সর্বনাশী কর্পোরেট কৃষি নয়, চাই পরিবেশসম্মত কৃষি
ফরিদা আখতার || Monday 22 August 2016 ||দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি্র কারনে জনগণের দৈনন্দিন জীবন জীবিকার সংগ্রাম কঠিন হয়ে পড়েছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলের ন্যায়সঙ্গত দাবী-দাওয়া উপেক্ষার ফলে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, হরতাল, অবরোধ ইত্যাদি ম্রহনত মানুষের জীবনকেও অতীষ্ঠ করে তোলে। যে কোন রাজনোইতিক কিম্বা সামাজিক অস্থিতিশীলতা দেশের অর্থনীতিকে পিছিয়ে দেয়ার জন্য এবং বিশেষ করে কৃষকের ফসল বাজারে আসার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট। আর সময়মতো ফসল বাজারজাত করতে না পারলে কৃষকের ক্ষতি হয় এ কথা সর্বজনবিদিত। ফসল বাজারজাত করতে না পারা শুধু রাজনৈতিক খারাপ পরিস্থিতিতেই হয় না, অন্যান্য স্বাভাবিক সময়েও একই ঘটনা ঘটে। ঢাকায় যে সবজি ২০ টাকা কেজি বিক্রি হয় তা গ্রামে বিক্রি হয় মাত্র ২ টাকায় বা ৫ টাকায়। আলু, পেঁয়াজ, টমেটো, পাট, ধানসহ বিভিন্ন ফসলে এই অবস্থা দেখা যায়। দুঃখজনক হচ্ছে কৃষি মন্ত্রণালয় কৃষিতে এতো সফল বলে দাবী করে, উৎপাদন বৃদ্ধির জন্যে বুক ফুলিয়ে গর্ব করে কিন্তু কৃষকের ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ এবং তাদের ফসল ঠিকমতো বাজারজাত করার জন্য আজও কোন ভাল উদ্যোগ গ্রহণ করতে তাদের দেখা যায়নি। কৃষক দিনে দিনে হতাশ হয়ে পড়ছে। কৃষি জীবন-জীবিকা নির্ধারণের জন্যে একটি লাভজনক পেশা হিসেবে এখন অনেকেই নিতে পারছে না।
কিন্তু তাই বলে কৃষি উৎপাদন থাকবে না? থাকবে, তবে যদি এভাবে কৃষকের স্বার্থ উপেক্ষা করে উদেশ্যহীনভাবে চলি তাহলে কৃষিকাজ কৃষকের হাতে থাকবে না, চলে যাবে দেশীয় এবং বহুজাতিক কোম্পানির হাতে। কৃষি হয়ে যাচ্ছে এগ্রোবিজনেস বা এগ্রোইন্ডাস্ট্রী। আমাদের দেশ ইওরোপ আমেরিকার মতো হয়ে যাবে। সেখানে কৃষকের সংখ্যা হাতে গোনা, অথচ কৃষি উৎপাদন হচ্ছে। ইওরোপিয়ান ইউনিয়নে ১ কোটি ৪০ লক্ষ কৃষক আছে, আর যুক্তরাষ্ট্রে আছে মাত্র ২০ লাখ। যুক্তরাষ্ট্রে মোট জনসংখ্যার মাত্র ২% কৃষক আছেন, অথচ ১০০ বছর আগে ছিল ৭০ থেকে ৮০%। বাংলাদেশে ৫০% জনগণ সরাসরি কৃষি কাজের সাথে যুক্ত, তার মধ্যে অধিকাংশই হচ্ছে ক্ষুদ্র কৃষক ও বর্গা চাষী। ষোল কোটি মানুষের দেশের তাহলে অন্তত ৮ কোটি মানুষ কৃষির ওপর নির্ভরশীল। কাজেই ইওরোপ-আমেরিকার কৃষি নীতি যা হবে, শুধু সংখ্যার দিক বিচার করলেও বাংলাদেশের কৃষি একই নীতিতে চলতে পারে না। উন্নত দেশের কৃষি পদ্ধতি এখানে চালানোর অর্থ হচ্ছে এখানকার কৃষকদের শেষ করে দেয়া।
