পোশাক শিল্পে শ্রমিকের অবস্থা
সীমা দাস সীমু || Wednesday 01 November 2017 ||দেশের রপ্তানী আয়ের সবচেয়ে বড় খাত পোশাক শিল্প। এই সেক্টরে ৪০ লাখেরও বেশী শ্রমিক কাজ করে যাদের বেশীর ভাগ নারী শ্রমিক। সেই শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ এখনও নিরাপদ হয় নি। গার্মেন্ট কারখানার যাত্রা (আশির দশক) থেকে এখন পর্যন্ত কয়েক হাজার শ্রমিক মারা গেছে আগুনে পুড়ে, পায়ের তলে পিস্ট হয়ে এবং কারখানা ধসে। তাই যে কোন শিল্পায়নের জন্য শ্রমিকদের নিরাপদ কর্মক্ষেত্র জরুরী। আশি দশকের শুরুতে ঢাকায় গার্মেন্ট শিল্প গড়ে উঠলেও এই শিল্পের সুনির্দিষ্ট কোন স্থান নাই। এখনও যেখানে সেখানে এমন কি আবাসিক এলাকাতেও গার্মেন্ট কারখানা গড়ে উঠছে। যেখানে ফায়ার সার্ভিসের গাড়িও ঢুকতে পারে না। তাজরিন গার্মেন্টে আগুন লাগার পরে বিল্ডং কোর্ড অনুযায়ী কারখানা ভবন নির্মানের জন্য মুন্সীগঞ্জে গার্মেন্ট পল্লী স্থাপনের জন্য ৫০০ একর জমি বরাদ্দ করেছে সরকার। এই স্থানে সকল গার্মেন্ট কারখানার স্থান সংকুলান সম্ভব নয় তবে যারা আবাসিক এলাকায় বা বাসাবাড়িতে গার্মেন্ট দিয়ে বসেছেন তাদের ওই জায়গায় স্থানন্তর সম্ভব। কিন্তু এর কোন উদ্যোগ নাই।
প্রায় ৫ হাজার পোশাক কারখানার মধ্যে অনেক কারখানায় ন্যূনতম মজুরী কাঠামো এখনও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। দীর্ঘ শ্রমিক আন্দোলনের পরে ২০১৩ সালের ৪ নভেম্বর শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরী পাঁচ হাজার ৩০০ টাকা নির্ধারিত হয়। ঘোষিত মজুরী অনুযায়ী প্রথম গ্রেড ৮ হাজার ৫০০ টাকা। দ্বিতীয় গ্রেড ৭ হাজার টাকা। তৃতীয় গ্রেড ৪ হাজার ৭৫ টাকা। চতুর্থ গ্রেড ৩ হাজার ৮০০ টাকা। পঞ্চম গ্রেড ৩ হাজার ৫০০ শত ৩০ টাকা। ষষ্ঠ গ্রেড ৩২ শো ৭০ টাকা এবং সপ্তম গ্রেড ৩ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। অধিকাংশ কারখানায় ৭ম গ্রেড ছাড়া অন্য কোন গ্রেড অনুসরণ করা হচ্ছে না।
কারখানায় গঠনমূলক ও আইনগত ট্রেড ইউনিয়ন মালিক ও শ্রমিকের মধ্যে সুসম্পর্ক বৃদ্ধি করে। কিন্তু এখন পর্যন্ত বেশীরভাগ পোশাক কারখানায় ট্রেড ইউনিয়নের সুযোগ নাই। পোশাক শিল্পের মালিকেরা ট্রেড ইউনিয়নকে শিল্পের জন্য ক্ষতিকর মনে করেন। এখন পর্যন্ত ৪ হাজারেরও বেশী প্রতিষ্ঠান ট্রেড ইউনিয়নের বাইরে রয়েছে (যুগান্তর, ২৩ এপ্রিল, ২০১৪) বলা হচ্ছে।
বর্তমানে দেশের পোশাক কারখানায় নতুন করে শ্রমিক নিয়োগ বন্ধ রয়েছে। নতুন মজুরী কাঠামো আসার পর থেকে ব্যয় সংকোচনের লক্ষ্যে শ্রমিক ছাঁটাই করছেন কারখানা মালিকেরা। আবার ক্রেতাদের নির্ধারিত মানে উর্ত্তীন্ন হতে না পেরে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বাড়ছে বেকার শ্রমিকের সংখ্যা। শ্রমিক সংগঠনগুলো দাবী করছে বর্তমানে প্রায় ৫০ হাজারের বেশী শ্রমিক তাদের চাকুরী হারিয়ে বেকার জীবন যাপন করছে।
রানাপ্লাজা ট্র্যাজেডির (২৪ এপ্রিল, ২০১৩) পর পোশাক খাতে নিরাপত্তার মান নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার পর আড়াই হাজার কারখানা পরিদর্শনের সিদ্ধান্ত নেয় ইউরোপীয় ইউনিয়নের ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের জোট অ্যাকর্ড অন ফায়ার এন্ড বিল্ডিং সেফটি ইন বাংলাদেশ এবং উত্তর আমেরিকা ক্রেতা জোট ‘অ্যালায়েন্স ফর বাংলাদেশী ওয়ার্কার্স সেফটি’। এই দুই জোটের পক্ষ থেকে কারখানা ভবনের কাঠামো, অগ্নি ও নিরাপত্তার মান যাচাইয়ের কোন ত্রুটি পেলেই পর্যালোচনা কমিটির মাধ্যমে কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। চলতি বছরে (২০১৪) প্রায় ৪ শত পোশাক কারখানা ইতোমধ্যে বন্ধ হয়েছে। ফলে শ্রমিক হয়ে পরছে বেকার। শ্রমিকেরা উদ্বিগ্নতার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে।
পোশাক শিল্প প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের একটি বড় জনগোষ্ঠির কর্মসংস্থানের পথ সৃষ্টি করেছে। প্রতি বছর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে। এই শিল্প গত ৩০ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়েছে। তাই এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারকেই বিশেষ উদ্যেগ গ্রহণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে এ খাতে বিপর্যয় নেমে এলে দেশের অর্থনীতি মারাত্মক বাধাগ্রস্ত হবে।