আধুনিক কৃষির গোড়ায় বিষ
ফরিদা আখতার || Thursday 20 June 2019 ||ট্রাক্টর দিয়ে জমি চাষ, হাইব্রিড বা ‘উচ্চ-ফলনশীল বীজ’, সার-বিষ ব্যবহার ও ডিপ টিউবওয়েল দিয়ে মাটির তলার পানি তোলা – সব মিলিয়ে পুরা প্যাকেজের নামই আধুনিক কৃষি। গত শতাব্দির ষাটের দশকে এ দেশে আধুনিক কৃষির প্রবর্তন করেছিলেন তৎকালিন পাকিস্তানের শাসক ফিল্ড মার্শাল আয়ুব খান। ঘটেছিল বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তায়। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল কমিউনিস্টদের বিপ্লবী ভূমিসংস্কার অর্থাৎ সামন্ততান্ত্রিক ও আধা-সামন্ততান্ত্রিক ভূমি বন্দোবস্ত উৎখাত না করে কৃষির সংস্কার। লাল বিপ্লবের বিপরীতে এই কৃষির নাম তাই ঘটা করে দেয়া হয়েছিল গ্রীন রেভ্যুলুশান বা সবুজ বিপ্লব।
‘আধুনিক’ নাম দেবার পেছনে উদ্দেশ্য ও প্রধান প্রপাগান্ডা ছিল আমাদের কৃষক ও কৃষি উভয়েই পশ্চাতপদ। তাদের জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা নাই, তারা টেকনলজি জানে না। রাসায়নিক সার, কীটনাশক না দিলে তারা কেমন করে আধুনিক হবে! আধুনিক কৃষি প্রবর্তন করে বিশ্ব ব্যাংক, রকেফেলার ফাউন্ডেশানের মতো দাতা সংস্থা। তারা এদেশের কৃষকদের উদ্ধার করার জন্যে আসে নি। কিংবা সেই সময় দেশে খাদ্য ঘাটতি হয়েছে এমন কোন ব্যাপারও ছিল না। কিন্তু এমন কিছু ব্যপার ছিল যা যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য ধনি দেশের জন্যে উৎকন্ঠার বিষয়। তার একটি ছিল এশিয়ায় লাল বিপ্লবের প্রসার।
লাল বিপ্লব ঠেকাতে হলে আরেকটি সম্পূরক কাজ করা দরকার। সেটা হচ্ছে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ। মানুষের সংখ্যা বেশি হলে, বিশেষত তারা যদি দরিদ্র ও নিপীড়িত হয়, তাহলে ধনি দেশের শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে। সেই সময় চীন এবং সোভিয়েত ইউনিয়নে কমিউনিস্ট এবং সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেখানে লাল বিপ্লবের ঝান্ডা উড়ছে। সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর ভয় ঢুকে গিয়েছিল যে বাংলাদেশসহ (বা তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তান) দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ এই বিপ্লবে অনুপ্রাণিত হতে পারে। তাই লাল বিপ্লবের বিপরীতে সবুজ বিপ্লব জরুরি হয়ে পড়েছিল। প্রপাগান্ডার দিক থেকে সুবিধা হোল সবুজ বিপ্লব এই দেশের বিশাল জনগোষ্ঠির খাদ্য যোগানের প্রতিশ্রুতি দেয়, অন্যদিকে সেই একই দাতা সংস্থা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসুচি পরিচালনার জন্যও অর্থ যোগান দেয়। বিজ্ঞান ও কৃৎকৌশলের আবিষ্কার ও প্রবর্তন রাজনৈতিক বিবেচনা, বিশেষত ভূ-রাজনৈতিক বিবেচনার বাইরের বিষয় নয়।