ দিয়ে খুদ রান্না করে গরুকে খাওয়ালে গরুর দুধ বাড়ে। মুরগী ও হাঁসের বাচ্চা যখন কেবল ফুটে বের হয় তখন খুদ খাওয়ানো হয়। নারিকেলের নাড়– বানানোর সময় খুদ ভেজে মিহিকরে বেটে নাড়– শক্ত হওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়।
খনার বচন
ধানের গাছে শামুক পা।
বন বিড়ালী করে রা।।
গাছে গাছে আগুন জলে।
বৃষ্টি হবে খনার বলে।।
অর্থ : শামুক ধান গাছ বেয়ে উপরেরর দিকে উঠলে, বন-বিড়ালী উচ্চস্বরে ডাকলে ও অসংখ্য খদ্যোত ঝোঁপ-ঝাঁড় পরিবেষ্টিত করে রাখলে শীঘ্র বৃষ্টি হয়।
আমে ধান।
তেতুঁলে বান।।
অর্থ: আম বেশি ফললে ধান বেশি জন্মে। তেতুঁল বেশি ফললে ঝড় তুফান-বন্যা বেশী হয়।
ডাংগা নিড়ান বান্ধন আলি।
তাতে দিও নানা শালী।।
অর্থ: জংগল ও দল-দুর্বা পরিস্কার করা শালী রোপণের প্রথম শর্ত।
আগে বেঁধে দিবে আলি।
তাতে রু-ই দিবে শাল।।
তাতে যদি না হয় শালি।
খানা বলে পাড় গালি।।
আগে ক্ষেতের বাঁধবা আইল।
তাতে রুইয়া দিবা শাইল।
অর্থ: প্রথমে ক্ষেতের আই ঠিকঠাক করে তারপর ধান রোপন করার কথা বলা হয়েছে।
যদি হয় চৈত্র মাসে বৃষ্টি।
তবে হয় ধানের সৃষ্টি।
অর্থ: চৈত্র মাসে বৃষ্টি হলে সে বছর প্রচুর ধান জন্মে।
বৈশাখের প্রথম জলে।
আশুধান দ্বিগুণ ফলে।
অর্থ: বৈশাখ মাসের প্রথম দিকে প্রচুর বৃষ্টি হলে আউশ ধান ভালো ফলে।
ঘন জলায় পাতলা গুছি-
ধান কয় আমি আছি।
অর্থ: পাতলা গাছ ফলন বেশী। ঘন গাছ চোখে সুবেশ।
তথ্যসূত্র: খনার বচন কৃষি ও বাঙালী সংস্কৃতি
কৃষকের পরিবারে ধানের গুরুত্ব
কৃষকের জন্য ধান ‘লক্ষ্মী’, সুভাগ্য এবং ধনের প্রতীক । তাই তাঁরা কিছু নিয়ম মেনে চলেন। যেমন জুতা পায়ে ধানের উপর দিয়ে হেঁটে যেতে হয় না তাহলে লক্ষ্মী চলে যায়। আমন ধান শুদ্ধ তাই যেকোন শুভ কাজে আমন ধান ব্যবহার করা হয়। ধানের সাথে দূর্বাকে লক্ষ্মী মনে করা হয় বলে নব বধুকে ধান দূর্বা দিয়ে বরণ করা হয়। নতুন বউ বাড়িতে আসলে শাশুড়ি একটি কুলায় অনেকগুলো দূর্বা ঘাসের সাথে ধান দিয়ে বউ বরণ করে। বউ বরনের সময় মেয়েরা এই কথাগুলো বলেন,
‘ধান লাগে দূর্বা লাগে আরও লাগে হলুদ
সবাইকে নিয়ে সুখে থাক, সুখী হোক জীবন’।
গৃহস্থ বাড়িতে গরু মহিষ কিনলে তার পায়ে ধান, দূর্বা ও তৈল ঢেলে বরণ করেন।
কৃষক যে মাসে গোলায় ধান রাখে, ঐ মাসে গোলা থেকে ধান বের করে না। যদি ঐ মাসে গোলা থেকে ধান বের করে তাহলে লক্ষ্মী থাকে না সংসারে।
কৃষক পরিবারে নারী, স্ত্রী, কন্যা, পুত্রবধু হিসেবে যে গুরুত্ব পায় তার সাথে ধানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। ছেলের বউ বাড়িতে আসার পর বরের বাবা-মা বউকে ১ কেজি ও এক মুঠো ধান মাপতে দেয়, বউ তা সঠিক ভাবে মেপে দেবে, যেন বেশী কম না হয়। এরপর ঐ ধান অর্ধেক পরিমাণ কলসিতে রাখে এবং বাকিটা জমিতে বোনা হয়।
নতুন বউ শ্বশুর বাড়িতে এলে মুরব্বিদের ছালাম করার পর বউ বাবার বাড়ি থেকে আঁচলে বেঁধে যে ধান নিয়ে আসে সেটা শ্বশুর বাড়ির ডোলে ঢেলে দেয়। পরে কুলায় পান সুপারি নিয়ে সবাইকে খেতে দেয়।
সন্তানের জন্ম হলে, যখন ৬ দিন বাচ্চার বয়স তখন দাদি অথবা নানি কুলার মধ্যে ধান দূর্বা নিয়ে বসে এবং পাট বিছিয়ে নাপিত তার উপর বসে বাচ্চার চুল কাটে, তাতে চুল পাটের মতো লম্বা হয়। আবার রাতের বেলায় ওই কুলায় ধান, দুর্বা, কাগজ কলম দিয়ে সারা রাত বাচ্চার পায়ের কাছে রাখে। এতে বাচ্চার ভাগ্য ভাল হয়।
কৃষক যে দিন তার জমিতে প্রথম ধান রোপণ করেন সেদিন ক্ষীর (পায়েশ) রান্না করে পাড়া প্রতিবেশী নিয়ে খেয়ে ধান রোপণ করতে যান। আবার যেদিন ধান কাটা শেষ হয় সে দিন নতুন ধান দিয়ে চিতই পিঠা তৈরি করে খান।
ধান কাটার সময় হলে কৃষকেরা দিনক্ষণ দেখে ধান কাটে। বিশেষ করে শুক্রবার দিনটা বেছে নেয়। কৃষকেরা জমিতে গিয়ে দেখে, যদি শুক্রবারের আগে ধান কাটা যাবে না তাহলে তারা এক গোছা ধান কেটে এনে চালে গুঁজে রাখে। কারণ প্রথম ধান শুক্রবারে কাটলে সংসারে আয় উন্নতি বেশী হয়।
