বিশ্ব জৈব কৃষি সম্মেলন, ২০১৭
ফরিদা আখতার || Tuesday 14 November 2017 ||দিল্লী ও তার আশ-পাশের এলাকা ঘন ধোঁয়ায় ছেয়ে গেছে। কুয়াশা নয়, বাতাশ দূষিত হয়ে এই অবস্থা হয়েছে। বলা হচ্ছে পাঞ্জাব ও হরিয়ানার কৃষকরা ধান কাটার পর খড় পুড়িয়ে দেয় বলেই এই অবস্থা। অন্যদিকে বলা হচ্ছে, শুধু খড় পোড়ালে এই অবস্থা হোত না, এর সাথে যুক্ত হয়েছে গাড়ী ও শিল্প কলকারখানার ধোঁয়া। নভেম্বরের এই সময়ে বাতাস স্থির থাকে তাই সব দূষিত ধোঁয়া জড়ো হয়ে বের হতে পারছে না। এবার বাতাসের দূষণের কথা ভেবেই সরকার দিওয়ালিতে পটকা ফোটাতে দেয় নি। কিন্তু তবুও রক্ষা হোল না। একটু বৃষ্টি হলেও হয়তো রক্ষা পাওয়া যেতো। কিন্তু হোল না। স্কুলগুলো রবিবার ১২ নভেম্বর পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করেছে।
এমন পরিস্থিতিতে ৯ – ১১ নভেম্বর ভারতের উত্তর প্রদেশের গ্রেটার নয়ডার ইন্ডিয়া এক্সপো সেন্টারে অনুষ্ঠিত হয়েছে ‘ইফোম’-এর ১৯ তম বিশ্ব জৈব কৃষি কংগ্রেস। দিল্লী থেকে ৪০ কি.মি দূরে গ্রেটার নয়ডার এক্সপো সেন্টারে আয়োজন করা হয় এই সম্মেলনের। প্রতি তিন বছরে এই কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয় এবং বিপুল সংখ্যক কৃষক, গবেষক, কৃষক সংগঠনের প্রতিনিধি, বিজ্ঞানী এবং সরকারি বেসরকারি সংগঠন এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন।
‘ইফোম’ ইংরেজিতে International Federation of Organic Movements – Organics International (IFOAM)। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যারা ‘অরগেনিক ফার্মিং’ বা জৈব কৃষি নিয়ে কজা করছেন এবং আন্দোলন-সংরাম করছেন এটা তাদের আন্তর্জাতিক ফেডারেশান। তিন বছর পরপর তারা আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করেন। উনিশ্তম সম্মেলন তারই ধারাবাহিকতা। এবার দিল্লিতে ১১০ টি দেশের কয়েকশত প্রতিনিধি এসেছেন; ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে এসেছেন প্রায় হাজার খানেক। সব মিলিয়ে প্রায় ২০০০ মানুষ এক জায়গায় জড়ো হয়েছেন। আধুনিক কৃষির নেতিবাচক দিক থেকে সরে এসে যারা জৈব কৃষির চর্চা করছেন তাদের মধ্যে সামনের সারির প্রায় সকলেই হাজির ছিলেন।
বাংলাদেশ থেকে বড় ধরণের প্রতিনিধিত্ব নেই, তবে নয়াকৃষি আন্দোলন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভাবে পরিচিত কৃষকদের একটি আন্দোলন। তাঁরা এবার দিল্লীতে নয়াকৃষির প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে চেয়েছেন। তাঁরা প্লেনারিতে নয়াকৃষি সম্পর্কে বলবার জন্য নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। যা ছিল আমামদের জন্য খুবই গৌরবের।