গত শতাব্দীর ষাটের মাঝামাঝি সময়ে এদেশে আধুনিক কৃষির প্রবর্তন কৃষকের পক্ষে যায়নি। যদিও উচ্চ ফলনশীল বীজের কারণে কিংবা সার দেয়ার কারণে উৎপাদন বেড়েছে। কিন্তু এর ফলে পরবর্তীকালে অনেক ক্ষতি হয়েছে, যেমন কৃষকের সংখ্যা কমে যাওয়া, পরিবেশ নষ্ট হওয়া, খাদ্যের বৈচিত্র্য নষ্ট হওয়া, এবং নির্বিচারে কীটনাশকের ব্যবহার, মাটির তলার সেচের পানি ব্যবহার এবং সার ও যান্ত্রিক প্রক্রিয়াজাত করার কারণে পুষ্টি ঘাটতি ও নানা রোগের সৃষ্টি হওয়া। বহু গবেষণায় দেখা গেছে যে আধুনিক কৃষির কারণে এই ক্ষতি হয়েছে। নীতিনির্ধারণে মধ্যবিত্ত শিক্ষিতরা আছেন যারা সরাসরি খাদ্য উৎপাদন করেন না তাদের কাছে বাজারে চালের সরবরাহ থাকাটাই বেশী জরুরী। তাই তারা এই ক্ষতি দেখেও মেনে নিয়েছে। অধিক উৎপাদন অর্জন করতে গিয়ে কি ক্ষতি হোল তা জানার দরকার নেই। উচ্চ ফলনশীলের পর এসেছে আরো বেশী কীটনাশক নির্ভর এবং বীজ ব্যবসায়ী ও কোম্পানি নিয়ন্ত্রিত হাইব্রীড বীজের। যার মাধ্যমে বাণিজ্যিক ফসলের চাষ বেড়েছে। কৃষক বাণিজ্যের স্বার্থে বিপুল পরিমানে কীটনাশক ব্যবহার করছে, বাজারের প্রয়োজনে রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার করে কাঁচা অবস্থা থেকে পাকানো, স্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর কৃত্রিম রং দেয়ার মতো কাজ বেড়ে গেছে। কৃষি পণ্য, বিশেষ করে খাদ্য শস্যের আবাদ ব্যাপকভাবে বাড়লেও হয়ে গেছে বিষাক্ত। তাই এখন নতুন ভাবনা এসেছে। খতিয়ে দেখা হচ্ছে খাদ্য নিরাপত্তা, (যার অর্থ হচ্ছে যথেষ্ট খাদ্য উৎপাদন করে ক্ষুধা মেটানো) নাকি নিরাপদ খাদ্য (খাদ্যকে স্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর উপাদান মুক্ত করা) – কোনটি বেশী জরুরী। মানুষ খাদ্য খায় সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্যে। খাদ্য কোন সৌখিন বিষয় নয় যে দেখতে সুন্দর ও চকচকে হলেই তা নিরাপদ হবে। শিল্প পণ্যের মত সুন্দর মোড়কে দেয়ার বিষয় নয়। খাদ্য উৎপাদন হয় কৃষকের মাঠে, প্রকৃতির সাথে মিল রেখে। এখানে পোকা লাগতে পারে, ফসলের আকৃতি ও রং ভিন্ন হতে পারে। সব বেগুন, টমেটো, মরিচ এক রকম হবে না, সবগুলোর স্বাদও এক হবে না। কিন্তু আধুনিক ও বাণিজ্যিক কৃষি এসে সে ধারণা পালটে দিয়েছে। সুপারমার্কেটের তাকে রাখার সুবিধা, দুরদুরান্ত থেকে পরিবহন করে এনে চকচকে অবস্থায় শহরে আনার প্রয়োজনে এবং সারা বছর একই সব্জি, ফলমূল, চাল খাওয়ার রীতি তৈরি করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ফসলের বৈচিত্র্য সংখ্যা কমে গিয়েছে কারণ ফ্যাক্টরীর মতো করে উৎপাদন করতে গেলে অনেক বৈচিত্র্য রক্ষা করা সম্ভব নয়। কৃষকের মতো তাদের জ্ঞানের বৈচিত্র্য নেই। তারা একটাই শেখে এবং একটাই সবখানে খাটায়।
