চাই বেগুন বাজারজাতকরণের ব্যবস্থা, প্রযুক্তি সমাধান নয়
ফরিদা আখতার || Sunday 08 April 2018 ||বেগুন ও বাজার
বাজারে বেগুনের মূল্য নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। ঢাকার কয়েকটি বাজারে খোঁজ নিয়ে জেনেছি ঢাকা মিরপুর-১ নং কাঁচাবাজারে প্রতি কেজি বেগুনের মূল্য ১০ টাকা থেকে ২০ টাকা, মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে প্রতি কেজি বেগুনের মূল্য ৩৫ টাকা থেকে ৫০ টাকা, কাওরান কাঁচাবাজার প্রতি কেজি বেগুনের মূল্য ৩০ টাকা থেকে ৪০ টাকা। ঢাকার বাইরে টাঙ্গাইল বাজারে প্রতি কেজি বেগুনের মূল্য ২০ টাকা থেকে ২৫ টাকা, পাবনার ঈশ্বরদী বাজার প্রতি কেজি বেগুনের মূল্য ২৫ টাকা, আবার নরসিংদীতে প্রতি কেজি বেগুনের মূল্য মাত্র ২ টাকা থেকে ৩ টাকা। উৎপাদন স্থল এবং ঢাকার বাজারের দামের এই বিরাট পার্থক্য কৃষক বা ভোক্তা কারোই উপকারে আসছে না, কেবল মধ্যস্বত্বভোগিরাই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। লাভ করছে তারাই। কৃষকদের মধ্যে যারা বাণিজ্যিকভাবে সব্জি চাষ করেন তাঁদের কাছে বেগুন একটি লাভজনক ফসল। অল্প জমিতে চাষ করে একই মৌসুমে কয়েকবার ফসল তুলে বিক্রি করে লাভ করা যায়। অথচ তারাই এখন হতাশ হয়ে বসে আছেন।
সম্প্রতি নরসিংদীর পাইকারী বাজারে বেগুনের দাম কমে যাওয়ার বিষয়টি পত্রিকার শিরোনাম হয়েছে ‘৬ মণ বেগুনের দামে এক কেজি গরুর মাংস!’ বাংলা ট্রিবিঊনের (৩ এপ্রিল, ২০১৮ তারিখে) প্রকাশিত একটি খবরে এমন শিরোনাম দেয়া হয়েছে। তথ্য হিসেবে বলা হয়েছে মৌসুমের শুরুতে প্রতি কেজি বেগুন ১৫ থেকে ২০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছিল কিন্তু এর পরে এক মাস ধরে বেগুনের দরপতন ঘটেছে। প্রতি কেজি বেগুন ২ থেকে ৩ টাকায় অর্থাৎ মণপ্রতি ৮০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। সার, কীটনাশক ও শ্রমিক খরচসহ প্রতি কেজি বেগুনের উৎপাদন মূল্য দাঁড়ায় ১০ থেকে ১৫ টাকা, বেগুন বাজারে আনতে পরিবহন খরচ যুক্ত করলে বাজারে যে দাম পাওয়া যাচ্ছে তা দিয়ে পরিবহন খরচও তোলা সম্ভব হচ্ছে না। কৃষি বিভাগের ব্যাখ্যা হচ্ছে, এ বছর সব্জির আবাদি জমির পরিমাণ বেড়েছে এবং বাম্পার ফলন হয়েছে, তাই দাম কমে গেছে। এদিকে কীটনাশকসহ কৃষি উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন খরচ কৃষকের থাকছেই, যা দিনে দিনে কেবল বাড়ছে।
বেগুনের মতো অতি ব্যবহৃত এবং জনপ্রিয় সব্জি সম্পর্কে নরসিংদীর বাজারের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক সংবাদ মাধ্যমে এসেছে। তা হচ্ছে পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকলেও পাইকারি ক্রেতাদের মধ্যে এসব বেগুন কেনায় উৎসাহ ছিল কম। ফলে কৃষক ভ্যানে করে বা রিক্সায় করে কষ্ট করে যে বেগুন বাজারে এনেছিলেন তার কদর দেখতে পান নি। তবুও আশা ছিল কোন পাইকারী ক্রেতা হয়তো কিনবে।