এরই মধ্যে ভারত সরকার ‘অর্গানিক ভারত’ এর ঘোষণা দিয়েছে, এবং এই কংগ্রেসের প্রতি তাদের সমর্থন জানিয়েছে। যদিও রাসায়নিক কৃষির প্রতিই ভারত সরকারের ঝোঁক এবং তারা জিএম ফসলও প্রবর্তন করেছে, তবুও ইফোমের এই কংগ্রেসে ভারতের এই ঘোষণা খুবই তাৎপর্যপুর্ণ। এই ঘোষণা থেকে বাংলাদেশ সরকার আশা করি শিক্ষা নেবেন। খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কংগ্রেস উদ্বোধন করবার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত কৃষি মন্ত্রী শ্রী রাধা মোহন সিং উদ্বোধন করেছেন। সাথে ছিলেন উত্তর প্রদেশের ইউনিয়ন মন্ত্রী সুর্য প্রতাপ সাহী। কংগ্রেসে সিকিমের মুখ্য মন্ত্রী শ্রী পবন কুমার চামলিংকে বিশেষ সম্মাননা দেয়া হয় কারণ তিনি সিকিম রাজ্যের কৃষিকে রাসায়নিক-মুক্ত করেছেন। রাসায়নিক সার-কীটনাশকে ১০% হারে ভুর্তুকি কমাতে কমাতে এখন আর কৃষকরা রাসায়নিক সার কীটনাশক ব্যবহার করেন না। এখন কোন ভুর্তুকি নাই।
কৃষিমন্ত্রী রাধা মোহন সিং সবুজ বিপ্লবের তীব্র সমালোচনা করলেন। হিন্দিতে দেয়া দীর্ঘ বক্তৃতায় তিনি আক্ষেপ করে বলেন রাসায়নিক সার-কীটনাশকের ওপর নির্ভরশীলতার কারণে আজ মাটি মরে গেছে অথবা মাটির “বিমার”হয়েছে। তাই ভারত সরকার ২২ লাখ হেক্টর জমিতে অর্গানিক কৃষি করছে এবং ২০০ কোটি রুপী বরাদ্দ দিয়েছে। তিনি বলেন ‘ধরতি মাতা’র স্বাস্থ্য রক্ষার জন্যই এই কাজ করতে হবে। তার শরীর কমজোর হয়ে গেছে। যদিও একটি বারও তিনি জিএম ফসল সম্পর্কে কিছু উচ্চারণ করেন নি, এবং কৃষকদের আত্মহত্যা নিয়েও কোন দুঃখপ্রকাশ করেন নি। বলেন নি ভারত সরকার জিএম ফসল সম্পর্কে কি সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।
ভুটানের কৃষি মন্ত্রী লুম্পো এসেই দর্জী বলেন ভূটান জৈবিক কৃষির দেশ। ভূটানের মুল লক্ষ্য হচ্ছে জাতীয় আনন্দের হার (Gross National Happiness) অর্জন করা। আর তা করতে গিয়ে কোন মতেই রাসায়নিক সার দিয়ে চাষাবাদ করা চলে না। মানুষের সুখ অর্জন করতে হলে তাকে রাসায়নিকমুক্ত হতেই হবে। তাই ভূটান পুরো দেশটাই অর্গানিক। এই দেশে সার কীটনাশকের ব্যবহার নাই।
উদ্বোধন শেষ হলে শুরু হয় সম্মেলনের আলোচনা অনুষ্ঠান। একের পর এক চলতে থাকে কয়েকটি হল রুমে। শুধু প্লিনারীতে সবাই এক সাথে থাকেন, বাকী সময়ে নিজের পছন্দের বিষয় নিয়ে নির্ধারিত হল গুলোতে ভাগ হয়ে যান। অনুষ্ঠানসূচি নিয়ে একটি বই ছাপানো হয়েছে। সেটা সবার হাতে হাতে, কোথায় কোন আলোচনা হচ্ছে তা লেখা আছে। তা দেখেই ছুটছেন সবাই। পাশাপাশি সাজানো হয়েছে অর্গানিক খাদ্য ও নানা পণ্যের প্রদর্শনী। বড় বড় প্যাভিলীয়ন সাজানো হয়েছে। সেখানেও চলছে কথা বার্তা। বাইরে খোলা লবিতে সাজানো হয়েছে কৃষকদের বীজ মেলা। গম গম করছে। কথা শোনা মুশকিল, জোরে কথা বলতে হচ্ছে। তবুও থেমে নেই কেউ।
বিশ্ব জৈব কৃষি কংগ্রেস ২০১৭তে বিজ্ঞানীদের পাশাপাশি কৃষকরা অংশ গ্রহণ করেন। যেসব ফসল বা উদ্ভিদ তুলনামূলক ভাবে উপেক্ষিত তাদের গুরুত্ব নিয়ে বিজ্ঞানী ও কৃষকদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। এখানে কৃষকরা তাদের পসরা সাজিয়ে বসেছেন এবং অবোধ্য বৈজ্ঞানিক ভাষায় কথা না বলে সহজ ভাবে অংশগ্রহণকারীদের বুঝিয়েছেন কেন এই বীজগুলোর সুরক্ষা নিশ্চিত করা খুব দরকার। গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদ হিসাবে বহু গাছপালা ও ফসলকে আমরা উপেক্ষা করি, অথচ তারা প্রাণ ব্যবস্থার অন্তর্গত।
