কৃষকের বৈচিত্র্যপুর্ণ ফসল পরিকল্পনা
ফরিদা আখতার || Sunday 19 June 2016 ||নয়াকৃষি আন্দোলনের কৃষকরা অধিকাংশই ক্ষুদ্র কৃষক। তাদের জমির পরিমান ১ একরের বেশী নয়, সারা বাংলাদেশেই এই ক্ষুদ্র কৃষকরাই কৃষিতে মূল ভুমিকা রাখছেন। তাদের ফসল পরিকল্পনায় নিজের পরিবারের খাদ্যের যোগান দেয়াই প্রধান উপলক্ষ, বাজারের জন্যও তাদের উৎপাদন করতে হয়। কিন্তু বাজার তাদের উৎপাদনের ধরণ পালটে দেয়। বাজারের চাহিদা অনুযায়ি উৎপাদন করতে গিয়ে কৃষকের ফসলের বৈচিত্র্য কমে যায়, আর নিজেরা খাওয়ার জন্যে আবাদি জমির কম অংশ ব্যবহার করেও বাড়ীর ফসলের বৈচিত্র্য দেখে অবাক হতে হয়। ঈশ্বরদীতে নয়াকৃষি বিদ্যাঘর আরশিনগরে জৈষ্ঠ্য মাসের ৩০ তারিখ থেকে আষাঢ়ের ১ তারিখ (১৩ থেকে ১৫ জুন, ২০১৬) পাঁচটি এলাকার কৃষকের সাথে ফসল পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এই সভায় অনেক গুরুত্বপুর্ণ তথ্য কৃষকরা দিয়েছেন।
নাটোরের বড়াই গ্রাম উপজেলার কৃষ্ণপুর গ্রামের কৃষক শূক চাঁদ আলীর জমি খুব বেশী নেই। মাত্র ৪ বিঘা জমিতে চাষ করেন, বসতভিটা রয়েছে ১০ শতাংশ জমিতে। বাংলাদেশে যারা নিজ জমিতে চাষ করছেন তাদের অবস্থা এমনই। তাদের চাষবাস নিজেদের জীবন জীবিকার জন্য , বিশেষ করে নিজের পরিবারের খাবার যোগানের জন্যে। কিন্তু তবুও কিছু তাদের বিক্রি করতে হয় অন্যান্য খরচ মেটাবার জন্যে। কাপড়-চোপড় কেনা, ছেলেমেয়ের লেখাপড়া, চিকিৎসা ইত্যাদীর খরচ কম নয়।
শুক চাঁদ আলী তার নিজের খাবারের জন্যে আউশ ধানের আবাদ করেন আর আমনের মধ্যে হিদি ধান তার পছন্দ। এই ধান তার বিক্রি করার মতো যথেষ্ট থাকে না। শাক-সবজি মৌসুম অনুযায়ী প্রায় সবগুলো করা হয়, যেমন লাল শাক, ডাটা, পুঁই শাক, পালং শাক, মিষ্টি কুমড়া, চাল কুমড়া, ঝিংগা, ধুন্দুল, করলা, সোলা কচু, গাছ আলু, পটল, বেগুন। পরিবারে শুধু শাক সব্জি আর ধান হলেই চলেনা। তাই শুক চাঁদ আলীর ফসলের তালিকায় সরিষা, তিল, তিসি – তেল হিসাবে, মসলার মধ্যে পেঁয়াজ, আদা, হলুদ, মরিচ বাদ পড়েনি। বাড়ীর আঙ্গিনায় বরই, পেয়ারা, পেঁপে ও কাঠাল গাছ আছে। ছেলেমেয়েদের ফল খেতে হয়। শুক চাঁদ কিছু ফসল করেন বিক্রি করে টাকা উপার্জনের জন্যে। এগুলো হচ্ছে পাট, ঢেঁড়শ, সীম, রসুন, ধনিয়া, কালি জিরা, মুগ কালাই, খেসারি ,গম, আর সাথে গবাদি পশু ছাগল ও গরু পালেন, পুকুরের মাছও বিক্রি করা হয়। গরু পালেন বিশেষ করে বিক্রির জন্যে তবে ঘরে দুধ খাওয়া হয়। মাংস খাওয়া হয় না। মুরগী দুই একটা পাললে ডিম খাওয়া হয়, মেহমান আসলে মুরগী জবাই করা হয়। এই কৃষকের উৎপাদনের তালিকায় নিজের ঘরের খাওয়ার প্রয়োজনে রয়েছে ২৩ রকমের ফসল আর বিক্রির জন্যে মাছ, গরু, ছাগল সহ ১৩টি।
