বাণিজ্যিক গাছ দিয়ে বন হয় না sdf
উবিনীগ ও নয়াকৃষি আন্দোলন || Saturday 21 May 2011 ||
প্রাকৃতিক বন রক্ষা করুন
ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিওতে ১৯৯২ সালে বিশ্ব পরিবেশ সম্মেলনে প্রাণবৈচিত্র্য সনদ বা Convention on Biological Diversity (CBD) গৃহিত হয়েছে। কিন্তু তার আগে এর প্র্রস্তুতির কাজ হয়েছে মে মাসে নাইরোবীতে; নাইরোবী ফাইনাল এ্যক্ট অব দা কনফারেন্স ২২ মে, ১৯৯২ তারিখে এই সনদের বক্তব্য অনুমোদন করে। সেই দিনকেই বিশ্ব প্রাণবৈচিত্র্য দিবস হিশেবে পালন করা হয়। আর বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালন করা হয় ৫ জ়ুন, যে দিন রিও ডি জেনেরিওতে বিশ্ব পরিবেশ সম্মেলনে প্রাণবৈচিত্র্য সনদ স্বাক্ষরিত হয়। পরিবেশ দিবসে অন্যান্য অনেক বিষয় আসে, কিন্তু প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংসের প্রক্রিয়া ভয়াবহ ভাবে অব্যাহত রয়েছে বলে যে কোন পরিবেশবাদীর জন্য এই দিনটি খুব তাৎপর্যপুর্ণ। অথচ আমরা দেখছি, প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষার বিষয়টি গৌন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এ বিষয়টি খুব উদ্বেগজনক। বছরে অন্যান্য দিন গুলো যেভাবে পালিত হয় বিশ্ব প্রাণবৈচিত্র্য দিবস সরকারের কর্মসুচীতে এখনো সেভাবে গুরুত্ব পায় নি। আমাদের পরিবেশ মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে বেশ উদাসীন।
জাতি সংঘের পরিবেশ কর্মসুচী (UNEP) এবং প্রাণ বৈচিত্র্য সনদের সচিবালয় যৌথভাবে এ বছরের প্রতিপাদ্য ঠিক করেছেন Forest Diversity বা বনের বৈচিত্র্য। অর্থাৎ এককাট্টা বাণিজ্যক বন নয়, প্রাকৃতিক বন, যেখানে যে পরিবেশে যে গাছপালা, লতাগুল্ম হবার কথা তার সংমিশ্রণের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে বলতে গেলে এটা খুব দুর্ভাগ্যজনক যে প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করার কাজ এখানে উন্নয়ন কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত হয়ে গেছে। গাছ লাগাবার অর্থ দাঁড়িয়েছে বিদেশী গাছ, কিংবা বাণিজ্যিক কারণে গাছ লাগানো। মানুষের জীবন-জীবিকা, সংস্কৃতি, ওষুধের উৎস, ঘর বাড়ীর সরঞ্জাম সবই প্রাকৃতিক বন থেকে আসে তা আমরা যেন ভুলে গেছি। জাতি সংঘের পরিবেশ কর্মসুচী এবং প্রাণ বৈচিত্র্য সনদের সচিবালয় বিশ্ব প্রাণ বৈচিত্র্য দিবস উপলক্ষ্যে একটি পুস্তিকা বের করেছে ‘Forest Diversity: Earth’s Living Treasure’ । এখানে বলা হয়েছে বিশ্বের ৭০০ কোটি মানুষের খাদ্য, ওষুধ, বস্ত্র, ঘর বাড়ির সরঞ্জামের যোগান দেয়া, মাটির ক্ষয় রোধ করা, জল বায়ু ও আবহাওয়ার ভারসাম্য ঠিক রাখা, পরিস্কার পানির সরবরাহ নিশ্চিত করা, এমনকি আমাদের শিল্প সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করা সবই এই বনের মধ্য থেকে আসে। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে যে বন ধ্বংসের প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে এবং ভয়াবহ পর্যায়ে এসে গেছে। বন ধ্বংসের সাথে কার্বন নির্গমনের মাত্রা আরো বেড়ে যাচ্ছে, যার ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সাথে সব ধরণের প্রাণবৈচিত্রের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। তাই আন্তর্জাতিক পর্যায়ের নীতিনির্ধারকদের টনক কিছুটা মনে হয় নড়েছে, তাই তারা ২০১১ সালকে আন্তর্জাতিক বন বছর (International Year of Forest বা Forest Year)ঘোষণা দিয়েছে।
পৃথিবীর ৩১% (৪ বিলিয়ন হেক্টর) ভূমি বনের অধীনে রয়েছে। মাত্র পাঁচটি দেশে যেমন চীন, রাশিয়া, কানাডা, আমেরিকা এবং ব্রাজিলে বিশ্বের ৫৩% বন রয়েছে। প্রায় ১.৬ বিলিয়ন মানুষ (১৬০ কোটি) জীবন জীবিকার জন্য বনের ওপর নির্ভরশীল, এবং ৩০ কোটি মানুষ বনেই থাকে। উন্নয়নশীল দেশের ৮০% মানুষ বন থেকে ওষুধ সংগ্রহ করে। বিশ্বের পরিস্কার পানির প্রায় ৭৫% বনের পানির রক্ষণাগার থেকে আসে এবং উন্নয়নশীল দেশের বড় বড় শহরে খাবার পানি শোধন করে দেয়।
এতো অবদান থাকা সত্ত্বেও বন রক্ষা করা হচ্ছে না। বরং বনকে বাণিজ্যক কারণে এককাট্টা বাণিজ্যক গাছ যেমন রাবার, ইউকেল্পিটাস, একাশিয়া লাগিয়ে প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে। পুস্তিকাটিতে বিশ্বের প্রেক্ষাপটে বলা হয়েছে প্রাকৃতিক বন ধ্বংসের হার ভয়াবহভাবে বেড়ে গেছে। গ্রীষ্মমন্ডলের বনাঞ্চলে (Tropical forest) প্রতিদিন ১০০ টি পশু ও গাছপালার জাত হারিয়ে যাচ্ছে। প্রাথমিক বন এলাকায় ভূমির পরিমান ২০০০ সালের পর লগিং (Logging) এবং কৃষি সম্প্রসারণের কারণে ৪ কোটি হেক্টর কমে গেছে। যদিও বন ধ্বংসের হার আগের তুলনায় কমেছে বলা হচ্ছে তবুও প্রতি বছর ১ কোটি ৩০ লক্ষ হেক্টর বন ধ্বংস হচ্ছে। হিশাব করে দেখা গেছে, বন ধ্বংসের সাথে প্রাণ বৈচিত্র্য ধ্বংসের পরিমান প্রতি বছর ১ – ৪ ট্রিলিয়ন।
বন রক্ষার সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক একেবারে সরাসরি। আন্তর্জাতিক গবেষণা The Economics of Ecosystems and Biodiversity (TEEB) গ্রীষ্মমন্ডলের বা ট্রপিকাল বনের নানা অবদান যেমন পানি সরবরাহ, মাটি রক্ষা, জলবায়ু ঠিক রাখা, উপকুলীয় এলাকা রক্ষা করা, খড়ি, ওষুধ ইত্যাদির মাধ্যমে বছরে গড়ে প্রতি হেক্টরে ৬,১২০ মার্কিন ডলারের পরিমাণ আর্থিক অবদান রাখে। বিশ্ব ব্যাংকের গবেষণায় দেখা গেছে ১২০ কোটি অতি গরিব মানুষের মধ্যে ৯০% মানুষ বনের বৈচিত্র্যের ওপর জীবন জীবিকা নির্বাহ করে বেঁচে আছে। অন্যদিকে Millennium Ecosystem Assessment দেখিয়েছে বিশ্বের ৩০ কোটি মানুষ তাদের নুন্যতম বেঁচে থাকার জন্য বনের ওপর নির্ভরশীল। এর সাথে ঘনিষ্টভাবে যোগ রয়েছে আদিবাসী মানুষের জীবন জীবিকা। বন ধ্বংস হওয়ার অর্থ হচ্ছে বনের মানুষের জীবন ও বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া। বাংলাদেশে এই উদাহরণ আমাদের অনেক আছে।