নতুন ধান কাটার আগে মাঠে গিয়ে ধানের ক্ষেত দেখে, যে ধান পেকেছে কিনা। যদি পাকে তখন ক্ষেতের থেকে ইনজা ছিঁড়ে আনে, সেই ধান স্ত্রীকে দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করে ধান কাটা চলে কিনা। স্ত্রী ধান কাটতে বললে কাটবে। আনা ইনজা ক্ষেতের আগ ধান, এটার সাথে বরকত আছে তাই ঘরে ঝুলিয়ে রাখে।
নতুন ধানের ভাত যেদিন রান্না করবে সেই দিন বাড়ির কেউ না খেয়ে আগে তিন চামুচ নিয়ে কলা পাতার মধ্যে আরো তিন মুঠ আতপ চাউল, এক মুঠ কানজির চাউল দিয়ে উঠানের দক্ষিণ পাশে রেখে দেবে। যতক্ষণ পর্যন্ত কাক পাখি না খাবে ততক্ষণ পর্যন্ত নিজেরা কেউ ঐ ভাত খাবে না। কাক পাখি খাওয়ার পর নিজেরা খাবে। তার কারণ হলো কাক পাখিতে খেলে বরকত হয়।
নতুন ধান কাটার পর ঘরে তুলে বেছে ভাল ধান রেখে দেন। তারপর চামারা ধানের মুড়ি ভাজেন। আবার ডেপা, দিঘা ধান ভাল করে শুকিয়ে আতপ চাল করে চিতুই পিঠা তৈরি করে দুধ, খেজুর গুড়, নারিকেল সব এক সাথে জ্বাল করে পিঠাগুলো দুধের মধ্যে ভিজিয়ে রেখে সকালে আত্মীয় স্বজন সবাইকে নিয়ে খুব ধুমধাম করে পিঠা খাবেন। এটাকে নবান্ন উৎসব বলে। এটা করার কারণ হল সারা জীবন যেন আনন্দে কাটে।
নবান্ন সময় যখন মেয়েকে নাইয়র আনে তখন চামারা ধানের মুড়ি নতুন কলসে ভরে কলস সাজিয়ে তার শ্বশুর বাড়ি পাঠায়। যাওয়ার সময় নতুন শাড়ি পরে মুড়ির কলস অন্য একজন মাথায় করে নিয়ে যায়। শ্বশুর বাড়িতে নিয়ে সেই মুড়ি আশেপাশের সবাইকে খেতে দেয়।
নতুন ধান যখন ঢেঁকিতে ভানা হয় তখন হলুদ এবং সরিষা তৈল দিয়ে ধোয়া হয়। তারপর ধান ঢেঁকিতে ভানা হয়।
বিশেষ ধানের ছড়া
আমার বাড়ি যাইও বন্ধু বসতে দিবো পিড়া
জলপান করতে দেব শালি ধানের চিড়া,
শালি ধানের চিড়া দেব বিন্নি ধানের খই
বাড়ির গাছের সবরি কলা গামছা বান্ধা দই ॥
আতা গাছে তোতা পাখি
দলকচু ধানের খই,
সখি, তুমি বলো
পংখিরাজ ধান গেল কই।
শাইলধানের পাতলা চিড়া
বিন্নি ধানের খই
ঘরে আছে তুলসীমালা
পায়সের অভাব কই ॥
পৌষ মাসের মুষ্টি পিঠা
চাপাল ধানের মুড়ি দিয়ে
খাইবো বসে সবাই মিলে ॥
আধুনিক কৃষি ও ধান
১৮৭৬ সালে অবিভক্ত বাংলায় মহাদুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। সেই দুর্ভিক্ষে বাংলায় এক কোটি মানুষ মারা যায়। দুর্ভিক্ষের কারণ খুঁজে বের করার জন্য তৎকালিন বৃটিশ সরকার ১৮৮০ সালে কৃষি কমিশন গঠন করেন। সেই কৃষি কমিশনের পরামর্শ অনুসারে ১৯০৬ সালে কৃষি ফার্ম প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সিদ্ধান্ত অনুসারে ঢাকা ফার্ম প্রতিষ্ঠা করার জন্য ঢাকার শের-ই-বাংলা নগর এলাকায় ১৬১.২০ হেক্টর জমি হুকুম দখল করা হয় এবং ঢাকা ফার্ম নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান ও ভারত স্বাধীন দেশ হয়। তখন বাংলাদেশ অংশের নাম ছিল পূর্ব-পাকিস্তান। পাকিস্তান স্বাধীন হবার কয়েক বছরের মাথায় সামরিক সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে নেয়। সামরিক সরকার সিদ্ধান্ত নেয় পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাজধানী প্রতিষ্ঠার। ফলে ঢাকা ফার্মের জন্য ১৬১.২০ হেক্টর জমি হুকুম দখল করা হয়েছিল, সেটা পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাজধানীর অবকাঠামো নির্মানের জন্য নিয়ে নেয়া হলো।
এ রকম অবস্থা চলছে, সময়কাল ১৯৬২ পর্যন্ত। তৎকালীন পকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান পূর্বপাকিস্তান পরিদর্শনে এলেন। কৃষি ফার্মের বিষয়টি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তারই নির্দেশে ১৯৬৬ সনে ঢাকা শহর থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে জয়দেবপুরে (গাজীপুর) ঢাকা ফার্মের নামে ২৬০ হেক্টর জমি হুকুম দখল করা হয়।
