কয়লা ব্যবহারই বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির মূল কারণ
ফরিদা আখতার || Wednesday 19 December 2018 ||বাংলাদেশে নির্বাচনের দিন ঘনিয়ে আসছে। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করার শর্ত কিছুটা পূরণ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু স্বচ্ছ, সব দলের সমান সুযোগ সৃষ্টি করার পরিবেশ, নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষ ও স্বাধীন ভূমিকা, ভোটারদের নির্ভয়ে ভোট দিতে পারার পরিবেশ হবে কিনা, এ বিষয়ে এখনো মানুষ শঙ্কিত। কারণ এখন সব আক্রমণ চলছে প্রার্থীর ওপর, সময়মতো ভোটারও আক্রান্ত হবে।
তবু নির্বাচন এলে আমাদের কিছু বিষয় অবতারণার সুযোগ হয়। ক্ষমতাসীন দল আবার ক্ষমতায় আসতে চায় উন্নয়নের ধারাবাহিকতার দোহাই দিয়ে। জিডিপির হার বাড়ছে এবং আরো বাড়বে বলে তারা অঙ্গীকার করছেন। উন্নয়নের একটি সূচক হচ্ছে, দেশে ঘরে ঘরে বিদ্যুতের আলো জ্বলবে, গাড়ি চলবে, বড় রাস্তা হবে ইত্যাদি। যদিও এ আলো সব বাড়িতে একইভাবে জ্বলবে না, সবাই গাড়িতেও চড়বে না। উন্নয়ন হলে বৈষম্য নাকি একটু-আধটু থাকেই, ওটা কিছু না। আওয়ামী থিংক ট্যাংক আমাদের সেটাই শেখান বিভিন্ন মাধ্যমে।
নির্বাচনের আগে বৈশ্বিক পর্যায়ে আগামীতে মানুষের বেঁচে থাকা না-থাকার বিষয়টি নির্ধারণ হওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। তা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সিদ্ধান্ত। এটা শুধু পরিবেশবাদীদের বিষয় নয়, রাজনীতিরও বিষয় বটে। এত উন্নয়নের কী অর্থ দাঁড়ায় এবং সে ধরনের সরকার আমরা চাই কিনা, যা পরিবেশ ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, ভোট দিতে গিয়ে সেই বিচার করার সম্পর্ক আছে। সম্প্রতি দুই সপ্তাহব্যাপী (ডিসেম্বর ২-১৪, ২০১৮) জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন শীর্ষক সর্বশেষ ২৪তম কনফারেন্স অব দ্য পার্টিজ (কপ) অনুষ্ঠিত হয়ে গেল পোল্যান্ডের ক্যাতোভিস শহরে। শেষে এসে একদিন বাড়ানো হলো। কারণ সিদ্ধান্ত নেয়া যাচ্ছিল না। ২০১৫ সালে ২১তম কপের প্যারিস জলবায়ু চুক্তির পর ক্যাতোভিসের এ সম্মেলন জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। প্যারিস চুক্তিতে বলা হয়েছিল, বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ধরে রাখতে হবে। আরো ভালো হয় এটি যদি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যায়। বিজ্ঞানীরা অবশ্য বারবারই সতর্কতা উচ্চারণ করে বলছেন, এক্ষেত্রে সময় খুব কম এবং তা খুব দ্রুত পার হয়ে যাচ্ছে। মানুষ ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হচ্ছে। জাতিসংঘের জলবায়ু প্যানেলের বিশেষজ্ঞদের সবচেয়ে বড় সতর্কতা ছিল জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ-সংক্রান্ত। এ শতাব্দীর শেষ নাগাদ জলবায়ু পরিবর্তন ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখতে চাইলে ২০৩০ সালের মধ্যে আমাদের অবশ্যই জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। জাতিসংঘ সতর্ক করে বলেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতা রোধে যে পরিকল্পনা, সে পথে ‘হাঁটছে না’ বিশ্ব।
এদিকে সর্বশেষ পরিস্থিতি বর্ণনা করে ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি) ২০১৮ সালের অক্টোবরে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি ঠেকাতে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এ প্রতিবেদনে বলা হয়, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখতে হলে ২০৩০ সালের মধ্যে গ্রিনহাউজ গ্যাসের নির্গমন ৪৫ শতাংশ কমাতে হবে। কিন্তু তা কমেনি, বরং সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে চার বছর ধরে কার্বন ডাই-অক্সাইডের নিঃসরণ সীমিত থাকলেও তা আবার বেড়েছে।