মরিয়ম এবং রাকন দুই নারী কৃষক তাদের জমির ফসলের হিসাব দিলেন। তাঁরা পাবনা জেলার ঈশ্বরদীর পাড়াসিধাই গ্রামের। বাড়ীর আঙ্গিনায় কি কি হয় তার খবর তাদেরই বেশী আছে। আবাদী জমিতে পাকরী ধান আর গম চাষ করা হয়। তবে পাকরী ধান নিজে খাবার জন্যে, গম বিক্রির জন্যে। বাড়ীর আংগিনায় যেখানে রোদ আছে সেখানে এক রকম ফসল করা হয়, আর যেখানে ছায়া বা স্যাঁতস্যাঁতে সেখানে ভিন্ন ফসল। বেশ কিছু জাতের কচু যেমন মৌলবী কচু, মান কচু, ওল কচু, আদা রসুন জায়গা বুঝে বাড়ীর আঙ্গীনায় বাড়ীর প্রয়োজনে লাগানো হয়। গরু ছাগল পালন করা হয় মূলত বিক্রির জন্যে, এছাড়া আছে পাট। তাঁদের নিজ খাওয়ার জন্যে ফসলের তালিকায় রয়েছে ১৩টি, আর বিক্রির জন্যে গরু, ছাগল আর পাট, মাত্র ৩টি।
চাপাইনবাবগঞ্জের কৃষক হান্নান ও রমজান চরে বাস করেন। কাজেই চাপাই বলতেই যে আম এর চাষ বোঝায় তেমন চাষী তাঁরা নন। মহানন্দা নদীর চরে তাদের বাস। এখানে তাঁরা আউশ ধানের ওপর খুব নির্ভর করেন। চারটি জাত ষাইটা, শনি, শংকপটি ও ভইরা চাষ করেন মুলত নিজেরা খাবার জন্যে। আর ব্রি ধান ২৮, ৩৬ ও নয়নমনি চাষ করেন বাজারে বিক্রির জন্যে। কিছু উচ্চ মূল্যের ধান যেমন জিরা শাইল বাজারে বিক্রি করে ভাল দাম পাওয়া যায়। অল্প জমিতে কি করে নিজ পরিবারের খাদ্য চাহিদা মেটানো যায় তার সুন্দর পরিকল্পনা তাদের আছে। ঢেঁড়স, ঝিঙ্গা, ধানি মরিচ, বেগুন (গিউন ও মুক্তা জাতের) মিশ্র ফসল হিসেবে চাষ করা হয়। পালং শাক, লাল শাক, আবাদী জমিতে করা হয় নিজে খাওয়ার জন্যে এবং বিক্রির জন্যে। ধনে, চান্দনী সজ আইলের মধ্যে লাগালে কীট পতঙ্গ থেকে ফসল রক্ষা পায়, আবার মসলার চাহিদাও মেটায়। হলুদ, পেঁয়াজের বীজ বাড়ীর আঙ্গিনায়, সরিষা ১.৫ বিঘা জমিতে বুনে কিছু বিক্রিও করা হয়। ফল খেতে হয় তাই বসত ভিটায় কলা ও পেঁপে গাছ লাগানো হয়। বিক্রির জন্যে উচ্চ মূল্যের ফসল যেমন পটল, মাশ কালাই, মসুর, কাঠ তিল, খেসারী ইত্যাদী আবাদী জমিতে করা হয়। গরু পাললে দুধ অল্প কিছু খাওয়ার জন্যে রেখে বাকীটা বিক্রি করা হয়। আর গরু বড় হলে বিক্রি করে বেশী টাকার প্রয়োজন মেটানো হয়। মুরগীও একটা দুইটা ঘরে থাকে। হিসেব করে নিজের পরিবারের খাদ্য চাহিদা মেটাতে এই দুই কৃষকের নানা ধরণের ফসলের তালিকায় গবাদি পশু ও মুরগি সহ ৩৬ রকমের ফসল ও ফল ফলাদী পাওয়া গেছে। বিক্রির তালিকায় রয়েছে গবাদী পশু ও মুরগী মাত্র ১৩ রকমের ফসল যা প্রধানত আবাদী জমিতে করা হয়।
হিজল দিঘা ধান টাংগাইলের কৃষক মোহাম্মদ নাসির ও সুরিয়া বেগমের তালিকায় নিজেদের খাওয়ার জন্যে পাওয়া গেছে। বাড়ির আলানে পালানে লাগানো মরিচ, নলী বেগুন, গাছ আলু, সাহেব আলু, লাউ, চাল কুমড়া, ডাঁটা ইত্যাদী সবজি ঘরেই হয়। বেশী হলে দুই একটি বিক্রি করা হয়। তবে খাওয়াটাই মুল উদ্দেশ্য। মসলার মধ্যে রসুন, পেঁয়াজ, রাধুনি সজ, হলুদ। আবাদী জমিতে বেশীর ভাগ এবং বেশী পরিমানে যা উৎপাদন করা হয় তার মধ্যে রয়েছে চিনিগুড়ি ধান, হরিঙ্গা চামারা, বরন ধান, কালিজিরা, মিষ্টি কুমড়া, মিষ্টি আলু, গোল আলু, ফুল কপি, বাধা কপি, ঢেঁড়স, মুলা, পেঁপে (কাচা এবং পাকা) শোল কচু ইত্যাদী। গম, পায়রা, পাট, তিল বিক্রির জন্যে বেশী পরিমানে করা হয়। নিজেরা খাওয়ার তালিকায় ২৮টি বিভিন্ন ফসল আছে, বিক্রির জন্যে ১৮টি।