বন বিভাগের ২০০১ সালের তথ্য অনুসারে বাংলাদেশের বনভূমির পরিমান দেশের মোট ভূমির প্রায় ১৮%। বন বিভাগ দেশের ১০.৩০% বা ১.৫২ মিলিয়ন হেক্টর ভূমি নিয়ন্ত্রণ করছে। এর মধ্যে রয়েছে পাহাড়ি বন, সমতল বন, সুন্দর বন, উপকূলে তৈরী করা বন এবং চা ও রাবার বাগানে সৃষ্ট বন। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত বিদেশী সাহায্য নিয়ে যে বন সৃষ্টি করা হয়েছে তার ফলে প্রাকৃতিক বনের অধিকাংশ বিলীন হয়ে গেছে, তার জায়গায় তৈরি করা হয়েছে ‘লাগানো বন’ আকাশিয়া, ইউকেলিপ্টাস, পাইন, রাবার ইত্যাদী বিদেশী প্রজাতি দিয়ে (ফিলিপ গাইনঃ বন, বন বিনাশ ও বন বাসীর জীবন সংগ্রাম, ২০০৪)। এখানে বিদেশী প্রজাতি বলতে শুধু অন্য দেশ থেকে আনা গাছ বোঝানো হচ্ছে না। এখানে বোঝানো হয়েছে এক পরিবেশের গাছ অন্য পরিবেশে বিজাতীয় অর্থে। আমরা যখন টাঙ্গাইল হয়ে যমুনা সেতু দিয়ে সিরাজগঞ্জ এবং উত্তর বঙ্গের দিকে যাই তখন রাস্তার দুই পাশে যে সব আকাশিয়া, ইউকেলিপ্টাস গাছ দেখা যায় তা সেই এলাকার পরিবেশের জন্য মোটেও উপযুক্ত নয়। অথচ সরকার এবং এনজিওদের সহযোগিতায় এই গাছগুলো লাগানো হয়েছে। তেমনি পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবানের সৌন্দর্যের ওপর কালিমা লেপে দিয়েছে এই সব গাছ।
কৃষির সম্প্রসারণকেও বন ধ্বংসের কারণ হিসেবে দেখা হয়েছে। কিন্তু এই কৃষি সাধারণ খাদ্য উৎপাদনের কৃষি নয়। আজকাল তামাক চাষকেও কৃষির ক্যাশ ক্রপ নাম দিয়ে কৃষি পরিসংখ্যানে দেখানো হয়। অথচ তামাক চাষ সরাসরি বন ধ্বংসের জন্য দায়ী। এই কথা পরিবেশ অধিদপ্তর কিংবা মন্ত্রণালয় থেকে স্পষ্টভাবে বলা হচ্ছে না এবং কোন ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হচ্ছে না। উবিনীগের গবেষণা থেকে তামাক চাষ এলাকা বান্দরবানে লামা-আলীকদমে পাতা পোড়ানোর জন্য ব্যবহৃত তন্দুর ও জ্বালানি কাঠের হিসাব দিচ্ছি। তামাকের সবুজ পাতা যখন পোড়ানোর জন্য তন্দুরে দেয় এটাকে লোড বলে। প্রতি লোডে ছোট সাইজের তন্দুরে ৪৫০ স্টিক দেয়া হয়। স্টিক হচ্ছে লম্বা কাঠির উপর সবুজ তামাক পাতা সুতলী দিয়ে বেঁধে ঝুলিয়ে দেয়া হয়। বড় সাইজের তন্দুরে ৫০০ স্টিক দেয়া হয়। প্রতি স্টিকে ৪০টি করে পাতা থাকে। একটি তন্দুরে প্রতি মৌসুমে ২ একর জমির পাতা পোড়ানো যায়। প্রতি লোডে তামাক পোড়াতে সময় লাগে ৬০ থেকে ৭২ ঘন্টা এই সময় তন্দুরের ভেতর একটানা আগুন জ্বলতে থাকে, ক্রমাগতভাবে কাঠ দিতে হয়। প্রতি লোডে তামাক পোড়ানোর জন্য ৩০ থেকে ৩৫ মণ লাকড়ী লাগে। এক একর জমির পাতা ৪ লোডে পোড়াতে হয়। প্রতি মৌসুমে তন্দুর প্রতি ২৪০ মণ লাকড়ী লাগে। এই লাকড়ী যোগাতে গিয়ে মাঝারী সাইজের ৯৬০টি গাছ কাটতে হয়। একটি এলাকায় যদি ৫০ থেকে ৮০টি তন্দু্র থাকে, তাহলে হিসেব করে দেখলে মাথা ঘুরে যায়, প্রায় ১২,০০০ থেকে ১৯,২০০ গাছ প্রতি মৌসুমে কাটা হচ্ছে!

