নারী ধর্ষণ ও নারী সংগঠনের ভুমিকা
ফরিদা আখতার || Tuesday 08 August 2017 ||দেশে জাতীয় নির্বাচনের মাত্র দেড় বছর বাকী, এই সময়ে জনগণের ভোটের অধিকার প্রয়োগের নিশ্চয়তা নিয়ে শান্তিপুর্ণভাবে নিরপেক্ষ একটি নির্বাচন হবে কিনা এসব প্রশ্ন নিয়ে আমাদের সংবাদ মাধ্যম ব্যস্ত থাকার কথা। কিছুটা থাকছেও। তাছাড়া বন্যা পরিস্থিতি, ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরের অতিবৃষ্টিতে সৃষ্ট জলজট, পাহাড়ধস, খাদ্য ঘাটতির সম্ভাবনা – কোনটাই কম নয়। দেশের মানুষের জন্যে দুশ্চিন্তার বিষয়। কিন্তু এতো সব জরুরি বিষয় থাকতে আমরা ব্যাস্ত থাকতে বাধ্য হচ্ছি ধর্ষণ ও নির্যাতনের মতো নির্মম ও পৈশাচিক ঘটনা নিয়ে। জাতীয় পর্যায়ের খবরের একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে নারী নির্যাতন বা আরো স্পষ্ট করে বললে নারী ধর্ষণের কথা। মর্মান্তিক এবং ভয়াবহ এসব ঘটনা, এখানে বয়সের বা স্থান কাল পাত্রের ভেদ নেই। একের পর এক ঘটে চলেছে নারী নির্যাতন। প্রতিদিন একটি ঘটনার তথ্য বলা কওয়া শেষ না হতেই আর একটি ঘটনা যুক্ত হচ্ছে। ভিন্ন ধরণের, ভিন্ন পরিস্থিতিতে, ভিন্ন বয়সে মেয়েদের নিয়ে। শুধু মিল এক জায়গায়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যারা এসব করছে তারা ক্ষমতার খুব কাছাকাছি। অধিকাংশই বিশেষ দলের অঙ্গ সংগঠনের নেতা বা কর্মী।
ধর্ষণের ঘটনা নতুন নয়। কিন্তু এ বছর (২০১৭) যেন সব বছরগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে। আইন ও সালিস কেন্দ্র বলছে পত্র- পত্রিকায় ছাপা খবর অনুযায়ী জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৩১৯ টি ধর্ষণের ঘটানা ঘটেছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ বলছে ৪২৯ টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, তাছাড়া ১০৪টি গণ ধর্ষণ এবং ৮০টি যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটেছে। মানুষের জন্য’র হিশাব মতে ২২৯ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। শিশুদের মধ্যে চার বছর বয়সী শিশুও রয়েছে, যাকে ধর্ষণের পড় হত্যা করা হয়। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের তথ্য হচ্ছে এ বছর জানুয়ারি থেকে জুন ৩৭১ নারী ও শিশু ধর্ষিত হয়েছে, এর মধ্যে বেশিরভাগ (২৬৩ জন) মেয়ে শিশু। ৯ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে।
এই পরিসংখ্যান ভয়াবহ। একটি দেশের ভাবমুর্তির জন্যে হুমকি বলা যায়, কিন্তু আমাদের কারো কোন মাথা ব্যাথা নেই মনে হয়। ঘটনা যা ঘটছে তা মিডিয়ায় বিস্তারিত আসছে, বেশ সমালোচনাও হচ্ছে। ড্রয়িং রুমে বসে বা টেলিভিশনের সামনে বসে আমরা দুঃখও করছি। ক্ষোভ ও প্রকাশ করছি। খবরে ধর্ষণের ঘটনা ফরেন্সিক প্রতিবেদনে প্রমান মেলা কিংবা ধর্ষণকারীকে গ্রেফতার পর্যন্ত এসে থেমে যাচ্ছে। আর থামবে নাই বা কেন। এরই মধ্যে তার চেয়েও মারাত্মক ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। যেমন বগুড়ায় মেয়েকে ধর্ষণ ও পরে মা সহ মেয়েকে মাথা ন্যাড়া করিয়ে দেয়া, ধর্ষণকারীর স্ত্রীসহ অপরাধের সাথে যুক্ত হওয়া, জন প্রতিনিধি (নারী কাউন্সিলার) যার কাছে বিচারের জন্যে যাওয়ার কথা, তিনি নিজেই অপরাধীর পক্ষ নেয়া, ইত্যাদি বিষয় সবাইকে হকচকিয়ে দেয়।