অপরদিকে ১৯৬২ সাল নিবিড় ধান গবেষণা প্রকল্পের মধ্য থেকেই ব্রি’র জন্ম প্রক্রিয়া শুরু হয়। তার ফলশ্রুতিতে ফোর্ড ফাউন্ডেশান, আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (IRRI) এবং বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO) ১৯৬৫ সালে পূর্ব পাকিস্তানে নিবিড় ধান গবেষণা পরিচালনা করার জন্য প্রকল্প অনুমোদন করেন। সে প্রকল্পের নাম ছিল East Pakistan Accelerated Rice Project। প্রকল্প ব্যয় ছিল ৩০ লক্ষ রুপি। প্রকল্প ব্যয় ৩০ লক্ষ রুপির মধ্যে ২০ লক্ষ রুপি ফোর্ড ফাউন্ডেশান দেয়। নিবিড় ধান গবেষণা প্রকল্পের মাধ্যমেই বাংলাদেশে আধুনিক কৃষি প্রবর্তন করা হয়, যা রাসায়নিক কৃষি নামে পরিচিত। এই আধুনিক কৃষির সাথে সুন্দর নাম জুড়ে দেয়া হয় “সবুজ বিপ্লব” ইংরেজিতে (Green Revolution) । সে সময় ধান গবেষণা করার কোন স্থান না পাওয়ায় ১৯৬৬ সালের মার্চ মাসে ঢাকার সাভারে অবস্থিত ডেয়ারি ফার্ম থেকে ২৫ একর জায়গা নিয়ে ধান গবেষণা শুরু হয়। ১৯৬৮ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের নির্দেশে ঢাকা ফার্মের জন্য যে ৬৪২ একর জমি জয়দেবপুর, গাজিপুরে হুকুম দখল করা হয়, সেখান থেকে ৯০ একর জমি শুধু ধান গবেষণার জন্য দিয়ে দেয়া হয়। ১৯৬৯ সালের জুন মাসে সাভার থেকে ধান গবেষণার কাজ জয়দেবপুরে নিয়ে যাওয়া হয়, যা বর্তমানে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট নামে পরিচিত। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার ১৯৭০ সালের প্রথম দিকে ধান গবেষণার জন্য আরো অতিরিক্ত ১৫৫ একর জমি প্রদান করেন। ১৯৭০ সালের ১ লা অক্টোবর থেকে ধান গবেষণার সকল কাজ জয়দেবপুরে করা শুরু হয়। পূর্ব পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (BRRI) নাম ছিল, পূর্ব পাকিস্তান ধান গবেষণা প্রকল্প EPK-RRP)। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর বাংলাদেশ সরকার একে স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা দেয় এবং নাম রাখা হয় বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট বা সংক্ষেপে ব্রি। এই বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে সারা দেশে তথাকথিত উফশী বা উচ্চফলনশীল ধানের প্রবর্তন করা হয়। উফশী ধানের ওপর অতি মাত্রায় গুরুত্ব দেয়া এবং স্থানীয় জাতকে অবহেলা করার কারণে বর্তমানে সিংহভাগ স্থানীয় জাতের ধান হারিয়ে গেছে। উফশীর আর এক না রাসায়নিক সার-কীটনাশক ও সেচ নির্ভর ধান।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি)
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট। সংক্ষেপে ব্রি নামে পরিচিত। আর ইংরেজিতে Bangladesh Rice Research Institute(BRRI)। এটি গাজিপুর জেলা সদরে অবস্থিত। সরকারি ভাবে ১লা অক্টোবর ১৯৭০ এর কার্যক্রম শুরু করলেও প্রকৃতার্থে আর ও অনেক আগে থেকেই (১৯৬২ সাল) এর কার্যক্রম শুরু হয়। এ প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশের স্থানীয় জাতের ধান সংগ্রহ করে উফশী অর্থাৎ উচ্চফলনশীল (High Yielding) ধান উৎপাদন এবং প্রবর্তন করার কাজ করে। এখন এই প্রতিষ্ঠান হাইব্রিড ধান ছাড় করা শুরু করেছে। বাংলাদেশের ১৫০০০ হাজার স্থানীয় জাতের বিপরীতে এই পর্যন্ত ব্রি মাত্র ৫৭টি উফশী জাত এবং ২ টি হাইব্রিড ধান প্রবর্তন করেছে। উফশী এবং হাইব্রিড দুই ধরণের জাতই প্রাকৃতিক পরিবেশ সহনশীল নয়। প্রকৃতির উৎপাদিকা শক্তির পরিবর্তে এ সকল ধান আবাদ করতে হলে রাসায়নিক সার, বিষ এবং সেচ অবশ্যই প্রয়োজন। যা অত্যন্ত ব্যয় বহুল। এই উফশী এবং হাইব্রিড ধানের কারণেই আজ আমাদের স্থানীয় ধানের জাত হারিয়ে গেছে। ধানের জেনেটিক রিসোর্স হারিয়ে যাওয়া মানে একটি দেশ বা জাতি বড় ধরণের হুমকির মধ্যে বসবাস করা। এ দেশের মানুষ সেই বড় ধরণের হুমকির দিকে পড়ে রয়েছে।
আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইরি)
আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, International Rice Research Institute (IRRI)। সংক্ষিপ্ত নাম ‘ইরি’। ইংরেজিতে ১৯৬০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের রকফেলার এবং ফোর্ড ফাউন্ডেশনের আর্থিক সহায়তায় এশিয়া মহাদেশের ফিলিপাইনে এই ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ প্রতিষ্ঠানটি সারা পৃথিবীর ধান উৎপাদনকারী দেশগুলো থেকে বিনা মূল্যে কৃষকদের না জানিয়ে স্থানীয় ধানের জাত সংগ্রহ করে রেখেছে। এখানে প্রায় ৮০ হাজার জাতের ধানের বীজ রাখ আছে। এ প্রতিষ্ঠানটি পৃথিবীর অন্যান্য দেশে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) মতো প্রতিষ্ঠানকে উফশী ও হাইব্রিড ধান উৎপাদনে কারিগরি, ধানের জেনেটিক রিসোর্স নিয়ে গবেষণা, প্রশিক্ষণ এবং আর্থিক সহযোগিতা করে থাকে। এই প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে এশিয়ার কৃষকদের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে, এবং কৃষকদের স্বার্থ বিরোধী কাজ করার কারণে দাবী উঠেছে বন্ধ করে দেবার। বহুজাতিক কোম্পানীর গবেষকরা অতি সহজে এখানে সংগৃহিত ধানের ওপর তাদের দখল দারিত্ব প্রতিষ্ঠা ক রতে পারেন, অথচ এশিয়ার কৃষকরা এই ধান নিতে পারেন না।
আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের জিন ব্যাংকে ধানের মোট জাত সংখ্যা রয়েছে ১০৮২৫৬। এর মধ্যে নিবন্ধনকৃত ধানের সংখ্যা ৮৬,১৯৪টি আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে ধানের জাত সংগ্রহশালা গড়ে উঠেছে বিভিন্ন দেশর ধানের জাত সংগ্রহের মাধ্যমে। যেমন-
ধান বীজ সংগৃহিত দেশের নাম | ধানের জাত সংখ্যা |
ভারত | ১৬০১৩ |
লাওস | ১৫২৮০ |
ইন্দোনেশিয়া | ৮৯৯৩ |
চীন | ৮৫০৭ |
থাইল্যান্ড | ৫৯৮৫ |
বাংলাদেশ | ৫৯২৩ |
ফিলিপাইন | ৫৫১৫ |
কম্বোডিয়া | ৪৯০৮ |
মালয়েশিয়া | ৪০২৮ |
মায়ানমার | ৩৩৩৫ |
ভিয়েতনাম | ৩০৩৯ |
নেপাল | ২৫৪৫ |
শ্রীলঙ্কা | ২১২৩ |
সূত্র: বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফ এ ও) ২০০৩
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি)এর ধানের জাত সংগ্রহ
বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জিন ব্যাংকে ধানের জাত মোট সংগ্রহে রয়েছে ৭৪৩৯। এই ৭৪৩৯ টি ধানের জাতের মধ্যে রয়েছে
ধানের জাত/লাইন | সংগ্রহ সংখ্যা |
স্থানীয় ধানের জাত সংখ্যা (ইন্ডিকা জাত) | ৩৭৮৪ |
পিওর লাইন | ৮৮৯ |
ইরি, চীন, যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য স্থান থেকে | ২৪২৪ |
জাপনিকা জাত | ৯৪ |
ইন্ডিকা ব্রিডিং লাইন | ১৬৮ |
বন্য ধান | ৮০ |
সূত্রঃ রাইস জার্মপ্লাজম ইন জিন ব্যাংক-ব্রি, ব্রুশিয়ার-তারিখ বিহিন
সামাজিক বীজ সম্পদ কেন্দ্র: নয়াকৃষি আন্দোলন, উবিনীগ
নয়াকৃষির কৃষকরা ফসলের বীজ নিরাপত্তার স্বাথ্যে সামাজিক বীজ সম্পদশালা বা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। সামাজিক বীজ সম্পদশালা সরাসরি নয়াকৃষির কৃষকদের দ্বারা পরিচালিত। নয়াকৃষি আন্দোলনের সামাজিক বীজ সম্পদশালায় স্থানীয় ধানের জাত সংগ্রহে রয়েছে ২৩৪৯ (২০০৯ পর্যন্ত)।
নয়াকৃষি আন্দোলনের কৃষকদের বীজ সম্পদ সংরক্ষণ কেন্দ্রের নাম সামাজিক বীজ সম্পদ কেন্দ্র। ইংরেজিতে বলা হয় Community Seed Wealth Center (CSW)। ১৯৯৮ সালে দেশব্যাপি বন্যার ফলে কৃষকরা মারাত্মকভাবে বীজ সমস্যায় পড়লে নয়াকৃষি আন্দোলনের কৃষকরা সামাজিক বীজসম্পদশালা বা বীজসম্পদ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। উদ্দেশ্য অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক গুরুত্বের দিক বিবেচনায় রেখে স্থানীয় জাতের বীজ সংগ্রহ, সংরক্ষণ, পুনরুৎপাদন, অধিক ফলনশীল জাত বাছাই এবং স্থানীয় জাতের বীজের বিস্তার ঘটানো এবং একই সাথে বীজের সঙ্গে জড়িত লোকায়ত সামাজিক জ্ঞান ও সংস্কৃতির তথ্য সংগ্রহ ও চর্চা। এই চর্চার মধ্য দিয়ে কৃষির বিকাশ ঘটানোই উদ্দেশ্য। নয়াকৃষি আন্দোলনের অধীনে কৃষি ব্যবস্থা ও প্রাকৃতিক পরিবেশ অঞ্চল অনুসারে তিনটি সামাজিক বীজ সম্পদ কেন্দ্র রয়েছে। বন্যাপ্রবণ বা বন্যাবিধৌত সমতল এলাকার সামাজিক বীজ সম্পদ কেন্দ্রটি রয়েছে রিদয়পুর