দীর্ঘদিন তামাক চাষের কারণে বন সম্পদ ধ্বংস হয়ে গেছে।
এই কাঠ আসছে লামা, আলী কদম, ইয়াংছা, ফাইতং এর সরকারি বাগান থেকে। বন বিভাগের বিট ও রেঞ্জ অফিসার কাঠের সওদাগরের মধ্যে এক ধরনের চুক্তি থাকে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। কুষ্টিয়াতে দীর্ঘদিন তামাক চাষের কারণে বন সম্পদ ধ্বংস হয়ে গেছে। এখন তামাক পাতা পোড়ানোর জন্য কাঠ পাওয়া যায় না, তারা পাট কাঠি, ধইঞ্ছা, আঁখের ছোবড়া, ধানের খড় ব্যবহার করছে, অর্থাৎ গো খাদ্য, বাড়ী ঘর বানাবার উপকরণ এবং রান্নার জ্বালানীও তামাক পাতা পোড়াতে গিয়ে ধ্বংস করছে।
পত্র পত্রিকায় বন ধ্বংসের কথা খুব বেশী লেখা না হলেও কিছু তথ্য পাওয়া গেছে যা ভয়াবহ। যেমন চলনবিলের ১৪টি উপজেলায় ইট ভাটায় দেদারসে বাঁশের মোথা পোড়ানো হচ্ছে (যুগান্তর, ২০ মার্চ, ২০১১)। মধুপুরের বনের শাল কাঠ প্রতি রাতে ভ্যান গাড়ীতে করে ইটের ভাটায় যাচ্ছে আর ট্রাকে করে গজারী কাট যাচ্ছে শহরে (আমার দেশ, ৭ মার্চ, ২০১০)। সীতা কুন্ডে ২০০৯ সালে এক বছরে ৩০ হাজারের বেশী গাছ নিধন করে ১২ টি শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড করা হয়েছে (দৈনিক ইত্তেফাক, ৪ ডিসেম্বর, ২০০৯)। এই কয়েকটি প্রতিবেদনে বোঝা যাচ্ছে শুধু বাণিজ্যিক কারণেই নির্মমভাবে গাছ নিধন চলছে, অথচ আমাদের বন বিভাগ এবং পরিবেশ মন্ত্রণালয় কোন ভ্রুক্ষেপ করছে না।
কিছুদিন ধরে আমরা লক্ষ করছি গাছের মড়ক দেখা দিয়েছে। রাস্তার ধারে ও জনবসতি এলাকায় লাগানো শিশু গাছ, রেইনট্রি ও গগন সিরিস এই মহামারীতে আক্রান্ত হয়েছে। তবে গাছ পালার এই মড়কের কারণ কি তা বিশেষজ্ঞরা এখনো বলছেন না। বড় গাছের মড়ক আমরা দেখছি। কিন্তু ছোট উদ্ভিদ যেমন, নীল, সবুজ, শেওলা, ছত্রাক, মস ইত্যাদি কি ঘটছে তা আমরা জানিনা। তবে এসব ক্ষুদ্র উদ্ভিদ প্রতিনিয়ত মাটি গঠন থেকে আরো কল্যাণমূলক কাজ করছে। যার উপর ভিত্তি করে কৃষি সভ্যতা গড়ে উঠেছে। জরুরী ভিত্তিতে এ বিষয় গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। এই মড়কের কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে নানামত রয়েছে। উল্লেখযোগ্য কারণগুলো হলো:
(১) রোগ, (২) পোকার আক্রমন, (৩) যানবাহন থেকে নির্গত গ্যাস যেমন: কার্বন মনো অক্সাইড, সালফার ডাই অক্সাইড ইত্যাদি, (৪) ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নীচে নেমে যাওয়া, (৫) মাটিতে জৈব পদার্থের ঘাটতি, (৬) মাটিতে মৌলিক উপাদানের ঘাটতি, (৭) একচেটিয়া ও একধরনের বৃক্ষ রোপন, (৮) বিদেশ থেকে আগ্রাসী জাত প্রবর্তন, (৯) আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তন, (১০) ইটভাটা থেকে নির্গত দূষিত গ্যাস, (১১) শিল্প কলকারখানার বর্জ্য, (১২) কীটনাশক ও রাসায়ানিক সারের ব্যাপক ব্যবহার, (১৩) অপরিকল্পিত নগরায়ন, (১৪) এ্যাসিড বৃষ্টি, (১৫) ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক প্রভাব, (১৬) অপরিকল্পিত বাঁধের কারণে ভূউপরিভাগের পানির প্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত, (১৭) খড়া, (১৮) জলাবদ্ধতা, (১৯) বৃক্ষ লালনের পরিকল্পনার অভাব, (২০) প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতা।
