টেকসই উন্নয়ন ও সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকা না থাকার প্রশ্ন
ফরিদা আখতার || Wednesday 10 February 2016 ||বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ বলতে তাদের সংখ্যায় পরিণত করার প্রবণতা দেখা যায় উন্নয়ন নিয়ে কথাবার্তায়। কত মানুষ গরিব, কত মানুষ কাজ করছে, কত মানুষ বেকার ইত্যাদি। এ আলোচনার একটি দিক দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে, তা হচ্ছে, জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে অন্তর্জাতিক মহলে উৎকণ্ঠা। বাংলাদেশ মানে হলো ছোট দেশ; কিন্তু মানুষের সংখ্যা বেশি।
এখানে উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা কঠিন কাজ। আসলে দেশের জনসংখ্যা কত, তাও হয়তো অনেকেই ঠিকমতো নিরূপণ করে বলেন না। ১৬ কোটি মানুষের দেশ বলতে বলতে মুখে ফেনা উঠে যায়; কিন্তু জনশুমারিতে দেখা যায়, ১৫ কোটির একটু বেশি। মন্ত্রীরা তাদের বক্তৃতায় একেক সময় একেক সংখ্যা বলেন। গ্যাস দিতে না পারলে বলেন, ১৬ কোটি মানুষের জন্য গ্যাসের জোগান দেয়া সম্ভব নয়; এলপিজি দিতে গেলেও সময় লাগবে। আবার খাদ্য উৎপাদন বাড়ছে বলে যখন গর্ব করে বলা হয় তখন আবার ১৬ কোটি সংখ্যাটি খুব ভালো হয়ে যায়। বাংলাদেশ কত সফল একটি দেশ, তা প্রমাণ করার জন্য এ সংখ্যা খুব কাজে লাগে। শুধু তাই নয়, মানুষের সংখ্যা বেশি বললে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য উচ্চফলনশীল, হাইব্রিড এবং বর্তমানে জিএম খাদ্য উৎপাদনেও যুক্তি দেয়া হয়- এত মানুষকে খাওয়াতে হলে এটাই করতে হবে নইলে উপায় নেই। স্বাস্থ্য ঝুঁকি আছে বললে তো হবে না, আগে মানুষকে খাওয়াতে হবে, সেটা বিষাক্ত হলেও ক্ষতি নেই! ঢাকা শহরে যানজট হচ্ছে, তখন বলা হয় এত মানুষ তাই এত জট। অথচ প্রতিদিন ঢাকা শহরে গাড়ির সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে সেটার দিকে নজর নেই। আমি এর আগে অনেকবার বলেছি, মানুষের জন্য পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি আছে; কিন্তু গাড়ির জন্য নেই কেন? গাড়ির সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি কে নেবে? শেষ পর্যন্ত দেশের উন্নয়নের যত দোষ তার দায় পড়ে এ নন্দ ঘোষ ‘জনসংখ্যা’ বা মানুষের সংখ্যার ওপরই। এ নন্দ ঘোষ আর কেউ নয়, গরিব মানুষকেই বোঝানো হয়; যাদের আমরা বাসের বা ট্রেনের ছাদে ঝুলে ঝুলে যেতে দেখি, যারা লঞ্চে গাদাগাদি করে যায়, যারা কাজের খোঁজে ঢাকা শহরে আসছে বলে মধ্যবিত্তদের মধ্যে উৎকণ্ঠা বাড়ে, কোথাও বোমাবাজি হলে ধরেই নেয়া হয় এ বস্তির মানুষ বা মাদরাসার গরিব ছাত্ররাই করেছে। অথচ উল্টোদিকে দেখা যায়, গার্মেন্ট কারখানায় লাখ লাখ শ্রমিক কাজ করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে দিলেই উন্নয়ন হয়েছে বলতে পারি, বিদেশে শ্রমিক হিসেবে গিয়ে দিন-রাত পরিশ্রম করে দেশে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার পাঠালে তখন দেশের উন্নয়নের গতি বাড়ে; কিন্তু এটা বলা হয় না, এ গরিব মানুষই আমাদের সম্পদ। এদের সব সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো রাষ্ট্রের কর্তব্য। এদের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