বিদ্যাঘর, টাঙ্গাইলে; খরা প্রবণ এলাকার জন্য সামাজিক বীজ সম্পদ কেন্দ্র রয়েছে আরশিনগর বিদ্যাঘর, ঈশ্বরদী, পাবনায় এবং উপকূলীয় ও পাহাড়ী এলাকার জন্য সামাজিক বীজ সম্পদ কেন্দ্র রয়েছে পদ্মাবতী বিদ্যাঘর, চকরিয়া কক্সবাজারে। প্রতিটি সামাজিক বীজ সম্পদ কেন্দ্রের আওতায় রয়েছে কয়েকটি বীজ আখড়া। বীজ আখড়া ইংরেজিতে Seed Hut নামে পরিচিত। বর্তমানে রিদয়পুর বিদ্যাঘরের আওতায় ৭টি বীজ আখড়া,আরশীনগর বিদ্যাঘরের আওতায় ৩টি বীজ আখড়া এবং পদ্মাবতী বিদ্যাঘরের আওতায় ৩টি বীজ আখড়া এবং আখড়াবাড়ি কুষ্টিয়া কেন্দ্রের আওতায় ৩টি বীজ আখড়া সক্রিয় রয়েছে।
নয়াকৃষি আন্দোলনের বীজ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম পরিচালিত হয় তিনটি ধাপে। প্রথম ধাপে কৃষক পরিবার, দ্বিতীয় ধাপে বীজ আখড়া এবং তৃতীয় ধাপে সামাজিক বীজ সম্পদ কেন্দ্র। বীজ আখড়ার অবস্থান কৃষকদের গ্রামে। নয়াকৃষির কৃষকদের সংগৃহিত বীজের একটি অংশ কৃষক নিজ সংগ্রহে রাখবেন, একটি অংশ গ্রামে অবস্থিত বীজ আখড়ায় সংরক্ষণ করা হয় এবং আর একটি অংশ সামাজিক বীজ সম্পদ কেন্দ্রে সংরক্ষণ করা হয়। নয়াকৃষি আন্দোলনের সার্বিক বীজ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম পরিচালনা করেন নয়াকৃষি বীজ সংঘের (ইংরেজীতে Nayakrishi Seed Network (NSN)) সদস্যগণ। প্রতিটি সামাজিক বীজ সম্পদ কেন্দ্রের আওতায় আলাদা আলাদাভাবে নয়াকৃষি বীজ নেটওয়ার্কের সদস্য রয়েছেন। সারা দেশে এ পর্যন্ত (২০১০) ১৯টি জেলা, ৭৩টি উপজেলা, ১৬৬টি ইউনিয়ন এবং ৬৭৭টি গ্রামে সরাসরি নয়াকৃষি বীজ সংঘের কার্যক্রম অব্যহত রয়েছে। দিনে দিনে নতুন নতুন এলাকায় নয়াকৃষি এবং নয়াকৃষি বীজ সংঘের কার্যক্রম সম্প্রসারিত হচ্ছে।
নয়াকৃষি সামাজিক বীজ সম্পদ কেন্দ্রের সংগ্রহ
মৌসুম ভিত্তিক ধানের জাত সংখ্যা
স্থান | আউশ | আমন | বোরো |
রিদয়পুর বিদ্যাঘর | ৪৪ | ১৬৭৩ | ২২ |
আরশিনগর বিদ্যাঘর | ২৯ | ৬৮৭ | ১৪ |
পদ্মাবতী বিদ্যাঘর | ২৬ | ৪৯১ | ১২ |
আবহাওয়া ও জলবায়ু সহিষ্ণু ধানের জাত
স্থান |
খড়া সহিষ্ণু |
লবন সহিষ্ণু |
পানি সহিষ্ণু |
রিদয়পুর বিদ্যাঘর | ৪৬ |
৯ |
১৯ |
আরশিনগর বিদ্যাঘর | ২৯ | ৮ | ৬০ |
পদ্মাবতী বিদ্যাঘর | ২৩ | ২৮ | ৭৭ |
ধানের রকমারী খাদ্য
স্থান | সুগন্ধি | মুড়ি | খই | চিড়া | পিঠা |
রিদয়পুর বিদ্যাঘর | ১৯ | ৪৩ | ৬৭ | ৪৮ | ৫৩ |
আরশিনগর বিদ্যাঘর | ২৩ | ২৫ | ১৮ | ৩৩ | ৩৮ |
পদ্মাবতী বিদ্যাঘর | ২১ | ৪৩ | ১৬ | ২৫ | ৩৫ |
নয়াকৃষি পর্যবেক্ষণ: স্থানীয় জাতের ধানের বর্তমান অবস্থা
স্থান | নিরাপদ | ঝুঁকিপূর্ণ | বিলুপ্ত |
রিদয়পুর বিদ্যাঘর | ৩৫০ | ৩০৯ | ৮৭২ |
আরশিনগর বিদ্যাঘর | ৫৫ | ৪৪৮ | ৫৭ |
পদ্মাবতী বিদ্যাঘর | ৩৪ | ৩৭ | ২৮৭ |
বিলুপ্তপ্রায় (Endangered): বিলুপ্তপ্রায় (Endangered) বলতে এখানে সেই রকম ধানের জাত গুলোকে বুঝানো হয়েছে যে জাত গুলিপ্রায় এক সময় বাংলাদেশে চাষ হতো কিন্তু এখন চাষ হয়না এবং যে ধানের জাত গুলি কৃষকের কাছ থেকে হারিয়ে গেছে এবং আমাদের কাছে সামান্য পরিমানে আছে এই জাতগুলো আমরা বিলুপ্তপ্রায় (Endangered) হিসেবে চিহ্নিত করেছি।
ঝুঁকিপুর্ণ (At Risk): ঝুঁকিপুর্ণ (At Risk): বলতে এখানে সেই জাতের ধানগুলোকে বোঝানো হয়েছে যে জাত গুলো আমাদের জানা মতে বর্তমানে কৃষক পর্যায়ে নেই, তারা জাত গুলি হারিয়ে ফেলেছে কিন্তু আমাদের কাছে এই জাতগুলি একটু বেশি পরিমানে আছে সেগুলোকে আমরা ঝুঁকিপুর্ণ (At Risk): হিসেবে চিহ্নিত করেছি।
নিরাপদ (Secure): নিরাপদ (Secure): বলতে এখানে সেই সকল ধানের জাতকে বুঝানো হয়েছে যে জাতগুলো কৃষকরা বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এখনও চাষ করে এবং আমাদের কাছে জাতগুলি আছে এই জাতগুলি নিরাপদে আছে সেগুলোকে আমরা নিরাপদ (Secure) হিসেবে চিহ্নিত করেছি।
উচ্চফলনশীল, হাইব্রিড ও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং পদ্ধতিতে বানানো ‘জিই’ বা ‘জিএমও’ ধান কি?