তবে গাছপালার মড়কের কোন সুনিদৃষ্ট কারণ বিশেষজ্ঞদের মতবাদ থেকে বের হয়ে আসেনি। পরিবেশ প্রকৃতির উপর ইদানিংকালে সেসকল অস্বাভাবিক কর্মকান্ড পরিচালনা করা হয়েছে তার ফলে উদ্ভিদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি, রোগ বালাই ও পরিবেশ প্রতিকূলতা প্রতিরোধের ক্ষমতা কমে গেছে।
বন সৃষ্টি হয় প্রাকৃতিক নিয়মে। প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেওয়া গাছপালা ধ্বংস করে ইচ্ছামত বিদেশ থেকে আহরিত বৃক্ষের চারা রোপন করে আর যাই হোক বনায়ন করা হয়েছে দাবী করা যায় না। মধুপুরে গজারীর বন ধ্বংস করে আকাশমনি ও মিনজিয়ামের বাগান করা হয়েছে। কোথাও কলার বাগান করা হয়েছে, কোথাও আনারসের বাগান করা হয়েছে। একইভাবে অন্যত্র রাবার অথবা পামগাছের বাগান করা হয়েছে। কোথাও আবার ইউকেলিপটাসের বাগানও করা হয়েছে। একথা সকলেরই জানা যে, প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রাণবৈচিত্র্যের একটা নিজস্ব শৃংখলা আছে। প্রকৃতিকে অবহেলা করে যা কিছু করা হয় তা আর যাই হউক বন সৃজন হয় না। গাছপালা পশুপাখি জীব অনুজীব এসবই প্রাণবৈচিত্র্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
স্থানীয় জাতের নিরোগ ও রোগ সহনশীল চারা লাগাতে হবে। জাতের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী পরিবেশ বাছাই করে চারা লাগাতে হবে। যেমন: কাঁঠাল গাছ ও সেগুন জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। ফলে কাঁঠাল ও সেগুন উঁচু জমি যেখানে পানি জমে না সেখানেই লাগাতে হবে। যেখানে পানি দাঁড়ায় এমন পরিবেশে পানি সহিষ্ণু গাছ যেমন: হিজল, বন্যা, পিটুলি জাতীয় গাছ লাগানো যেতে পারে।
আধুনিক পদ্ধতিতে ধান চাষের জন্য মাটির তলার পানি তুলে সেচ দেওয়া হচ্ছে। উচ্চ ফলনশীল ও হাইব্রিড বোরো ধান আবাদ করতে পানি সেচ দিতে হয়। প্রচলিত বৃষ্টিনির্ভর শস্যক্রম পরিবর্তন করে সেচ নির্ভর বোরো ধানের আবাদ প্রবর্তন করা হয়েছে। নির্বিচারে মাটির তলার পানি তুলে সেচ দেওয়া হচ্ছে। এই পানির সাথে আর্সেনিক, লৌহ এবং আরো কিছু মৌলিক উপাদান মাটির উপরেরস্তরে ওঠে আসছে। বিষাক্ততার ফলে গাছপালার মধ্যে প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। এই অবস্থার পরিবর্তন করে বৃষ্টি নির্ভর ও ভূউপরিভাগের পানি ব্যবহার করে ধান চাষবাদের প্রচলন করতে হবে।
ইট ভাটায় কাঠের জ্বালানী সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে হবে। শিল্প কারখানার বর্জ্য বিজ্ঞান সম্মত উপায়ে ব্যবস্থাপনা করতে হবে।
রাসায়ানিক সারের পরিবর্তে জৈব সার ব্যবহারের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। যেসব ফসলে মাটিতে জৈব সার যুক্ত হয় সেসব ফসলের আবাদ বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে ডাল, সীম ও পাটের আবাদ সম্প্রসারণ করতে হবে। কীটনাশকের ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। গ্রামে জীবন জীবিকার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।