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে কৃষক-শ্রমিক সহ দেশের সাধারণ মানুষ প্রাণ দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছেন। কিন্তু খুব অবাক হবার বিষয় না হলেও বলতে হয় স্বাধীন বাংলাদেশ শুরু থেকেই পাকিস্তানের ভূত কাঁধে তুলে নিয়েছে। পাকিস্তানের আধুনিক কৃষি ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসুচি বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলো বাংলাদেশে অব্যাহত রেখেছে। কাজেই লাল-সবুজ পতাকা হাতে দেশ স্বাধীন হলেও কৃষিতে পাকিস্তানের অনুসৃত সাম্রাজ্যবাদী নীতিই বহাল রইলো।
আধুনিক কৃষির গোড়ার গলদটা হচ্ছে এই পদ্ধতি আসলেই কৃষির স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক নিয়ম শৃংখলা মানে না। কৃষি কাজের সাথে প্রকৃতির যে স্বাভাবিক প্রাণোৎপাদনের সম্পর্ক তা ধ্বংস করেই ফসল ফলায়। এটা আসলে কৃষি নয়, এটা মূলত ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল ফুড প্রডাকশান। অর্থাৎ পুঁজিতান্ত্রিক কারখানার মডেলে জীবাশ্ম জ্বালানি ভিত্তিক উৎপাদন। আধুনিক কারখানার বর্জ্যের মতোই আধুনিক কৃষিজাত বিষাক্ত বর্জ্য পরিবেশ ও প্রকৃতির মধ্যেই ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই কাজ করে শিল্পন্নোত দেশগুলো বহু আগেই নিজের দেশের কৃষি ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছে। প্রকৃতির বিনাশ ও ক্ষতির দিক তারা জানে। এখন বিষ ও ক্ষতির দিক আড়াল করে তাদের ব্যবসায়িক কর্পোরেশনের অর্থনৈতিক স্বার্থে আমাদের দেশে আধুনিক কৃষির প্রবক্তা হয়ে উঠেছে। আমাদের দেশের প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশ ধ্বংস করছে।
ফসল ফলানোর জন্য কৃষিতে বিষের ব্যবহার এক অপরিহার্য বিষয় করে ফেলা হয়েছে। পোকা ও কীট দমনের জন্য পেস্টিসাইড ও ইন্সেক্টিসাইড ব্যবহার হয়। আবার আধুনিক কৃষকের জন্যে মূল ফসলের গাছ ছাড়া বাকি সকল প্রাকৃতিক উদ্ভিদই ‘আগাছা’। এগুলো নষ্ট করতে ব্যবহার করা হ্য় আগাছানাশক বা হার্বিসাইড। সবই রাসায়নিক এবং বিষ, যা নাশ করে বা মেরে ফেলে। যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৫০ সালেই জানা গিয়েছিল যে খাদ্য এবং পানিতে ব্যবহৃত রাসায়নিক দ্রব্যের কারণে ক্যান্সার হয়। কাজেই যুক্তরাষ্ট্রের জনস্বাস্থ্য নীতির অধীনে খাদ্য ও ওষূধ প্রশাসনের (এফডিএ) অন্যতম প্রধান কাজ ছিল ফলমূল, সব্জি ইত্যাদি খাদ্য দ্রব্যে রাসায়িক পদার্থ আছে কিনা পরীক্ষা করা। ক্যান্সারের আতংক এতো বেশি হয়েছিল যে খাদ্যে কীটনাশকের সামান্য প্রামাণিক সাক্ষ্য পাওয়া গেলেই তা বাজার থেকে তুলে নেয়া হোত।