এ খারাপ খবর দিয়েই শুরু হয়েছিল ক্যাতোভিসে সম্মেলন। এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে, ধনী দেশ জলবায়ু পরিবর্তন রোধে তাদের দায়িত্ব পালন করছে না এবং আগামীতে করবে বলেও মনে হচ্ছে না। ধনী দেশের হয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন, তারাই মোট ৪০ শতাংশ কার্বন নিঃসরণের জন্য দায়ী। তাদের ধনী জীবনযাপনের ফলে আমরা উন্নয়নশীল দেশ এবং বিশেষ করে গরিব দেশ সবাই ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেছি। কিন্তু তারা কোনো দায়িত্ব নেবে না। সাফ কথা।
আর হাঁটবেই বা কী করে। যেখানে এ সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা, সেই আয়োজক দেশ পোল্যান্ডের অর্থনীতির প্রায় পুরোটাই জীবাশ্ম জ্বালানি বা কয়লার ওপর নির্ভরশীল। আর কয়লা পোড়ানোই গ্রিনহাউজ গ্যাসের মূল কারণ হিসেবে ধরা হয়। ইউরোপের বাকি দেশগুলো যেমন এককথায় কয়লার ব্যবহার বাতিল করে দিতে পারে, পোল্যান্ডের ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়।
এছাড়া প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী ধনী দেশগুলোর জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় দরিদ্র দেশগুলোকে আর্থিক সহায়তা করার কথা। কারণ গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণের প্রধান দায় শিল্পোন্নত দেশগুলোর, যার কুফল ভোগ করছে ক্ষুদ্র ও দরিদ্র দেশগুলো। কাজেই তারা ক্ষতিপূরণ দেবে। কিন্তু এ আলোচনার মাঝপথে এসেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্যারিস চুক্তি থেকে বের হয়ে গেলেন। এতে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় যে তহবিল পাওয়া যাচ্ছিল, তাতে ঘাটতি পড়বে বলে আশঙ্কা করা হয়।
কপ ২৪-এর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে, কয়লার ব্যবহার-সংক্রান্ত পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের ক্ষতি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি নতুন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার ভূমণ্ডলের তাপ বাড়িয়ে দিচ্ছে এবং একই সঙ্গে বায়ুদূষণের মাধ্যমে বছরে ৭০ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটাচ্ছে।
বাংলাদেশ বৈশ্বিক পর্যায়ে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে চরম ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর অন্যতম। অথচ বাংলাদেশ মাত্র শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ বৈশ্বিক গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন করে। কিন্তু বাংলাদেশ এখন যে উন্নয়নের ঘোড়ার পেছনে ছুটছে, তাতে নিজ দেশে পর্যাপ্ত কয়লার খনি না থাকলেও বিদেশ থেকে কয়লা এনে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করছে। অর্থাৎ কয়লার ব্যবহার বেড়ে যাচ্ছে। উন্নয়নের নামে গত কয়েক বছরে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে, যা বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে যোগ হবে এবং বাংলাদেশের অবদান বাড়বে। বাংলাদেশ নিজেও ক্ষতিগ্রস্ত হবে, অন্যদেরও ক্ষতির কারণ হবে। মানুষের ধ্বংস ত্বরান্বিত হবে।
কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে অনেক আন্দোলন হয়েছে, অনেকেই জেল-জুলুমের শিকার হয়েছেন, হতাহতের ঘটনাও কম ঘটেনি। কিন্তু তাও এ প্রকল্পগুলোর কাজ থেমে থাকেনি। আজ সেই প্রকল্প দেখিয়েই বলা হচ্ছে, উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে এবং সে কারণে ক্ষমতাসীন দলকেই আবার নির্বাচিত করতে হবে।
দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়ায় ২০০৬ সালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কয়লার ব্যবহার শুরু হয়। ২০১০ সালে ভারতের সঙ্গে চুক্তি করে সুন্দরবনের কাছে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ চলছে। এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে সুন্দরবন এবং এর সঙ্গে যুক্ত পশু-পাখি, গাছপালা, প্রাণবৈচিত্র্য ও মানুষের জীবন-জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে ইউনেস্কো এ প্রকল্প বাতিল করতে বলেছে। বাংলাদেশে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন এখনো চলছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা!