আমরা নারী সংগঠন হিসেবে যতো সোচ্চার বা প্রতিবাদে ফেটে পড়ার কথা ছিল তার কিছুই হচ্ছে না। দুই একটি মানব বন্ধন, তাও জাতীয় পর্যায়ে নয়, জেলায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আমাদের অনেক নারী নেত্রীরা বর্তমান সংসদে সংরক্ষিত আসনেও আছেন। এই সময় তাঁদের একটা ভুমিকা রাখার উপযুক্ত সময় ছিল। তাঁরা বিষয়টি সংসদে উত্থাপন করা এবং স্পীকারের কাছে স্মারকলিপি দিয়ে রাজনৈতিক ভাবেও অবদান রাখতে পারতেন। স্পীকার শিরিণ শারমিন চৌধুরি নিজে একজন আইনজীবি এবং স্পীকার হবার আগে তিনি মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। ফলে সেদিক থেকে তার অভিজ্ঞতার অভাব নেই। এই সময় একজন নারী স্পীকার, যার নারী অধিকার বিষয়ে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা রয়েছে, জাতীয় সংসদে বিষয়টিকে জাতীয় ইস্যুতে পরিণত করতে পারতেন। সেক্ষেত্রে সংসদ নেতা এবং প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেতার সবার সমর্থন মিলত বলে আমার বিশ্বাস। যেসব নারী সংগঠন বর্তমান সরকারের মতাদর্শের কাছাকাছি বলে বিব্রত হয়ে চুপ হয়ে আছেন তাঁরাও এর সাথে যুক্ত হয়ে উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারতেন। এর ফলাফল ইতিবাচক হোত। রাজনৈতিক ক্ষমতার কারণে যারা ধর্ষণের মতো পৈশাচিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে তারা অন্তত সাবধান হয়ে যেতো যে এভাবে তারা পার পাবে না। তাদের প্রতি দলের এবং সহযোগীদের কোন সমর্থন নেই। এই সব কথা আমি হয়তো অযাচিতভাবেই বলছি। কিন্তু দেশের একজন নাগরিক হিসেবে এই প্রত্যাশাটুকু আমি করতেই পারি।
আমি এবিষয়ে টেলিভিশনে কয়েকটি টক শো দেখেছি, যেখানে অতিথিদের মধ্যে বিএনপি, আওয়ামী লীগের নারী নেত্রী এবং নারী অধিকার কর্মীকে আনা হয়েছে। ভাবখানা এমন যে আওয়ামী লীগ আমলে এবং আওয়ামী লীগের দলের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এই কাজ করেছে, কাজেই বিএনপি তাদের ভালোভাবে ধরতে পারবে। আওয়ামী নেত্রীরা বলছেন, আমাদের দলের হলেও আমরা তাদের শাস্তি দিচ্ছি, দল থেকে বহিস্কার করছি, ব্যাস। আমাদের দায়িত্ব শেষ। তাছাড়া এই ঘটনা বিএনপি আমলেও তো হয়েছে, যেমন ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা। বিএনপি বলছে বিএনপি আমলে এতো ঘটনা ঘটেনি, শুধু ইয়াসমিন ছাড়া। তারা বর্তমানের ঘটনার ফিরিস্তি দিতে থাকেন। মনে হয় যেন এই ফিরিস্তি দিয়ে খুব আনন্দ পাচ্ছেন কারণ এটা আওয়ামী সরকারের দুর্বলতা প্রকাশ পায়। আর