এসব বলছি এ কারণে যে, বাংলাদেশের মতো দেশে গরিব মানুষ ‘সংখ্যা’ হয়ে যায়, তারা মানুষ, তাদের জন্ম এবং সুস্থভাবে বেঁচে থাকা নিশ্চিত করা হয় না। শুধু গরিব মানুষই নয়, নিম্নমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্তদের জীবনও এখন নিরাপদ নয় এবং এ বিষয়টি শুধু বাংলাদেশের বিশেষ বৈশিষ্ট্য তাও বলা যাবে না। বিশ্বের অনেক দেশেই মানুষের জীবন এখন হুমকির মুখে পড়েছে। বিখ্যাত চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যবিষয়ক সাময়িকী ল্যান্সেটে প্রকাশিত একটি গবেষণার তথ্য যথেষ্ট ভাবনার উদ্রেক করেছে। তথ্যটি হচ্ছে, ২০১৫ সালে সারা বিশ্বে ২৬ লাখ মৃত শিশু জন্ম নিয়েছে। এর দুই-তৃতীয়াংশ মৃত শিশুর জন্ম হয়েছে দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকার কয়েকটি দেশে। বলা বাহুল্য, বাংলাদেশ শীর্ষ ১০টি দেশের তালিকায় স্থান পেয়েছে। এখানে ২০১৫ সালে মৃত শিশুর জন্ম হয়েছে ৮৩ হাজার। আমি অবাক হয়ে যাই এ বিষয়টি নিয়ে স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়লেও ব্যাপক আলোচনা হয়নি। দুর্নীতিতে বাংলাদেশের স্থান ১৩তম হওয়ায় তার চেয়ে অনেক বেশি হৈচৈ হয়েছে। মৃত শিশুর জন্ম হওয়ার সঙ্গেও দেশের সুশাসনের প্রশ্ন কি জড়িত নয়? দেশের উন্নয়নের কি কোনো সম্পর্ক নেই? ল্যান্সেটেও বিষয়টি নিয়ে অস্বাভাবিক নীরবতায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। দ্য ল্যান্সেটের প্রধান সম্পাদক রিচার্ড হর্টন মন্তব্য করেছেন, ‘বিষয়টি নিয়ে যে নীরবতা তা বাকরুদ্ধ হয়ে যাওয়ার মতো।’ আসলেই তাই। শিশুমৃত্যু কমানোর যে উদ্যোগ তা শুধু জীবিত শিশু জন্মের পর তাকে রক্ষা করার জন্য। কিন্তু যে শিশু মায়ের গর্ভেই মারা যাচ্ছে, তার ব্যাখ্যা কী? সে কি কোনো গণনার মধ্যে পড়ে না? তাকে বাঁচানোর চেষ্টা কোথায়? যে মা এ শিশুকে গর্ভে ধারণ করেছেন ১০ মাস ১০ দিন, তার এ কষ্টের ফল কি একটি মৃত শিশু প্রসব করা? নবজাতক শিশুর মৃত্যুর সংখ্যাও প্রায় সমান। এ দুইটি দুঃখজনক ঘটনার জন্য কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে মায়ের বা গর্ভাবস্থায় শিশুর অসুস্থতা এবং অদক্ষ হাতে সন্তান প্রসবের চেষ্টা।