একটি ঘটনা উল্লেখ করছি যাতে বোঝা যাবে যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশেও বিষ কোম্পানির শক্তি জনস্বাস্থ্য নীতি থেকেও কত শক্তিশালী। ১৯৫৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগ একটি নতুন আগাছানাশক অনুমোদন দিয়ে নির্দেশ দিল যে এই বিষ ক্রানবেরি (একটি বুনো টক ফল) ফলের ঝাড় পরিস্কার করার জন্যে ব্যবহার করতে পারবে তবে তা দিতে হবে ক্রানবেরি ফল তোলার পর। কিন্তু অনেক কৃষকই তা খেয়াল না করে ফল তোলার আগেই ক্রানবেরি ঝাড়ে স্প্রে করে দিল। এর ফলে ক্রানবেরী ফলে এই বিষ লেগে গেল। দু’বছর পর গবেষণায় দেখা গেল আগাছানাশক বিষ দেয়া ক্রানবেরী খেয়ে ইঁদুরের ক্যান্সার হয়েছে। এতে উদ্বিগ্ন হয়ে এফডিএ আরও নজরদারি বাড়িয়ে দিয়ে দেখতে পেল পাইকারী বাজারের ক্রানবেরীতে এই আগাছানাশক পাওয়া গেছে। আর যায় কোথায়। এফডিএ সব ক্রানবেরী বাজার থেকে জব্দ করে ধ্বংস করে দিল। এবং ঘোষণা দেয়া হোল যে এফডিএ দ্বারা পরীক্ষা করা ছাড়া কোন ক্রানবেরী যেন কেউ না কেনে। এদিকে থাংক্স গিভিং অনুষ্ঠান সামনে; ক্রেতা, বিক্রেতা সকলেই এক অনিশ্চয়তায় পড়ে গেল। আগাছানাশকের উৎপাদনকারি কোম্পানি খুব ক্ষেপে গেল। তারা সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করলো। ফলে একদিন আমেরিকার তৎকালিন ভাইস প্রেসিডেন্ট রবার্ট নিক্সন একটি রাজনৈতিক নৈশভোজে গিয়ে সাংবাদিকদের সামনে ক্রানবেরী সস চারবার নিয়ে খেলেন। জনগণকে আশ্বস্থ করার জন্যে। এতে নিক্সন তক্ষুণি অসুস্থ হয়ে যান নি বটে তবে ক্রানবেরী সত্যটা ঢাকা পড়ে গেল। অবশ্য ক্রানবেরির পর আঙ্গুর, আপেল, টমেটো, গমও রাসায়নিক দ্বারা বিষাক্ত হোল কিনা সেই সন্দেহের তালিকায় পড়ে গেল।
কিন্তু তাই বলে কি আগাছানাশক নিরাপদ হয়ে গেল? বা আগাছানাশক স্প্রে করা ফসল কি নিরাপদ? আগাছানাশকের কারণে ক্যান্সার হওয়ার তথ্য কি মিথ্যা? তাতো নয়। তাতে অবশ্য কোম্পানির কিছু যায় আসে না। কোম্পানি তার ব্যবসা চালিয়ে নেয়ার জন্য কৃষিতে বিষাক্ত রাসায়নিকের ব্যবহার কমতে দিল না।
যুক্তরাষ্ট্রে কৃষিতে রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহার দুটো কারণে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে, যা এখন আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশও অনুসরণ করছে। প্রথম কারণ হচ্ছে, কৃষি পণ্য অন্যান্য শিল্প পণ্যের মতো দেখতে সুন্দর ঝকঝকে এবং কোন দাগ ছাড়া হতে হবে। এটাই ভোক্তার চাহিদা। কাজেই আপেল, আঙ্গুর, টমেটো ইত্যাদি দাগ ছাড়া, সুন্দর আকৃতির রাখার জন্য রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা যাবে। তবে বলা হয় সীমিত ভাবে, কিন্তু ব্যবহারের সীমা ও মাত্রা রাষ্ট্রের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা সব সময়ই কঠিন।