সারা দেশে মোবাইল ফোনের টাওয়ার স্থাপন করা হয়েছে। এর ফলে গাছপালার উপরে ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক প্রভাব এবং কিছু বিরূপ প্রতিক্রিয়া থাকতে পারে বলে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যাচ্ছে। এই বিষয়ে পুর্ণাংগ গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। নদীর গতিপথ ও পানির প্রবাহ স্বাভাবিক ধারায় প্রবাহিত হওয়া বাঞ্চনীয়। বাঁধ নির্মানের ক্ষেত্রে বিষয়টি গুরুত্বের সাথে পর্যালোচনা করে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
গাছপালা লাগানোর জন্য সরকারীভাবে যথেষ্ট অর্থের বরাদ্দ দেওয়া হয়। তবে লাগানো গাছপালা লালন পালনের জন্য একইভাবে অর্থ বরাদ্দ রাখতে হবে।
আমাদের উন্নয়ন কর্মকান্ড এমনভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে যাতে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় থাকে। আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে খরা, জলাবদ্ধতা, সাইক্লোন, বন্যা, ইত্যাদি দূর্যোগ বাড়ছে। বনায়নের ক্ষেত্রে এবং গাছপালা লাগানোর ক্ষেত্রে পরিবেশ সহনশীল স্থানীয় জাতের গাছপালার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে।
গাছপালা ও প্রাণীজগৎ একে অপরের উপর নির্ভরশীল। তাই গাছপালা না থাকলে প্রাণীকুলের অস্তিত্ব বিপন্ন হতে বাধ্য। অস্তিত্বের ক্ষেত্রে গাছপালার বর্তমান মড়ক একটি অশনি সংকেত। মানুষের সাবধান হওয়ার এখনি সময়। কারণ গাছপালা না থাকলে এই পৃথিবীতে মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীর বিলুপ্তি ঘটবে।
এখনো সময় আছে। এই পুরো বছরটি বন রক্ষার জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। তাই সরকার কাজ যদি করতে চায় অবশ্যই সুযোগ আছে। আশা করি তামাক চাষ বন্ধ করা, ইটের ভাটায় কাঠের ব্যবহার বন্ধ করাসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে বন রক্ষা এবং একই সাথে প্রাণ বৈচিত্র্য রক্ষার কাজ করা হবে। আগামি ৩১ মে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস আর ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস। প্রাণবৈচিত্র্য দিবসের জন্য নেয়া পদক্ষেপের সাথে এই দিন গুলোর সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। কাজেই এখন থেকেই আমাদের সক্রিয় হতে হবে।
আমাদের সুনির্দিষ্ট দাবী হচ্ছেঃ
১। তামাক পাতা পোড়ানোর ক্ষেত্রে গাছ কাটা নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে
২। প্রাকৃতিক বন রক্ষার উধ্যোগ নিতে হবে, এক কাট্টা ও বাণিজ্যক বন করা যাবে না।
৩। বনের ওপর নির্ভরশীল মানুষের জীবন-জীবিকা রক্ষার পরিকল্পনা গ্রহন করতে হবে।
৪। উন্নয়ন কর্মকান্ড বা শিল্প কল কারখানা স্থাপন করতে গিয়ে গাছ পালা কাটা নিষিদ্ধ করতে হবে।
৫। মোবাইল ফোনের টাওয়ার স্থাপনের ওপ র নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে।
৬। ইটের ভাটায় জ্বালানী কাঠের ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে হবে।
৭। ইউকেলিপ্টাস, আকাশিয়া, মেহেগনি সহ পরিবেশ ও প্রাণ বৈচিত্রের জন্য ক্ষতিকর গাছ লাগানোর কর্মসুচী বন্ধ করতে হবে।
সব শেষে সবুজ শ্যামল এ দেশের নিজস্ব পরিবেশের সাথে খাপ খায় এমন গাছ পালা লাগিয়ে প্রাণবৈচিত্র রক্ষা করার জন্য সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সকল মহলের কাছে আহবান জানাচ্ছি।
ঢাকা, ২২ মে, ২০১১