নির্বিচার প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলাফল বাংলাদেশের মতো দেশে ভাল হয়নি। কৃষক সার-কীটনাশক নির্ভর কৃষির ক্রমবর্ধমান খরচ মেটাতে না পেরে কৃষি কাজ থেকে সরে অকৃষি কাজে চলে যাচ্ছে। একটি জরীপে দেখা গেছে ঢাকা শহরের রিক্সা ওয়ালাদের মধ্যে ৬৭% আগে কৃষি কাজ করতেন। কেউ কেউ মৌসুমী কৃষি কাজ করে আবার ঢাকায় কিংবা যে কোন শহরে রিক্সা চালান, বা দিন মজুর খাটেন। ফলে কৃষি কাজ প্রধান পেশা হিশেবে কমে যাচ্ছে। এর একটি প্রমাণ পাওয়া যায় ২০১২ সালে পরিসংখ্যান ব্যুরো কর্তৃক প্রকাশিত ২০১১ সালে “Population and Housing Census, 2011: Socio-Economic and Demographic Report” প্রতিবেদনে। এই প্রতিবেদনে পেশা হিশেবে কৃষি কাজ বা কৃষক বলে কিছু নেই, আছে “Skilled Agriculture/Forestry and Fisheries Workers”। প্রায় ৩০.১% মানুষ এই কাজে নিয়োজিত এবং অন্যান্য সব ধরণের কাজের চেয়ে এটাই সবচেয়ে বেশী। কিন্তু ২০০৪ সালেও এর পরিমান ছিল ৪৯.৫%। এটা যথেষ্ট উদ্বেগজনক। এর একটি কারণ হতে পারে কৃষি কাজে নিয়োজিতদের শ্রমিক হিশেবে চিহ্নিত করে স্ব-নিয়োজিত কৃষকদের একেবারে গণ্য না করা, অথবা আসলেই কৃষি কাজ থেকে কৃষক সরে যাচ্ছে। গ্রামের নতুন প্রজন্ম কৃষি কাজে থাকছে না, জমি বিক্রি করে বিদেশ যাচ্ছে ‘প্রবাসী শ্রমিক’ হয়ে। সেখানে মানবেতরভাবে খাটা খাটুনি করে দেশে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছে, দেশের প্রবৃদ্ধি হচ্ছে কিন্তু কৃষক থাকছে না। মেয়েরা গ্রাম থেকে চলে আসছে শহরে গার্মেন্ট শ্রমিক হয়ে, কাজেই তারাও কৃষি কাজ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। মেয়েরা কৃষিতে অনেক গুরুত্বপুর্ণ ভুমিকা রাখে। বর্তমান প্রজন্মের মেয়েদের অংশগ্রহণ কৃষিতে পাওয়া যাচ্ছে না।
বর্তমানে কৃষক হিশেবে যারা আছেন তাদের দুরাবস্থা দেখেই ভবিষ্যত প্রজন্ম এই কাজে আসছে না, এমন কি কৃষকরা নিজেদের সন্তানদের কৃষি থেকে দূরে রাখছেন। এ পরিস্থিতি বোঝার জন্যে ভারতের তেলেঙ্গানার এক গ্রামের মর্মস্পর্শি একটি ঘটনার উল্লেখ না করে পারছি না। এক কৃষক পিতা আত্মহত্যা করার আগে নিজের শিশুপুত্রকে শেষ কথা হিশেবে বলে গিয়েছেন ‘কৃষক হয়ো না’। এর কিছুক্ষণ পরেই তিনি গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। খবরটি ভারতের এনডিটিভির বরাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, (১৫.৭.২০১৪) ছেপেছে। আরেকজন ২০১৩ সালে আত্মহত্যাকারী কৃষকের ছেলে হায়দ্রাবাদে চলে যাওয়ায় তার বিধবা মা খুশি, যদিও তিনি ছেলেকে মাসের পর মাস দেখতে পান না। তার পরিবারে বড় ধরণের ঋণ রয়েছে। তাদের কথা “আমরা যাই উৎপাদন করি তার জন্যে লোকসান গুণে ভোগান্তির শিকার হই। ঋণ শুধু বাড়েই, কখনো কমে না।” সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০০১ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে ভারতের প্রায় ৯০ লাখ কৃষক কৃষিকাজ ছেড়ে দিয়েছেন। এরা তো সব কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তি বিশেষ করে জিএম ফসল উৎপাদন করার পর থেকে এমন অবস্থায় পড়েছেন। তাহলে কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার কৃষককে ধ্বংস করে দিচ্ছে, এই কথা কি বলা যায় না?