যারা হাইব্রিড ও উফসী জাতের বেগুন বাণিজ্যিকভাবে চাষ করেছেন তাদের বেগুন ক্ষেতে নিয়মিত সার,কীটনাশক প্রয়োগ করতে হয়েছে। এবং কৃষক এর জন্যে অনেক খরচ করেছেন এই আশায় যে বাজারে ভাল দামে বিক্রি করতে পারবেন। সার-কীটনাশকের খরচ বহন করতে গিয়ে অনেক কৃষক ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন, এমন খবরও প্রকাশিত হয়েছে পত্র-পত্রিকায়। বাংলা ট্রিবিউনে (৩ এপ্রিল, ২০১৮ তারিখে) প্রকাশিত খবরে কৃষক শফিকুল ইসলাম হিসাব দিয়েছেন ‘জমিতেই প্রতি কেজি বেগুনের উৎপাদন খরচ পড়ে ১০ টাকা থেকে ১৫ টাকা। তারপর পরিবহন খরচ দিয়ে বাজারে এনে বিক্রি করতে হচ্ছে ৮০ থেকে ১২০ টাকা মণ। বর্তমান বাজারে এক কেজি গরুর গোশত কিনতে গেলে ৬ মণ বেগুন বিক্রির টাকায়ও হয় না।’ এক কেজি গরুর মাংসের দাম ৪৮০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা আর ৬ মণ বেগুনের দাম ৪৮০ টাকা থেকে ৭২০ টাকা।
যারা সব্জির পাইকারী ব্যবসা করেন তারাও লাভ দেখছেন না। এ বছর বাজারে চাহিদার তুলনায় বেগুনের সরবরাহ বেশি বলেই দাম কমে গেছে; পাইকাররাও বেগুন কিনতে সাহস পাচ্ছেন না। চলতি মৌসুমে নরসিংদী জেলায় প্রায় ৮ হাজার হেক্টর জমিতে বেগুনসহ বিভিন্ন ধরনের শাকসবজির আবাদ হয়েছে বলে জানান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মো.লতাফত হোসেন।
শুধু নরসিংদী নয়, বেগুনের দাম কমেছে গাজীপুর, জামালপুর, ময়মনসিংহ, বগুড়া, রংপুর, কুমিল্লা এবং বরিশাল জেলায়। ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেস পত্রিকায় মার্চের ২৮ তারিখে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা গেছে এসব জেলায় বেগুনের দাম প্রতি কেজি মাত্র ৪ থেকে ৭ টাকা। কৃষি পণ্য বাজারজাতকরন বিভাগ (Department of Agricultural Marketing (DAM)] এর মতে গত তিন বছরে বেগুনের দামের তুলনায় এই বছর সবচেয়ে কম।
বলা হচ্ছে বেগুনের উৎপাদন বেশি হয়েছে বলেই দাম কমেছে এবং কৃষক যখন পাইকারের কাছে বিক্রি করছে তখন দাম একেবারে নেমে গেছে। কিন্তু তাই বলে কি ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরের ক্রেতারাও কম দামে বেগুন কিনছে? তা মোটেও নয়। পত্রিকাটির প্রতিবেদনে কৃষি পণ্য বাজারজাত করনের বিভাগ (Department of Agricultural Marketing (DAM) এর বরাতে বলা হয় যে ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাজারে বেগুনের দাম ৩০ থেকে ৫০ টাকা কেজি। অর্থাৎ বেশি উৎপাদনের কারণে সরবরাহ বেশি হওয়ার যুক্তিতে যদি কৃষককে বেশি দাম দেয়া না যায় তাহলে এই বেগুন যখন ঢাকা বা চট্টগ্রামে আসে তখনও তো সরবরাহ বেশিই থাকে। তাহলে শহরের বাজারে সরবরাহ বেশি হলে দাম কমবে এমন অর্থনৈতিক সুত্র কাজ করে না কেন? এই বাড়তি বেগুন তাহলে কোথায় যায়? নাকি এই যুক্তি শুধু কৃষককে ঠকানোর কাজেই পাইকার এবং মধ্যস্বত্বভোগিরা ব্যবহার করেন। কৃষি পণ্য বাজারজাত করণ বিভাগের কি এখানে করনীয় কিছুই নেই?
