মামুদপুর গ্রামের ফসলের বৈচিত্র্য: প্রতুলতা ও প্রসারতা নিরুপণ
উবিনীগ ও নয়াকৃষি আন্দোলন || Monday 17 June 2019 ||ফোর-সেল এ্যনালাইসিস: রিচনেস-ইভেননেস অব বাইওডাইভারসিটি (Four Cell Analysis: Richness and Evenness of biodiversity), যে কোন একটি এলাকায় প্রাণবৈচিত্র্যের অবস্থা নিরুপণের অংশগ্রহণমূলক গবেষণা পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে গত ১৬ জুন, ২০১৯ তারিখে টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার মামুদপুর ও তার আশেপাশের গ্রামের কয়েকজন কৃষককে নিয়ে আলোচনা করা হয়।
কৃষক সভার স্থান: রিদয়পুর বিদ্যাঘরের “বীজসম্পদ” কেন্দ্রের সামনে
অংশগ্রহকারী কৃষক :
১। কৃষক সুরাইয়া বেগম, গ্রাম বাবুপুর, ২। আলী হোসেন, গ্রাম বাবুপুর, ৩। ওসমান গনি, গ্রাম মুশুরিয়া ৪। আমেনা বেগম, গ্রাম মামুদপুর এবং ৫। রীনা বেগম, গ্রাম মামুদপুর
নবীরন বেগম ফাজিলহাটি থেকে এসেছেন, তিনি মূলত পর্যবেক্ষক হিসেবে ছিলেন।
এঁরা সকলেই দীর্ঘদিন ধরে নয়াকৃষি আন্দোলনের সাথে যুক্ত আছেন এবং তাঁদের গ্রামে বীজ আখড়ার দায়িত্ব নিয়েছেন। নয়াকৃষি আন্দোলনের কৃষকরা দেশের অন্য সব কৃষকদের মতোই ক্ষুদ্র কৃষক এবং নিজের সংসারের প্রয়োজনে এবং কিছু বাজারে বিক্রির জন্যে ফসলের চাষ করেন । তবে তাঁরা স্থানীয় জাতের বীজের ব্যবহার করেন, কোন প্রকার রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক ব্যবহার করেন না। অনেকেই বোরো মৌসুমে বিআর-২৯ চাষ করতে গিয়ে সামান্য সার ব্যবহার করেন, কিন্তু কীটনাশক ব্যবহার করেন না মোটেই।
আলোচনা মামুদ পুর গ্রাম নিয়েই করা হয়। এই গ্রামে শতকরা ৭০ ভাগ নিচু জমি এবং ২০ ভাগ মাঝারী উঁচু, এবং ১০ উঁচু জমি।
মামুদপুর গ্রামে চাষ হয় এমন ১০টি গুরুত্বপুর্ণ ফসলের তালিকা করা হয়। এই ফসল গুলো হচ্ছে, ১। চামারা ধান (আমন) ২। সরিষা, ৩। সোনালী গম, ৪। পাঁচ শির তিল, ৫। আলু ৬। চাল কুমড়া ৭। ধুইনা সজ ৮। পাট ৯। মিষ্টি কুমড়া এবং ১০। বেগুন।
ফসলের বৈচিত্র্য রক্ষা হচ্ছে কিনা বুঝতে হলে দুটো বিষয় জানা গুরুত্বপূর্ণ। এক। গ্রামের কত কৃষক পরিবার নির্দিষ্ট ফসল চাষের সাথে যুক্ত, দুই। কত পরিমাণ জমিতে এই ফসল চাষ হচ্ছে। সহজভাবে বোঝার জন্যে বলা যায়, কোন নির্দিষ্ট ফসল কম সংখ্যক পরিবার বা বেশি সংখ্যক পরিবার এবং কম পরিমান জমি বা বেশি পরিমান জমিতে চাষ হওয়া। এভাবে ফসলকে চারভাগে ফেলে দেখতে হবে কোন ফসলের কি অবস্থা। এই চারভাগ হচ্ছে :
১। বেশি সংখ্যক কৃষি পরিবার, বেশি পরিমান জমি
২। কম সংখ্যক পরিবার, বেশি পরিমান জমি
৩। বেশি সংখ্যক কৃষি পরিবার, কম পরিমান জমি
৪। কম সংখ্যক পরিবার, কম পরিমান জমি
কৃষক প্রতিটি ফসল ধরে এই আলোচনা করেন। যেমন
১। চামারা ধান - বেশী পরিবার, বেশী জমি
২। সরিষা - বেশী পরিবার, বেশী জমি
৩। সোনালী গম - বেশী পরিবার, কম জমি
৪। পাঁচ শির তিল - কম পরিবার, কম জমি
৫। আলু - বেশী পরিবার, কম জমি
৬। চাল কুমড়া - বেশী পরিবার, কম জমি
৭। ধুইনা সজ -কম পরিবার, কম জমি
৮। পাট - কম পরিবার, কম জমি
৯। মিষ্টি কুমড়া - কম পরিবার, কম জমি
১০। বেগুন - কম পরিবার, কম জমি
সে অনুযায়ি ১০টি ফসলকে ছকে ফেললে এভাবে দেখা যায়।