আমরা যে শাকসবজি খাই তারা আদৌ নিরাপদ কিনা সেটা খুবই গুরুতর প্রশ্ন হয়ে উঠেছে। দেখুন, এখানে কিভাবে আধুনিক চাষী খাদ্য ও জমিকে বিষাক্ত করে তুলেছে। বিচ্ছিন্ন ভাবে একা কোন কৃষক সারবিষ মুক্ত নিরাপদ কৃষি পরিবেশ গড়ে তুলতে পারে না। এক সঙ্গে যৌথ ভাবে কৃষকের নিত্যদিনের সংগ্রাম হিসাবে নয়াকৃষি আন্দোলন গড়ে ওঠার পেছনে এটাই বড় কারন।
বিশ্বে আধুনিক কৃষি বলেও আর কিছু নেই, নেই সবুজ বিপ্লব নামক কোন নীতি্র গ্রহণযোগ্যতা। সবুজ বিপ্লব মানে সার-কীটনাশকের ব্যবহার এবং তার ফলে পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্যের ক্ষতি এখন বিশ্ব ব্যাংক, জাতি সংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থাসহ অনেকেই স্বীকার করে। ইংরেজীতে Green Revolution কে Grey Revolution হিশেবে আখ্যায়িত করা হয়। ব্যাপক পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্যের ক্ষতি হয়েছে। রাসায়নিক সার, কীটনাশক ব্যবহারের কারণে কেঁচো থেকে শুরু করে প্রজাপতি, মৌমাছিসহ ছোট, বড় প্রাণী ও জীব-অনুজীব ধ্বংস হয়েছে, মাটির উর্বরতা নষ্ট হয়েছে, পানি বিষাক্ত হয়েছে, তাই সবুজ বিপ্লব আর সবুজ থাকেনি। সবুজ বিপ্লবের সময় থেকেই শুরু হয়েছে কৃষকের সংখ্যা কমে যাওয়ার ঘটনা, কিন্তু তারপর বাজারে কীটনাশক ও রাসায়নিক কোম্পানির নেতৃত্বে এসেছে হাইব্রিড বীজ, তখন কৃষকের অবস্থা আরও নাজুক হয়েছে। কৃষি পরিবার বলতে যা বোঝায়, যেখানে নারী-পুরুষ উভয়ে মিলে ফসল উৎপাদন ও বীজ সংরক্ষণের কাজ করে সেই পরিবারগুলো ভেঙ্গে যাচ্ছে। পরিবারে কৃষিকাজ থাকলেও বীজ রক্ষার কাজ নারীর হাতে আর নেই। স্বামী বাজার থেকে প্যাকেটে বীজ ও কীটনাশক কিনে তাদেরই দেয়া পরামর্শে ফ্যাক্টরীর মতো করে ফসল উৎপাদন করছেন। এর ফলে গ্রামীণ নারীর অর্থনৈতিক অবদান কমে যাচ্ছে। কৃষিতে নারীর জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও তার মর্যাদার ক্ষতি হয় এমন প্রযুক্তির ব্যবহারের ক্ষেত্রে যারা কোন চিন্তা-ভাবনা করেন না, তাদের জানাতে চাই তাদের এই নীতিও নারীর প্রতি বৈষম্য , অসমতা ও নির্যাতনের জন্যে দায়ি।
সবুজ বিপ্লবে সরকারের মাধ্যমে, হাইব্রিড বীজ ব্যবসায়ীর পাশাপাশি এখন কৃষি চলে যাচ্ছে বড় বড় বহুজাতিক কোম্পানির হাতে, তথাকথিত বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি জেনেটিকালী মডিফাইড অর্গানিজম বা জিএমও প্রবর্তনের মধ্যেমে। এখন বিশ্বে যেসব বড় বড় কোম্পানি কৃষির ওপর নিয়ন্ত্রণ নিতে আগ্রহী তারা এখন এমন বীজ প্রবর্তন করতে চায় যার মালিকানাসহ নিয়ন্ত্রণ কোম্পানির থাকবে। তারা বলছে ‘We, the corporations, own the seeds. You, the farmer, cannot save or