উচ্চফলনশীল ধান:
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (BRRI) থেকে যে সকল ধানের জাত চাষাবাদের জন্য প্রবর্তন করা হয়েছে সে সকল ধানের জাতকে উচ্চফলনশীল ধান বলা হয়। উচ্চফলনশীলকে সংক্ষেপে “উফশী” ধান বলা হয়। আর ইংরেজিতে বলা হয় High Yielding Rice (HYV)।
বিজ্ঞানীরা একটি ধানের জাতের সঙ্গে এক বা একাধিক জাতের মিলন বা সংকরায়ন করে যে সকল ধানের জাত বের করে সেই পদ্ধতিতে তৈরি করা ধানের জাতকে উচ্চফলনশীল ধান বলা হয়। মনে রাখতে হবে এই ধানের জাউ হাওয়া থেকে তৈরী হয় নি, কৃষকদের ঘরে কৃষকেরই মাঠে আবিষ্কৃত ধান থেকে ‘উফশী’ ধান তৈরী করা হয়েছে। এই ক্ষেত্রে কৃষকের অবদান প্রাথমিক ও মৌলিক।
বাংলাদেশে উচ্চফলনশীল ধানের জাতের মধ্যে রয়েছে, বিআর-১ (চান্দিনা), বিআর-২ (মালা), বিপ্লব, ব্রিশাইল, দুলাভোগ, ব্রিবালাম, আশা, সুফলা, বিআর-১১, ময়না, গাজী, মোহনী, শাহীবালাম, হাসি, শাহজালাল, মঙ্গল, দিশারী, বিআর-২৬, ব্রিধান-২৭, ব্রিধান-২৮, ব্রিধান-২৯, ব্রিধান-৩০, ব্রিধান-৩১, ব্রিধান-৩২, বিধান-৩৩, ব্রিধান-৩৪ ইত্যাদি।
প্রথম উচ্চফলনশীল ধান তৈরি করে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (IRRI)। ইরির প্রখ্যাত উচ্চফলনশীল ধানের জাতের নাম হচ্ছে আই আর-৮।
উচ্চফলনশীল ধানের জাত তৈরি এবং প্রবর্তন করার প্রধান উদ্দেশ্য কৃষকদের হাত থেকে তাদের নিজস্ব শস্য বীজ কেড়ে নেয়া। উচ্চফলনশীল ধানের জাত প্রাকৃতিক বৈরি আবহাওয়া ও জলবায়ু সহ্য করতে পারে না। এটা একটি প্যাকেজ প্রোগাম। কেননা এ ধান চাষাবাদ করতে হলে রাসায়নিক সার, বিষ, ভূগর্ভস্থ পানির সেচ লাগে। উফশী ধানের বীজের কারণে কৃষকদের কাছে সার, বিষ, পানি বিক্রির ব্যবসা করা হয়। উচ্চফলনশীল ধানের কারণে সবচেয়ে মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে-সেটা হলো স্থানীয় ধানের জাতের যে বিশাল বৈচিত্র্য ছিল তা হারিয়ে গেছে। এককাট্টা উফশী ধান চাষাবাদ করার কারণে দেশের প্রকৃত ফসলচক্র পরিবর্তন হয়ে গেছে। কিন্তু বাস্তবে উচ্চশলনশীল ধানের ফলন বাড়ে নাই।
হাইব্রিড ধান:
সাধারণভাবে সহজাত একই জাতের দুইটি জাতের সংকরায়নের ফলে যে নতুন জাত সৃষ্টি করা হয় তাকে হাইব্রিড ধান বলা হয়। তবে শর্ত হচ্ছে হাইব্রিড সংকরায়ন করার জন্য প্রয়োজন অসম জনন শক্তি। একে বৈজ্ঞানিক ভাষায় বলা হয় হাইব্রিড ভিগর। যখন একই প্রজাতির বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ জাতের মধ্যে সংকরায়ন করা হয় তখন এ সংকরের মধ্যে উচ্চতর ফলন বা সংকর সাবল্য বিকশিত হয়।
অবশ্য এই সংকর জাতের প্রথম বছর বাড়তি ফলন ক্ষমতা প্রথম প্রজন্মের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আশা করা যায় কিন্তু পরবর্তী ফলন কম হয়ে থাকে। এটা একটি জটিল পদ্ধতি ফলে যে কেউ ইচ্ছা করলেই করতে পারেন না। এটিও একটি প্যাকেজ প্রোগ্রাম। হাইব্রিড ধান আবাদ করতেও রাসায়নিক সার, বিষ, ভূগর্ভস্থ পানির সেচ প্রচুর দরকার হয়। হাইব্রিড ধানের বীজ কৃষকরা আগামি মৌসুমে চাষাবাদের জন্য নিজ হতে রাখতে পারবেন না। হাইব্রিড ধান প্রবর্তনের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে ব্যবসা।
উত্তর আমেরিকায় হাইব্রিড ভুট্টার সাফল্যে অনুপ্রাণীত হয়ে চীনের গবেষকরা ১৯৭০ সালে হাইব্রিড ধান তৈরির গবেষণায় মনোনিবেশ করেন। প্রথমে তারা ধানের আদি জাতের মধ্যে পুরুষ বন্ধ্যাত্ব খুঁজে বের করেন। এরপর ধানের আবাদী জাতের মধ্যে পুরুষ বন্ধ্যাত্ব সংযোজনের চেষ্টা করেন। এভাবে পুরুষবন্ধ্যাত্ব ব্যবহার উপযোগী হয়। উদ্ভাবিত এ লাইনকে বলা হয় পুরুষবন্ধ্যাত্ব সংরক্ষণকারী লাইন। সংকরায়নের এ পদ্ধতিকে বলা হয় সাইটোপ্লাজমীয় কৌলিক পুংবন্ধ্যাত্ব পদ্ধতি। অন্য লাইনকে বলা হয় উর্বর পুনস্থাপক লাইন বা আর লাইন। আর লাইন হলো একটি পরাগায়ক জাত দ্বারা সিএমএস লাইন পরাগায়ন করে হাইব্রিড বীজ উৎপাদন করা।