১। বেশি সংখ্যক কৃষি পরিবার, বেশি পরিমান জমি – এখানে মাত্র দুটি ফসল, চামারা এবং সরিষা দেয়া হয়েছে। আমনের মৌসুমে বেশিরভাগ কৃষক সকল নীচু জমিতে চামারা ধান চাষ করছেন। গ্রামের ৪ ভাগ মানুষের ৩ ভাগই করে। যদিও এরই সাথে আরও কয়েকটি স্থানীয় জাতের ধান হিজল দিঘা, কার্তিক ঝুল, ঝুল এবং ভাওয়াইল্লা দিঘা দানও চাষ করেছেন। তবে এই ধানগুলো চামারা ধানের আগেই তা কাটা হয়। এই গ্রামের অধিকাংশই নীচু জমি, এবং চামারা ধানের জন্যে নীচু এবং পানি থাকে এমন জমিরই দরকার। কৃষকদের প্রচলিত কথাই আছে, ইষ্টির মধ্যে মামারা যদি থাকে নানী, ধানের মধ্যে চামারা যদি থাকে পানি। নীচু জমি হওয়ার কারণে এই গ্রামে চামারা ধান বেশি হয়। মাঘী সরিষা রবি মৌসুমের ফসল হিসেবে মাঝারি ও উঁচু জমিতে চাষ হয়। নীচু জমির একটা বড় অংশ প্রায় ৪০ ভাগ জমিতে সরিষা আবাদ করে এবং এই জমিতেও অধিকাংশ কৃষক চাষ করেন। তাঁদের ফসল পরিকল্পনায় এর পর বোরো ধান বিআর ২৯ এর চাষের চিন্তা থাকে। তাই সরিষা তুলেই বোরো ধান লাগানো হয়।
২। কম সংখ্যক পরিবার, বেশি পরিমান জমি – এই ঘরে কোন ফসল পাওয়া যায় নি। তার কারণ এই গ্রামে ধনি বা বেশি জমি আচে এমন কৃষক নেই। এখানে সবাই ক্ষুদ্র কৃষক।
৩। বেশি সংখ্যক কৃষি পরিবার, কম পরিমান জমি – এই ঘরে গম, আলু ও চাল কুমড়া পাওয়া যায়। এই তিনটি ফসল যদিও কম জমিতে করা হয়, কিন্তু ফসলের দিক থেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ । এইসব ফসলি উঁচু জমিতে হয়। গ্রামে উঁচু জমির পরিমান কম হওয়ার কারণেও কৃষক এর চাষ বাড়াতে পারছেন না। গম ইদানীং মানুষের খাদ্যের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে কারণ অনেক মানুষই ডায়াবেটিস রোগে ভুগছেন এবং তাদের ভাত কম খেয়ে রুটি খাওয়ার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। তাই তাঁরা গমের চাষ করেন। আউশা আলু প্রায় সব কৃষক করেন কিন্তু এর জন্যে যথেষ্ট উঁচু জমি নেই। চাল কুমড়া কম জমিতে করে। অর্থাৎ প্রায় সব পরিবারই বাড়ীর উঠানে ঘারের চালে করে। চাল কুমড়া ধরেও বেশী। এলাকার মানুষের নিকট চালকুমড়া খুব প্রিয় সবজি। তরকারী, ভাজিসহ বিভিন্ন ভাবে রান্না করে খেয়ে থাকেন। আবার কুমড়া পাকিয়ে রেখে দেয়া হয়। অন্য সব্জির ঘাটতি হলে অসময়ে ভাজি করে খেয়ে থাকেন। মোরব্বা করেন। কুমড়া বড়ি বানিয়ে নিজে খেয়ে থাকেন আবার বিক্রি করে আয় করেন। কুমড়ার বহুমূখি ব্যবহারের কারণে বেশী পরিবার চাল কুমড়া করেন, কিন্তু জমি মূলত বাড়ীর উঠান হবার কারণে জমির পরিমাণ কম।
৪। কম সংখ্যক পরিবার, কম পরিমান জমি – এই ঘরে মিষ্টি কুমড়া, পাট, তিল, ধনিয়া সজ এবং বেগুন পাওয়া যায়। মিষ্টি কুমড়া বাড়ীর উঠানে ঘরের চালে করে না, উঠানে ঘরের চালে করলে ফলন ভাল হয় না। জমিতে মিষ্টি কুমড়া করলে, ভাল হয়, জাংলা লাগে না, ফলনও ভাল হয়। তবে বেশি জমি ও লাগে না। তাছাড়া গ্রামের একটা অংশে উচুঁ জায়গা আছে সেখানে করে , প্রথমে আলু লাগায়, আলুর গাছ একটু বড় হলেই লাইনের মাঝ খানে মিষ্টিকুমড়া লাগায়। কিছু দিন পর আলু তুলে নেয়, মিষ্টিকুমড়া গাছ থেকে যায়।। আবার মিষ্টি কুমড়া গাছ দামায়ে যায় (ঘন হয়) তোলার পর মিষ্টি কুমড়া তুলে পাট আবাদ করে। দেশাল পাট পানি সমস্যার কারণে বেশি কৃষকরা করেন না। শুধু পাট শাক খাওয়া ও পারিবারিক গৃহস্থালী