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ জানায় এই রবি মৌসুমে ৩১,৫০০ হেক্টর জমিতে ৩ লক্ষ ২০ হাজার টন উৎপাদনের টার্গেট বেঁধে কৃষকরা বেগুন উৎপাদন করেছে। মার্চের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত তারা প্রায় ২ লক্ষ টন বেগুন তুলতে পেরেছে, কিন্তু দাম কমে যাওয়ায় অনেকেই মাঠ থেকেই নামমাত্র দামে বিক্রি করে দিয়েছে। লাভের যে আশা ছিল তা আর হয় নি।
বেগুনসহ সকল সব্জি উৎপাদন করতে গেলে ফলনের দিকে নজর থাকে কৃষকের, সেটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। কৃষক তার জীবন-জীবিকা হিসেবেই ফসল উৎপাদনের কাজ করে। কাজেই তাকে বেঁচে থাকার জন্যে ফলনের দিকে তাকাতে হয়, ফসলের দামের দিকে তাকাতে হয়। ‘বাম্পার ফলন’ হলে সরকার বাহবা নেবে আর কৃষক মাথায় দিয়ে বসে থাকবে এটা কাম্য নয়। ব্যবসায়িরা একদিকে কৃষককে ঠকাতে পারছে অন্যদিকে বাড়তি উৎপাদন হলেও ভোক্তাদেরও সুবিধা দিচ্ছে না।
বাংলাদেশ: প্রাণবৈচিত্রের ভৌগলিক অঞ্চল।
ধান চাষের পাশাপাশি এলাকা ও জমি বিশেষে বছরের ফসল চক্রের মধ্যে সব্জি অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ ফসল। সব্জির মধ্যে আলু, বেগুন, ঢেঁড়শ, বরবটি, লাউ, মিষ্টি কুমড়া ইত্যাদী প্রায় সারা বছর পাওয়া যায়। তাছাড়া শীতকালে রবি ফসলে সব্জির ছড়াছড়ি তো রয়েছেই। এতোসব সব্জির মধ্যে আলুর পরেই ব্যবহারের দিক থেকে বেগুন দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। এই সব্জি অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং দেশে এবং বিদেশে এর চাহিদা রয়েছে। বেগুন পুষ্টির দিক থেকেও খুব গুরুত্বপুর্ণ খাদ্য তালিকায় পড়ে। এর মধ্যে মধ্যে রয়েছে প্রোটিন, শর্করা, খনিজ লবন, ম্যাগ্নেসিয়াম, ক্যালসিয়াম, জিঙ্ক, ভিটামিনসহ অনেক পুষ্টিগুণ। বেগুন একই সাথে খাদ্য এবং ওষুধি গুণ সম্পন্ন হওয়ায় এর ব্যবহার অনেক বেশী। খেতেও খুব মজা, রান্না করা সহজ, কিছু না হলে ভর্তা বা ভাজি করে খাওয়া যায়। বেগুনের নাম শুনে গুণ নাই মনে হলেও বে-শুমার গুণের অধিকারি এই বেগুন। গরিব-ধনী নির্বিশেষে এই সব্জি খায়।
বেগুনের আর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য বাংলাদেশের মানুষের জন্য তাৎপর্যপুর্ণ। ডি ক্যানডোল (১৮৮৬) অরিজিন অব কালটিভেটেড প্লান্টস (আবাদী ফসলের আদি উৎপত্তিস্থল) গ্রন্থে (Candolle 1885) উল্লেখ করেছেন যে প্রাচীন কাল থেকে বেগুন (Solanum melongena) প্রজাতি অবিভক্ত ভারতে পরিচিত। সে অর্থে বেগুন জন্মগত ভাবে এশিয়া মহাদেশের একটি প্রজাতি। রুশ বিজ্ঞানী ভ্যাভিলভ (১৯২৮) এর মতে বেগুনের আদি উৎপত্তিস্থল ইন্দোবার্মা অঞ্চল, বাংলাদেশ যার অন্তর্গত। আজও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় বিভিন্ন আকৃতির ও বর্ণের বেগুন পাওয়া যায়।
