খনার বচন কৃষি ও ফল সংক্রান্ত বচন
নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা || Wednesday 01 November 2017 ||বিদূষী খনা
গ্রামেগঞ্জে খনার বচন সকলের অত্যন্ত পরিচিত। এখনও কৃষির সাথে সম্পৃক্ত খনার বচন গ্রামে জনপ্রিয়। অভিজ্ঞ কৃষক ও গ্রামের গুরুজনেরা কথায় কথায় ব্যবহার করেন। অন্যদের জ্ঞানদান করেন। আসলে খনা তাঁর কালজয়ী বচনে কৃষিতত্ত্বজ্ঞান সমাজের সম্মুখে বেদবাণীর মতো উপস্থাপিত করেছেন। খনার বচনের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে আধুনিক যুগের কৃষিতত্ত্বও খনার বচনের চেয়ে ধিক অবদান রাখতে পারেনি।
খনা যে প্রাচীন বাংলাদেশের একজন বিদূষী খ্যাতনাম্নী জ্যোতিষী ছিলেন, সে সম্পর্কে সন্দেহের আর কোন অবকাশ নেই। খনা সম্পর্কে বাংলা ও উড়িয়া ভাষায় কিংবদন্তী আছে। গল্প দুটি প্রায় একরকম তবে মূল জায়গায় মত-পার্থক্য আছে। প্রথমে আমরা গল্পটি সম্পর্কে ধারণা করে নেব। তারপর পার্থক্যের দিকগুলো বিবেচনা করবো।
গল্পটি হচ্ছে এরকম
খনা লংকা দ্বীপের রাজকুমারী ছিলেন। লংকা দ্বীপবাসী রাক্ষসগণ একদিন স্ববংশে তাঁর পিতা মাতাকে হত্যা করে এবং শিশু খনাকে হস্তগত করে। একই সময়ে, উজ্জয়িনীর মহারাজ বিক্রমাদিত্যের নবরত্ন সভার প্রখ্যাত জ্যোতিষ পণ্ডিত বরাহ স্বীয় নবজাত শিশু সন্তানের অকাল মৃত্যুর কথা ভুল গণনাবশত জেনে নবজাতককে একটি তাম্রপাত্রে রেখে স্রোতে ভাসিয়া দেন। তিনি ভেবেছিলেন এভাবে শিশুটি মৃত্যু থেকে পরিত্রাণ পেতে পারে। পরিত্যক্ত এই শিশুকেও ভাসমান তাম্র-পাত্র থেকে রাক্ষসেরা তুলে নেয় এবং দুটো শিশুকে একত্রে পালন করতে থাকে।
খনা ও মিহির কালক্রমে জ্যোতিষ শাস্ত্রে দক্ষতা অর্জন করেন এবং যৌবনে পরস্পর পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। খনা খগোল শাস্ত্রেও পারদর্শী হয়ে ওঠেন। একদিন খনা ও মিহির গণনায় অবগত হলেন যে, মিহির উজ্জয়নীর সভাপণ্ডিত বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ বরাহের পুত্র। এক মাহেন্দ্রক্ষণে উভয়ে রাক্ষস গুরুর অনুমতিক্রমে এবং একজন অনুচরের সহায়তায় ভারতবর্ষে যাত্রা করেন। উজ্জয়নীতে এসে খনা ও মিহির পন্ডিত বরাহের নিকট আত্মপরিচয় দান করেন। কিন্তু পণ্ডিত সে কথা বিশ্বাস করতে চান না। কারণ, তিনি গণনা দ্বারা জানতে পেরেছিলেন যে, এক বছর বয়সেই তাঁর পুত্র মিহিরের মৃত্যু ঘটবে। খনা তখন তাঁর একটি বচন উদ্ধৃতি দিয়ে শ্বশুরের ভুল গণনা প্রতিপন্ন করেন -