দ্বিতীয় কারন হোল, মানুষের শরীরে এই সব রাসায়নিক পদার্থ গেলেও তাৎক্ষণিকভাবে কোন ক্ষতি হতে দেখা যায় না। যেমন নিক্সনের হয় নি। ক্যান্সার হলেও তা সনাক্ত হতে অনেক সময় লাগে। তাই কৃষিতে কীটনাশকের ব্যবহারে ভয়ানক ক্ষতি হলেও অনেককেই বিশ্বাস করানো কঠিন যে এটা ব্যবহার করা উচিত নয়। তারা পোকার আক্রমন সরাসরি দেখে কিন্তু পোকা দমনের পদ্ধতির ক্ষতি তক্ষুণি চোখে দেখতে পায় না। আর না দেখলে তারা বিশ্বাস করে না। ’নিরাপদ খাদ্য’ নিয়ে আজকাল কথাবার্তা হচ্ছে। কিন্তু বর্তমান সময়ের বিজ্ঞানীরা নিরাপদ খাদ্য বলতে খাদ্যকে জীবানুমুক্ত হওয়াকেই বোঝায়, কীটনাশক মুক্ত হওয়া নয়। অর্থাৎ তারা মনে করে ভাল করে হাত ধোয়া, পরিষ্কার জায়গায় সংরক্ষণ করা ইত্যাদি। অথচ এটা আমরা সবাই জানি কীটনাশকে দূষিত খাদ্য যতোই পরিষ্কার পরিচ্ছন্নভাবে রাখা হোক তা নিরাপদ হয়ে যায় না।
পোকা-মাকড় মানুষের শরীরে নানান ধরণের রোগ ছড়ায় এমন ধারণা কয়েক শত বছর আগে থেকেই ছিল। যেমন ঝাঁকে ঝাঁকে মাছি মানুষের মলের ওপর বসে এবং পরে খাদ্যের ওপরে বসে তাতে “খারাপ” কিছু ঘটে যায় এমন ধারণা বিজ্ঞানীরা আবিস্কার করেছিলেন ১৫০০ শতকেই। আবার ১৮৯৭ সালে ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতে মশার কারণে ম্যালেরিয়া রোগ হয় বলে উৎকন্ঠিত হয়েছিলেন বৃটিশ বিজ্ঞানিরা।
একই সাথে কৃষিতে পোকার আক্রমণ এক বিরাট সমস্যা হিশেবে দেখা দিয়েছিল বেশ কয়েক শত বছর আগে। যদিও পোকার কারণে মানুষের শরীরেও অনেক রোগ হচ্ছে বলে বিজ্ঞানীরা অনেক আগে থেকেই জেনেছেন। যেমন, মশা, উকুন, মাছি, ছারপোকা অনেক রোগ ছড়ায় যার কারণে মানুষ মারাও যায়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে এই বিষয়টা যতো না প্রতিরোধের চেষ্টা করা হয়েছে তার চেয়ে বেশি মনোযোগ দেয়া হয়েছে কৃষি ফসলে পোকা দমনের জন্য। পোকা দমনের উপায় কি? পোকাকে বিষ দিয়ে মারতে হবে। খাদ্য ফসল বিষাক্ত হলে হোক, কিন্তু পোকার আক্রমণ থেকে ফসল বাঁচাতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ধরণের পোকার আক্রমণ হোত। যেমন গম ক্ষেতে ঝাঁকে ঝাঁকে ফড়িং এসে গম খেয়ে ফেলতো। এসব পোকার শত্রু পোকা থাকলে প্রাকৃতিকভাবেই একটা ভারসাম্য রক্ষা হয়, কিন্তু যদি শত্রু পোকা না থাকে তাহলে ফসল শেষ। পোকাগুলো এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে ভ্রমন করে। বিংশ শতাব্দির শুরুতে যুক্তরাষ্ট্র যেসব পোকা কৃষির জন্যে ক্ষতিকর বলে চিহ্নিত করেছে সেই ৭০টি পোকার অর্ধেকই এসেছে অন্য দেশ বা অঞ্চল থেকে। যেমন কটন বল উইভীল বা গুবরে জাতীয় পোকা এসেছে ম্যাক্সিকো হয়ে সেন্ট্রাল আমেরিকা থেকে। এরা ভিন্ন পরিবেশে এসে টিকে থাকতে পারে যদি এদের কোন শত্রু পোকা না থাকে।
