বাঁশের ছটকাঃ নদী ভাঙ্গন মোকাবেলায় কৃষকের জ্ঞান (১)
রবিউল ইসলাম চুন্নু ও ফাহিমা খাতুন লিজা || Friday 02 June 2017 ||নদীর পাড়ের গ্রামগুলির বর্তমান অবস্থা:
শ্রীপুর গ্রামের দুই পাশেই নদী। কিছু ঘর বাড়ী ভাঙ্গা শুরু হয়েছে কিন্তু শত শত বিঘা ফসলেরর মাঠ নদী গর্ভে বিলিন হয়ে যাচ্ছে। ধীতপুরের একটি বড় অংশ নদী গর্ভে চলে গেছে। ছোট চামতারা ও বড় চামতারা গ্রামের লোকজন বাড়ীঘর ও ফসলি জমি হারিয়ে অন্য চরে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। যারা এখনও আছে তারা খুবই শংকার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে এই মৌসুমে অবশিষ্ট ঘর বাড়ী থাকবে কিনা। বানতিয়ার গ্রামের একাংশ নদীতে ভেঙ্গে গেছে। পাশের গ্রাম বালিয়াকান্দিতে তারা আশ্রয় ও বাড়ি ঘর তৈরী করেছে। অত্র অঞ্চলের একমাত্র অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের মূল কেন্দ্র বানতিয়ার বাজার নদী ভাঙ্গনের কবলে পড়েছে। সপ্তাহে একদিন হাট ও প্রতিদিন বাজার বসে। গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগী, কৃষকের উৎপাদিত ফসল এবং নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস-পত্র এখানে বেঁচা -কেনা হয়। চরের কিছু মানুষের আয়ের প্রধান উৎস দোকান ও হাট বাজার। বাজার সংলগ্ন অত্র এলাকার একমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বানতিয়ার হাইস্কুল, মাদ্রাসা ও প্রাথমিক বিদ্যালয় নদী ভাঙ্গনের কারনে হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। তিল, কাওন, বাদাম, বিভিন্ন জাতের ধান ও সবজিসহ ফসলের মাঠ ভাঙ্গার কারণে এই গ্রামগুলোর কৃষকেরা খুবই হতাশার মধ্যে দিনাতিপাত করছে।
নদী ভাঙ্গনের কারণ:
কৃষক সোলায়মান, মোহাম্মদ আলী, আ: বাতেন, আ: জলিল সহ উপস্থিত কৃষকেরা বলেন - বন্যা এবং ২০০৪ সালের পর থেকে যমুনা নদীতে ব্রীজ দেওয়ার জন্য নদীর পাড় বাঁধ দেওয়ার কারনে নদীর ভাটিতে প্রতি বছরই আমরা নদী ভাঙ্গনের স্বীকার হই। জ্যৈষ্ঠ থেকে আষাঢ় মাসে নদীতে পানি বাড়তে থাকে এর সাথে তৈরী হয় প্রচন্ড স্রোত, নদীর পাড়গুলো উঁচু আর স্রোত নদীর নীচে থাকার কারনে নদী ভাঙ্গতে থাকে। পানি বেশী না হওয়া পর্যন্ত নদী ভাঙ্গতে থাকে। আবার পানি যখন কমতে থাকে আশ্বিন- কার্তিক মাসে তখন নদী ভাঙ্গতে থাকে। অসময়ে বন্যা ও অতি বৃষ্টির কারণেও নদী ভাঙ্গন বেশী হয়।
ছটকার ধারনা কিভাবে পেল:
এই এলাকা পয়েস্তি (পতিত) ছিল। নদীতে নতুন চর জাগলে এলাকার সবাই মিলে করচা ঘাস (কাঁশ বন) লাগায়, কাঁশ বন একটু বড় হলে বন্যার পানি যখন চরের উপর দিয়ে যায় কাঁশবনের সাথে পলি মাটি জমতে থাকে এবং চর উঁচু ও আবাদ যোগ্যহয়। পরে চিন্তা করে বাঁশ যদি নদীতে একটু এ্যাংগেল করে পুঁতে নদীর স্রোতকে অন্য দিকে ঠেলে দেওয়া যায় তা হলে পানি বারি খেয়ে অন্য দিকে যাবে আর স্রোতের সাথে ভাসমান খড় কুটো ঘাস ও গাছ পালার ডাল বাধা পেয়ে পলি জমতে সহায়তা করবে। ফলে ছটকার পিছনের পাড়ে স্রোত আঘাত না হানার কারণে ভাঙ্গন রোধ হয় এবং ছটকার সামনের অংশে পলি জমে বিশাল চর তৈরী হয়।