কৃষকরা ফসল উৎপাদনের জন্য হাইব্রিডজাত ব্যবহার করতে পারেন তবে হাইব্রিড ধান এমন ভাবে তৈরি করা হয় পরবর্তী মৌসুমে কৃষক আবাদের জন্য বীজ রাখতে পারেন না। ফলে বারবার কৃষককে কম্পানির কাছেই বীজের জন্য ফিরে আসতে হয়। হাইব্রিড ধান/শস্য প্রথম প্রজন্মে অধিক ফলন আশা করা যায় কিন্তু পরবর্তী প্রজন্ম থেকে ফলন কমতে থাকে।
হাইব্রিড ধান কোন রকম প্রাকৃতিক বৈরিতা সহ্য করতে পারে না। ফলে বাংলাদেশের পরিবর্তনশীল আবহাওয়া এবং জলবায়ুতে টিকে থাকে না পারায় ফলন মারাত্মক রকম কমে যায় অথবা একেবারেই নষ্ট হয়ে যায়।
বাংলাদেশে হাইব্রিড ধানের নামগুলো হচ্ছে, বিজয়, সোনার বাংলা-১, সোনার বাংলা-৬, হিরা-১, হিরা-২, ময়না, টিয়া, গোল্ড, রাইচার-১০১, তাজ-১, তাজ-২, এসিআই-১, এসিআই-২, জাগরন, রাইসার, চমক, আলোড়ন, ডায়ামন্ড, কহিনূর, আলোক-৬২০১, লোকনাথ, অমরশ্রী, ব্রি-হাইব্রিড ধান-১, ব্রি-হাইব্রিড ধান-২, শক্তি, এলপি-৫০, এলপি-৭০, এলপি-১০৮, এলপি-১০৬, এলপি-৫, মানিক-২, রাজকুমার, কিষাণ, এগ্রোজি-১, তিনপাতা-৪০, এইচটিএম-৬, এইচটিএম-৭০৭, সুরমা-৩, সুরমা-১, তিনপাতা-১০, তিনপাতা সুপার ইত্যাদি।
জি ই ধান:
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বা সক্ষেপে ‘জিই’ ইংরেজি শব্দ। এটা একটি প্রযুক্তি। যেকোন উদ্ভিদ/শস্যের নতুন জাত তৈরির কাজে এ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। এ প্রযুক্তি অত্যন্ত জটিল এবং মারাত্মক বিপদজনক। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভুট্টা, সয়াবিন, গম, ধানসহ বিভিন্ন ফসলের নতুন জাত উন্নত দেশগুলোর বহুজাতিক কোম্পানিগুলো তৈরি করে বাজার জাত করছে। জেনেটিক Organism বা সংক্ষেপে জিএমও (GMO) বলা হয়।
সহজ কথায় জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং প্রযুক্তি এমন এক প্রযুক্তি যা বীজের প্রাণকোষে এমন এক জেনেটিক কোড ঢুকিয়ে দেয়ার কারিগরী যার ফলে ঐ বীজের প্রজনন ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। এর ফলে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করা যে কোন বীজ একবার লাগালে এর ফসল থেকে পরবর্তী ফসলের জন্য বীজ নেয়া/রাখা যাবে না। এর মানে হচ্ছে, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর প্রধান উদ্দেশ্যই হচ্ছে কৃষক যেন নিজের ফসলের বীজ নিজে সংগ্রহ করতে না পারে তা নিশ্চিত করা।
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং পদ্ধতিতে ধানের যে জাত তৈরি করে বাংলাদেশে প্রবর্তনের চেষ্টা করা হচ্ছে তাকেই সক্ষেপে ‘জি-ই ধান’ বলা হয়। প্রথম যে জিই ধানের কথা শোনা গেছে তার নাম হচ্ছে গোল্ডেন রাইস বা ভিটামিন-এ সমৃদ্ধ্ব ধান। এরপর বলা হচ্ছে লবণাক্ততা সহন শীল, খরা সহনশীল ধান, ইত্যাদি। এ ধানগুলো এখনও গবেষণা পর্যায়ে রয়েছে এবং এর কার্যকারিতা, পরিবেশের ওপর প্রভাব, এবং মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব সম্পর্কে কিছুই জানা যায় নি।
জি ধানের বিষয়ে আরও একটি বড় উদ্বেগের কারণ হচ্ছে এই বীজ বহুজাতিক কোম্পানী পেটেন্ট করে বাজারে ছাড়ে। অর্থাৎ হাজার বছরের ধানের কোন একটি জাতে সামান্য জিনগত পরিবর্তন ঘটিয়ে তারা নিজেদের নামে পেটেন্ট করে। অথচ দেশীয় ধানের হাজার জাত কৃষকরা শত বছর ধরে উদ্ভাবন করলেও পেটেন্ট করেননি। পেটেন্ট করা ধান কোনভাবেই কৃষকের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