বন্দনা শিবা প্রথম প্লিনারীর বক্তা ছিলেন। তিনি বলেন ভারতের ৯৫% প্রাণবৈচিত্র্য ধংস হয়ে গেছে রাসায়নিক কৃষির কারণে। আর জিএম তুলা চাষ সুপার পেস্ট ( বা অতি মাত্রার পোকা) তৈরি করেছে। আধুনিক কৃষিতে রাসায়নিক সার-কীটনাশকের কারনে এখন সেখানে ক্যান্সার ট্রেন চালু হয়েছে। ক্যান্সারের রোগী এতো বেশি যে তাদের চিকিৎসার জন্যে যাতায়াতের বিশেষ ট্রেন চালু হয়েছে। সুইজারল্যান্ডের বিজ্ঞানী এঞ্জেলিকা হিলবেক (Angelika Hilbeck) জিএম ফসলের ক্ষতি সম্পর্কে বিস্তারিত ভাবে বৈজ্ঞানিক তথ্য তুলে ধরেন। প্রায় ৯৯% জিএম ফসল দু’ধরণের ট্রেইটের মধ্যে সীমাবদ্ধ; একটি হচ্ছে হার্বিসাইড টোলারেন্ট, যা ৮৬.৫ মিলিয়ন হেক্টার জমিতে চাষ হচ্ছে, অপরটি হচ্ছে বিটি ইন্সেক্টিসাইড, যা ২৩.১ মিলিয়ন হেক্টার জমিতে চাষ হচ্ছে। মাত্র ৪টি ফসলে জিএম সীমিত হয়ে আছে। সেগুলো হচ্ছে সয়াবিন, ভূট্টা, তুলা এবং কানোলা। বাংলাদেশের বিটি বেগুন এবং গোল্ডেন রাইস এর বিফলতা সম্পর্কে এঙ্গেলিকা বলেন ‘এটা মোটেও ‘আশ্চর্যজনক বিফলতা’ নয়। এটাই হবার কথা ছিল। কীটনাশকের ব্যবহার ট্রান্সিশনের সময় একটু কমে, পরে আবার বেড়ে যায়। খরা সহনশীল জিএম ফসলের কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নাই। আসলে জিএম ফসল টিকে আছে ‘অতি মাত্রায় প্রতিশ্রুতি’র ওপর। এটা ভদ্র ভাষায় বলা। আসলে জিএমও টিকে আছে মিথ্যা প্রপাগাণ্ডার ওপর।
যারা এই সম্মেলনের আয়োজন করেছেন তারা চেষ্টা করেছেন বিভিন্ন দেশের এবং বিভিন্ন প্রকার জৈব কৃষির অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে। সেদিক থেকে তারা সফল এবং আন্তরিকভাবেই করেছেন। দ্বিতীয় দিনের প্লিনারীতে জাপানের এলিস কানিংহাম তার নিজের জীবনের কথাই বলতে গিয়ে বলেন অর্গানিক কৃষি আসলে একটা জীবন ব্যবস্থা এবং জীবন দর্শন। একটা গাছ কাটা শুধু কাটাই নয়; এর যে কত চেইন প্রভাব রয়েছে তা দেখে আশ্চর্য হতে হয়। এর প্রভাব মাটি, পানি, মাছ সবকিছুতে গিয়ে পড়তে পারে। মাটি খারাপ হলে বাতাস এবং পানিও ক্ষতিগ্রস্থ হয়। মাটিকে নিঃশ্বাস নিতে দিতে হবে। যাই কিছু করিনা কেন মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা করতে হবে। মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা হলে সুস্বাদু খাদ্যও উৎপাদিত হবে। স্বাদ মাটি থেকেই আসে।
ইন্দোনেশিয়ার মান্তাসা (বাংলায় সেতু) নামক সংগঠনের হুয়া দুয়া পাত্রিয়া [Hayu Dyah Patria] গরিবের খাদ্য সম্পর্কে গবেষণা করতে গিয়ে অনাবাদী বা কম ব্যবহৃত ফসল সম্পর্কে জেনে নিজেই অবাক হয়ে যান। শুধু অনাবাদী মাশরুম আছে ৩০ জাতের। আরো খোঁজ করতে গিয়ে দেখেন ৩০০০ রকমের অনাবাদী গাছ-গাছালী আছে যা খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এমন কি একটি বিষাক্ত শেকড়কেও গ্রামের নারীরা দীর্ঘদিনের চর্চার মধ্যে খাদ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এমন উদাহরণও আছে। এই শেকড় কেটে, লবণ দিয়ে ধূয়ে তার ওপর ছাই দিয়ে শেষ পর্যন্ত বিষ নামিয়ে খাবার উপযুক্ত করেছেন। তেমনি বাঁশের কলির ব্যবহারও খাদ্য হিশেবে হয়েছে। এদিকে মনসান্তোর মত কোম্পানি এসে তাদের স্থানীয় জাতের ভূট্টা নিয়ে যাচ্ছে।