প্রাকৃতিক পরিবেশে বেগুনের সর্বাধিক বৈচিত্র্য দেখা যায় বাংলাদেশ ও মায়ানমারে। অর্থাৎ সারা পৃথিবীতে যে বেগুন পাওয়া যায় তা কোন না কোনভাবে এই অঞ্চল থেকেই গিয়েছে। খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিশেবে বাংলাদেশে ২৪৮ জাতের বেগুন আছে, কিন্তু উফশী ও হাইব্রিড জাত আসার কারণে স্থানীয় জাত বিলুপ্ত হচ্ছে, এবং চাষের ধরণ বদলে যাচ্ছে। স্থানীয় জাতের সবগুলোর চাষ না থাকলেও এখনো বাজারে গেলে কম পক্ষে ৪০-৫০ জাতের বেগুন পাওয়া যাবে। এলাকাভেদে বেগুনের বৈচিত্র্য দেখলে অবাক হতে হয়। বেগুনের বিভিন্ন নামের মধ্য দিয়র বেগুনের ভৌগলিক পরিচয়, রঙ, স্বাদ, আকার, মৌসুম ইত্যাদির তথ্য পাওয় যায়। কৃষকের দেওয়া নামের মধ্যে শুধু বেগুনের বাস্তুবিজ্ঞান চিহ্নিত (ecology) থাকে তা না, একই সঙ্গে একটি জাতকে 'গৃহস্থ' (domestication) করবার মধ্য দিয়ে ফসল কৃষকের কতো অন্তরঙ্গ সেটাও অনায়াসে ধরা পড়ে। কোন রকম পেটেন্ট ছাড়াই নামধাম বাস্তিবিজ্ঞান চর্চা চলে আসছে চলে আসছে শত শত বছর ধরে। এর মধ্যে রয়েছে নয়নতারা, ঝুমকি, লইট্টা, হিংলা, ভোলানাথ, তবলা, ঢেপা, দুধ বা ডিম বেগুন, লাফা, ঘৃত্কাঞ্চন সহ শত শত জাত।
দেশীয় বেগুনের ওপর প্রথম হস্তক্ষেপ হয়েছে হাইব্রিড বেগুন প্রচলনের মাধ্যমে। বাণিজ্যিক চাষবাদে হাইব্রিড বেগুনে ব্যাপক কীটনাশকের ব্যবহার সঙ্গত কারণেই উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। হাইব্রিড বেগুনের জাত প্রধানত এককাট্টা চাষ বা মনোকালচার করা হয়, তার মধ্যে বেশ কয়েক ধরণের পোকার আক্রমণ হয়। ডগা ও ফল ছিদ্রকারি পোকার (Fruit & Shoot Borer, FSB) কারণে ৫০ থেকে ৭০% বেগুনের ফসল নষ্ট হয়ে যায় এবং তাই কৃষকরা এক মৌসুমে ৮০ বার কীটনাশক প্রয়োগ করে। এই তথ্য বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বরাতে ডেইলি স্টারের প্রতিবেদনে (১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৩) বলা হয়েছিল। অথচ স্থানীয় জাতের বেগুনে পোকার আক্রমণ তেমন তীব্র হয় না, এবং কীটনাশকও দিতে হয় না, কারণ এসব বেগুনের মনোকালচার বা একাট্টা চাষও হয় না। ঘরের আলানে পালানে কিম্বা ক্ষেতে মিশ্র চাষ হিশাবে উৎপাদিত হয়। দেশি বেগুনের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও রয়েছে। যেসব স্থানীয় জাতের বেগুনের ওপর সম্প্রতি বিকৃত বা জেনেটিক ইঞ্জিনীয়ারিং করা হয়েছে সেগুলো কৃষকের আবিষ্কার করা জাত। সেগুলোতে এমনিতেই পোকার আক্রমণ তীব্র বা অস্বাভাবিক নয়। ফলে ভাল বেগুন তুলতে কৃষকের মোটেও অসুবিধা হয় না। বারির নিজস্ব গবেষণাতেই দেখা গেছে স্থানীয় জাতের বেগুনে পোকার আক্রমণ খুব কম হয়। যেমন ঝুমকি বেগুনে পোকা খুবই কম লাগে, মাত্র ১ – ১০% (Highly Resistant) খটখটিয়াও মোটামুটি কম লাগে, ২০% (Fairly Resistant)। কিছু বেগুন যেমন ইসলামপুরি ২১ – ৩০% পোকার সম্ভাবনা আছে (Tolerant) এবং ইরি বেগুন