কিসের তিথি কিসের বার।
জন্ম নক্ষত্র কর সার ॥
কি করো শ্বশুর মতিহীন।
পলকে আয়ু বারো দিন।
এ গণনায়, মিহিরের আয়ু ১০০ বৎসর।
পণ্ডিত বরাহ সানন্দে খনা ও মিহিরকে স্বগৃহে গ্রহণ করেন।
এদিকে পালাবার পর দ্বীপনেতা পলাতক দম্পতিকে ধরার জন্যে আয়োজন করেছিলেন। তখন খনা-মিহিরের ওস্তাদ বলেন যে, ওরা জ্যোতিষী গণনা দ্বারা এমন এক অনুকূল মুহূর্তে পলায়ন করেছেন যে, তারা নিরাপদে পৌছে যাবেন। ফলে অনুসন্ধান পরিত্যক্ত হয়।
ক্রমে খনার অগাধ জ্ঞানের কথা জানাজানি হয়ে যায়। রাজসভাতে তিনি আমন্ত্রিতা হন। খনা জ্ঞান-গরিমা সভা-পণ্ডিতদের ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি তিনি পণ্ডিত বরাহের জ্যোতিষশাস্ত্রীয় বহু দুঃসাধ্য সমস্যা সমাধান করে দিতে লাগলেন। এতে অপমানিত ও ঈর্ষান্বিত পণ্ডিত বরাহ পুত্র-বধূকে জিহ্বা কর্তন করে তাকে বোবা বানিয়ে দেয়ার জন্যে পুত্রকে আদেশ করেন। মিহির খনাকে একথা সবিশেষ জানান। খনা এ শাস্তি মেনে নেন। পিতার আদেশে দেশে মিহির এক তীক্ষ্ণধার ছুরি দিয়ে খনার জিহ্বা কর্তন করেন। মাত্রাবিধ রক্তক্ষরণে অসামান্যা বিদূষী খনার মৃত্যু হয়। লোক্কথায় প্রচলিত যে খনার কর্তিত জিহ্বা ভক্ষণ করে টিকটিকি গুপ্ত জ্ঞান লাভ করেছিল।
উড়িয়া কিংবদন্তী অনুযায়ী খনার আসল নাম ছিল লীলাবতী। শ্বশুর বরাহ তার পুত্র মিহিরকে আদেশ করেছিলেন পুত্রবধূর জিহ্বা কেটে ফেলতে। তাই সে ‘খনা’। আসলে লীলাবতী ও খনা একই ব্যক্তি হতে পারেন। তবে দুটো গল্পেরই সারমর্ম এক: খনার মৃত্যুর কারণ ছিল তাঁর অসাধারণ প্রজ্ঞা।
উড়িয়া কিংবদন্তী অনুযায়ী পিতার আদেশ পেয়ে নিরূপায় স্বামী মিহির খনার জিহ্বা কর্তনের পূর্বে কিছু কথা বলার সুযোগ দিয়েছিলেন। খনা তখন কৃষি, আবহ-তত্ত্ব, জ্যোতিষশাস্ত্রীয় এবং মানবজীবনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে বহুবিধ কথা বলে যান। পরবর্তীকালে, সেসব কথা ‘বোবার বচন’ বা খনার বচন নামে অবিহিত হয়।