এর মধ্যে সবচেয়ে বড় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন হচ্ছে চট্টগ্রামে, যা বাঁশখালী কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নামে বেশি পরিচিত। প্রায় ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের এ প্রকল্পের কাজ ২০১৬ সালে শুরু হয়েছে চীনের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে। এখানে ব্যবহূত কয়লা আসবে ইন্দোনেশিয়া থেকে, যেখানে চীন কয়লা খনিতে বিনিয়োগ করেছে। বাঁশখালী কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র ১ হাজার ২২৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে।
এদিকে জাপানের সহযোগিতায় ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কক্সবাজারের মহেশখালী দ্বীপের মাতারবাড়ীতে ৪ দশমিক ৫৪৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে। এর কাজ শুরু হয়েছে ২০১৪ সালে।
খেয়াল করলে দেখা যাচ্ছে, কয়লা ব্যবহারের মূল কাজটির বিনিয়োগ করে দিচ্ছে জাপান ও চীন; যা বৈশ্বিক কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণে বেশি ভূমিকা রাখছে। তারাই বাংলাদেশকে ব্যবহার করছে কয়লা ব্যবহারের মাধ্যমে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিতে।
পোল্যান্ডের ক্যাতোভিসে প্রায় ১৯৬টি অংশগ্রহণকারী দেশের সিদ্ধান্ত নেয়া আটকে গিয়েছিল কার্বন মার্কেট এবং কোন দেশ কত কার্বন ব্যবহার কমাবে তা নিয়েই অঙ্গীকারের প্রশ্নে। মোট কথা, কার্বন নিঃসরণ রোধে দেশগুলোর প্রচেষ্টা জোরদারে এ সম্মেলন ব্যর্থ হয়েছে। শুধু তাই নয়, সম্মেলন ভেস্তে যেতে বসেছিল। শেষ পর্যন্ত প্যারিসে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০২০ সাল থেকে কার্যকর করে বিশ্বের তাপমাত্রা ২ ডিগ্রির নিচে রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে।
অন্য ক্ষতিগ্রস্ত উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশও ক্ষতিপূরণ চেয়েছে। অন্যদিকে ধনী দেশ ক্ষতিসাধনের জন্য দায়ী বলে তাদের বিশাল অংকের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে বলে উত্কণ্ঠিত। সে কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, রাশিয়া ও কুয়েত ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি) ২০১৮ সালের বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি ঠেকানোর প্রতিবেদন জাতিসংঘ ‘স্বাগত’ জানাক, এটা চায়নি। তাহলে তাদের ওপর অনেক দায় এসে পড়ে।
কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করে বাংলাদেশ উন্নত দেশ হয়তো হবে, কিন্তু বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে অবদান রেখে নিজেও কি অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড়াবে না?
আমার প্রশ্ন, জনগণকে উন্নয়নের ধারাবাহিকতার কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু এর অন্য পিঠে আছে বৈষম্য এবং অপরাধ। এ উন্নয়ন সইবে তো?
প্রকাশিত দৈনিক বণিক বার্তা: কয়লা ব্যবহারই বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির মূল কারণ