এই সময় মার্কিন কৃষকরা পোকা মারার অস্ত্র হিশাবে বিষ ব্যবহার শুরু করেন। প্রথমে তারা নিজের ঘরেই নানা রকম প্রাকৃতিক উপাদান থেকেই বিষ তৈরি করতেন। এই ঘরোয়া বিষের মধ্যে প্যারিস গ্রীন, যার অন্যতম উপাদান ছিল আর্সেনিক, খুব জনপ্রিয় ছিল। এর সাথে ব্যবহার হোত কেরোসিন তেল। কিন্তু ১৯০০ শতকের শুরু থেকেই ঘরোয়া বিষের ব্যবহার কমে যেতে লাগলো, কারন তখন বিভিন্ন কোম্পানি বাণিজ্যিকভাবেই কীটনাশক উৎপাদন করছিলেন। এবং ততদিনে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় সব কাউন্টিতে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের অফিসাররা কৃষকদের পোকা দমনের কথা বলতে শুরু করেন। প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই যুক্তরাষ্ট্র ডিপার্টমেন্ট অব এগ্রিকালচারের নেতৃত্বে পোকার বিরুদ্ধে যুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার শুরু হয়ে গেল। তারা শক্তিশালি রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহারের সিদ্ধান্ত দেয়া শুরু করলো। পোকা দমনের জন্য যতো বেশি ক্ষমতাশালী রাসায়নিক পদার্থ দেয়া যায় কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা এবং কোম্পানির ততই কদর বাড়ে। এভাবে বিংশ শতাব্দির শুরু থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত সব পোকামাকড় (insect) মেরে ফেলাই ছিল অর্থনৈতিক-পতঙ্গবিজ্ঞানের মূল চালিকা শক্তি।
দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ও প্রশংসিত কীটনাশক ছিল ডিডিটি (DDT) পুরো নাম Dichlorodiphenyltrichloroethane । বিশ্বযুদ্ধে এই ডিডিটি ঝাড়া পাউডার হিশাবে ব্যবহার করা হোত। ১৯৪২ সালে একজন সুইস বিজ্ঞানী এটা ইওরোপ থেকে বের করে আনে এবং পরে মার্কিন দেশে পাঠানো হয়। সেখানে পরীক্ষা করে দেখা যায় যে এটা খুব ভাল কীটনাশক এবং স্বল্পমেয়াদে এর কোন স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা যায় নি। অবশ্য তখন পর্যন্ত দীর্ঘ মেয়াদের সমস্যা আছে কিনা দেখার কোন উদ্যোগও নেয়া হয় নি। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মিত্র বাহিনীর সৈন্যদের ম্যালেরিয়া থেকে রক্ষার জন্য ডিডিটি ব্যবহার করা হোত, এবং তা বেশ কার্যকরও হয়েছিল।
শুধু ম্যালেরিয়া নয়, ইওরোপে বাস্তুচ্যুত মানুষের মধ্যে টাইফাস (Typhus) নামক মারাত্মক জ্বরে মানুষ মারা যাওয়া ঠেকানোর জন্যে উকুন নিধন করা হোত ডিডিটি দিয়ে। চারিদিকে ডিডিটির গুণগান গাওয়া শুরু হোল। এমনও মনে করা হোত যে ডিডিটি খোদাপ্রদত্ত। এমন কি সুইস কেমিস্ট পল মুলার ( Paul Muller) যিনি প্রথম ডিডিটি’র উপকারিতা আবিষ্কার করলেন তাঁকে ১৯৪৮ সালে নোবেল পুরুষ্কারও দেয়া হয়েছিল! ডিডিটির মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে পরবর্তীকালে ডিডিটিকে সবচেয়ে ক্ষতিকারক ১২টি কীটনাশকের একটি হিশেবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সারা বিশ্বে এর ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছিল। নোবেল কমিটি এমন একটি মরণঘাতি দ্রব্যের পক্ষে দাড়াবার জন্যে পরে আফসোস করেছেন কিনা জানা যায় নি। অবশ্য এই সিদ্ধান্তে ডিডিটি উৎপাদনকারি কোম্পানী ডু-পন্টের (Dupont) ব্যবসার বিশাল সফলতা এসেছিল।
