আবদুল খালেক দেওয়ান 


সাধক, কবি ও শিল্পী খালেক দেওয়ান ঢাকা জেলার কেরানীগঞ্জ থানার শাক্তা ইউনিয়নের বামনসুর গ্রামে ১৩১৬ সালের ১২ই ফাল্গুন জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আলেপ চান্দ শাহ্ ওরফে আলফু দেওয়ান নিজেও একজন সাধকপুরুষ ছিলেন। তাঁর মা বিবরন নেসা ছিলেন একজন গুণী মহিলা। বাবামায়ের তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে সবার বড় ছিলেন আব্দুল মালেক দেওয়ান (জন্ম ১৩০১)। মালেক দেওয়ানও বাংলাদেশের আরেকজন স্বনামধন্য শিল্পী। দ্বিতীয়জন ফাতেমা বেগম (জন্ম-১৩০৮ বঙ্গাব্দ) আবদুল খালেক দেওয়ান তৃতীয় ও সর্বকনিষ্ঠ। আলফু দেওয়ানের পিতা ইসমাইল দেওয়ান এবং মা করিমন নেসার দুই ছেলে এক মেয়ের মধ্যে আলফু দেওয়ান ছিলেন সবার বড় এবং তাঁর ভাই ইসহাক দেওয়ান সবার ছোট ছিলেন।

কিশোর খালেক স্থানীয় নয়াবাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাঁর শিক্ষা জীবন শুরু করেন। গ্রামের মাদ্রাসায় তিনি আরবি শিখে কিশোর বয়সেই সুরেলা কন্ঠে কোরান শরিফ পড়ে বড়োদের মুগ্ধ করেছেন। শিশু-কিশোর বয়স থেকেই তার স্মৃতিশক্তির ক্ষমতা দেখে অনেকে বিস্মিত হয়েছেন। যে কোন গান একবার শুনলেই তিনি মুখস্থ বলতে পারতেন। কোন পড়া একবার মাত্র পড়লেই তাঁর মনে থাকতো। এভাবে প্রতি শ্রেণীতে প্রথম স্থান পেয়ে তিনি তাঁর শিক্ষা জীবনের প্রাথমিক পর্ব পার করেন। আবদুল খালেক তৃতীয় শ্রেণীতে পড়বার সময় তার পিতা আলফু দেওয়ান তাঁর বড় ছেলে আবদুল মালেক দেওয়ানকে সাধন ধারার সঙ্গীতে তালিম দিয়ে, পেশাগতভাবে গান গাইবার অনুমতি দিয়ে, নিজে পেশাগত গান ছেড়ে দেন।

কিশোর খালেক দুরস্ত ছিলেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি ছাড়িয়ে তিনি পড়তে যান "কালিন্দি উচ্চ বিদ্যালয়ে"। সেই সময় তার এলাকার তরুণ সম্প্রদায় একটি শৌখিন যাত্রাদল গঠন করে। আবদুল খালেক এ যাত্রাদলে যোগ দিয়ে নানা ধরণের অভিনয় আরম্ভ করেন। এতে তার লেখাপড়া ব্যাহত হয়। দূরন্ত আব্দুল খালেকের পাঠে অমনোযোগিতায় বাবা আলফু দেওয়ান খুবই রাগ করেন। এলাকার ছেলেদের প্রভাব থেকে মুক্ত রাখার জন্য তিনি কিশোর মালেককে ১৩৩২ সালের শেষের দিকে আসামের চাউলখোয়ায় তাঁর ভক্ত নবাবজানের কাছে পাঠিয়ে দেন।