কাজ (রশি) এবং জ¦লানীর জন্য চাষ করেন। পাটকাঠি রান্নার জ্বালানী হিসাবে ব্যবহার করে এবং মাটির উর্বরা শক্তি বৃদ্ধি করে। কৃষকরা বলেন,আগের মত বন্যা হয় না। পানি কম দুরে খাল বিলে নিয়ে পাট পচাতে হয়। অল্প পানিতে পাট পানিতে পচালে পানি কালো এবং দুগন্ধ হয়। কামলারা পানিতে নেমে পাট ধুতে চায় না। শরীর চুলকায়। পাট পচায়ে ডাঙ্গায় তুলে আঁশ ছাড়াতে হয় , এভাবে আঁশ ছড়ালে পাটের রং নষ্ট হয়ে যায়। জাগ দেয়ার পানির অভাবে পাটের চাষ প্রায় উঠে গেছে। বেগুন কম জমিতে বা শুধুমাত্র বাড়ীর উঠানে করে, কিন্তু লাভ বেশী। মামুদপুর এলাকা নিচু বেগুন চাষ কম হয়। বেগুনের জন্য টান জমি দরকার। এ ধরণের জমি নাই বলে করে না। তবে বেগুনের বীজ রক্ষা করার প্রয়োজনে অল্প হলেও করা হয়। ধুনিয়া সজ কম জমিতে করলেও বেশী ফলন হয়। বাড়ির পালানে উচুঁ জায়গায় করে, ক্ষেতের চার পাশে করে ফসলকে পোকামাকড়ের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য। ধনে সজ তুলে আবার ঐ জমিতে পাট চাষ করা হয়। পাঁচ শির তিল টান জমিতে হয়। এলাকায় টান জমি কম থাকায় কম পরিবার কম জমিতে করেন। এটি বীজ রক্ষার জন্যই প্রধানত করেন।
মামুদ গ্রামে ফসল বৈচিত্র্যের ফলাফলের চিত্র
কৃষক ও জমির ভাগ | বেশি কৃষি পরিবার | কম কৃষি পরিবার |
বেশি জমি | চামারা ও সরিষা : কৃষকের নিজের পরিবারের খাদ্যের প্রয়োজন মেটানো এবং বাজারে বিক্রি করে সংসারের খরচ মেটানোর প্রয়োজনে – প্রায় সকল কৃষকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য (common) |
কোন ফসল পাওয়া যায় নি |
কম জমি |
গম, আলু ও চাল কুমড়া : বিশেষ প্রয়োজনে চাষ (special needs), সামাজিক ও সাংকৃতিক (cultural) প্রয়োজনে ব্যবহার হয় |
মিষ্টি কুমড়া, পাট, তিল, ধনিয়া সজ এবং বেগুন : এর মধ্যে তিল ও ধ্য়া সজ (less use value) সব পরিবার ব্যবহার করে না। পাট ঝুঁকিপূর্ণ (threat) ফসল হয়ে গেছে। |
আলোচনার শেষ পর্যায়ে এসে ফসলের সার্বিক অবস্থা বোঝা চেষ্টা করা হয়। ফসলের বৈচিত্র্য রক্ষার ক্ষেত্রে বাধগুলো চিহ্নিত করতে গিয়ে দেখা গেল, সরকারের আধুনিক কৃষি নীতি, বিশেষ করে অনেক ফসলের জন্যে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বিআর – ২৯ ধান প্রায় সব কৃষ ক করে, এর জন্যে সেচের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর আওতায় যেসব জমি আছে তাতে অন্য কোন ফসল করা যায় না, কারণ সেই জমিতেও সেচের পানি ঢুকবে। তাছাড়া বর্তমানে পানির অভাব খুব তীব্রভাবে দেখা যায়, বিশেষ করে পাটের মৌসুমে পাটজাগ দেয়ার মতো পানি থাকে না। তাই পাট প্রায় বিলুপ্ত হতে চলেছে। কৃষকরা পাট অর্থকরী ফসল হিশেবে চাষ করেন না।
অন্যদিকে কৃষকরা মনে করেন গ্মের আবাদ করা খুব জরুরী। তবে সোনালী গমের বীজ কম পাওয়া যায়। গমের প্রচলন বেশী হবার কারণ হচ্ছে আগেকার দিনে কৃষক আউশ ধান করত, বর্তমানে এলাকায় আউশ ধান বিলুপ্তির পথে। বোরো মৌসুমে ২৯ ধান করেন। সে কারণে ঐ আউশ ধানের স্থানে গমের চাষ করে। গমের চাষ কম হলেও গমের প্রয়োজন। এখন কোন পরিবার নেই যে রোগ নেই। তার সাথে ডায়াবেটিস রোগ রয়েছে ফলে মানুষ ভাতের পরিবর্তে গমের রুটি খেয়ে থাকেন। এই কারণে গমের প্রয়োজন এবং সোনালী গমের বীজ সংরক্ষণ করা প্রয়োজন।