নারী নেত্রীরা এর কারণ অনুসন্ধানে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, দীর্ঘ মেয়াদী সমাধান খোঁজেন ইত্যাদি। কেউ কেউ এর সাথে যৌনতার সম্পর্ক কতখানি আছে বা নাই তার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেন। একটি চ্যানেলে তিনজন নারী অতিথিকে নিয়ে একজন পুরুষ সঞ্চালক আলোচনা করছেন “পুরুষ কেন ধর্ষণ করয়ে?” আমার হাসতে ইচ্ছে করেছে, তারা কি ঠাট্টা করছে? এই আলোচনা পুরুষদের নিয়ে করা হলেও বুঝতাম পুরুষরা নিজেরা বুঝতে চাচ্ছে, কেন এমন ঘটনা ঘটছে? পুরুষরা কি নিজেরা উপলব্ধি করেন না তাদের মধ্যে স্বল্পসংখ্যক পুরুষরা এই কাজ করলেও সকল পুরুষের দিকেই আঙ্গুল উঠছে। অথচ ভাই, বাবা, বন্ধু বা স্বামী হিশেবে তারা নিজেরাও নির্যাতিত হচ্ছে, তাদের কষ্ট নারীদের চেয়ে কম নয়। নির্যাতিতা নারীর সাথে আত্মীয়তা না থাকলেও পুরুষরা কি দেশের মানুষ হিশেবেও কষ্ট পান না? নিশ্চয়ই পান। এবং তাই তাঁদের কলম দিয়ে লেখা বের হয়, প্রতিবাদ আসে। আমি তাঁদের ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করতে চাই না, কারণ তাঁরা তাঁদের দায়িত্ব হিসেবেই করেছেন।
নারীদের জন্যে ভাল কিছু ঘটলে বলি এ দেশ নারী-বান্ধব কারণ দেশের সর্বোচ্চ সকল পর্যায়ে নারী আছেন এবং বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী নারীর ক্ষমতায়নের জন্যে বিশেষভাবে চেষ্টা করছেন। অনেক নারী মন্ত্রী আছেন, তাঁরা বিচার বিভাগ নিয়ে কথা বলছেন, অন্যান্য সকল রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে মন্তব্যও করছেন। এখন সকল ক্ষেত্রে নারীদের দেখলে আশা জাগে। নারীদের শক্তি বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা আর পুরুষদের ওপর নির্ভরশীল নয়। তারাই পরিবার, সমাজ এবং দেশের চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে। আমরা বিশ্বাস করি নারীর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জিত হলে তার প্রতি নির্যাতন কমে যাবে।
কিন্তু তাহলে ধর্ষণের মতো এতো নির্মম ঘটনা কেন ঘটছে? এখানে আমাদের সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোকে একটু পর্যালোচনা করে দেখতে হবে। এখন যা ঘটছে তার মধ্যে নারী ধর্ষণ যে্মন আছে তার চেয়ে বেশি আছে কন্যা শিশু ধর্ষণ। অর্থাৎ নারীর অগ্রগতির বা পশ্চাদপদতার সাথে সম্পৃক্ত বিষয়টি নয়, এখানে কোন কারণে সমাজে ক্ষমতার এমন বিকৃতি ঘটেছে যার প্রকাশ দেখতে পাই এমন পৈশাচিক আচরণের মধ্যে। রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রদর্শন অবশ্য নারী ধর্ষণের মধ্যেই দেখা যাচ্ছে, আর সামাজিক ক্ষমতার, ধর্ষণকারী নিজেই যে পর্যায়েরই হোক না কেন, সে তার এই ক্ষমতা দেখাতে চায়।