খনা সিংহলের রাজকুমারী হলেও বাংলাদেশের সাথে তার সম্পর্ক-সূত্র পাওয়া যায় বিভিন্ন ইতিহাসে। ফলে খনার ভাষা বাংলা হওয়া খুব অবাস্তব নয়। তবে খনার বচনের বর্তমান ভাষা মূল ভাষার বিবর্তিত রূপ। তাঁর আবির্ভাব কাল সম্পর্কে ধারণা করা যায় সম্ভবত তিন চার শত বর্ষের মধ্যে হয়েছিল।
কয়েকটি খনার বচন
আমরা এখানে কয়েকটি খনার বচন উদ্ধৃত করছি।
পূর্ব আষাঢ়ে দক্ষিণা বয়
সেই বৎসর বন্যা হয় ॥
মংগলে ঊষা বুধে পা,
যথা ইছা তথা যা ॥
পাঁচ রবি মাসে পায়,
ঝরা কিংবা খরায় যায় ॥
বামুন বাদল বান,
দক্ষিণা পেলেই মান ॥
বেঙ ডাকে ঘন ঘন,
শীঘ্র হবে বৃষ্টি জ্ঞান ॥
খনা বলে মুন কৃষকগণ।
হাল লয়ে মাঠে বেরুবে যখন।
শুভ দেখে করবে যাত্রা।
না শুন কানে অশুভ বার্তা।
ক্ষেতে গিয়ে কর দিক নিরূপণ।
পূর্ব দিক হতে হাল চালন।
নাহিক সংশয় হবে ফলন।
চালায় চালায় কুমুড়ম পাতা
লক্ষ্মী বলেন আছি তথা ॥
আখ, আদা, পুঁই,
এই তিন চৈতে রুই ॥
চৈত্রে দিয়া মাটি
বৈশাখে কর পরিপাটি ॥
দাতার নারিকেল, বখিলের বাঁশ
কমে না বাড়ে বারো মাস ॥
সোমে ও বুধে না দিও হাত।
ধার করিয়া খাইও ভাত ॥
ভরা হতে শুন্য ভাল যদি ভরতে যায়।
আগে হতে পিছে ভাল যদি ডাকে মায় ॥
মরা হতে তাজা ভাল যদি মরতে যায়।
বাঁয়ে হতে ডাইনে ভাল যদি ফিরে চায় ॥
বাঁধা হতে খোলা ভাল মাথা তুলে চায়।
হাসা হতে কাঁদা ভাল যদি কাঁদে বাঁয় ॥
জ্যৈষ্ঠতে তারা ফুটে
তবে জানবে বর্ষা বটে ॥
কি করো শ্বশুর লেখা জোখা।
মেঘেই বুঝবে জলের রেখা ॥
কোদাল কুড়–লে মেঘের গাঁ।
মধ্যে মধ্যে দিচ্ছে বা ॥
কৃষককে বলোগে বাঁধতে আল।
আজ না হয় হবে কাল ॥
বাঁশের ধারে হলুদ দিলে।
খনা বলে দ্বিগুণ বাড়ে ॥
গাই পালে মেয়ে
দুধ পড়ে বেয়ে ॥
শুনরে বাপু চাষার বেটা।
মাটির মধ্যে বেলে যেটা।
তাতে যদি বুনিস পটল।
তাতে তোর আশায় সফল ॥
যদি বর্ষে মাঘের শেষ।
ধন্য রাজার পূণ্য দেশ ॥
মাঘ মাসে বর্ষে দেবা,
রাজ্য ছেড়ে প্রজার সেবা ॥
চৈতের কুযা আমের ক্ষয়,
তাল তেঁতুলের কিবা হয় ॥
অর্থ- কুয়াশায় আমের বোল নষ্ট হয়ে যায়।
আমে ধান তেঁতুলে বান ॥
অর্থ: আম বেশি ফললে ধান বেশি জন্মে। তেঁতুল বেশি ফললে ঝড় তুফান, বন্যা বেশি হয়।
সাত হাতে, তিন বিঘাতে।
কলা লাগাবে মায়ে পুতে ॥
কলা লাগিয়ে না কাটবে পাত।
তাতেই কাপড় তাতেই ভাত ॥
ডাক ছেড়ে বলে রাবণ
কলা রোবে আষাঢ় শ্রাবণ ॥
