জাতীয় কৃষিনীতি ২০১৮: কৃষিকে ইনপুট-অউটপুট নির্ভর শিল্পে রুপান্তর
ড. এম. এ. সোবহান || Monday 02 July 2018 ||একটি উচ্চাভিলাষী বিনিয়োগ ও বাণিজ্যিক কৃষি উন্নয়নের দৃষ্টি কোণ থেকে জাতীয় কৃষিনীতি ২০১৮ প্রণীত হয়েছে। এ নীতি পরিবেশ বান্ধব নয়, স্থিতিশীল নয়, এবং সৃজনশীলতা বর্জিত।
গত শতাব্দীর ষাটের দশক থেকে তথাকথিত সবুজ বিপ্লবের মূলনীতি নির্ভর অধিক ফলনের সোনার হরিণের পিছনে লাগামহীন গতিতে যে যাত্রা শুরু হয়েছিল তা বর্তমান জাতীয় কৃষিনীতি ২০১৮ তে আরো বহুগুণ বেগবান করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
মনে রাখা ভালো, কৃষি মানব জাতির একটি বেহেস্তি উপহার। প্রকৃতির দান, প্রাণ প্রকৃতির সহমর্মিতায় স্থিতিশীল ফলন। পরিবেশের ভারসাম্য রহ্মার স্বার্থে উৎপাদন উপকরণ, ফলন এবং নেট রিটার্ন হিসাব রাখা প্রয়োজন। কারণ কোন সম্পদই অফুরন্ত নয়। কৃষি উৎপাদনের প্রধান হ্মেত্র মাটি। সচেতন ব্যবস্থাপনায় মাটির গুণাগুণ সংক্ষরণ করা প্রয়োজন।
তথাকথিত সবুজ বিপ্লবের ফলে সবচেয়ে বেশী ক্ষতি হয়েছে পরিবেশের। পশ্চিমা শক্তির সহায়তায় পাওয়া গ্রিন রিভলিউশন বা সবুজ বিপ্লব এর বাহন মেজাজী বীজ, রাসায়নিক সার, বালাই নাশক এবং মাটির তলার পানির সাহায্যে সেচ। একদা স্বাবলম্বি কৃষকের উৎপাদন আজ কোম্পানি নির্ভর ভয়াবহ জালে আটকা পড়েছে।
হাজার বছরের ঐতিহ্যে লালিত সমৃদ্ধ ফসলের জাত বিলুপ্ত হয়েছে। বীজের জন্য কৃষক এখন বাজার নির্ভর হয়েছে। বীজ কৃষির চাবি। কৃষকের স্বপ্ন। আজ আমাদের ঘরের চাবি পরের হাতে। স্বপ্ন এখন দূঃস্বপ্ন। হাইব্রিড ধান চাষ করে কৃষক কখনও ধানের বদলে পাচ্ছেন চিটা। আবার কখনও বন্যায় ডুবে ফসল হানিতে কৃষক হচ্ছেন সর্বস্বান্ত। নীচু জমির উপযোগী বোনা আমন ধানের অনেক স্থানীয় জাত ছিল যা পানির সাথে বেড়ে উঠতো। যমুনা নদীর প্লাবন ভূমি অঞ্চলে এমন একটি বোনা আমন ধানের নাম ছিল চামাড়া। এ জাতের সঙ্গে যুক্ত একটি শ্লোক ছিল, ‘‘ধানের মধ্যে চামাড়া যদি থাকে পানি, ইষ্টির মধ্যে মামারা যদি থাকে নানী’’। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যা প্রবন নিচু জমির জন্য শত শত বোনা আমন ধানের জাত ছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য জাত ছিল- হরিঙ্গা দিঘা, বাওই ঝাঁক, মরিচ ফুল, মধু শাইল, লোহাডাং, ভাওয়ালিয়া, বাঁশীবাজ, হিজলদিঘা, দুধরাজ, ইত্যাদি। এখনও এরকম বাষট্টিটি বোনা আমন ধানের জাত উবিনীগের তত্ত্বাবধানে নয়াকৃষি কৃষকদের মাঝে আছে। যমুনা নদীর অববাহিকায় বন্যা বিধৌত পললভূমিতে চৈত্র-বৈশাখ মাসে বোনা আমন ধান এবং আউশ ধানের জাত যেমন কালা মানিক, কালা বকরি ইত্যাদি বীজ এক সাথে ছিটিয়ে বোনা হতো। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে আউশ ধান কাটা হতো। আমন ধান মাঠে থাকতো। অগ্রহয়ণ-পৌষ মাসে আমন ধান কাটা হতো। অবশ্য আমন ধান মাঠে থাকতেই কার্তিক মাসে মাঠের পানি যখন শুকিয়ে আসতো জোঁ বুঝে তখন ধানের ক্ষেতে মাসকালাই অথবা খেশারি বীজ ছিটিয়ে বোনা হতো। অগ্রহয়ণ- পৌষ মাসে আমন ধান কাটার পরে মাস কালাই/ খেশারি মাঠে থাকতো। মাঘ-ফাল্গুন এ মাসকালাই/খেশারী তোলা হতো।