এ প্রসঙ্গে রাসেল কার্সেনের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘সাইলেন্ট স্প্রিং’ এর কথা উল্লেখযোগ্য। রাসেল মূলত মেরিন বায়োলজিস্ট ছিলেন এবং তাঁর লেখা কিছু গ্রন্থ যেমন The Edge of the Sea বেশ সাড়া জাগিয়েছিল এবং তিনি বেশ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। কার্সনের এক বন্ধু নিউ ইয়র্কে লক্ষ্য করলেন যে ডিডিটি উড়ো জাহাজ দিয়ে স্প্রে করা হচ্ছে, এর ফলে অনেক পাখী মারা যাচ্ছে কিন্তু ঝাঁকে ঝাঁকে মশাগুলো বেশ মোটাসোটা হয়েই আছে। কর্তৃপক্ষ মশা মারার জন্য ডিডিটির পরিমান বাড়িয়ে দেন। কার্সন তাঁর বন্ধুর কাছে এই ঘটনাটি শুনে প্রতিবাদের সিদ্ধান্ত নিলেন। কার্সনের প্রতিবাদের কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যেও এর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হোল, কিন্তু এই বিষয়ে কার্সনের লেখা প্রবন্ধ পত্রিকায় প্রকাশের ক্ষেত্রে বিরাট বাধা সৃষ্টি করা হোল। যার কারণে কার্সন আরো গবেষণা করে বই লেখার সিদ্ধান্ত নেন। সাইলেন্ট স্প্রিং তারই ফল। ডিডিটি উৎপাদনকারি কোম্পানি এবং ব্যবসায়িরা ক্ষুদ্ধ হোল। বিষয়টি কোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছিল। আশ্চর্য হবার কিছু নেই যে আধুনিক কৃষির পিতা নরমান বোরলোগ ডিডিটির পক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। অথচ গম উৎপাদন নিয়ে তাঁর কাজের সাথে রাসায়নিক সারের সম্পর্ক ছিল, কীটনাশকের সম্পর্ক ছিল না। তবুও তিনি কার্সেনের বিরোধিতা কেন করলেন তা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে। বলা বাহুল্য, নরমান বোরলোগও ১৯৭০ সালে নোবেল পুরুস্কার পেয়েছিলেন।
বাংলদেশের কৃষিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব অনেক বেশি। কৃষি বিশ্ববিদ্যালসহ বিভিন্ন কৃষি বিষয়ক গবেষণা সরাসরি ইউএসএইডের অর্থায়নে হয়। আধুনিক কৃষি প্রবর্তনে মার্কিন প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান ফোর্ড এবং রকেফেলার ফাউন্ডেশানের সক্রিয় ভুমিকা ছিল। এই আধুনিক কৃষি প্রবর্তনের পর কৃষকের নিজস্ব জ্ঞানের মূল্য কমে গেল। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের কাজ হোল কৃষককে রাসায়নিক সার-কীটনাশক ব্যবহার শেখানো, ইরি ধানের বীজ দেয়া, মাটির তলার পানির জন্যে ডিপ টিউবওয়েলের ব্যবহার শেখানো ইত্যাদী। বড় বড় বিল বোর্ডে “বোকার ফসল পোকায় খায়” লিখে কীটনাশকের পক্ষে প্রচার চালানো হয়। সরল কৃষক সেগুলো দেখে বিশ্বাস করেছে। কারন ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে লেখাপড়া জানা ও শার্ট-প্যান্ট পরা শহরের মানুষই বিজ্ঞান জানে, খালি পা খালি