কি কর শ্বশুর মিছে খেটে।
ফাল্গুনে এঁটে পোত কেটে।
বেড়ে যাবে ঝাড়কি ঝাড়।
কলা বইতে ভাংগে ঘাড় ॥
ভাদরে করে কলা রোপন।
স্ববংশে মরিল রাবণ ॥
অর্থ: ভাদ্র মাসে কলা রোপন করা নিষেধ। কৃষিবিদদেরও একই উক্তি।
গো নারিকেল নেড়ে রো।
আম টুকরো কাঁঠাল ভো ॥
অর্থ: সুপারী ও নারিকেল চার নেড়ে পোঁতলে গাছ সবল ও বলবান হয়। আমের চারা নেড়ে পোঁতলে ফল ছোট ছোট হয়, আম কাঁটাল চারা নেড়ে পোঁতলে সাধারণত: ফল হয় না।
সুপারীতে গোবর, বাঁশে মাটি।
অফলা নারিকেল শিকর কাটি ॥
অর্থ: সুপারী গাছের মূলে গোবর ও বাঁশের গোড়ায় মাটি দিতে হয়। নারিকেল গাছে ফল না ধরলে তার কিছু শিকড় কেটে দিতে হয়।
খনা বলে শুনে যাও।
নারিকেল মূলে চিটা দাও।
গাছ হয় তাজা মোটা।
তাড়াতাড়ি ধরে গোটা ॥
যদি না হয় আগনে পানি।
কাঁঠাল হয় টানাটানি ॥
বিশ হাত করি ফাঁক।
আম কাঁঠাল পূঁতে রাখ।
গাছ গাছি ঘন রোবে না।
ফল তাতে ফলবে না ॥
বার বছরে ফলে তাল।
যদি না লাগে গরুর নাল ॥
অর্থ: তালের চারাতে গরুর-লালা বা জিহ্বা না লাগলে বার বছরে ফল ধরে। নচেৎ বিলম্ব হয়।
তাল বাড়ে ঝোঁপে।
খেজুর বাড়ে কোপে ॥
এক পুরুষে রোপে তাল।
অন্য পুরুষে করে পাল।
তারপর যে সে খাবে।
তিন পুরুষে ফল পাবে ॥
নিত্যি নিত্যি ফল খাও
বদ্যি বাড়ি নাহি যাও ॥
চৈত্রেতে থর থর
বৈশাখেতে ঝড় পাথর
জ্যৈষ্ঠতে তাঁরা ফুটে
তবে জানবে বর্ষা বটে ॥
জল খেয়ে ফল খায়।
যম বলে আয় আয় ॥
দিনের মেঘে ধান
রাতের মেঘে পান ॥
বেল খেয়ে খায় পানি।
জির বলে মইলাম আমি ॥
আম খেয়ে খায় পানি।
পেঁদি বলে আমি ন জানি ॥
শুধু পেটে কুল
ভর পেটে মূল ॥
চৈতে গিমা তিতা,
বৈশাখে নালিতা মিঠা,
জ্যৈষ্ঠে অমৃতফল আষাঢ়ে খৈ।
শায়নে, দৈ।
ভাদরে তালের পিঠা,
আশ্বিনে শশা মিঠা,
কার্তিকে খৈলসার ঝোল,
অগ্রাণে ওল,
পৌষে কাঞ্ছি, মাঘে তেল,
ফাল্গুনে পাকা বেল ॥
তিন নাড়ায় সুপারী সোনা
তিন নাড়ায় নারকেল টেনা
তিন নাড়ায় শ্রীফল বেল
তিন নাড়ায় গেরস্থ গেল ॥
অর্থ: সুপারী, বেল ইত্যাদি তিনবার নেড়ে লাগাতে হয়। কিন্তু তিনবার নারকেল চাড়া স্থানান্তর করলে গাছ বাড়ে না, বার বার গেরস্থ বাড়ী বদলালে খুব ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
আম লাগাই জাম লাগাই
কাঁঠাল সারি সারি-
বারো মাসের বারো ফল