মুজাফফর ও আব্দুল কাদের কক্সবাজার জেলার চকরিয়াতে নিজের জমিতে চাষ করেন। তাঁরা নিজেরা খাওয়ার জন্যে চার জাতের ধান উৎপাদন করেন লাল ধান, বিন্নি ধান, লালমতি ও সুম্মা ধান। শুধু খাওয়ার জন্যে সবজি করা হয় না। বেশীর ভাগ সব্জি যেমন আলু, টমেটো, বেগুন, ঢেঁড়স, বরবটি, রঙ্গিমা সীম, শসা, মিষ্টি কুমড়া, লাউ, কঢ়লা, মুলা বিক্রির জন্যে করলেও নিজেরা খাওয়ার জন্যে রাখা হয়। বাড়ীর আঙ্গিনায় নিজের খাওয়ার জন্যে মাইট্যা আলু তবে মসলা জাতীয় ফসল অল্প জমিতে কিংবা বাড়ীর কাছে করা হয়, যেমন রসুন, পেঁয়াজ, মরিচ, আদা ও ধনিয়া। ফল যা হোক কিছু না কিছু বসতভিটায় থাকে যেমন আম পেঁপে। কলা এখানে পাহাড়ে ব্যাপক পরিমানে পাওয়া যায়, তাই বাড়ীতে লাগাতে হয় না। তাদের গ্রামে গরুর ঘাস খাওয়ার জন্যে কিছু জমি আছে। গরু ছাগল পাললে দুধ খাওয়া হয় তবে মাংস খাওয়া হয় না। নিজেরা খাওয়ার জন্যে ফসলের তালিকায় আছে ১৭টি আর বিক্রি জন্যে গরু, ছাগল আর বিআর ধান ৩৩, ২৯, ২৮, ৪১ সহ ৬টি।
কৃষকদের জীবন জীবিকার সংগ্রামের অভিজ্ঞতা গুরুত্বপূর্ণ উপসংহার টানতে পারি, যা আগামিতে আরও গবেষণা ও নয়াকৃষির কর্মকান্ড পরিচালনার নির্দেশক হতে পারে।
১. গার্হস্থ্য ও কৃষি ব্যবস্থাপনায় ক্ষুদ্র কৃষক প্রাণের সংরক্ষণ ও বৈচিত্র রক্ষায় নিজের জীবন জীবিকার তাগিদেই খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রাণের বৈচিত্র সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার দিক থেকে ক্ষুদ্র কৃষকের এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যকে কিভাবে একটি এলাকায় প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষার নির্ধারক ভূমিকায় পরিণত করা যায় তা নিয়ে আরও গবেষণা ও সুনির্দিষ্ট কর্মকান্ডের পরিকল্পনা করা।
২. ক্ষুদ্র কৃষককে নিজের খাওয়ার জন্য স্বাধীনভাবে চাষ করার সুযোগ দিলেই ফসলের বৈচিত্র্য রক্ষা হলেও বাজারের সঙ্গে কৃষকে সম্পর্ক ঝুঁকিপূর্ণ। দেখা যায় কৃষক বাজারমুখী হলে ফসলের বৈচিত্র হ্রাস পেয়ে একাট্টা ফসল চাষের দিকে ঝোঁকার বিপদ তৈরি হয়। অথচ বাজার থেকে আর্থিক সুবিধা অর্জন কৃষকের জন্য দরকার। এই ক্ষেত্রে জীবিকার নিশ্চয়তা বিধান ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণে সক্ষম ফসলের সঙ্গে অর্থকরী ফসলের সমন্বয় সাধন খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি গবেষণা ও পরিকল্পনার ক্ষেত্র। এটা সহজেই অনুমান করা যায় যে কৃষক ও তার অভজ্ঞতা এবং এলাকা ভেদে সব কৃষকের জন্য একই ধরণের চর্চার সম্ভব হবে না। তবে গ্রাম ভিত্তিক পরিকল্পনা নিলে বিভিন্ন কৃষক পরিবার নিয়ে চাষাবাদের পরিকল্পনা একটি সম্ভাব্য পদক্ষেপ হতে পারে।
৩. ওপরের দুটো নিরীক্ষণ এবং তার ভিত্তিতে দেওয়া প্রস্তাব বাস্তবায়ন করতে হল ক্ষুদ্র কৃষকদের নয়াকৃষির ওপর আরও প্রশিক্ষণ দেওয়া জরুরী। এই ক্ষেত্রে নয়াকৃষির বিদ্যাঘরেও পুষ্টি সমৃদ্ধ ফসল নির্বাচনের জন্য আরও গবেষনা দরকার। যেন কৃষকের নির্বাচিত ফসল শুধু খাদ্য চাহিদা নয়, পুষ্টি চাহিদাও মেটাতে পারে।