আউশ আমন ধান ও ডালের মিশ্র আবাদের ফলে মাটির উর্বরতা বজায় থাকতো। গোখাদ্য নিশ্চিত হতো। কৃষক কম পরিশ্রমে এবং কম বিনিয়োগে বিভিন্ন ফসল ঘরে তুলতে পারতো। সর্বোপরি কৃষি উৎপাদন ঝুঁকি মুক্ত থাকতো।
পক্ষান্তরে কৃষকের ঐতিহ্যগত ফসলের জাত এবং উৎপাদন ব্যবস্থার পরিবর্তে আমন ধানের মৌসুমে বন্যা প্রবন অঞ্চলেও খাটো জাতের রোপা আমন ধান যেমন- বি আর ১১, ব্রিধান ৭৫, ৭৬, ৭৭, ৭৮, ৭৯, ৮০, ইত্যাদি ছাড় করা হয়েছে। বোরো মৌসুমেও খাটো কান্ডের ধান যেমন- ব্রি ধান-২৮, ২৯ ইত্যাদি ছাড় করা হয়েছে। বস্তুত রবি মৌসুমে ৫১ টি মাঠ ফসলের পরিবর্তে এক কাট্রা বোরো ধান আবাদ সম্প্রসারণ করা হয়েছে। শুকনো মৌসুমে মাটির তলার পানি তুলে সেচের মাধ্যমে বোরো ধান আবাদ করার ফলে মাটির তলার আর্সেনিক উপরে উঠে আসছে। বাংলাদেশের ৬৪ টি জেলার মধ্যে ৬২ জেলার পানি এখন আর্সেনিকে দূষিত। প্রতি বছর প্রায় ১০০০ টন আর্সেনিক ভূ-উপরি ভাগে উঠে আসছে। মাটিতে আর্সেনেক উপস্থিতির কারণে ফসলের দেহে অন্যান্য খনিজ উপাদানের উত্তোলন বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। ফলে ফলন কমছে। আন্যদিকে ধানের পরে ধান আবাদের ফলে মাটি সব সময় ভিজা থাকে। পরিনামে আবাদি ফসলের জন্য জিঙ্কের প্রাপ্তির সুযোগ কমেছে। মাটিতে বিদ্যমান ফসফরাসের সাথে মিশে কঠিন যৌগ জিঙ্ক ফসফেটে রূপান্তর হচ্ছে। যা ফসলের পক্ষে গ্রহণ সম্ভব হচ্ছে না। সব ধরণের খাদ্য শস্যের মধ্যে জিঙ্কের ঘাটতি দেখা দিচ্ছে।
গত শতাব্দীর ষাটের দশকে সবুজ বিপ্লব ভিত্তিক ফসলের জাত এবং চা্ষাবাদ প্রযুক্তি প্রচলনের পূর্বে এদেশে মাটিতে জৈব পর্দাথের পরিমাণ ছিল ৩-৫%। ফসল উৎপাদনের জন্য তা ছিল উত্তম। তখন মাটিতে কোন মৌলিক উপাদানের ঘাটতি ছিল না। কিন্তু এখন গড়ে বাংলাদেশের মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ ১% এর কাছাকাছি। স্মরণযোগ্য যদি মাটিতে জৈব পর্দাথের পরিমাণ ০.৮% বা তার নীচে চলে যায় তাহলে সে মাটিতে কোন ফসল হয় না। বলা বাহুল্য সবুজ বিপ্লবের অভিশাপে বাংলাদেশের মাটিত শুধু জৈব পদার্থের অভাব ঘটেছে তা নয় বরং মৌলিক উপাদন যেমন নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম ঘাটতি বহু আগে থেকেই শুরু হয়েছে। ইদানিং কালে সালফার, জিঙ্ক, বোরন, ম্যাগনেশিয়াম, কপার এবং ম্যঙ্গানিজের ঘাটতিও দেখা যাচ্ছে। কৃষিনীতি ২০১৮ যে ভাবে সাজানো হয়েছে এর ফলে অচিরেই অন্তত ১৪ টি মৌলিক উপাদান বাহির থেকে প্রয়োগ করে কৃষি উৎপাদন করতে হবে। ফলে বেহেস্তি উপাহার কৃষি আর কৃষি থাকবে না। ইনপুট-অউটপুট নির্ভর শিল্প হবে।