নাচে জড়াজড়ি ॥
তাল. তেঁতুল, কুল
তিনে বাতু নির্মূল ॥
ঘোল কুল, কলা
তিনে নাশে গলা ॥
আম নিম জামের ডালে
দাঁদ মাজও কুতুহলে ॥
সকল গাছ কাটিকুটি
কাঁঠাল গাছে দেই মাটি ॥
শাল সত্তর, আসন আশি
জাম বলে পাছেই আছি ॥
তাল বলে যদি পাই কাত
বার বছরে ফলে একরাত ॥
অর্থ: শাল গাছ ৭০ ও আসন গাছ ৮০ বছর বাঁচে। জাম গাছ আরও বেশি বাঁচে। তাল গাছ বার বছরে ফল ধরে।
পূর্ণিমা আমাবস্যায় যে ধরে হাল।
তার দুঃখ হয় চিরকাল।১
তার বলদের হয় বাত
তার ঘরে না থাকে ভাত ॥
খনা বলে আমার বাণী।
যে চষে তার হবে জানি ॥
থেকে বলদ না বয় হাল।
তার দুঃখ সর্বকাল ॥
বাপ বেটায় চাষ চাই।
তা অভাবে সহোদর ভাই ॥
ভাদরের চারি আশ্বিনের চারি।
কলাই রোব যত পারি ॥
ফাল্গুন না রুলে ওল।
শেষে হয় গ-গোল ॥
মাঘে মুখী। ফাল্গুনে চুখি ॥
চৈতে লতা। বৈশাখে পাতা ॥
অর্থ: চুখি = চোখা।
সরিষা বনে কলাই মুগ।
বুনে বেড়াও চাপড়ে বুক ॥
গোবর দিয়া কর যতন।
ফসল রতন ফলবে দ্বিগুণ ॥
লাংগলে না খুড়লে মাটি।
মই না দিলে পরিপাটি ॥
ফসল হয় না কান্নাকাটি ॥
খনা বলে চাষার পো
শরতের শেষে সরিষা রো ॥
সেচ দিয়ে করে চাষ।
তার সবজি বার মাস ॥
তিনশ ষাট ঝাড় কলা রুয়ে
থাকগা চাষি মাচায় শুয়ে
তিন হাত অন্তর এক হাত খাই
কলা পুতগে চাষা ভাই ॥
বৎসরের প্রথম ইশানে বয়
সে বৎসর বর্ষা হবে খনার কয় ॥
পঁটল বুনলে ফাল্গুনে।
ফল বাড়ে দ্বিগুণে ॥
উঠান ভরা লাউ শসা
খনা বলে লক্ষ্মীর দশা ॥
শুনরে বেটা চাষার পো ॥
বৈশাখ জ্যৈষ্ঠে হলুদ রো ॥
আষাঢ় শাওনে নিড়িয়ে মাটি
ভাদরে নিড়িয়ে করবে খাঁটি ॥
হলুদ রোলে অপর কালে।
সব চেষ্টা যায় বিললে ॥
পান লাগালে শ্রাবণে।
খেয়ে না কুলায় রাবণে ॥
ফাল্গুনে আগুন চৈতে মাটি।
বাঁশ বলে শীঘ্র উঠি ॥
জ্যৈষ্ঠে খরা আষাঢ়ে ভরা।
শস্যের ভার সহে না ধরা ॥
ভাদ্র আশ্বিনে বহে ঈশান।
কাঁধে কোদালে নাচে কৃষাণ ॥
বৈশাখের প্রথম জলে।
আশুধান দ্বিগুণ ফলে ॥
বাড়ীর কাছে ধান পা।
যার মার আগে ছা ॥
চিনিস বা না চিনিস।
ঘুঁজি দেখে কিনিস ॥
শীষ দেখে বিশ দিন
কাটতে মারতে দশদিন ॥
ওরে বেটা চাষার পো।
ক্ষেতে ক্ষেতে শালী রো ॥
খনা ডাকিয়া কন।
রোদে ধান ছায়ায় পান ॥
গাই দিয়া বায় হাল।
দুঃখ তার চিরকাল ॥
তপ্ত অম্ল ঠান্ডা দুধ
যে খায় সে নির্বোধ ॥
ডাক দিয়ে বলে মিহিরের স্ত্রী,
