তিনবারের পাহাড়ি ঢলেও দমেনি চকরিয়াবাসী ও উবিনীগ
উবিনীগ || Tuesday 22 December 2015 |||| Tuesday 22 December 2015 || বিষয়: নদী ভাঙ্গন ও বন্যা প্লাবন, জীবিকার সংগ্রাম
গত জুন ২০১৫ থেকে আগষ্ট ২০১৫ এই ৩ মাসের ব্যাবধানে টানা বর্ষণ ও পাহাড়ী ঢলে ককসবাজার জেলার চকরিয়া উপজেলা এবং বান্দরবান জেলার লামা ও আলীকদম উপজেলা ৩ বার বন্যায় প্লাবিত হয়। এলাকায় সৃষ্ট ব্যাপক বন্যায় মানুষ পানি বন্দি ও গৃহহারা হয়ে পড়ে। ঘরবাড়ি ভেঙ্গে যায়, গবাদি পশু- পাখি ভেসে যায়, ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয় এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে। দূর্গত মানুষের পুরোপুরি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে প্রায় ৩ মাস সময় লেগেছে। এখনো কোন কোন এলাকার পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। পদ্মাবতী বিদ্যাঘরের কর্মীরা এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার। সার্বিক ভাবে কেন্দ্রের ঘর, অফিস কক্ষ, বীজঘর, গাছপালা, নার্সারী, হাঁস-মুরগী, পুকুর, মাছ, জমির ফসল সহ ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়েছে। পদ্মাবতী বিদ্যাঘরের জমিতে এখনো শুকায়নি।
ইতোমধ্যে চকরিয়া ও লামা উপজেলায় মা ও শিশু স্বাস্থ্য কর্মসূচীর ৪টি দাইঘরের আওতায় বন্যা কবলিত ১৯ টি গ্রামে ক্ষয়ক্ষতির নিরুপণ ও জনগনের প্রয়োজন নির্ধারণ শীর্ষক জরীপ করা হয়েছে।
সে মোতাবেক প্রথম দফায় চকরিয়ায় ৩টি দাইঘরের অধীনে এবং উবিনীগ পদ্মাবতী কেন্দ্রের আশে পাশের গ্রাম সহ বেশী ক্ষতিগ্রস্থ মোট ১৬টি গ্রামে মোট ৮৫০টি পরিবারে জরুরী খাদ্যসহায়তা দেয়া হয়েছে
বন্যার সময় ত্রাণ কাজে স্থানীয় জনগণের সঙ্গে উবিনীগ। পরনির্ভরশীলতা নয়, স্থানীয় জনগণের উদ্যোগকে শক্তিশালী করাই উবিনীগের নীতি।
উল্লেখ্য উক্ত গ্রামগুলোতে ৭৫০টি পরিবারে খাদ্য সহায়তা দেয়ার কথা থাকলেও মানুষের প্রয়োজন ও দু:খ কষ্টের কথা বিবেচনা করে মুল বাজেটের মধ্যে থেকে সামান্য কম রেটে মালামাল কিনে বাড়তি টাকা দিয়ে আরও ১০০টি পরিবারে খাদ্য সরবরাহ করা হয়েছে।
প্রথম পর্বের রিলিফের কার্যক্রম ১লা সেপ্টেম্বর ২০১৫ থেকে শুরু হয়ে ০৯ সেপ্টেম্বর ১৫ তারিখে শেষ হয়।
এই সময়ের মধ্যে রিলিফ কমিটি গঠন, মালের কেটেশন সংগ্রহ, যাচাই বাছাই করা,ওয়ার্ক অর্ডার দেয়া, নির্ধারিত গ্রামে সরেজমিনে গিয়ে পরিবার নির্বাচন ও প্রতিটি পরিবারে কার্ড বিতরণ মালামাল প্যকিং এবং পরিবহন ব্যবস্থা করা হয়। মালামালের মূল্য পরিশোধ করা হয় একাউন্ট পে চেকের মাধ্যমে।
মাল বিতরণ করা হয় মূলত ৪ দিনে। এর মধ্যে ৩টা দাইঘরে ৩দিন ১ দিন পদ্মাবতী বিদ্যাঘরে।
রেজিস্টার খাতায় প্রতিটি গ্রহীতার নাম ,ঠিকানা স্বাক্ষর/টিপসহি নেয়ার পর মালামাল বিতরণ শেষে প্রতিটি পাতায় ৩ সদস্য বিশিষ্ট কমিটির (দাইমা, মহিলা মেম্বার,উাবনীগ প্রতিনিধি) স্বাক্ষর নেয়া হয়।
এক নজরে ১ম দফা খাদ্য সহায়তা কার্যক্রম।
দাইঘরের নাম | উপজেলা ইউনিয়ন | গ্রাম সংখ্যা | মোট পরিবার |