মৃত শিশুর জন্ম হওয়ার পরিস্থিতি কেন সৃষ্টি হচ্ছে? আসলে এ বিষয় নিয়ে খুব কম গবেষণা হয়েছে। তবে কয়েকটি বিষয় ইদানীং আলোচনায় আসছে এবং সে আলোচনা থেকে এ কথা পরিষ্কার যে, মৃত শিশুর জন্ম প্রতিরোধযোগ্য এবং তার জন্য পরিবার এবং সামাজিক পর্যায়ে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টির প্রয়োজন আছে। আমি সব বিষয় নিয়ে আজকের লেখায় লিখছি না; শুধু একটি বিষয় তুলে ধরছি, যা সাম্প্রতিক এসডিজি সংক্রান্ত আলোচনার জন্য প্রাসঙ্গিক হবে। সেটা হচ্ছে, তামাক উৎপাদন ও তামক সেবন। মৃত শিশুর কথা যখন আমরা বলছি তখন একই সঙ্গে মা ও শিশু উভয়ের স্বাস্থ্য কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কিনা, তা দেখার কথা। তামাক উৎপাদনে, যেমন তামাক চাষে যখন একটি পরিবার যুক্ত হয়, তখন তাদের ঘরের মহিলারাও বিভিন্ন কাজে যুক্ত থাকেন পারিবারিক শ্রম হিসেবে। সে সময় কোনো মহিলা গর্ভধারণ করেছেন এমন অবস্থায়ও থাকতে পারেন। তামাক চাষের সময় যেভাবে বিষ ব্যবহার করা হয় তাতে গর্ভাবস্থায় নারীর শরীরে তা প্রবেশ করতে পারে এবং গর্ভের শিশু অসুস্থ হতে পারে। চুল্লিতে তামাক পাতা পোড়ানোর পর বের করার সঙ্গে সঙ্গেই যে গ্যাস নির্গত হয় তাতে নারীর শরীর ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং গর্ভের শিশু অসুস্থ হয়। তেমনি যারা বিড়ি কারখানায় কাজ করছেন কিংবা জর্দা-গুল কারখানায় কাজ করছেন তাদেরও মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। তামাক সেবনের ক্ষেত্রে নারী এবং তার গর্ভের শিশু দুইভাবে আক্রান্ত হয়। যেমন পরিবারে স্বামী বা পুরুষ সদস্য ধূমপান করলে কিংবা কর্মস্থলে সহকর্মীরা ধূমপান করলে গর্ভবতী নারী নিজে এবং তার গর্ভের সন্তানের ক্ষতি হয়। নিজে ধূমপান না করেও অন্যের ধূমপানের কারণে পরোক্ষভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছে এমন নারীর সংখ্যা লাখ লাখ আছেন। তাদের মধ্যে হাজার হাজার অন্তত গর্ভবতী অবস্থায় থাকতে পারেন। তারা জানতেও পারছেন না হয়তো তাদের এত যত্নে গর্ভে লালন করা শিশুটি জীবিত অবস্থায় জন্ম নাও নিতে পারে কিংবা জীবিত জন্ম হলেও তার ওজন আশঙ্কাজনকভাবে কম হতে পারে এবং নবজাতক হিসেবে মারাও যেতে পারে। অর্থাৎ যে মৃত শিশু জন্ম নিয়েছে সে পৃথিবীর আলোই দেখল না, আর যে আলো দেখল সে আর বেশিক্ষণ তা ভোগ করতে পারল না। নারী নিজেও তার গর্ভের শিশুর ক্ষতি করে বসতে পারেন। যেমন তিনি নিজে যদি গর্ভাবস্থায় ধূমপান করেন কিংবা পানের সঙ্গে জর্দা, সাদা পাতার মতো ধোঁয়াবিহীন তামাকদ্রব্য সেবন করেন। মা হয়ে শিশুর এ ক্ষতি যিনি করেছেন তিনি হয়তো জানেন না; কিন্তু তাকে এ বিষয়ে জানানোর দায়িত্ব আমাদের রয়েছে। বিশেষভাবে রয়েছে স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত চিকিৎসক এবং কর্মীদের।
আরও দুঃখজনক হচ্ছে, অনেক শিশু ‘সুস্থ’ভাবে জন্ম হয়েছে এবং বেঁচেও গেছে; কিন্তু একটু বয়স বাড়তেই ধরা পড়ে হাঁটতে না পারা, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধকতা ইত্যাদি সমস্যা। এগুলো এখন চেনা রোগ। প্রায় ঘরে দেখা যাচ্ছে। আমরা সব সময় শুনছি অটিস্টিক, সেলিব্রাল পলসি বা ডাউন সিনড্রমে ভুগছে এমন শিশুর কথা। এদের ও এদের মা-বাবাদের যে কষ্ট করতে হয় এবং ভোগান্তি হয় তা বর্ণনাতীত। এ সমাজ তাদের সাহায্য