শুধু মাটির তলায় কন্দ বা আলু জাতীয় কতো রকম ফসল হতে পারে তা দেখচ্ছেন একজন কেরালার কৃষক। শুধু খাদ্য হিসাবে নয়, এদের অনেকগুলো মূল্যবান ওষুধও বটে। বাংলাদেশ একসময় কন্দ বা আলু জাতীয় ফসলে সমৃদ্ধ ছিল। কিন্তু আধুনিক কৃষির ফলে ্সেখানে ক্ষয় ঘটেছে। নয়াকৃষি আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে উপেক্ষিত ফসল ও খাদ্য পুনরুদ্ধার ও প্রবর্তন। কেরালার কৃষকদের এই চেষ্টা আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে।
কেরালার কৃষি মন্ত্রী ভি, এস, সুনিল কুমার এই অধিবেশনে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন। তিনি রাসায়নিক কৃষির ক্ষতিকর দিক নিয়ে বিস্তারিত বর্ণনা দেন এবং সেই কারনে ২০০৮ সালে তাঁর রাজ্যে জৈব কৃষি নীতি প্রণয়ন করা হয়। কেরালা ধানের জন্যে বিখ্যাত। বেশ কিছু ধানের আদি স্থল এই কেরালা। জৈব কৃষির জন্যে দুটি বিশেষ ধানের জাত নির্ধারণ করা হয় এবং রাসায়নিক সার বন্ধ করে জৈব-সার প্রবর্তন করা হয়। শুধু তাই নয় সব্জিতে কীটনাশকের রেসিডিউ কেমন আছে তা জানার জন্যে ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হয়। জৈব কৃষির সাথে নিরাপদ খাদ্যের ধারণাও যুক্ত করা হয়।
দেবিন্দর শর্মা প্রখ্যাত খাদ্য ও বাণিজ্য নীতি বিশ্লেষক। তিনি দেশের অর্থনীতির বিশ্লেষন করে দেখালেন যে প্রবৃদ্ধির সাথে মিলিয়ে কৃষি নীতি করতে গিয়ে খাদ্য উৎপাদন যেমন বেড়েছে তেমনি বেড়েছে রোগ বালাই। বিশেষ করে ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, উচ্চ রক্ত চাপের মতো ব্যয় বহুল চিকিৎসার রোগ। ফলে ওষুধ বিক্রি বাড়ছে, ডাক্তারের ও হাসপাতালের আয় বাড়ছে। প্রবৃদ্ধি তো হবেই!
বাংলাদেশের নয়াকৃষি আন্দোলনের কথা তুলে ধরেন ফরিদা আখতার। নয়াকৃষির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটা শুধু অর্গানিক বা জৈবিক নয়, একই সঙ্গে প্রাণবৈচিত্র্য কেন্দ্রিক। স্থানীয় জাতের আবাদি ও অনাবাদি ফসল রক্ষা এবং পুরানা ঐতিহ্যগত বীজ আবার প্রবর্তন করার কারনে নয়াকৃষি জৈব ফসল চাষ করবার আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। নয়াকৃষির কৃষকরা স্থানীয় জাতের বীজ রক্ষা করছেন। যে বীজ হাজার বছর ধরে তারা অতি আদরে ধরে রেখেছেন তা সম্ভব করবার সামাজিক কৌশল হচ্ছে বীজের নামকরণ। নামকরণ সামাজিক স্মৃতি রক্ষা ও কৃষি জ্ঞানচর্চার বিকাশ ঘটানোর কার্যকর উপায় । কৃষকরা বলেন, নাম না থাকলে সন্তানের লালন পালন যেমন সম্ভব নয়, তেমনি তাদের হারিয়ে যাবার সম্ভাবনাও থাকে। বিভিন্ন জাতের ফসলের নামও তেমনি। যেমন, তুলসিমালা, কটকতারা, লেম্বুরু, বাঁশফুল, টেপাবোরো,সড়সড়ি, চামারা, আবছায়া, ইত্যাদি হাজারো নাম। নাম দিয়ে কৃষক বোঝেন এই জাতের ফসল কিভাবে কখন চাষ করতে হবে, ইত্যাদি। আধুনিক কৃষি আসায় বীজের জাতের নাম সংখ্যায় পরিণত হয়েছে। ধানের নাম হারিয়ে এখন হয়ে গিয়েছে ‘নম্বরী’: যেমন, ১১, ২৮, ২৯ ইত্যাদি। শুধু সংখ্যায় পরিণত করে স্মৃতিশূন্য করা নয়, আধুনিক কৃষি কৃষিকে করেছে বিষাক্ত। ধানের বীজ থেকে শুরু করে এখন বেগুন জেনেটিকালি মডিফাইড হয়ে সংখ্যায় পরিণত হয়েছে।