গা লুঙ্গি পরা কৃষক না। কৃষক লেখা পড়া জানে না। কীটনাশকের প্রচার এতোই বেড়ে গেল রেডিওতে বিশেষ অনুষ্ঠান করে কৃষককে পরামর্শ দেয়া হয়। মোবাইল ফোন আসার পর ফোনেই কীটনাশকের পরামর্শ পাওয়া যায়। ফলে কীটনাশকের ব্যবহার অনেক বেড়ে গেল। বাংলাদেশ ক্রপ প্রটেকশান এসোশিয়েনের তথ্য অনুযায়ি ২০১১ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত নানাধরণের বিষ ব্যবহার হয়েছে; এর মধ্যে ইন্সেক্টিসাইড ১৩,৪৪২ মেট্রিক টন, ছত্রাক নাশক ১৪৮৯৫ মেট্রিক টন, আগাছানাশক ৪,০১৫ মেট্রিক টন সহ অন্যান্য বিষের পরিমান ৩৩, ৩৭১.৬০ মেট্রিক টন। (সুত্র: কৃষি পরিসংখ্যান বর্ষগ্রন্থ ২০১৬)।
বাংলাদেশে ডিডিটির মতো মারাত্মক ক্ষতিকর কীটনাশকের ব্যবহার শুরু হয়েছে ১৯৫৭ সাল থেকে প্রথমে নারায়নগঞ্জে ৬২৫ একর ধান চাষে একটি আর্মি ওয়ার্ম নামক পতঙ্গ দমন করার জন্যে। পরে সারাদেশে ব্যবহার শু্রু হয়ে যায়। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের কর্মকর্তারা কৃষকদের ডিডিটি ব্যবহারের পরামর্শ দেন। এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য দিয়ে দ্যা ডেইলি সান পত্রিকায় ২০১৭ সালের ২ ডিসেম্বর তারিখে প্রবন্ধ লিখেছেন বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক মহাপরিচালক ড: জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস। শুধু পরামর্শ নয়, ডিডিটিসহ অন্যান্য কীটনাশক ব্যবহারের জন্য সরকার ১০০ ভাগ ভূর্তুকি এবং স্প্রে করার মেশিনটাও দিত। এই ১০০ ভাগ ভুর্তুকি দেয়া অব্যাহত ছিল ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত, ১৯৭৮ সালে ৫০% কমিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু ততদিনে কৃষকরা এতো বেশি কীটনাশক নির্ভর হয়ে গেছে যে তারা ঋণ নিয়ে হলেও কীটনাশক দিয়েছেন। আর কৃষকের বিষের চাহিদা দেখে বাম রাজনৈতিক নেতারা কৃষককে সচেতন করার পরিবর্তে কীটনাশকে ভুর্তুকি দেয়ার জন্যে দাবী তোলেন। তারা বলেন না কীটনাশক দেয়ার প্রয়োজন নেই। অজ্ঞতা আর কাকে বলে। তাঁরাও ঘুরে ফিরে আধুনিক কৃষিতে বিশ্বাস করেন। জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস দেখিয়েছেন সবুজ বিপ্লবের আগে গত শতাব্দির সত্তর দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত কীটনাশকের ব্যবহার কম ছিল। কিন্তু ১৯৭৭ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত কীটনাশকের ব্যবহার বছরে ১০% হারে বেড়েছে, অথচ উৎপাদন বৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ১%। কীটনাশকের ব্যবহার যেমন বেড়েছে তেমনি বেড়েছে রোগ বালাই, বিশেষ করে ক্যান্সার। বাংলাদেশে প্রায় ১৫ লাখ ক্যান্সার রোগী আছেন, প্রতি বছর ২ লাখ নতুন রোগী যুক্ত হচ্ছে।
আধুনিক কৃষি বা সবুজ বিপ্লবের এই বিষাক্ত রূপ আমাদের কি একটুও ভাবায় না?