কৃষ্ণাপুর দাইঘর | চকরিয়া | বিএম চর | ৪টি ১৭২ |
মগনামাপাড়া দাইঘর | চকরিয়া | বদরখালী | ৫টি ২৩৯ |
উত্তর নতুন ঘোনা দাইঘর | চকরিয়া | বদরখালী | ৪টি ১৮৬ |
পদ্মাবতী বিদ্যাঘর | চকরিয়া | পূর্ব বড় ভেওলা | ৪টি ২৫৫ |
মোট | ১৭টি | ৮৫২ |
ত্রান সামগ্রীর বিবরন : প্রতি পরিবারে চাল ৫ কেজি, আলু ২ কেজি, তেল ৫০০ গ্রাম।
দাইঘর মেরামত
ত্রাণ বিতরনের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্থ দাইঘর মেরামতের কাজটি একই সাথে চলতে থাকে। ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্থ ৪টি দাইঘর মেরামত করা হয়েছে এবং যথারীতি দাইঘরে কার্যক্রম চলছে। কৃষ্ণাপুর (বিএম চর) দাইঘরটি মেরামত করতে সময় লেগেছে। কারন ঐ গ্রামে র্দীঘ দিন বন্যার পানি জমে ছিল। বর্তমানে দাইঘরের কার্যক্রম নিয়মিত ভাবে চলছে। দাইমারা ও সহযোগী নিয়মিত দাইঘরে আসছে এবং সেবার কাজ চলছে।
ভ্যান এম্বুলেন্স মেরামত
বন্যার সময় ৪ টি দাইঘরে থাকা ভ্যান গুলো কিছুদিন পানির মধ্যে থাকায় ভ্যানের চাকা, ছাউনি ও অন্যান্য যন্ত্রাংশ পানিতে ঢুবে থাকায় মরিচা ধরে নষ্ট যায়। ভ্যান ৪ টি পূনরায় মেরামত করে রং করা হয় এবং চলাচলের উপযোগী করা হয়।
কৃষি পূনর্বাসন
পরপর ৩ দফার বন্যায় ঘরবাড়ির ক্ষতি, যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হওয়া, নদী ভাঙ্গন ইত্যাদি ক্ষয়ক্ষতির তুলনায় ফসলের ক্ষতি হয়েছে সবচাইতে বেশী। কারন আমন ধানের বীজ তলা পরপর ৩-৪ বার ডুবে যাওয়া এবং জমিতে পানি থাকার কারনে কৃষকরা আমন ধানের আবাদ করতে পারে নাই।
বন্যার পরপর ক্ষয়ক্ষতি নিরুপনের জন্য যখন গ্রামে দূর্গত মানুষ, দাইমা ও কৃষকদের কাছে যাওয়া হয়, তখন জরুরী খাদ্য সহায়তার প্রয়োজনের পাশাপাশি কৃষকরা রবি মৌসুমে বীজ প্রদানের জন্য জোরালো দাবি জানান। কারন অধিকাংশ কৃষকের ঘরের ভিতরে বন্যার পানি ঢুকে যাওয়ার কারনে কৃষকদের বাড়িতে সংরক্ষিত ধান ও অন্যান্য ফসলের বীজ সম্পূর্ন রূপে নষ্ট হয়ে যায়।
বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর আস্তে আস্তে জমি শুকাতে থাকে তখন কৃষকেরা বীজের জন্য দিশেহারা হয়ে পড়ে। দাইমা ও কৃষকদের প্রয়োজনের কথা বিবেচনা করে কৃষকদের মাঝে শীতকালীন শাক-সবজির বীজ বিতরনের পরিকল্পনা করা হয়।
এর ধারাবাহিকতায় গত কার্তিক‘১৪২২ মাসের শুরুতে অর্থাৎ অক্টোবর‘২০১৫ এর মাঝামাঝি সময়ে বীজ বিতরনের প্রক্রিয়া শুরু হয়।
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ দাইমা ও কৃষকদের মধ্যে সুষ্ট ভাবে বীজ বিতরন করার জন্য কতগুলো সুনির্দিষ্ট ধাপ অনুসরন করা হয়।
ধাপ গুলোর নিন্মরুপ:
১. গ্রাম নির্বাচন
২. সরেজমিনে কৃষকদের জমি দেখা
৩. কৃষক ও দাইমাদের সভা
৪. কৃষকদের কাছ থেকে বীজের চাহিদার তালিকা সংগ্রহ করা
৫. চাহিদা অনুযাযী তালিকা ধরে কৃষকদের সাথে যোগাযোগ
৬. বীজ বিতরন কমিটি গঠন
৭. বীজ সংগ্রহের জন্য অন্য এলাকা ও স্থানীয় বাজারে বীজের প্রাপতা সর্ম্পকে তথ্য সংগ্রহ
৮. বীজের গুনগত মান যাচাই ও বীজ সংগ্রহ করা
৯. বীজ বিতরন
বীজ বিতরন