উফশী এবং হাইব্রিড ধানে অতিরিক্ত বিষের ব্যবহার
এদেশে আধুনিক কৃষি পদ্ধতিতে ধান আবাদের পূর্বে ধান চাষাবাদে কোন রকম রাসায়নিক সার বা বিষ ব্যবহার করা হতো না। এ দেশে উফশী এবং হাইব্রিড ধানের জাত প্রবর্তনের সাথে একটি প্যাকেজ প্রোগ্রাম কৃষকের হাতে ধরে দেয়া হয়। সেই প্যাকেজ প্রোগ্রামে উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে-উফশী ধান চাষাবাদ করতে হলে রাসায়নিক বিষ ব্যবহার করতে হবে। আমরা পুষ্টি সমৃদ্ধ খাদ্যের কথা বলি, রাসায়নিক বিষ দিয়ে চাষাবাদ করা চালের ভাত কি পুষ্টি সমৃদ্ধ। উফশী এবং হাইব্রিড ধান বিভিন্ন ধরণের কীটপতঙ্গ ও রোগবালাইয়ে আক্রান্ত হয়ে থাকে। উফশী এবং হাইব্রিড ধানের কীট-পতঙ্গ নিয়ন্ত্রণের জন্য যে সকল রাসায়নিক বিষ ব্যবহার করা হয়ে থাকে সে সব রাসায়নিক বিষের নাম হচ্ছে-
নং | বাংলায় রাসায়নিক বিষের নাম | ইংরেজিতে রাসায়নিক বিষের নাম |
১ | ফসফামাইডন-১০০ | Posphamidon-100 |
২ | ডাইক্রটোফস-৮৫ | Dicrotophos-85 |
৩ | মনোক্রটোফস-৮০ | Monocrotophos-80 |
৪ | ডায়াজিনন-৬০ | Diazinon-60 |
৫ | ফেনাথোয়েট-৫০ | Phenthoate-50 |
৬ | ফেনথিয়ন-৫০ | Fenthion-50 |
৭ | ফেনিট্রেথিয়ন-৫০ | Fenitrethion-50 |
৮ | কুইনালফস-২৫ |
Quinalphos-25 |
৯ | কার্বোসালফান-২০ | Carbosulfan-20 |
১০ | ক্লোরোপাইরিফস-২০ | Chloropiriphos-20 |
১১ | কারটাপ-৫০ | Cartuf |
১২ | ডায়জিনন-১৪ | Diazinon-14 |
১৩ | ডায়জিনন-১০ |
Diazinon-10 |
১৪ | কুনালফস-০৫ | Quinalphos-05 |
১৫ | কার্বোফুরান-০৩ | Carbofuran-03G |
১৬ | কার্বোফুরান-০৫ | Carbofuran-05 |
১৭ | ফেনথোয়েট-০৫ |
Phenthoate-05 |
১৮ | ডাইমোথোয়েট-৪০ | Dimothoate-40 |
১৯ | ফেনিট্রোথিয়ন-৫০ | Fenitrothion-50 |
২০ | ম্যালাথিয়ন-৫৭ | Malathion-57 |
২১ | অক্সিডিমেটন মিথাইল-২৫ | Oxydematon mithyl-25 |
২২ | ফজালোন-৩৫ |
Fazalon-35 |
২৩ | ফেনথিয়ন-৫০ | Fenthion-50 |
২৪ | ডায়াজিনন-৬০ | Diazinon-60 |
২৫ | ডাইক্লোরভস-১০০ | Dichlorvos-100 |
২৬ | ফসফামিডন-১০০ |
Posphamidon-100 |
২৭ | সাইপারমেথ্রিন-১০ | Cypermethrin-10 |
২৮ | আলফামেথ্রিন-০২ | Alphamethrin-02 |
২৯ | ফেনভেলারেট-২০ | Fenvelarate-20 |
৩০ | কার্বোসালফান-২০ | Carbosulfan-20 |
৩১ | মনোক্রটোফস-৪০ |
Monocrotophos-40 |
৩২ | কুইনালফস-২৫ | Quinalphos-25 |
৩৩ | পিরিমিফস মিথাইল-৫০ | Pirimiphos mithyl-50 |
৩৪ | কারবারিল-৮০ | Carbaril-80 |
৩৫ | এম আই পি সি-৭৫ | MIPC-75 |
৩৫ | এস ফেনভেলারেট-০৫ | S Fenvelarate-05 |
৩৭ | সাইপারমেথ্রিন-১০ |
Cypermethrin-10 |
৩৮ | কারবারিল-৮৫ | Carbaryl-85 |
৩৯ | ডায়াজিনন-১০০ | Diazinon-100 |
৪০ | ফরমোথিয়ন-২৫ | Formothion-25 |
৪১ | সাইপারমেথ্রিন-১০০ |
Cypermethrin-100 |
৪২ | বি পি এম সি-৫০ | BPMC-50 |
৪৩ | ডি ডি ভি পি-১০০ | DDVP-100 |
৪৪ | কারবারিল-৮০ | Carbaryl-80 |
৪৫ | ক্লোরপাইরিফস মিথাইল-২৫ | Chlorpyriphos methul |
৪৬ | এম আই পি সি-৭৫ | MIPC-75 |
৪৭ | ফেনিট্রোথিয়ন-০৩ | Fenitrothion-03 |
৪৮ | মেথামিডিফস-৪০০ | Methamidiphos-400 |
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ কীট নাশকের বাজারী নামের পরিবর্তে জেনেরিক নাম ব্যবহার করা হলো।
সূত্রঃ আধুনিক ধানের চাষ বাংরাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) গাজিপুর-১৭০১