একটু বেশী লাগে ৪১% এর বেশী। এ ধরণের জাত বাছাই করেই বহুজাতিক কোম্পানির বীজ বিকৃত করবার টেকনলজি ব্যবহার করে প্রমাণ করবার চেষ্টা হয় যে টেকনলজির কারনেই কাণ্ড ও ফল ফুটা করা পোকা রোধ করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বহুজাতিক কোম্পানি কৃষকের লব্ধ জ্ঞান চুরি করে তার ওপর ব্যবসায়িক স্বার্থে কের্দানি ফলাতে তৎপর। বিটিবেগুন নিয়ে আমাদের গবেষণায় আমরা তা বিভিন্ন সময় প্রমাণ করেছি।
কৃষকের জ্ঞান ও আবিষ্কার নিয়ে সাধারণত কোন প্রতিবেদন করা হয়না। দেশী ও হাইব্রিডের ফলন, গুণগত পার্থক্য এবং বাজারজাত করবার সমস্যা এক রকম নয়। কিন্তু এই পার্থক্য নিয়ে খুব কমই পত্রপত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। শুধু তাই নয়, এই মৌসুমে প্রায় ১০ জেলায় বেগুনের দাম কম হয়েছে বলা হচ্ছে কিন্তু সব জেলাতেই কি একই বেগুন চাষ হয়েছে? তা নিশ্চয়ই নয়। জামালপুর এবং বগুড়ায় হাইব্রিড ছাড়া অন্য বেগুন চাষ হলে জাতের ভিন্নতা থাকার কথা। পত্র-পত্রিকা এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া যখন রিপোর্ট করেন তখন বেগুন নামক সব্জি বলতে যেন একটি জাতই বোঝায়। অথচ সব বেগুন একরকম নয় সেটা বাজারে গেলেই দেখা যায়। কোনটা সবুজ, কোনটা বেগুনি, লম্বা, গোল, ডিম আকৃতির, লম্বা মোটা, কিংবা পাতলা – এভাবে নানা রং ও আকৃতির বেগুন পাওয়া যায়। এদের প্রত্যকের নির্দিষ্ট নাম আছে, তাদের রান্নার পদ্ধতিও এক রকম নয়। যে বেগুন ভর্তা খাওয় হয়, সেই বেগুন শুটকি দিয়ে রান্না বেগুন, কিম্বা তেঁতুল-চিনি দিয়ে রান্না করা বেগুন থেকে আলাদা। শয়লা, তবলা বেগুন, ইসলামপুরি ইত্যাদি প্রত্যেকটির সঙ্গে রান্না প্রকরণেরও ভেদ আছে।
একটু পেছনের দিকে যাওয়া যাক। বেগুনের দাম এবারই হঠাৎ কমেনি। আগেও হয়েছে। উদাহরণ হিশেবে দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত একটি খবর ('আশাতীত ফলনেও হতাশ পশ্চিমাঞ্চলের বেগুন চাষি, ২৪ মার্চ, ২০১২') থেকে কিছু তথ্য দিচ্ছি। “পাইকারী সব্জি বাজারে মাত্র দেড় থেকে দুই টাকায় কেজি দরে বেগুন বিক্রি হতে দেখা যায়। আবার কোন হাটে ৪০-৫০ কেজি ওজনের এক বস্তা বেগুন ৫০-৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অথচ এর মাস দেড়েক আগে পাইকারী প্রতি মণ বেগুন ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা উপজেলার কৃষ্ণনগর গ্রামের একজন চাষী মোঃ তেয়াজ উদ্দিন জানান ক্ষেত থেকে ২ মণ বেগুন তুলতে এবং ভ্যান ভাড়া দিয়ে আনতে ৮০ টাকা খরচ হয়েছে কিন্তু ২ মণ বেগুন বিক্রি হয়েছে মাত্র ১৫০ টাকায়।’’ কিন্তু এখানে তো পোকার আক্রমণের কোন ব্যাপার নেই। আছে দাম কমে যাওয়ার ব্যাপার, যা সহজেই কোন প্রকার বিষ না দিয়েই সমাধান সম্ভব।