চাউলখোয়া পৌঁছে নবাবজানের সাথে দেখা করে সাধক আলফুজানের নিজের জবানীতে লেখা চিঠি দেওয়ায়, নবাবজান আনন্দে আত্মহারা হয়ে যান। নবাবজানের বাড়িতে অতি আদরের সঙ্গে কিশোর খালেক গৃহীত হন। সেখানেই তাঁর থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হয়। নবাবজান ছিলেন পিরহেজগার এবং নামাজী মোমিন। তিনি তাঁর স্ত্রীকেও নামাজ ও ইসলামের বিধি বিধান শিখিয়েছিলেন। আসামে পৌঁছার কয়েক দিন পর রোজা শুরু হয়। আবদুল খালেকও নবাবজান ও তার পরিবারের সাথে রোজা রাখা ও পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া শুরু করলেন। এগুলো কিশোর মালেক আগে থেকেই জানতেন। কিছুদিন পার হবার পর নবাবজান তাঁকে রাস্তার পাশে একটি মুদি মনোহারী দোকান নিয়ে দিলেন। আবদুল খালেকও ক্রমেই দোকানি হয়ে উঠলেন। সপ্তাহে দুইদিন হাট থেকে মালপত্র কিনে এনে দোকানদারি করতে লাগলেন। সপ্তাহ শেষে ছুটির দিনে চা বাগানে বিভিন্ন প্রসাধন সামগ্রী ফেরি করে বেচতেও লাগলেন। এর সাথে সাথে চললো নামাজসহ শরীয়তের যাবতীয় আদেশ ও নিষেধ পালন করা।

স্থানীয় এক চা বাগানে একজন বাঙালী ডাক্তার থাকতেন। তাঁর দু'টি মেয়ে ছিল। ডাক্তার সাহেবের সঙ্গীতের প্রতি বিশেষ ঝোঁক থাকাতে তাঁর মেয়ে দু'টির জন্য একজন গানের ওস্তাদ রেখে দিয়েছিলেন। সেই ওস্তাদজী আসতেন ডিব্রিুগড় থেকে সাপ্তাহিক ছুটির দিন। আবদুল খালেক ব্যবসায়িক কাজে (ফেরি করা) ঐ ছুটির দিনগুলোতে ডাক্তার সাহেবের বাড়ি যেতেন। সেখানে একটি বকুল বাগান ছিল। সেখানে বলেই আবদুল খালেক তার পণ্য সামগ্রী বিক্রি করতেন। আর ডাক্তার সাহেবের মেয়েদের ওস্তাদজী যে গানে তালিম নিতেন তিনি তা গভীর মনোযোগের সঙ্গে শুনতেন। এভাবে ঐ মেয়ে দুটির সা রে গা মা দেখতে দেখতে অনেক দিন কেটে গেল। ওস্তাদজী মাঝে মাঝেই তাঁকে খেয়াল করতেন। একদিন হঠাৎ ওস্তাদজী জানতে চাইলেন যে, এই কিশোর কী চায়। কেন এভাবে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকে। উত্তরে আবদুল খালেক জানালেন, গান তার খুব ভালো লাগে এবং সে গান শিখতে চায়। সুযোগ পেয়ে ওস্তাদজীকে গান শেখাবার জন্য খালেক অনুরোধ করলো।

ওস্তাদজীর সেই মেয়েদের শেখানোর মত করে খালেক নিজেই হারমোনিয়ান বাজানোর চেষ্টা করতেন। পিতা আলফু দেওয়ান আর বড় ভাই মালেক দেওয়ানের সাহচর্যে সুর সম্পর্কে খালেকের ধারণা ছিল খুব ছোট বয়সেই। ফলে ওস্তাদজীর দেখানো সা-রে-গা-মা তিনি প্রথম দিনেই শিখে ফেললেন। এরপর চেষ্টা চললো গান বাজানোর জন্য। তাঁর দৈনিক রুটিনটাই এমন হলো যে সারাদিন দোকান করা এবং রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর হারমোনিয়াম নিয়ে বসা। ইতোমধ্যে তার নামাজ পড়াও হচ্ছে ওয়াক্ত মত।

এভাবে মাস খানেকের প্রচেষ্টায় আবদুল খালেক গান তুলতে পারলেন এবং হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাওয়াও তাঁর শেখা হয়ে গেল। একদিন ছুটির দিনে সেই ওস্তাদজীর সঙ্গে খালেকের দোকানের সামনেই দেখা হয়ে গেল। তিনি বিনয়ের সঙ্গে ওস্তাদজীকে তার ঘরে নিয়ে তার হারমোনিয়ানটা দেখালেন। এবং সা. কে, গা, মা গেয়েও শোনালেন। শেষে এমনকি হারমোনিয়াম বাজিয়ে একটি গানও খালেক শুনিয়ে ফেললেন। গানটি ছিল:

“তুমি যে গিয়াছ বকুল বিছান পথে।’’

গান শুনে ওস্তাদজী ধারণা হোল আবদুল খালেক আগে থেকেই গান গাইতে পারে। আবদুল খালেক তাকে বিশ্বাস করাতেই পারলো না যে, সে ওস্তাদজীর সা রে গা মা শুনে এবং দেখে দেখে রীড টিপে টিপে হারমোনিয়াম বাজাতে শিখেছে। খালেদ জিদ ধরলে ওস্তাদজী তাকে "ঢাকাইয়া বাটপার” বলে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। কিন্তু এভাবেই খালেকের সাধনা চলতে লাগলো। রাতের সঙ্গীত সাধনাও চলতে লাগলো অব্যাহত।

১৩৩৭ সালের শুরুর দিকে আলফু দেওয়ান আসানে হাজির হন। সেখানে একদিন অবস্থান করে আবদুল খালেককে তিনি আবার তাঁর নিজের গ্রামে নিয়ে আসেন।

সেই সময় গান গাইবার সময় বাংলাদেশে হারমোনিয়ামের কোন প্রচলন ছিল না। কলকাতার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উত্থান এবং “আধুনিক গানের দাপট বৃদ্ধির অনেক পরে হারমোনিয়ান বাঙালির সংস্কৃতি চর্চার প্রধান একটি যন্ত্র হয়ে উঠেছে। তারের যন্ত্র হিসাবে একতারা এবং সারিন্দা ছিল প্রধান যন্ত্র। যারা তারযন্ত্রে দক্ষ ছিলেন তাঁরা বেহালা দিয়ে গান গাইতে পছন্দ করতেন। প্রতিষ্ঠিত লোকগায়কদের মধ্যে বেহালার আদর ছিল। একদিন আলফু দেওয়ান আবদুল খালেককে বললেন, যে হারমোনিয়ামটা আসাম থেকে আনা হয়েছে তার সাথে বেহালার ঠাঁট মেলাতে বা সুরে বাধতে। আবদুল খালেক হারমোনিয়াম নিয়ে বসেন আর বড় ভাই আবদুল মালেক দেওয়ান বসেন বেহালা নিয়ে। আলফু দেওয়ান, নিজেই ঠাট করে দেন বেহালা। এরপর আবদুল মালেক দেওয়ান হারমোনিয়ান ও বেহালার সুরে গান শোনান তাঁর পিতাকে। আবদুল মালেক দেওয়ান তখন বাংলার একজন প্রতিষ্ঠিত "বাউল গায়ক ছিলেন। তাঁর খ্যাতি তখন বেশ। হারমোনিয়ামের সুরে গান পরিবেশন আরো সাবলীল হয় দেখে আলতু দেওয়ান আবদুল মালেক দেওয়ানকে আবদুল খালেককে তার দলে অন্তর্ভুক্ত করে নেবার জন্য বললেন। আবদুল মালেক দেওয়ান তাকে দোহার হিসেবে দলে নিলেন।

বড় ভাই আবদুল মালেক দেওয়ানের সাথে প্রতি রাত্রেই দোহার হয়ে শুরু হোল আবদুল খালেকের গায়কী জীবন। দুই বৎসর টানা দোহারী করার পর আবদুল খালেক নিজেও গান গাইতে শিখলেন। মাঝে মাঝে বিভিন্ন গানের আসরে আবদুল মালেক দেওয়ানের গানের ফাঁকে তিনি নিজের লেখা ভজনও পরিবেশন করতেন। বড় ভাই আবদুল মালেক দেওয়ানের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এবং পিতা আলফু দেওয়ানের আশীর্বাদে ক্রমেই তিনি একজন দোহারী থেকে গায়কে পরিণত হয়ে উঠলেন। রেডিওতে তিনি প্রথম যে গান করেন তার কলিটি হচ্ছে: “আমার দেহতরী ভাসাইলাম দয়াল তোমারই নামে

(তথ্য সংগ্রহের উৎস: নবপ্রাণ আন্দোলন এবং খালেক দেওয়ান গীতিসমগ্র, সম্পাদনা হাসনুল কবীর, খালেক দেওয়ান ফাউন্ডেশন, বইমেলা ১৯৯৯)

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।