অবশ্য ইতোমধ্যে অধিক ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যে ব্যবহৃত রাসায়নিক সার, বালাই নাশক, আগাছা নাশকসহ অনান্য যে সব রাসায়নিক দ্রব্য মাটিতে জমছে তা পরিষ্কার করা আবশ্যক। স্মরণযোগ্য প্রতিবর্গ সেন্টিমিটার মাটিতে পাঁচ বিলিয়ন অণুজীব বাস করে। মাটি গঠন করে। গাছ পালার খাদ্য গ্রহণ এবং অন্যান্য ভাবে ফসল উৎপাদনে সহায়তা করে। এ সব জীব অণুজীবের স্বাভাবিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার জন্য মাটি বিষ মুক্ত হওয়া প্রয়োজন।
ফসলের ক্ষেতে রোগ বালাই দমনের জন্য যে বালাই নাশক ব্যবহার করা হয়েছে তার ফলে পরাগায়ণ সহায়তাকারি কীট প্রতঙ্গ, মৌমাছি, ভ্রমর, প্রজাপতি, ইত্যাদি ধ্বংস হয়েছে। পরাগায়ণ নির্ভর ফসল যেমন তরমুজ, মিষ্টি কুমড়া, পটল, কাকরোল, শসা, চাল কুমড়া ইত্যাদি ক্ষেতে ফুল দেখা যায়। কিন্তু পরাগায়ণের অভাবে ফল হয় না। কাজেই ফসলের ক্ষেতে বিষ মুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
প্রস্তাবিত জাতীয় কৃষিনীতি ২০১৮ খসড়ায় কৃষি খামারকে কৃষি কারখানায় রূপান্তরের পরিকল্পনা করা হয়েছে। কৃষি উপকরণ (ইনপুট)- উচ্চ ফলন শীল জাত/হাইব্রিড / জিএম বীজ, বালাই নাশক, রাসায়নিক সার, জ্বালানি, সেচ ইত্যাদি এবং ফসল (আউট পুট) ধান, গম, ডাল, শাক সবজি ইতাদির ব্যবস্থাপত্র দেয়া হয়েছে। লক্ষ্য ফলন বৃদ্ধি (যেমন, টন/হেঃ) এবং উৎপাদন খরচ কমানো। এ ব্যবস্থা অগোচরে নিঃশেষ করবে সীমিত সম্পদ জীবাস্ব জ্বালানী, পানি এবং মাটি। তদুপরি পরিবেশের দূষণ বাড়াবে। বায়ু পানি মাটি দূষিত হবে। বিলুপ্ত হবে প্রাণবৈচিত্র্য, মাছ, জলজসম্পদ, প্রাণবৈচিত্র্য জীব অণুজীব, ইত্যাদি।
সাম্প্রতিক একটি শিরোনামে দৃষ্টি আটকে যায়,‘‘নদীর দেশে পানির জন্য কান্না’’। পটুয়াখালীতে পানির স্তর নেমে গেছে ৩২ ফুট নীচে। নদীর দেশে চলছে পানির জন্য কান্না। চলছে হাহাকার। প্রতিদিনই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এ কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে পটুয়াখালীর পৌর শহরের সর্বত্র। এ শহরের ১১৫০ টির মধ্যে অর্ধেক টিউবঅয়েলেই পানি উঠছে না। হস্তচালিত টিউবঅয়েলর পানি উত্তোলনের ক্ষমতা ২৬ ফুট পর্যন্ত। কিন্তু পানির স্তর নেমে গেছে ৩২ ফুট নিচে। অবশ্য ২০১৬ সালে পানির স্তর ছিল ২৪ ফুটে। ২০১৭ সালে ছিল ২৬ ফুট (আর টিভি অনলাইন, ১৪ জুন ২০১৮)। লালন সাঁইজীর একটি উক্তি মনে পরে “ফকির লালল মরল জল পিপাসায়, কাছে থাকতে নদী মেঘনা”।
গত দুই দশকে সেচ নির্ভর বোরো ধান চাষ সম্প্রসারণের ফলে বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে প্রায় স্বয়ং সম্পূর্ণ হয়েছে। তবে সেচ নির্ভর বোরো ধান চাষ সম্প্রসারণের ফলে ভূ-গর্ভস্থ পানির মানের অবনতি ঘটেছে এবং পানির স্বল্পতা সৃষ্টি হয়েছে। জ্বালানির দাম ও সেচ ব্যবস্থা চালু রাখার ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। দ্রুত অবনতিশীল এ অবস্থার সমাধান প্রয়োজন। বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে ভূ-উপরিভাগের পানির সাহায্যে সেচ দিতে হবে। পানি সাশ্রয়ী অর্থাৎ কম পানি প্রয়োজন এমন প্রযুক্তি ও ধানের জাত বাছাই করতে হবে। বোরো ধানের পরিবর্তে বৃষ্টি নির্ভর আউশ ধানের উপর গুরুত্ব দিতে হব। ফসল চক্র পরিবর্তন করতে হবে। রবি মৌসুমে বোরো ধানের পরিবর্তে শাক সবজি, ফলমূল, তেল বীজ, ডাল, মসলা, ভুট্রা, গোল আলু, মিষ্টি আলু, গম, পায়রা ইত্যদি চাষ বাড়াতে হবে।