কক্সবাজার জেলার চকরিয়া উপজেলার বন্যায় সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রহ ২ টি ইউনিয়নে বীজ বিতরন করা হয়। মিশ্র ফসলের আবাদের জন্য কৃষকদেরকে ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির বীজ বিতরন করা হয়। কোন কৃষককে এক প্রজাতির বীজ বিতরন করা হয়নি।
বন্যা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় সবচেয়ে বড় সংকট হিসাবে হাজির হয় বীজের অভাব। উবিনীগ নয়াকৃষি আন্দোলনের নেতৃত্বে বীজ সংরক্ষণ, পুন্রুৎপাদন ও বিতরণ করে থাকে। ফলে বন্যাপীড়িত এলাকায় বীজ বিতরণকে উবিনীগ সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়।
এক নজরে বীজ বিতরনের তালিকা:
বীজের প্রজাতি: রঙ্গিমা সীম, ঢেঁড়শ, মূলা, বরবটি, মিষ্টি কুমড়া, লাউ
নং | গ্রাম | ইউনিয়ন | কৃষক সংখ্যা | বিতরনের তারিখ |
০১. | নয়া পাড়া | বি এম চর | ১৪ জন | ১০/১১/১৫ |
০২. | ফকির ঘোনা | বি এম চর | ১৫ জন | ১৫/১০/১৫ |
০৩. | দক্ষিণ কৃষ্ণাপুর | বি এম চর | ১৫ জন | ১০/১১/১৫ |
০৪. | উত্তর কৃষ্ণাপুর | বি এম চর | ১০ জন | ১৫/১০/১৫ |
০৫. | বটতলী পাড়া | বি এম চর | ৩২ জন | ০৯/১১/১৫ |
০৬. | উত্তর নতুন ঘোনা | বদরখালী | ২৩ জন | ১২/১১/১৫ |
০৭. | ঢেমুশিয়া পাড়া | বদরখালী | ১১ জন | ১২/১১/১৫ |
০৮. | মাঝের পাড়া | বদরখালী | ৩০ জন | ১২/১১/১৫ |
০৯. | কুতুবদিয়া পাড়া | বদরখালী | ০৯ জন | ১২/১১/১৫ |
১০. | মুহুরী জোড়া পাড়া | বদরখালী | ২৬ জন | ১৪/১০/১৫ |
১১. | মগনামা পাড়া | বদরখালী | ০৫ জন | ১২/১১/১৫ |
১২. | আজমনগর পাড়া | বদরখালী | ০৮ জন | ১২/১১/১৫ |
১৩. | দাতিনাখালী পাড়া | বদরখালী | ০৩ জন | ১২/১১/১৫ |
১৪. | পুকুরিয়া পাড়া | বদরখালী | ০২ জন | ১২/১১/১৫ |
মোট | ২১৫ জন |
এলাকার পরিবেশ ও প্রকৃতি অনুযায়ী বীজ বিতরণের সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া দীর্ঘদিন এলাকার কৃষি ব্যবস্থার সঙ্গে সরাসরি কাজের অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করে। এই ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ কৃষকদের ভূমিকা সবসময়ই অনন্য ভূমিকা পালন করে। বীজ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেবার ও বীজ বিতরণের একটি ছবি।
বীজ বিতরনের শর্ত সমূহ:
১. ফলন ভাল হলে কৃষকরা বিতরন কৃত বীজের সমপরিমান বীজ ফেরত প্রদান করবেন।
২. ফসল উঠার পর প্রত্যেক কৃষক নিজেদের জন্য পরবর্তী মৌসুমের বীজ সংরক্ষন করবেন।
৩. ফসল উৎপাদনে জমিতে কোন রকম রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করবে না।
৪. কৃষক নিজের ব্যবহারের পাশাপাশি অন্য কৃষকদের মাঝে বীজ বিনিময় করবেন।
৫. কৃষকরা ফসল উঠার পর সংশ্লিষ্ট দাইঘরের জন্য কিছু বরাদ্দ রাখবেন।
নোট: বীজ বিতরনের সময় প্রত্যেক কৃষকের কাছ থেকে রেজি: খাতায় স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে। ঐ খাতায় বীজ বিতরন কমিটির সদস্যদের স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে।
কক্সবাজার-বান্দরবান।
তারিখ: ১৮/১১/২০১৫