সমাজে কিছু বদলও এসেছে, যার ইতিবাচক ও কিছুটা নেতিবাচক দিকও আছে। যেমন আগের তুলনায় ধর্ষণ বেড়েছে বললে সবটা সঠিক বলা হয় না এই কারণে যে আগে এতো প্রকাশ হোত না। নির্যাতিতা নারী, তার পরিবার সকলে চুপ করে থাকতো, পুলিশে রিপোর্ট হোত কম। কিন্তু সেদিক থেকে এখন ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। কেউ বিচার চাইতে চাইলে তার সে সুযোগ আছে। আগে ধর্ষিতা নারীর ছবি ও বর্ণনা ছাপা হোত বিস্তারিত। এখন ধর্ষণকারীকে প্রকাশ্যে দেখানো হয়, তার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে ওঠে। তার পরিবারও ছেলের অপরাধের কারণে লজ্জিত হতে হয়, সমাজে হেয় হতে হয়। যতোই ক্ষমতাবান হোক তাদের কেউ বাহবা দেবে না। ধর্ষনের ঘটনা প্রকাশ হবার পর সেই পুরুষ এবং তার পরিবার বিচারের আগেই শেষ হয়ে যায়। যদিও অনেক বড় বড় ধর্ষনের ঘটনা যেমন কুমিল্লার তনু ধর্ষণ ও হত্যা সম্পর্কে এখনো কিছুই হয় নি। ঢাকার রেইন্ট্রি রেস্টুরেনেটে ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনায় অনেক তোলপাড় হয়েছে , কিন্তু সঠিক বিচার এখনো দেখা যাচ্ছে না। আবার গাজীপুরের মেয়েটিকে ধর্ষণের তার বাবা তাকে নিয়ে আত্মহত্যা করলো, তার ব্যাপারে কিছু হোল না। এখানে ধনী ও গরিবের পার্থক্য দেখা যায়। একের পর এক চাঞ্চল্যকর ঘটনার সংখ্যা ও ধরণ বেড়ে যাওয়া বিষয়টিকে সহনশীল করে তুলছে না তো?
ধর্ষণকারীর ছবি দেখানো হলেও এখনো মিডিয়ার আগ্রহ থাকে ধর্ষিতা নারীর কথা শোনার। টিভি টক শো এবং খবরে তাদের প্রতি সহমর্মিতা দেখাতে গিয়ে তার ছবি আবছা করে দিয়ে কন্ঠ শোনানো হয়। এমন একটি অনুষ্ঠানে বগুড়ার মেয়েটি অনুরোধ করেছিল আমাদের তো এরপর সমাজে বাঁচতে হবে। তাই যারা আমাদেরই উপকারের জন্যে ফেসবুকে আমাদের ছবি ছাপিয়েছেন তাদের প্রতি অনুরোধ এগুলো ডিলিট করেন। মেয়েটি বারে বারে এই কথাই বলছিল।
ধর্ষিতা মেয়ের ছবি না দেয়া এবং তার বর্ণনা না ছাপানোর ব্যাপারে নারী আন্দোলনের বিশেষ ভুমিকা আছে। সেটা শধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বব্যাপী। নব্বুইয়ের দশকে বাংলাদেশ নারী আন্দোলন এ ব্যাপারে অনেক গঠনমূলক ভুমিকা রেখেছিল এবং তারা সব সময় তাদের কাজ রাজপথে এবং নীতিনির্ধারণে একইসাথে করেছেন।
বর্তমান সময়ে নারী সংগঠন মাঠে নেই তার অনেক রাজনৈতিক ও সামাজিক কারণ থাকতে পারে। যে কারণই থাকুক আমরা নারী আন্দোলনের কর্মী হিসেবে নিজেদের দায়িত্ব এড়াতে পারি না। নারীদের প্রতি নির্যাতনের যে এখনকার যে পরিস্থিতি তা নিয়ে মাঠেই থাকতে হবে তার কোন বিকল্প নেই। তবে এখন তা শুধু নারী সংগঠনের একার কাজ হিসেবে না দেখে সকল প্রগতিশীল মানুষের, রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব হিসেবে নিতে হবে। নেতৃত্বে নারীদের থাকাটা এই আন্দোলনের সঠিক দিক নির্দেশনা দেবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
আসুন আমরা নারী ও শিশু ধর্ষণের বিরুদ্ধ্বে দল মত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হই। এখন দোষারোপের সময় নয়, এখন সময় নারী ও শিশুদের রক্ষা করার।
বন্ধ হোক এই পৈশাচিকতা।