দেশের উপকূলীয় এলাকার শুকনো মৌসুমে এবং বর্ষা মৌসুমে পানির লবনাক্ততার প্রবনতা পরীক্ষা ও বিশ্লেষন প্রয়োজন। পরিবর্তনশীল পরিবেশের উপযোগী ফসলের জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা প্রয়োজন।
জাতীয় কৃষিনীতি ২০১৮ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এর মূল সুর- কৃষি উৎপাদনে অধিক ফলন এবং মুনাফা অর্জন। তবে তা হবে,খাদ্য নিরাপদতা আপস করে এবং স্বাস্থ্য সংঙ্কট বৃদ্ধি করে। স্মরণ যোগ্য গত শতাব্দীর ষাটের দশকে যখন এ দেশে সবুজ বিপ্লবের সূচনা ঘটে তখন অসংক্রামক ব্যাধি যেমন এজমা, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, উচ্চ রক্তচাপ, বাত, কিডনির জটিল রোগ ইত্যাদির প্রবনতা ছিল সীমিত। তবে সবুজ বিপ্লব সম্প্রসারণের সাথে এসব রোগের প্রদূর্ভাব বেড়েছে বহুগুণ। বর্তমানে এদেশের প্রায় ৬২% মানুষের মৃত্যু হচ্ছে অসংক্রামক রোগের কারণে। সে সময় এদেশে মাত্র একটি মেডিক্যাল কলেজ ছিল, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ। আর এখন সরকারী ৩৫টি এবং বেসরকারী ৫৪টিসহ মোট ৮৯টি মেডিক্যাল কলেজ রয়েছে। তার পরেও কোন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সাক্ষ্যাৎকার পেতে মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হয়। তদুপরি পার্শ্ববর্তী দেশ যেমন ভারত, থাইল্যান্ড, মালয়শিয়া ও সিঙ্গাপুর গামী যাত্রীর বেশীর ভাগই অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত রোগী, চিকিৎসা সেবা প্রার্থী। এ প্রবনতার পরিবর্তন প্রয়োজন।
বর্তমানে যে খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা চালু আছে এবং প্রস্তাবিত কৃষি নীতি ২০১৮ তে জন স্বাস্থ্য “সুরক্ষার” বিষয়টি অবহেলিত হয়েছে। আমাদের প্রধান খাদ্য দানা শস্য -চাল, গম, ফলমূল, শাকসবজি, মাছ, মাংস ইত্যাদির মধ্যে উৎপাদন ব্যবস্থার ত্রুটির কারণে বিষাক্ত রাসায়নিক মিশ্রণ ঘটছে। উৎপাদন ব্যবস্থায় ব্যবহার হচ্ছে রাসায়নিক সার,বালাই নাশক, এন্টিবায়োটিক, হরমোন ইত্যাদি।
তবে আধুনিক কৃষি প্রবর্তনের আগে যে কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা চালু ছিল তখন কোন রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা হতো না। আজকের আধুনিক এক কাট্টা ফসলের স্থলে তখন ছিল- মিশ্র ফসলর শস্য পর্যায়। সে ব্যবস্থায় মাটির স্বাস্থ্য ও উৎপাদিকা শক্তি বৃদ্ধি পায়,গাছপালা পরিবেশ বান্ধব ব্যবস্থাপনায় শক্তিশালী হয়। রোগ, পোকামাকড় ও আগাছা প্রতিরোধ ক্ষমতা ও বৃদ্ধি পায়।