শোন পতির পিতা।
ভাদ্র মাসে জলের মধ্যে
নড়েন বসুমাতা।
রাজ্য নাশে, গো নাশে,
হয় অগাধ বান।
হাতে কাটা গৃহী ফেরে
কিনতে না পান ধান।।
ফাল্গুনে আট, চৈতের আট
সেই তিল দায়ে কাট ॥
ষোল চাষে মূলা
তার অর্ধেক ধান।
বিনা চাষে পান ॥
খনারবচন।
মিথ্যা হয় না কদাচন ॥
আশ্বিনে ঊসিশ। কার্তিকেরউনিশ ॥
বাদ দিয়ে যত পারিস মটর কলাই বুনিস ॥
চৈত বৈশাখে লাগাইয়া ঝাল
সুখে কাটে বর্ষাকাল ॥
আরে বেটা চাষার পো
চৈত্র মাসে ভুট্টা রো ॥
আষাঢ়ে উৎপত্তি
পত্রাবনে যুবতী
ভাদে পোয়াতী।
আশ্বিনে বুড়া ॥
কার্তিকে দেয় উড়া ॥
আসমান ফাঁড়া ফাঁড়া।
বাতাস বহে চৌধারা ॥
কৃষক ক্ষেতের বান্ধ আইল।
বৃষ্টি হইবে আইজ কাইল ॥
মাঘের মাটি, হীরের কাঠি
ফাল্গুনের মাটি সোনা
চৈতের মাটি যেমন তেমন,
বৈশাখের মাটি নোনা ॥
মাঘ মাসে বর্ষে দেবা।
রাজায় ছাড়ে প্রজার সেবা ॥
খনার বানী
মিথ্যা না হয় জানি ॥
ধানের গাছে শামুক পা।
বন বিড়ালী করে রা ॥
গাছে গাছে আগুন জলে।
বৃষ্টি হবে খনায় বলে ॥
কচু বনে ছড়ালে ছাই।
খনা বলে তার সংখ্যা নাই ॥
পশ্চিমের ধনু নিত্য খরা।
পূর্বের ধনু বর্ষে ঝরা ॥
স্বর্গে দেখি কোদাল কোদাল।
মধ্যে মধ্যে আইল।
ভাত খাইলাও শ্বশুর মশায়।
বৃষ্টি হইবে কাইল ॥
তিথি বারো, স্বনক্ষত্র মাসের বারোদিন
একত্র করিয়া তারে সাতে করো হীন,
এক শুভ, দুইয়ে লাভ, তিনে শক্রক্ষয়
চতুর্থেতে কার্যসিদ্ধি, পঞ্চমে সহায়,
ষষ্ঠে মৃত্যু, শূন্য হলে পায় বহু দুঃখ,
খনা বলে যাত্রা কভু নাহি সুখ ॥
চৈতের ধূলি, বৈশাখের পেঁকি,
ধান হয় ঢেঁকি ঢেঁকি ॥
আগে বেঁধে দেবে আইল,
তবে তায় রুইবে শাইল ॥
উণা ভাতে দুনা বল
অতি ভাতে রসাতল ॥
আউশের ভুঁই বেলে,
পাটের ভুঁই আঁটালে ॥
যদি বর্ষে আগনে, রাজা যায় মাগনে,
যদি বর্ষে পৌষে, শস্য যায় তুষে ॥
মধুমাসে প্রথম দিবসে হয় যেইবার
রবিশেষে মঙ্গল বর্ষে, দুর্ভিক্ষ বুধবার,
সোম, শুক্র গুরু যার,
পৃথ্বি সয়না শস্যের ভার ॥
আঁধারে পড়ে চাঁদের কলা,
কতক কালা, কতক ধলা,
উত্তর উঁচু, দক্ষিণ কাত
ধারায় ধারায় ধানের ধাত
ধান - চাল দুই-ই সমান
মিষ্টি হবে লোকের কথা ॥
যে গুটিকাপাত হয়
সাগরের তীরেতে,
সর্বদা মঙ্গল হয়,
কহে জ্যোতিষেতে,
নানা শস্যে পরিপূর্ণ,
বসুন্ধরা হয়,
খনা কহে মিহিরকে,
নাহিক সংশয় ॥