নয়াকৃষি আন্দোলনের জন্য এটা খুবই গৌরবের যে আমরা এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছি। উবিনীগ ও নয়াকৃষির পক্ষ থেকে ফরিদা আখতার মূল সম্মেলনে নয়াকৃষির বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করেছেন। আমরা সোনার বাংলার গান গাই, কিন্তু কিভাবে আধুনিক কৃষি দিয়ে সেই বাংলাকে বিষাক্ত করছি আর মেরে ফেলছি সে ব্যাপারে আমাদের বিশেষ হুঁশ নাই। নয়াকৃষি আন্দোলন সবুজ শ্যামল বাংলা গড়ে তুলবার ক্ষেত্রে কৃষকদের নিয়ে কৃষি ক্ষেত্রে আমাদের বিজ্ঞান ও কৃৎকৌশলগত চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করছে যা এখন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত। ফলে তা বিশ্ব জৈব কৃষি আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও বটে।
নয়াকৃষি অর্থ শুধু আবাদী ফসল নয়, বরং আবাদী ও অনাবাদী মিলে একটি সুন্দর কৃষি পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা, যেখানে কিছু ফেলনা নয়। এই কৃষিতে আগাছা বা ক্ষতিকর কীতপতং নামক কোন ধারণা নাই, সবই প্রাণ সম্পদের অন্তর্গত। অতএব এই কৃষিবিজ্ঞান একান্তই বিভিন্ন প্রাণ এবং অপ্রাণের মধ্যে সপর্ক ও সমন্বয় রক্ষার চর্চা যাতে সামগ্রিক ভাবে প্রকৃতি থেকে আমরা উচ্ছ ফলন আদায় করে নিতে পারি। নয়াকৃষি রাজনৈতিওও বটে। কারন অর্গানিক কৃষি করার অর্থ শুধু নিজেরাই ভাল উৎপাদন করা নয়, একই সঙ্গে যারা আমাদের প্রাণবৈচিত্র্য ধংস করছে তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোও কর্তব্য।
একটি অধিবেশন শেষ হতেই ছুটতে হয় অন্য অধিবেশনে। এত বড় সম্মেলনে সময়ের ব্যাপারে উদ্যোক্তারা খুব সচেতন ছিলেন। আয়োজক, বক্তারা ও শ্রোতারা হাজির হয়েছেন সময় মতো। প্লিনারীর পরেই সমান্তরালভাবে চলেছে ফার্মার্স ট্রাক বা কৃষকের কথা, সাইন্টিফিক ট্র্যাক বা বিজ্ঞানিদের কথা, কর্মশালা ইত্যাদি। পাশাপাশি বীজ মেলা ও প্রদর্শনী। সব খানেই ভিড়। সব খানেই আলোচনা; একে অপরের সাথে আন্তরিকভাবে মেশা, জানতে চাওয়া কে কি করছে। বলাবাহুল্য একজনের পক্ষে সবগুলো শোনা বা দেখা সম্ভব নয়, তাই আগেই কোথায় কোন বক্তব্য শোনা হবে ঠিক করেই রাখা হয়।