এই পরিস্থিতিতে ২০১৩ সালে হঠাৎ বিটি বেগুন নামক একটি জেনেটিকালী মডিফাইড অর্থাৎ বিকৃত বেগুনের জাত কৃষক পর্যায়ে ছাড়ার যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তা যেমন দামের সমস্যা সমাধানে কাজে লাগেনি তেমনি পোকা দমনের ব্যাপারেও কোন সুরাহা করতে পারেনি। পাঠককে মনে করিয়ে দেয়ার জন্যে জানাচ্ছি, বিটি বেগুন একটি জিএমও। অর্থাৎ প্রাণের গঠন সংকেতে (Gene) বিকৃতি ঘটাতে সক্ষম সাম্প্রতিক প্রযুক্তি (Genetic Engineering) ব্যবহার করে এই বেগুন বানানো হয়েছে। এই বিকৃত ঘটানো হয়েছে ব্যাসিলাস থুরিনজেনসিস (বিটি) ব্যাকটেরিয়া থেকে ক্রিসটাল জিন বেগুনে সংযোজন করা করে। তাই এই বেগুনের নাম দেয়া হয়েছে 'বিটি বেগুন'। আমাদেরই দেশের নয়টি স্থানীয় বেগুনের জাতের ওপর এই কাজ করা হয়েছে। এই জাতগুলোতে এমনিতেই পোকার ক্রমণ হয় না, কিম্বা হলেও সেটা কৃষকের জন্য সমস্যা নয়। অথচ ২০১৪ সাল থেকে ধাপে ধাপে কৃষকদের বিটি বেগুনের বীজ দেয়া হয়েছে। ভারতের মহারাষ্ট্র হাইব্রিড বীজ কোম্পানি বহুজাতিক বীজ কোম্পানি মনসান্টোর সহায়তায় বেগুনের জিন বিকৃতির এ কাজটি সম্পন্ন করে ২০০৫ সালে। একই সময় বাংলাদেশ ও ফিলিপাইনে বিটি বেগুন নিয়ে গবেষণা শুরু হয়। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) এ কাজের সাথে যুক্ত হয়। এর সাথে বাংলাদেশের কৃষকদের প্রয়োজনের কোন সম্পর্ক ছিল না। ভারত ও ফিলিপাইনে আজও এই বেগুন ছাড় পায়নি, অথচ আমাদের দেশে ব্যাপকভাবে ব্যর্থ হবার পরেও এবং গবেষণার ফলাফল মিথ্যা বলে হাতে নাতে ধরা পড়ার পরও এখনও বিটি বেগুন কৃষকদের দেয়া হচ্ছে।
প্রশ্ন হচ্ছে বিটি বেগুন কি বাজারে এসেছে? বিটি বেগুনের জন্যে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্রে শর্ত দেয়া ছিল যে বাজারজাত করতে হলে লেবেল লাগাতে হবে। আমরা বাজারের কোন বেগুনে বিটি বেগুন লেখা কোন লেবেল দেখি না। এমন কি বিক্রেতাদের জিজ্ঞেস করলেও তাঁরা বলতে পারেন না এর মধ্যে কোন বিটি বেগুন আছে কিনা। এটা অবশ্যই জিএম খাদ্য ফসল প্রবর্তনের দিক থেকে নিয়মের লংঘন। বাজারে যদি লেবেল ছাড়াও এসে থাকে তাহলে বিটি বেগুন কি ভাল দাম পাচ্ছে? আমরা এসব প্রশ্নের উত্তরও জানিনা। তাহলে ডগা ও ফল ছিদ্রকারি পোকা গাছের মধ্যেই মেরে কৃষকের কি বিশেষ উপকার হয়েছে যা অন্য বেগুনে হচ্ছে না? অথচ জিএমও বিটিবেগুন বাংলাদেশে কৃষি ব্যবস্থাকে জেনেশুনে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। বিটি বেগুন কৃষক পর্যায়ে ভালভাবে উৎপাদন হচ্ছে না, ফলন দিতে ব্যর্থ হচ্ছে, এই তথ্য সংবাদপত্রে আসার পরও বহুজাতিক কোম্পানির স্বার্থ বিকৃত বেগুন জোর করে কৃষকের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
আমাদের কৃষকের এখন বড় সমস্যা হচ্ছে দাম পাওয়ার। বেগুন উৎপাদনে কোন সমস্যা নাই। তাঁদের উৎপাদিত ফসলের দাম পাওয়াই প্রধান সমস্যা। প্রযুক্তি বা জেনেটিক কারিগরি এখানে কোন কাজে লাগবে না।
৮ এপ্রিল ২০১৮। ২৫ চৈত্র ২৪২৪। শ্যামলী।