করে না, তাদের জন্য প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। অথচ এ রোগগুলো হওয়ার কথা ছিল না। আমাদের খাদ্য উৎপাদনে বিষের ব্যবহার, বিদেশ থেকে আমদানি করা খাদ্যে জেনেটিক্যালি মডিফাইড খাদ্যের উপাদান থাকা অটিজমের একটি প্রধান কারণ হিসেবে জানা গেছে। এ গবেষণা উন্নত বিশ্বে হচ্ছে। আমাদের দেশে আমরা খাদ্যে নানা ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করে ‘খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা’ অর্জন করছি বলে বাহবা পাচ্ছি; কিন্তু অজান্তেই মেরে ফেলছি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে।
আশার কথা, এমডিজির লক্ষ্যমাত্রায় সংখ্যা দিয়ে মা ও শিশুর মৃত্যু ঠেকানোর কথা বলা ছিল, তাই ১৫ বছরে তা খুব সফল হতে পারেনি। কিন্তু টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজিতে মান বাড়ানোর কথা এসেছে এবং এর জন্য নির্দিষ্ট টার্গেট নির্ধারণ করা হয়েছে। মান বাড়ানোর কথা আসতেই মানুষের স্বাস্থ্য রক্ষার ক্ষেত্রে প্রতিরোধযোগ্য কারণগুলো গুরুত্ব পেয়েছে। ঢাকায় তেমনই একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলন হয়ে গেছে ৩০ ও ৩১ জানুয়ারি। ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের আয়োজনে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সংসদের স্পিকারদের সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে ঢাকা ঘোষণার ১২ দফায় উল্লেখ করা হয়েছে, টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য বাস্তবায়নে অন্যতম সমস্যা তামাকজাত পণ্যের ব্যবহার। গ্রাহকের কেনার ক্ষমতা কমিয়ে আনার জন্য তামাকজাত পণ্যের ওপর কর বাড়ানোর প্রস্তাব জোরালোভাবে এসেছে। সমাপনী অধিবেশনে প্রধান অতিথির ভাষণে শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘তামাকের ব্যবহার কমিয়ে আনতে আগামী মার্চ থেকে তামাকজাত পণ্যের মোড়কে ছবি সংযোজন করে সতর্কবার্তা দেয়া হবে। ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকের ব্যবহার নির্মূল করতে হবে।’ যদিও তামাক কোম্পানি এ বিষয়ে বাধার সৃষ্টি করে চলেছে। প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্য তামাক নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত সামাজিক সংগঠন ও ব্যক্তিদের উৎসাহিত করেছে। অন্তত তামাকের কারণে মানুষের জীবনের মানের যে অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে, নিষ্পাপ শিশু মায়ের গর্ভে মারা যাচ্ছে কিংবা পঙ্গুত্ববরণ করছে, তাদের রক্ষার জন্য সহায়ক হবে বলে আমার বিশ্বাস।
ইতিবাচক পদক্ষেপ দেখলে আমরা আশায় বুক বাঁধি। এ দেশের সাধারণ মানুষ সংখ্যা নয়, তারা মানসম্পন্ন জনসম্পদ। তাদের জীবনের মান রক্ষা করা, তাদের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার ব্যবস্থা করলেই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।