প্রসঙ্গ ক্রমে উল্লেখ করা যায় যে স্থানীয় কৃষকের অর্জিত জ্ঞানও অভিজ্ঞতার অলোকে উবিনীগের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে নয়াকৃষি আন্দোলন। প্রণীত হয়েছে প্রাণবৈচিত্র্য নির্ভর প্রকৃতিক কৃষি- নয়াকৃষি আন্দোলন। বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তিন লাখের অধিক কৃষি পরিবার এ আন্দোলনের সাথে যুক্ত রয়েছে। কৃষির অর্থ চাষবাদ। মানুষের সাথে পরিবেশের বন্ধুত্ব পূর্রণ সহবাসে কৃষি উৎপাদন। আন্দোলন অর্থাৎ বাংলা একাডেমির ব্যবহারিক বাংলা অভিধান অনুযায়ী আলোড়ন যেমন ছাত্র আন্দোলন বা ভাষা আন্দোলন তেমনি পরিবেশ ও কৃষি রক্ষায় কৃষক আন্দোলন, সর্বগ্রাসী ধ্বংসাত্মক পথ থেকে সৃষ্টি শীল অন্দোলন। জীবনের পথে এগিয়ে চলা।
বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দুই শতাধিক গ্রামে শস্য উৎপাদন এবং প্রাণবৈচিত্র রক্ষার সাথে যুক্ত হয়েছে কৃষকরা। এ সব গ্রামে কৃষকরা কোন প্রকার বালাই নাশক, আগাছা নাশক ও অন্যান্য রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার না করে বরং শস্য পার্যায়, মিশ্র ফসলের চাষ এবং বৈচিত্র্য পূর্ণ প্রজাতির ফসল চাষ করে। মাটির উৎপার্দিকা শক্তি বৃদ্ধি করছেন। বালাই প্রতিরোধের ক্ষমতা বাড়িয়ে চলছেন।
কৃষকের ঐতিহ্য ও অর্জিত জ্ঞানের সমন্বয়ে প্রনীত হয়েছে নয়াকৃষির দশনীতি। নয়াকৃষির প্রথম নীতি হচ্ছে ফসল উৎপাদনে কোন প্রকার বালাই নাশক ব্যবহার না করা। প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ নয়াকৃষির দ্বিতীয় নীতি। তৃতীয় নীতি হচ্ছে রাসায়নিক সার ব্যবহার না করে মাটিতে বিদ্যমান জীব অণুজীবের মাধ্যমে মাটির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি করা। অনান্য নীতির মধ্যে রয়েছে শস্য পর্যায় প্রাণবৈচিত্র্যপূর্ণ ফসলের চাষ, মিশ্র ফসলের চাষ,এবং আবাদি ও অনাবাদি প্রজাতি গাছ পালা সংরক্ষণ করা। স্থানীয় প্রজাতির গাছ পালা সংরক্ষণের সাথে সাথে মৌমাছি, প্রজাপতি ও পাখি সংরক্ষণের মাধ্যমে গাছ পালার পরাগায়ন নিশ্চিত করা। মাটির তলার পানি ব্যবহার না করে বরং ভূ-উপরিভাগের পানির সাহায্যে ফসলের ক্ষেতে সেচের ব্যবস্থা করা। কৃষকরা সচেতন ভাবে তাদের খাদ্য, জ্বালানী ,আঁশ, ওষুধ ও অন্যান্য জরুরী প্রয়োজনে যাবতীয় সম্পদ গুরুত্বের সাথে সংরক্ষণ করছেন। নয়াকৃষি চাষের মাধ্যমে কৃষকরা প্রাণীসম্পদ, গাছ, অন্যান্য জলজ সম্পদ ব্যবহার ও সংরক্ষণ করছেন। নয়াকৃষির দশম নীতি হচ্ছে ঐতিহ্যগত কলাকৌশল চার্চার মাধ্যমে স্থানীয় জন গোষ্ঠির জীবন জীবিকা উৎকর্ষ সাধন করা। সারাদেশে নয়াকৃষির বিস্তার হলে কৃষি পরিবেশ বিষমুক্ত হবে। সার্বিক পরিবেশ নির্মল হবে, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে,সকলের জন্য খাদ্য নিরাপদ হবে এবং সর্বোপরি জনগণের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত হবে।
পরিবেশ, প্রাণবৈচিত্র্য, জনস্বাস্থ্য তথা জাতীয় অগ্রগতির স্বার্থে প্রস্তাবিত জাতীয় কৃষি নীতি-২০১৮ ঢেলে সাজানো প্রয়োজন।