replant them by law; you must buy new seeds every year from us, the corporations. [Ref: GMOs - who will feed us and what will they feed us? Nana Ama Amamoo 2013-09-26, Issue 647 http://pambazuka.org/en/category/features/89001] ’ আমরা, কর্পোরেশানরা, বীজের মালিক। তুমি, কৃষক, আইনগতভাবে বীজ রক্ষা বা পুণউৎর্পাদন করতে পারবে না; তোমাকে প্রতিবছর নতুন বীজ কিনতে হবে আমাদের (কর্পোরাশানের) কাছ থেকে”। এই কর্তৃত্বকারী কোম্পানীর সংখ্যা খুব বেশী নয়। মাত্র ১০টি বহুজাতিক কোম্পানি বিশ্বের ৭৩% জিএম বীজের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। এই দশটির মধ্যে মাত্র ৩টি কোম্পানি মনসান্তো, সিনজেন্তা ও ডু-পন্ট ৫৩% বাজার দখল করে আছে। তবে এই তিন মোড়লের মধ্যে মনসান্তো একাই ২৩% বাজার দখলে রেখেছে। [Who Owns Nature, Corporate Power and the Final Frontier in the commodification of life, ETC group, 2008] এরাই আবার কীটনাশকের বাজারে ৯৫% দখল করে আছে। অর্থাৎ বীজের বাজার ও কীটনাশকের বাজার একই কোম্পানির হাতে রয়েছে।
প্রচুর সুর্যালোক, উত্তরে হিমালয়ে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে বৃওষ্টিপাত এবং বিশাল তিন নদির মোহানায় জেগে ওঠা বদ্বীপ বাংলাদেশের জমি অতি উর্বর। এই দেশ কৃষি ফসলের দেশ, যাকে বলে সুজলা সুফলা শস্য শ্যমলা বাংলাদেশ। অথচ এই কৃষিকে ক্রমাগতভাবে কৃষকের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে বহুজাতিক কোম্পানির হাতে সোপর্দ করা হচ্ছে। এই দেশে কোন প্রয়োজন ছাড়াই জিএম ফসলের প্রবর্তন করছে। এবং খুব গর্বের সাথে ঘোষনা দেওয়া হচ্ছে যে বাংলাদেশ জিএম ফসল উৎপাদনকারি ২৮টি দেশের সাথে যোগ দিচ্ছে। বলা হচ্ছে আমরা আমাদের প্রাণ ও প্রাণের বৈচিত্র্য বিকৃতি ঘটাচ্ছি, এবং এটা খুব আনন্দের বিষয়! এই ঘোষনা এসেছিল ২০১৩ সালে প্রথম জিএম খাদ্য ফসল বিটি বেগুনের মাঠ পর্যায়ের চাষের অনুমোদন দেয়ার সময়। দেশে কৃষক সংগঠন ও পরিবেশ সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ করা হয়েছে, কিন্তু সরকার তাতে কর্ণপাত করেনি। বিশ্বের পরিবেশবাদী সংগঠন এবং স্বাধীন বিজ্ঞানীরাও প্রধান মন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রী ও পরিবেশ ও বন মন্ত্রীর কাছে সরাসরি চিঠি লিখেছেন এই অনুমোদন না দেয়ার জন্যে। এরপর ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে ২০ জন কৃষককে বিটি বেগুনের চারা দেয়া হয়, কিন্তু চাষ করে কৃষকের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা লাগবে না বলে এই প্রযুক্তি দেয়া হলেও বেগুন গাছের পাতায়, ডগায় এমনকি ফলেও পোকা লেগেছে। বিটি