জৈব কৃষি বা অর্গানিক ফার্মিং শুধুমাত্র রাসায়নিক বিহীন চাষাবাদ নয়; এ মধ্যে অনেক ধরণ আছে, অনেক বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষা আছে। ফার্মার্স ট্র্যাকের অধিবেশনে প্রতিদিন কম পক্ষে ২০ থেকে ২৫ জন বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি নিজ নিজ অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। মেক্সিকো, ব্রাজিল, কিউবা, বুরকিনা ফাসো, ইথিওপিয়া, যুক্ত রাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়াসহ ইওরোপ, আমেরিকা, এশিয়া, আফ্রিকা ও প্যসিফিক অঞ্চলের কৃষক অথবা কৃষক সংগঠনের প্রতিনিধিরা এসেছেন কথা বলতে। ভাষা একটা বড় সমস্যা ছিল, কারণ কোন অনুবাদের ব্যবস্থা ছিল না। ইংরেজীতেই সব উপস্থাপন করা হচ্ছিল। কিন্তু যখনই কারো সমস্যা হয়েছে, মাইকে ঘোষণা দিলে অনুবাদ করার জন্যে এগিয়ে এসেছেন অংশগ্রহণকারীদেরই কেউ। পাওয়ার পয়েন্টে ছবি দেখিয়ে অনেকে ভাষার সমস্যা ঘুচাবার চেষ্টা করেছেন। ভারতের কয়েকটি সংগঠনের নারী কৃষক এসে তাদের অভিজ্ঞতা খুব সুন্দরভাবে নিজ ভাষাতেই বললেন অনুবাদকের সহায়তায়। এই নারীরা আগে কোনদিন নিজের গ্রাম থেকেই বের হন নি। এখানে এসে হোটেলে লিফটে উঠতে গিয়ে এবং সম্মেলনের এস্কেলেটরে ভয়ে কাতর হয়েছেন। কিন্তু কৃষি কাজ নিয়ে তাদের দৃঢ়তা দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। একইভাবে ব্রাজিলের কৃষক বা মেক্সিকোর কৃষকের স্বভাবও একই রকম তাদের হাত খড় খড়ে, মুখে সরল হাসি এবং চোখে জ্ঞানের আলো যেন চিক চিক করছে।
রাসায়নিক কৃষির বৈচিত্র্য নেই, যা আছে তা কোম্পানি নির্ভর। কিন্তু অর্গানিক কৃষিতে হরেক রকম চর্চা সম্ভব, কারণ তারা প্রকৃতির সাথেই তাল মিলিয়ে কাজ করছে। রাসায়নিক সার-কীটনাশক বাদ দিলেই জৈব কৃষি হয় না, প্রকৃতিকে বুঝতে হয়, জানতে হয়। মাটি, পানি, বাতাস, চাঁদ, সুর্য, গ্রহ-নক্ষত্র সব কিছু। প্রতি নিয়ত নতুন নতুন চিন্তা গবেষণা যুক্ত হচ্ছে। বায়োডাইনামিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ নিয়ে বেশ কয়েকজন কথা বললেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন মিসর, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের কৃষক। বায়োডাইনামিক চাষ পদ্ধতির সাথে গবাদি পশু-পালনের সম্পর্ক, আবার খরা এবং শুকনো জায়গায় কি করে চাষাবাদ করা যায় তা বর্ণনা করলেন ইরানের কৃষক। ব্রাজিলে জিএম ভুট্টা চাষ করার কারণে মাটি দুষিত হবার পর কি করে অর্গানিক খাদ্য ফসল চাষ করে মাটি ঠিক করতে হয় তার উদাহরণ দিলেন ব্রাজিলের কৃষক। বীজ ব্যাংক পরিচালনা করতে গিয়ে জিএম ফসল কি করে হুমকি সৃষ্টি করছে এবং কেমন করে তা মোকাবেলা করছেন তার বর্ণনাও পাওয়া গেল। অর্থাৎ অর্গানিক কৃষি এমন একটি বিশেষ চাষাবাদ ব্যবস্থা যে কৃষকদের একই সাথে প্রতিকুল অবস্থার সাথে লড়াই করতে হয়।
বীজ মেলায় কৃষকদের দেখে মন ভরে যায়। তারা একেক ফসলের বৈচিত্র্য উপস্থাপন করার জন্যে তাদের ফসল থরে থরে সাজিয়েছেন। ধান, গম, ভুট্টা, যব, ছাড়াও সব্জি ও মসলার বীজ সাজিয়েছেন নানা ডিজাইন করে। বীজ দিয়েই আঁকা হয়েছে মানচিত্র, নিজেদের সংগঠনের নাম। আবার কথা বলছেন সবার সাথে। উত্তর দিচ্ছেন নানা প্রশ্নের। কেউ কেউ ইংরেজি জানেন না, হিন্দীও সবার ভাষা নয়। তবুও কথা থেমে নেই।
আর মুখের হাসির তো কোন ভাষার প্রয়োজন পড়ে না।
একটা মস্তো বড় হাসি ও বিপুল প্রেরণা নিয়ে ফিরে এলাম।