নিহার বানু ও ‘কালো বকরী’ স্থানীয় জাতের ধানের গল্প
নয়াকৃষি আন্দোলন || Monday 06 May 2019 ||বড়াইগ্রাম উপজেলার (নাটোর) এর রাজেন্দ্রপুর গ্রামের নিহার বানু একজন নয়াকৃষির কৃষক। তিনি দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে আউশ ধান কালো বকরী চাষ করছেন। এই ধান খরা সহনশীল হিসাবে পরিচিত। যত খরা হোক না কেন ধানের গাদ মাটিতে মিশে গেলেও আবার হালকা হালকা একটু বৃষ্টি পেলে গাছ তাজা হয়ে যায়। তাই শুধু নিহার বানু নয়, তার গ্রাম এবং তার জানামতে আশে পাশের গ্রামে শতকরা ৫০-৬০% কৃষক এই ধান চাষ করে।
নিহার বানুর যখন বিয়ে হয়, স্বামীর অবস্থা তেমন ভাল ছিল না। তিনি কালো বকরী ধান চাষ করার জন্য তার বাবার কাছ থেকে ৫ কেজি বীজ এনে ১২ কাঠা জমিতে চাষ করেন। বাবার বাড়িও নাটোরের একই বিলে। এরপর থেকে তিনি এই ধান চাষ করে আসছেন। কোন সময় বাদ দেন না। এই ধানের বীজ কৃষকের ঘরে ঘরে আছে। এই ধান ভাত হিসাবে খেতে খুব স্বাদ। এর আরও গুণ এবং প্রয়োজন আছে। এই ধানকে কৃষকেরা ধরে রেখেছেন কারণ এই ধানকে তারা ‘ঐতিহ্য ধান’ মনে করে।
কালো বকরী ধান উঁচু, মাঝারি, বেলে ও এঁটেল মাটিতে ভাল হয়। নিহার বানুর সেই ধরণের অল্প জমি আছে।
এই ধান বৈশাখ মাসে বুনতে হয় এবং ভাদ্র মাসের শুরুতে কাটতে হয়। যত খরাই হোক এই ধানের কোন ক্ষতি হয় না। তবে খরার মধ্যে বৃষ্টি হলে এই ধান ভাল হয় না। অতি বৃষ্টিতে এই ধান টেকে না। গত বছর চৈত্র- বৈশাখ মাসে এই ধানের থোর নামার সময় বৃষ্টি হওয়াতে ধানের ক্ষতি হয়।
কালো বকরী ধানের রং কালো। একেবারে কালো ছাগলের মত। কিন্তু ভিতরে চালের রং লাল। সারা বৎসর বিশেষ উৎসবে এই ধানের প্রয়োজন হয়। যেমন, ছেলে মেয়ের বিয়ের সময় এই ধান, কাঁচা হলুদ ও দূর্বা ঘাস চেরাগ বাতি জ্বালিয়ে সাত জন এয়ো (সাত জন বিবাহিত মহিলা) মিলে ঢেঁকি পূজা করে। সেই ধানের ক্ষির রান্না করে ছেলে মেয়ের মুখে দেয়।
তবে ‘কালো বকরী’ ধান না থাকলে ‘লাল কাইকে’ কিংবা ‘সাদা কাইকে’ ধান দিয়ে উৎসব পালন করা হয়। কালো বকরী ও কাইকে ধানের মিশ্র চাষ হয়ে থাকে।
এই ধানের বাজার মূল্য অনেক বেশী। গত বছর ১৬ শো টাকা মন বীজের ধান কিনতে হয়েছিল। কারণ গত বছর বৃষ্টি হওয়াতে ধানের ক্ষতি হয়েছিল। তাই বীজের দাম বেশী ছিল। এবারে দাম কম। সব কৃষকের ঘরে এই বীজ আছে।
কালো বকরী ধানের সাথে সংস্কৃতির এক নিগুড় সম্পর্ক ফুটিয়ে তোলা হয় নিহার বানুর গল্পে। নির্দিষ্টভাবে নয়াকৃষির কৃষক নিহার বানুর কাছে এই ধানের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে:
১। কালো বকরী উৎসবের ধান – ছেলে মেয়ের বিয়ের সময় এই ধান, কাঁচা হলুদ ও দূর্বা ঘাস চেরাগ বাতি জ্বালিয়ে সাত জন এয়ো (সাত জন বিবাহিত মহিলা) মিলে ঢেঁকি পূজা করে। সেই ধানের ক্ষির রান্না করে ছেলে মেয়ের মুখে দেয়।
২। উৎসবে এই ধান না পাওয়া গেলে বিকল্প ধান: ‘কালো বকরী’ ধান না থাকলে ‘লাল কাইকে’ কিংবা ‘সাদা কাইকে’ ধান দিয়ে উৎসব পালন করা হয়। কালো বকরী ও কাইকে ধানের মিশ্র চাষ হয়ে থাকে।
৩। খরা সহনশীল ধান - যত খরা হোক না কেন ধানের গাদ মাটিতে মিশে গেলেও আবার হালকা হালকা একটু বৃষ্টি পেলে গাছ তাজা হয়ে যায়।
৪। উঁচু ও মাঝারি জমিতে হয়
৪। লাভজনক ধান – বীজের দাম অনেক বেশি। টাকা ১৬০০ প্রতি মণ
৫। ধান কালো, চাল লাল
৬। কৃষকের ঘরে বীজ আছে এবং বাজারেও পাওয়া যায়
৭। অনেক কৃষক এই ধান চাষ করে - গ্রামে শতকরা ৫০-৬০% কৃষক এই ধান চাষ করে।
৮। এই ধানে মিশ্র আবাদ ভাল হয়, সাদা কাইকে ধানের সাথে মিশ্র করা হয়।
কালো বকরী ধান চাষের পেছনে নাটোরের বিল এলাকার কৃষকরা আউশ মৌসুমে এই কালো বকরী চাষ করে ধানটী আবাদ টিকিয়ে রেখেছেন। খরা সহনশীল ধান হিশেবে এই ধানের কদর কৃষকের কাছে অনেক বেশি, তাছাড়া ভাতের স্বাদ একটি বড় গুণ।