বেগুনের ব্যর্থ অভিজ্ঞতার পরও আরো পাঁচটি বিটি ফসলের অনুমোদন দিয়েছে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের ন্যাশনাল কমিটি অন বায়োসেফটি (এনসিবি) (বণিক বার্তা ১৪ জানুয়ারি, ২০১৫)। এর মধ্যে দুটি ধানের জাত, দুটি আলুর এবং একটি তুলার জাত রয়েছে। এই তথ্য থেকে পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে বহুজাতিক কোম্পানি বাংলাদেশকে দুর্বল আইনী ব্যবস্থা, অগণতান্ত্রিক ও অস্থির রাজনৈতিক অবস্থার সুযোগ নিয়ে তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করতে চাচ্ছে। কারণ এশিয়ার অন্যান্য দেশে এতো সহজে আর কোন দেশে অনুমোদন নিতে পারবে না। কারণ এখানে যারা পরিবেশ, স্বাস্থ্য ও কৃষকের স্বার্থ রক্ষার কথা বলছেন তাদের কথা না শুনলেও কোন জবাবদিহি করতে হয় না। এখানে শিক্ষিত মানুষ জিএম প্রযুক্তিকে বিজ্ঞানের অবদান বলে খুব স্বাগত জানান। যদিও যারা বিরোধিতা করছে তারাও বিজ্ঞানের পক্ষে। বোঝা দরকার যে কর্পোরেশান নিয়ন্ত্রিত প্রযুক্তি বিজ্ঞানের জন্যে নয়, তাদের মুনাফার জন্যে প্রবর্তন করা হয়। দুঃখজনক হচ্ছে বাংলাদেশ সরকার এমন আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত নিয়ে দেশের মানুষের স্বাস্থ্যের ও পরিবেশের ক্ষতি করছে এবং কৃষক হাত থেকে কৃষি বীজ কেড়ে নিয়ে বহুজাতিক কোম্পানির ওপর নির্ভরশীল করিয়ে দিচ্ছে।
শেষ করবো কিছু আশার কথা বলে। যতোই কর্পোরেশানগুলো বীজের বাজারে দখল নিক, এখনো বিশের ৭০% খাদ্য সাধারণ কৃষকরাই মাত্র ২৫% চাষাবাদী জমিতে উৎপাদন করছে। কৃষকের নিজস্ব জ্ঞানের ব্যাবহার করে বৈচিত্র্যপুর্ণ, পুষ্টিকর এবং সুস্বাদু খাদ্য তারা উৎপাদন করছেন এবং শুধু মানুষ নয় অন্য সকল প্রাণীর খাদ্যের যোগান দিচ্ছেন। তারাই এখনো বিশ্বের এক তৃতীয়াংশ মানুষের জীবন-জীবিকার সংস্থান করছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের এই ঝুঁকিপুর্ণ সময়ে বিশ্বের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যে রাসায়নিক সার-কীটনাশক ছাড়া উৎপাদন গুরুত্বপুর্ণ ভুমিকা রাখছে এবং ভবিষ্যতে এটাই সমাধান হিশেবে আসবে।
বাংলাদেশও তেমন একটি দেশ। এখানে এখনও ধানের বৈচিত্র্য, শাক-সব্জি, মাছের বৈচিত্র্য ধরে রেখেছে কৃষক এবং জেলেরা। হাঁস-মুরগী, গরু-ছাগলের স্থানীয় জাত এবং স্থানীয় ফসলের বীজ ধরে রেখেছে নারীরা।
কাজেই প্রযুক্তি নির্ভর কৃষি উৎপাদনের পরিকল্পনা নয়, কৃষকের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও পরিবেশ নির্ভর কৃষিকে মানুষের প্রয়োজনে কাজে লাগাতে হবে। কোম্পানির মুনাফার জন্যে নয়, মানুষের পুষ্টি, সুস্থ থাকা এবং জীবন-জীবিকা চালানো সব চিন্তা করতে হবে।