ছটকার স্থান নির্বাচন পদ্ধতি:
গ্রামের বয়স্ক অভিজ্ঞ কৃষকেরা যারা নদীর গতি পথ বোঝে, পানির ধার দেখলেই বুঝতে পারে এ বছরে নদী কোন পাড়ে ভাঙ্গতে পারে, এরকম চার থেকে পাঁচ জন অভিজ্ঞ কৃষক নদীতে নেমে নদীর (ধার ) স্রোত বুঝে এবং বালি পরীক্ষা করে দেখে যে কোন দিকে ছটকা দিলে টিকবে তার পর ছটকার জায়গা নির্বাচন করে।
ছটকার উপকরণ:
সাধারণত বিভিন্ন জাতের বাঁশ থাকলেও ছটকাতে ভইরা বাঁশ ব্যবহার করা হয়। এই বাঁশ শক্ত ও ভিতরে ফাঁপা থাকে না ফলে অতিরিক্ত পানির চাপ সহ্য করতে পারে। অন্য জাতের বাঁশ দিয়ে ছটকা করলে পানির চাপে বাঁকা ও ভেঙ্গে যায। চর এলাকায় এ সব বাঁশ কম হয় এগুলো অন্যান্য জেলা থেকে চর এলাকায় যায়। এ ছাড়া লোহার পেরেক ও জিআই তার ছটকার কাজে ব্যবহার করা হয়। এবং ছটকা দেওয়ার কাজে সহযোগিতার জন্য বড় নৌকা ব্যবহার করা হয়।
ছটকা দেওয়ার উপকারিতা/ফলাফল:
দূর্গম চরে সরকারী কোন সহযোগিতা না থাকার কারণে অবহেলিত মানুষের বেঁচে থাকার অবলম্বন নিজের ভিটে মাটি ও ফসলের জমি। ছটকা দেওয়ার কারনে রক্ষা পায় দুটোই। নিশ্চিন্তায় করতে পারে কৃষি কাজ। থাকে না বার বার ঘরবাড়ী ভেঙ্গে কোথাও যাওয়ার তাগিদ বা অন্যের আশ্রয়ে।
গত ২৩ থেকে ২৫ মে, ২০১৭ তারিখ পযর্ন্ত শ্রীপুর ও বানতিয়ারে নদীর বিভিন্ন জায়গায় ছয়টি ছটকা নির্মান করা হয়। তার মধ্যে চারটি ছটকা নদীর পানির গতিপথ পরিবর্তন করার জন্য এবং দুইটি ছটকা তাৎক্ষণিক ভাঙ্গন রোধ করার জন্য। সব মিলে এলাকায় তিন থেকে চার কিলোমিটার জায়গা ভাঙ্গন রোধ করা সম্ভাব হবে বলে কৃষকেরা ধারণা করছেন।
প্রতিটা ছটকার সামনে বড় বড় চর জাগবে আর এ চরে মাসকলাই, খেসারী, বাদাম, রাই সরিষা, কাওন, তিল প্রচুর পরিমাণে জন্মে। কৃষকের মতে, কোন রকম বীজ ছিটিয়ে আসতে পারলেই হয়, কোন সার বিষ লাগে না। নতুন পলি পরার কারণে জমিতে ঘাস হয় না, তাই ফসলে নিড়ানী দেওয়া লাগে না। ছটকার কারনে পলি জমে যে নতুন চর হয় সেখানে প্রতি বছর বন্যায় পলি জমে উঁচু হতে থাকে এ ভাবে সাত থেকে আট বছর পরে সেখানে বসতি স্থাপন করা যায়। তাই ছটকার উপকারিতার মাধ্যমে কৃষকেরা খুঁজে পায় নিশ্চিত ভবিষ্যৎ।
এলাকার কৃষকদের ভূমিকা:
নদী ভাঙ্গনের কাছে কৃষকেরা অসহায়। একার পক্ষে কাজ করা তাদের দ্বারা সম্ভব না। পূর্বে নয়াকৃষি থেকে ছটকা দেওয়ার কারণে বিশাল চর জাগে এবং সেখানে এখনও কৃষকেরা চাষাবাদ করছে। এবারে কৃষকদের দাবী ছিল জমি, ঘরবাড়ী, হাট-বাজার ও গ্রাম রক্ষা করার। তাই নয়াকৃষির পাশাপাশি গ্রামের কৃষকেরাও বাঁশ কাটা, নৌকায় বাঁশ ভর্তি করে নদীতে নেওয়া সহ শ্রমিকদের সাথে সার্বিক সহযোগিতা করেছে। বাড়ী বাড়ী থেকে টাকা তুলে বাঁশ কিনে নয়াকৃষির সাথে আরো কয়েকটি ছটকা দিয়েছে। নয়াকৃষির সাথে একত্রে ছটকা দিতে পেরে গ্রামের মানুষ খুবই খুশি। গ্রামের মানুষের অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত।
এই প্রতিবেদনটি সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলার একটি চরে চলমান কাজের অংশ
২৯ মে, ২০১৭